ফ্লোরিডা থেকে:-

দেবতাদের খেলা বড় নিষ্ঠুর , তাদের অসাধ্য কিছু নেই । তাদের বিবেক আর মানুষের বিবেক এক নয়। মানুষের বোধের বাইরে তাদের বোধ । মানুষের পূজা গ্রহন করে সুন্দরের মোড়কে তারা মানুষেরই জন্য অকল্যাণ পাঠান।
আজকের দিনের দেবতারা আগের দিনের দেবতাদের মতই অদৃশ্য তবে ক্ষমতার দিকে দিয়ে তারা মেগা দেবতা এবং তারা নিষ্ঠুরতায় আরও কঠোর ।

আমি অনুভব করলাম যে আমার অ্যারিদনেকে নিয়ে থাকলে চলবেনা, অনেক দূরে যেতে হবে , তাই আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলাম।
আমার ক্লান্তি লাগছিল ।
আমি কি যেন বইছিলাম কিন্তু কি বুঝতে পারছিলামনা, কিন্তু মাথার মধ্যে অবসশেনের মত ঘুরছিল “সেলফী”,”সেলফী”। স্বপ্নে প্রায়শই বস্তু ও বোধের মধ্যে ব্যবধান দূর হয়ে যায়, বস্তু মনে হয় বোধ , আর বোধ বস্তু । পিথাগোরাসের যেমন মনে হয়েছিল সংখ্যা হচ্ছে এই বিশ্ব সংসারের মূল ভিত্তি ( সংখ্যা যে tangible কিছু নয় তা তার মনে হয়নি),আমারও এই সেলফী শব্দটিকে মনে হল বোঝা।
আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম কেন আমি এই বোঝা বইছি যার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমার কোন আইডিয়াই নেই। আমার সাথের অন্যেরা যারা ভবিষ্যতে বাস করেনি ,বলেছিল ভবিষ্যতে কাজে লাগবে , কিন্তু যা অপরিচিত, অযৌক্তিক এবং intangible তা বইতে আমার মন বিদ্রোহ করলো। আমি এডামেন্ট হয়ে সেই অযৌক্তিক ভারটি সিড়ির পাশে রেখে হাঁটতে শুরু করলাম। আমার নিজেকে অনেকটা হাল্কা মনে হল । অতটা হাল্কা আমার কখনও বোধ হয়নি।

অনেকদূর হেঁটে নামার পরে প্রশ্ন হল আমি যে পাত্রটি হাতে নিয়ে যাচ্ছি পবিত্র জল আনতে তাই বা কেন। জল যে পবিত্র তা আমি জানলাম কি করে ? বা আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে যে জলই আছে তাই বা আমি কেন ভাবছি । সেখানে মরুভূমিও তো থাকতে পারে ।
আমার মধ্যে এই প্রশ্ন গুলো সংশয়ের সৃষ্টি করল , আমি খুব অস্থিরতা অনুভব করলাম । যা একসময় সত্য বা প্রয়োজনীয় মনে হয় পর মুহূর্তে তা নিয়ে অন্য বোধ আসে কেন ? তাহলে আমরা যে সিদ্ধান্ত গুলো নিই তাদের সত্যতা বা প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমরা কি করে এত নিশ্চিত হই ?

মনে হল আমি পাত্রটি বইছি অযথা , আসলেই তার কোন প্রয়োজন নেই। এই গভীর ঘুমের মধ্যে আমার দার্শনিক ডায়াজিনিসের কথা মনে হওয়ার কথা নয় । কারন দিগম্বর ডায়াজিনিস সব কিছুর মায়া ত্যাগ করা সত্ত্বেও একটি জল পান করার মগ হাতে নিয়ে বেডিয়েছেন সারা জীবন , তার পর বৃদ্ধ বয়েসে এক শিশুকে হাতের তালুতে করে ঝর্নার জল পান করতে দেখে নিজেকে “বৃদ্ধ গর্দভ” বলে গালি দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন শেষ সম্বল সেই মগটিকেও।

সমস্ত সত্ত্বায় আমি নিশ্চিত হলাম যে ওই পাত্রটার আমার মোটেও প্রয়োজন নেই , কেউ আমাকে দিয়ে জোর করে ওটা বইয়ে নিচ্ছে , কি কারন আমার জানা নেই, আমি আমার নিজস্ব বিবেচনা দিয়ে পরিচালিত হচ্ছি না । আমার নিজস্ব মত হচ্ছে, যা আমার বিশ্বাস ও মননের পরিপন্থী আমি তার বোঝা বইবো না। সেই পাত্রটি সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে সিঁড়ির পাশের অতল অন্ধকারে ছুড়ে ফেলে দিয়ে হাঁটতে লাগলাম।

