শরীর ও মন দুটি আলাদা শব্দ, কিন্তু অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, আমরা শরীর নিয়ে যতটা ভাবি বা যত্ন করি, মনের ব্যাপারে অনেকটাই উদাসীন থাকি। আর এই উদাসীনতা তাড়ানোর জন্য আজ আমরা মানসিক স্বাস্থ্য (Mental Health) নিয়ে কিছু জানা অজানা কথা নিয়ে আলাপ করবো। আরও দুইটি কারণে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা মনে করছি। প্রথমতঃ অনেক সময় সমাজের কথা ভেবে আমরা নিজেদের মানসিক রোগের উপসর্গকে একটি লজ্জাজনক ব্যাপার মনে করে নিজেদের মধ্যে ঢেকে রাখি, ডাক্তারের কাছে যাই না। দ্বিতীয়তঃ এই বিষয় নিয়ে সাধারণত তেমন গভীরভাবে তথ্য (Information) না নিয়েই অতি সহজেই একটি মানুষকে আমরা মানসিক রুগী (Mental health patient) বানিয়ে ফেলে ‘পাগল’ বলে অবজ্ঞা করি, যেন মানসিক রোগ (Mental illness) একটি গালির বিষয়। তাই, আজকে আমরা খুব অল্প কথায় এই বিষয় সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো।


ইদানিং টেলিভিশনের খবরে মানসিক স্বাস্থ্য (Mental Health) নিয়ে প্রায়ই কথা শোনা যাচ্ছে।
কোভিড মহামারী (COVID epidemic ) সময়, আমাদের সবারই মানসিক স্বাস্থ্য সারাক্ষন উৎকণ্ঠার মধ্যে থেকে থেকে কম বেশি বিপর্যস্ত। আমাদেরকে অনেক সীমাবদ্ধতা (Restriction ) এর মধ্যে থাকতে হচ্ছে, কারো বাসায় বা নিজ বাড়িতে বাহিরের মানুষজন নিয়ে দাওয়াত/পার্টি করতে পাচ্ছিনা, অফিসের কাজ কর্ম ঘরে বসেই করতে হচ্ছে। অনেকে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে, আবার এমনকি অনেকেই চাকুরী হারিয়ে ঘরে বসে আছে, তাই আমাদের সবারই মানসিক স্বাস্থ্য এমনিতেই কম বেশি ভেঙ্গে পড়েছে । তাই, চলুন আর কথা না বাড়িয়ে মানসিক স্বাস্থ (Mental health ) নিয়ে কিছু জানা অজানা কথা জেনে নেই।


জাতিসংঘের স্বাস্থ্য সম্পর্কের বিশেষ সংস্থার নাম হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থা (WHO: World Health Organization) যা মানসিক রোগকে (Mental illness) শুধুমাত্র মানসিক রোগ হিসাবে না দেখে এটিকে স্বাস্থ্যের একটি অপরিহার্য উপাদান (Essential component ) হিসাবে অবিহিত করে মানসিক স্বাস্থ্য (Mental health ) কে এভাবে সংগায়িত (Definition) করেছে : ” মানসিক স্বাস্থ্য (Mental health ) হচ্ছে সুস্থতার একটি অবস্থা যেখানে ব্যক্তি তার নিজস্ব সামর্থ (Abilities ) উপলব্ধি (Realizes) করে, জীবনের স্বাভাবিক চাপের সাথে লড়াই করতে পারে, উৎপাদনশীল (productive) এবং ফলদায়কভাবে (Fruitfully) কাজ করতে পারে এবং তার কমিনিউটির জন্য অবদান (Contribution ) রাখতে সক্ষম হয়’।

এই সজ্ঞা (Definition) এর সাথে আরেকটু যোগ করি, মানসিক স্বাস্থ্য বলতে আমাদের সামগ্রিক (Holistic) মানসিক অবস্থাকে আসলে উপস্থাপন করি যা দিয়ে বুঝায় আমরা কিভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমাদের জীবনের ভালো/মন্দ সবকিছু বিবেচনা করি, আমাদের জীবনকে সুন্দরভাবে উপভোগ করি ইত্যাদি। অপরদিকে, মানসিক রোগ বলতে বুঝায় আমাদের এমন কিছু অসুস্থতা যা আমাদের চিন্তাশক্তি (Thought process), অনুভূতি (Feeling) ও মনোজগতকে ব্যাঘাত ঘটিয়ে থাকে এবং এটি আমাদের দৈনন্দিন কাজের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়। সুতরাং, আমরা বুঝতে পারলাম যে মানসিক স্বাস্থ্য যেহেতু স্বাস্থ্যেরই অন্তর্ভুক্ত, তাই স্বাভাবিকভাবেই, আমাদের কেউই মানসিক স্বাস্থ্যের বাহিরে নই, কিন্তু মানসিক রোগ (Mental Illness) বলতে আমরা বুঝি যখন কিছু মানুষ নির্দিষ্ট কিছু উপসর্গ (Symptom ) প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজ নিজ স্ট্রাগলের এর কথা প্রকাশ করে থাকেন।

মানসিক রোগ শুনেই ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আমাদের অন্যান্য শারীরিক রোগের (Physical illness) এর মতো মানসিক রোগও হচ্ছে একধরণের রোগ যা অন্যান্য রোগের মতোই চিকিৎসা (Treatment ) করতে হয় । আমরা আসলে মানসিক রোগ শুনেই তিন হাত লাফিয়ে উঠি তার কারণ আমাদের আশেপাশে মানসিক রোগ নিয়ে অনেক শ্রুতি (Myth) রয়েছে যা আমাদেরকে অনেক সময় ভুল বুঝিয়ে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যেটি প্রচলিত সেটা হচ্ছে মানসিক রোগী মানেই হিস্র (Violent) ও বিপদজনক । আমাদের একটি কথা খুব ভালো করে বিশ্বাস করতে হবে মানসিক রুগীরা হিস্র ও বিপদজনক তো নয়ই বরং এঁরা তথাকথিত স্বাভাবিক মানুষের হিংস্রতার শিকার । আমরা বিচ্ছিন্ন ভাবে দুই একজন মানসিক রুগী দেখি যারা অনিয়মিত ঔষুধ পত্র ও কোনোরকম ট্রিটমেন্ট ছাড়া দিনের পরদিন থাকে এবং যারা বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু অপরাধ কার্যের (Criminally activities ) সাথে যুক্ত থাকতে পারে, কিন্তু তার মানে এই না, সবাই একরকম। টেলিভিশনের সামনে বসলে প্রতিদিন হরেকরকমের অপরাধের ও হিংস্রতার খবর দেখতে হয় যারা কোনোভাবেই মানসিক রোগী না এবং যারা আপনাদের আমাদের মতোই সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ।

তাহলে উপরের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পেলাম মেন্টাল হেলথ মানেই মানসিক রোগ (Mental illness / Mental disease ) না। আসুন, এবার কয়েকটি প্রধান প্রধান মানসিক রোগ (Mental disease) নিয়ে বেসিক কিছু তথ্য জেনে নেই :