ঠিক এই মুহুর্তে আমার পিছনের উপরের সিঁড়ি গুলো থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে আমাকে অতিক্রম করে চলে গেল নীচের দিকে একটা কিছু। আমি দৌড়াতে লাগলাম পিছু পিছু । দেখলাম একটি রক্তাক্ত ধরশূন্য মাথা।
আমি বিস্মিত হয়ে ভাবতে লাগলাম কার মাথা এটা?
কম্পিউটারের সার্চ ইন্জিন যেভাবে কাজ করতে থাকে তেমনি দ্রুত গতিতে চলল অনুসন্ধান : বিদ্যুৎ চমকের মত মনে পড়ল মিখাইল বুলগাকভের “মাস্টার ও মার্গারিতা” উপন্যাসের কথা । চিরায়ত মানব মনের দুর্বলতা, জটিলতা, ভালোবাসা, প্রতারনা, অহংবোধ, আদর্শের কচকচানী ইত্যাদি নিয়ে লিখিত জটিল এই উপন্যাসে ব্ল্যাক ম্যাজিকের প্রফেসর ভোলান্দ দুই সাহিত্যিক ইভান নিকোলায়েভিচ বেজদোমনি এবং মিখাইল আলেক্সান্দ্রোভিচ বেরিলিওজের সাথে কথা বলতে বলতে বলেছিল যে মাথায় ইট পড়ে বেরিলিওজের মারা যাবার সম্ভাবনা নেই কিন্তু পা পিছলে পরে চলন্ত ট্রামের চাকায় তার ধর থেকে মাথা কাটা যাবে । এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তার কথা সত্য হয়। বেরিলিওজের ধর থেকে মাথা ছিন্ন হয়ে যায়।
কিন্তু না ,এটা বেরিলিওজের মাথা নয়। আমি বেরিলিওজকে খুব ভালো করে চিনি। এ মাথা অন্য কারো।

আমার চোখে ভেসে উঠল প্যারিসের লোকে লোকারণ্য প্রাসাদ চত্ত্বর,১৭৯৪ সালের ৮ই মে । পুরনোকে ভেঙে দেয়ার পৈচাশিক উন্মত্তায় মুক্ত-উন্মত্ত মানুষ নতুনের অবয়বহীন রূপসী- ভয়ংকর মুখ দেখতে গত এক বছর ধরে এসে জড়ো হয় এখানে । মাত্র একবছর আগে রাজা ১৬ শ লুইকে গিলোটিনে হত্যা করা হয়েছে এবং তার অন্যতম হন্তা বিপ্লবী জ্যাঁ পল মারাত নিহত হয়েছে নিজের বাসস্হলে বাথ টাবে এক রূপসীর ছুরির আঘাতে । রোবেসপিয়ের সওয়ার এক অদমিত ঐরাবতের পিঠে যে তার পায়ে পায়ে তছনছ করে ছডাচ্ছে ভয়ংকর মৃত্যু । সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার শ্লোগান আর মার্সেল (La Marseillaise) উদ্বেলিত বিপ্লবের
বেদীতে প্রতিদিন চলছে মানব বলি। রোবেসপিয়ের তখনও ধারনা করতে পারেনি যে মাত্র ২ মাসের মাথায় ( রাত জুলাই ২৭-২৮) সেও এগিয়ে যাবে সেই একই গিলোটিনের দিকে যেখানে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে মারাতের দ্বারা অভিযুক্ত ৫০ বছর বয়স্ক মানব জাতির শ্রেষ্ঠতম সন্তানদের একজন লেভয়সিয়ের । না , পবিত্র রক্ত ছাড়া বিপ্লবের দেবীর তৃষ্ণা মিটবেনা, থেমে যাবে মানবতা মুক্তির তৃষিত উষ্ট্র-ক্যারাভান। মাত্র ৪০,০০০ মানুষের মাথা ধরহীন করতে পারেনা যে বিপ্লবের গিলোটিন তা কেমন বিপ্লব ? দিন শেষে যেয়ে এ গুলো সবই তো ছিন্ন কিছু মস্তক ,অ্যাসেরিয়ানদের বীরত্ব মাপার নিক্তি, বা একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট পিথাগোরীয়ান সংখ্যা মাত্র।

না, এই ছিন্ন মাথাটি আধুনিক কেমিস্ট্রির জনক অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেনের আবিষ্কারক লেভোয়সিয়েরের নয় , নয় ফরাসি বিপ্লবের নেতা ম্যাক্সিমিলান রোবেসপিয়েরের।
এ এক বৃদ্ধ মানুষের মাথা, যার মুখ ভরা দাড়ি আর মাথায় মধ্যএশীয় পাগড়ী ।

হঠাৎ সেই ছিন্ন মস্তক কথা বলে উঠল । বলতে লাগল হর হর করে সমরখন্দের কথা, দাদা তৈমুরের কথা , পিতা শার রুখের কথা যার ছত্র ছায়ায় ১৪১১থেকে ১৪৪৯ পর্যন্ত সে উজবেকিস্থান,তাজিকস্থান,তুর্কমেনস্থান, কিরগিজস্থান, দক্ষিন কাজাকস্থান ও আফগানিস্তানের শাসক ছিল । কিন্