১. সিজিওফ্রেনিয়া (Schizophrenia): এই রোগের ঠিক কি কারণে হয়ে থাকে সেটা পুরাপুরি না জানলেও অনেকে মতে মানুষের ব্রেনের মধ্যে একধরণের জৈব রাসায়নিক ক্রিয়াকলাপ (Biochemical action ) এর কারনে এই রোগ হয়ে থাকে যা মানুষকে তাঁর সত্য -মিথ্যা যাচাই ক্ষমতা কমিয়ে ফেলে। আবার অনেক গবেষক এই রোগটিকে জেনেটিক, জৈবিক (Biological) ও পরিবেশগত (Environmental) কারণ হিসাবে মনে করে থাকেন। এই ধরনের রুগীদের মধ্যে একেক জন একেক রকমের উপসর্গ (Symptom) দেখা যায়। কেউ কেউ এমন কিছু মিথ্যা শব্দ শুনতে পায় (Hearing Voice ), এমন গন্ধ (Smell) পেয়ে থাকে বা এমন কাউকে দেখতে পায় যা সত্যিকারে তার আশেপাশে নেই. যেমন: এঁরা হটাৎ করে কাউকে দেখে হয়তো বললো “তুমি আমার ঘরে ঢুখেছিলে কেন?’ অথবা ‘ আমি এই কাজটি করেছি কারণ অমুক লোক কাজটি করতে বলেছে (যদিও কেউ তাকে বলে নি)। এধরণের উপসর্গকে বলে হ্যালোসিনেশন (Hallucinations)। আবার ডেলিউশন (Delusion) হচ্ছে এঁদের আরেক ধরণের সিন্টোম যা মিথ্যা বিশ্বাস (False belief ) থেকে জন্মায়। যেমন একজন বললো, মাইকেল জ্যাকসন আমার বাবা হয়, অথবা, আমি এই শহরের মেয়র , অথবা টেলিভিশনে হয়তো কোনো খবর হচ্ছে ওঁরা বলছে দেখো টেলিভিশন আমাকে নিয়ে বাজে কথা বলছে ) ইত্যাদি ইত্যাদি । এগুলি হচ্ছে সিজোফ্রেনিয়ার পজিটিভ সিন্টোম। নেগেটিভ সিন্টোম হচ্ছে একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মধ্যে যে গুণাবলী (Criteria) থাকে এঁদের মধ্যে তার চেয়ে সেসব কম থাকে , যেমন, কম কথা বলা, আবেগ (Emotion ) কম থাকা, ইত্যাদি। যে কোনো মানুষের এ রোগ হতে পারে। তবে, সাধারণতঃ এই রোগ সবসময় উঠতি বয়সী (Teen aged ) ছেলে-মেয়েদের থেকে শুরু হতে দেখা যায় হয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের এই রোগ কিছুটা দেরিতে শুরু হয়।

২. মেজর ডিপ্রেশন বা ডিপ্রেশন (Major depression or depression) : আমাদের সবারই কম বেশি কিছু ভালো সময়ের পাশা পাশি খারাপ সময় যায়, সে সময় কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছা হয় না, আমরা এসময় খানিকটা একা একা থাকি, গান শুনি বা অন্য কিছু করি যাতে মন ভালো হয়, কিন্তু এই ডিপ্রেশন যদি দিনের পর দিন স্থায়ী হয় তখন এটি রোগের পর্যায়ে পড়ে। আমাদের কারো কখনো যদি এরকম অনুভূতি (Feelings) হয়, তবে অবশ্যই আমাদের ফ্যামিলি ডাক্তারের সাথে কথা বলা উচিত। এই রোগ মারাত্তক আকারে দেখা দিলে অনেকে সুইসাইডের কথা ভেবে থাকে, বা চেষ্টা করে অথবা এমনকি সুইসাইড করেই ফেলে।

৩. বাইপোলার ডিজ অর্ডার (Bipolar disorder) : এটিও একধরণের মেজাজ জনিত রোগ (Mood disorder), তবে এই রোগের দুইটি পর্ব (Episode) থাকে। একটি ম্যানিয়া (Mania)বা অনেকে এটিকে হাই (High) বলে থাকে। এসময় ঘুম খুব কম হয় এবং রুগীদের মধ্যে সবসময় একটি অতিরিক্ত ব্যাস্ততা (Hyper activity) লক্ষ্য করা যায়। খুব অল্প সময় ঘুমান ও অধিকাংশ সময়ই জেগেও থাকেন, অস্বাভাবিক ভাবে অতিরিক্ত কথা বলেন, কথা /বার্তা দ্রুত বলতে থাকেন এবং চিন্তা জাগতে এতো দ্রুত পরিবর্তন আনেন যে সহজেই এক কথা থেকে আরেক কোথায় চলে জান ( Racing thought), সবসময় অতিরিক্ত হাসি-খুশিতে থাকেন (Euphoric), নিজেদেরকে অনেক সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ (Exaggerated self -esteem or felling of grandeur ) মনে করেন। আরেকটি এপিসোড হচ্ছে ম্যানিক (Manic) বা ডিপ্রেশন যা অনেকটাই ডিপ্রেশন রোগের মতো উপসর্গ।


৪. এংজাইটি ডিসর্ডার (Anxiety disorder) : আমাদের সবার মধ্যেই কম বেশি উদ্বেগ (Anxiety) কাজ করে। বাসের জন্য অপেক্ষা করে বাস মিস করলে, পরীক্ষার আগে ভালো প্রিপারেশন (Preparation) না হলে, বা কোনো কিছু হারিয়ে গেলে আমরা অনেকেই উদ্বিগ্ন (Anxious) হয়ে পড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এই উদ্বেগ আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে তেমন প্রভাব (Affect) ফেলে না। যদি এই উদ্বেগ অনেক দিন ধরে হতেই থাকে এবং আমাদেরকে এতো বেশি প্রভাব বিস্তার করে যে আমাদের ঠিক ভাবে খাওয়া হয় না, ঘুম হয় না ইত্যাদি , তখন এটিকে চিকিৎসা (Treatment) করতে হয়। অনেক রকমের এংজাইটি ডিসর্ডার এর উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমনঃ স্পেসিফিক ফোবিয়া (Specific Phobia): আমাদের অনেকেই মাকড়সা , ইঁদুর , তেলাপোকা ইত্যাদির উপর ফোবিয়া বা আতঙ্ক থাকে যা আমরা এগুলিকে পরিহার করে থাকি, কিন্তু এগুলি যখন অতিরিক্ত পর্যায়ে চলে গেলে রোগের পর্যায়ে পড়ে।

প্যানিক ডিজ অর্ডার (Panic Disorder): এ ধরণের রুগীদের হটাৎ হটাৎ করে বার বার মারাত্মক আতঙ্কিত (Panic attack) হতে দেখা যায়, বুক ধড়ফড় (pounding) করে, ঘেমে যায় (Sweating), এমন কি হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়াকলাপ বন্ধ (Heart attack) পর্যন্ত হতে পারে।

এগ্রোফোবিয়া (Agoraphobia): বিশেষ কোনো পরিস্থিতি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে না পাড়ার জন একধরণের আতঙ্ক থেকে এই ধরণের রুগীরা জনসমাবেশ (Public gathering ), এলিভেটর প্রভৃতি পরিহার করে, এমন কি ভয়ে বাড়ি থেকে বের হয় না।

৫. পোস্ট ট্রমাটিক ডিজ অর্ডার বা পি টি এস ডি( Post Traumatic disorder, PTSD): কারো কারো জীবনে এমন কোন অনাকাঙ্খিত মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে যা কখনো ভোলা যায় না, মাঝে মাঝেই ঘুরে ফিরে মনে হতে থাকে (Flashback) এবং মানুষকে এতো বেশি উদ্বিগ্ন (Anxious) করে তোলে যে সাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়ে থাকে। যেমন নিউ ইয়র্কের নাইন ইলেভেন এর পরে অনেকেরই এরকম হয়ে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের (Second World War) এর পরে হিটলারের বাহিনী দ্বারা নির্যাতিত হয়ে অনেকেই যারা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলো পরে তাদের মাঝে অনেকেরই এই ধরণের পি টি এস ডি রোগ দেখা গিয়েছিলো।

৬. ইটিং ডিজ অর্ডার (Eating Disorder): বেশি খেলেও যেমন সমস্যা, কম খেলেও সমস্যা। ইটিং ডিজ অর্ডার এর রুগীরা নিজেদের শরীরের ওজন (Body Weight) নিয়ে অতিরিক্ত সচেতন থাকে। এদের মধ্যে যারা এনোরেক্সিয়া নার্ভোসা (Anorexia nervosa) টাইপের তারা আবার বেছে খেতে খেতে খাওয়া/দাওয়া একেবারেই প্রায় ছেড়ে দিয়ে নিজেকে কংকালসার এর মতো গড়ে তোলে। আবার, বুলিমিয়া নার্ভোসা (Bulimia nervosa) রোগে আক্রান্ত পেসেন্টরা আবার খেতে খেতে বেশি খেয়ে ফেলে (Unhealthy eating ), পরে নিজের ওজন ব্যাপারে এত বেশ সচেতন হয় যে নিজের ওজন কমার জন্য মুখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে বমি করে, লেক্সাটিভ ট্যাবলেট (Laxative tablet) খায়, অতিরিক্ত ব্যায়াম এর মাধমে নিজেকে একেবারে শুকিয়ে ফেলে ইত্যাদি ।

৭. ও সি ডি বা অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজ অর্ডার (OCD: Obsessive Compulsive Disorder): একটি কাজ করার পরে আমাদের সবার মাঝে কম বেশি কিছুটা দ্বিধা (Confusion) থাকে, কাজটি করেছি কি না। যেমন, বাসা থেকে বের হওয়ার সময় হয়তো দরজা বন্ধ (Lock) করেছি, কিন্তু পরে মনে হচ্ছে বন্ধ করিনি । অথবা, রান্না করার পরে চুলা অফ করেছি, কিন্তু পরে মনে হচ্ছে চুলা অফ করিনি। কিন্তু, ও সি ডি পেশেন্টদের মধ্যে এ ধরণের প্রবণতা (Tendency) এত বেশি থাকে যে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে কে মারাত্মক ভাবে প্রভাবিত করে। আরেকটু বিস্তারিত আলাপ করা যাক। রোগটির নামের মাঝে মূলত দুটি শব্দ রয়েছে : অবসেশন (Obsession) ও আরেকটি হচ্ছে কম্পালসন (Compulsion)। অবসেশন মানে হচ্ছে এক ধরণের চিন্তা (Thought ) যা সহজেই মন থেকে যায় না, বার বার অতিরিক্তভাবে মনে হতে থাকে (Recurrent thought )। যেমন, আমি ফোনের বিল দিয়েছি কিনা, এসাইনমেন্ট সময়মতো জমা দিলাম কিনা, বাহিরে বের হয়েছিলাম, কোনো জার্ম হাতে লেগেছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। কম্পালসন হচ্ছে অবসেশন দূর করার জন্য বার বার চেকিং করা। যেমন একটু কোনো কিছু হাতে ধরলেই বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, অসংখ্যবার ব্যাংকে বা ইন্টারনেটে চেক করে খোঁজ নেয়া বিল দিয়েছি কিনা ইত্যাদি ।

৮ . সিজনাল এফেকটিভ ডিজ অর্ডার বা এস এ ডি (Seasonal Affective Disorder: SAD) নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এটি সিজনাল রোগ। এই ধরণের রুগীদের মাঝে প্রত্যেক বছর একই সময়ে বিশেষ করে শীত কালে ডিপ্রেশন দেখা যায়। সামারে ধীরে ধীরে এটি দূর হয়ে যায়। ডিপ্রেশন রোগের সাথে এটির পার্থক্য হলো, এটি শুধুমাত্র বছরের একটি নিদৃষ্ট সময়ে হয়ে থাকে।

তাহলে আমরা উপরের আলোচনা থেকে মানসিক স্বাস্থ্য ও মানসিক রোগ নিয়ে কিছুটা ধারণা পেলাম। এবার, এসব রোগের প্রতিকার (Remedy) নিয়ে কথা শোনা যাক। আমাদের অন্যান্য শারীরিক রোগের (Physical disease ) এর ক্ষেত্রে যেমন আমরা ডাক্তারের সাথে কথা বলি, ডাক্তার এর প্রেসক্রিপশন (Prescription) অনুযায়ী মেডিকেল টেস্ট করি, ঔষুধ খাই এবং একসময় সেই রোগ ভালোও হয়ে যায়, কিন্তু মানসিক এর ক্ষেত্রে কিন্তুই এরম না, তার কারণ এই রোগের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের মনোজগৎ যা কিনা আবার আমাদের পারিপার্শ্বিকতা, আমাদের অতীত দুর্ঘটনা ও কিছু ক্ষেত্রে পারিবারিক হিস্ট্রি। আর তাই, মানসিক রোগের ক্ষেত্রে, ডাক্তারের দেয়া ঔষুধের পাশাপাশি এসব রুগীকে কিছু বাড়তি কাজ করতে হয় । যেমন, রুগীকে মানসিক রোগ নিয়ে যারা কাজ করেন Mental health professionals ) উনাদের সাথে পরামর্শ (Counselling) নিতে হয়, কিছু থেরাপি নিতে হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী থেরাপি হচ্ছে কগনেটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি বা সি বি টি (Cognitive Behabiour Therapy: CBT )। এই থেরাপির মাধ্যমে মনোরোগের চিকৎসকগণ আমাদের সাথে কথা বলার মধ্যে দিয়ে আমাদের অসংলগ্ন চিন্তা ধারাকে সহজেই বুঝতে পারেন, আমাদের মনের সকল নেতিবাচক বা নেগেটিভ চিন্তাগুলিকে পসিটিভ চিন্তায় রূপান্তরিত করে থাকেন।

তবে, থেরাপি বলি বা ওষুধপত্র বলি, মানসিক রোগের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা যেটি বলবো সেটি হচ্ছে, আমরা যাঁরা রুগীর আশেপাশে থাকি আমরা তাদেরকে প্রতিনিয়ত যেন সহযোগিতা করি, উৎসাহ যোগাই যাতে এসব রুগীরা নিজেদের পায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। আমাদের সবার সহযোগিতা পেয়ে একসময় এসব রুগীরা শতকরা একশতভাগ (Hundred percent) সুস্থ না হলেও এটা নিশ্চিত নিয়মিত ঔষুধ খেয়ে, প্রফেশনালদের সহযোগিতা নিয়ে , আমাদের সবার সহযোগিতা নিয়ে, নিজ নিজ রোগের উপসর্গগুলিকে কমিয়ে (Minimize) স্থিতিশীল (Stable) অবস্থায় থেকে স্বাভাবিক ভাবে আমাদের মতো লেখা পড়া করতে পারবে, বাজার ঘাট করতে পারবে, চাকুরী করতে পারবে।

আরেকটি কথা, এই কোভিড মহামারী (COVID epidemic ) এর, আমরা যদি সত্যিকারভাবে নিজেদের মেন্টাল হেলথ নিয়ে চিন্তা করি , আমরা অবশ্য অবশ্যই সবাই নিজ নিজ দেশের হেলথ গাইড লাইন মেনে চলবো, বাড়িতে সবার সাথে মিলে মিশে আনন্দে থাকার চেষ্টা করবো। নিয়মিত মেডিটেশন (Meditation ), ব্যায়াম (Exercise ) প্রভৃতি অনেক সময় আমাদেরকে অনেক ভালো রাখে. এছাড়া , রান্না/বান্না (cooking ), ঘর-বাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা (House chore ) ইত্যাদি কাজে সাহায্য করবো, তাহলে নিজেরেও যেমন ভালো থাকবে, বাড়ির সবাইও ভালো থাকবে, সবাই মিলে ভালো ও সুখে শান্তিতে থাকতে পারবো।

আজ এ পর্যন্তই থাক, এসব বিষয়ে আরোও জানতে হলে মানসিক রোগ নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের সাথে যোগাযোগ করে বিস্তারিত জানতে পারবেন। তবে শেষ করার আগে লেখকের পক্ষ থেকে বিশেষ উনরোধ আজ থেকে আমরা মনে প্রাণে অন্তত তিনটি বিষয় অবশ্যই মেনে চলবো:

১. মানসিক রুগী কোনো ক্লাউন না যে তাঁদের নিয়ে হাসি তামাশা করবো
২. মানসিক রুগীকে ভয় পাওয়ার কোনোই কারণ নেই
৩.মানসিক রোগের কোনোরকম উপসর্গ দেখা দিলে সেটিকে আমলে এনে ডাক্তারের সাথে কথা বলবো

সবাই সুস্থ থাকুন, নিরাপদ থাকুন, সুন্দর থাকুন ।

———————-
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন, রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার, টরেন্টো, ২০২১

(লেখকের এই লেখাটি ‘টরন্টো বাংলা স্কুল’ এর সম্পাদনায় ‘বর্ণমালা’ নামক পত্রিকায় এপ্রিল ২০২১ সময়কালে প্রকাশিত হয়েছিল )

পূর্ববর্তী নিবন্ধ_আমাকে খুঁজে পাচ্ছি না _
পরবর্তী নিবন্ধমৃত্যুর সাথে লড়ছেন-ডাঃ সিনহা আবুল মনসুর
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন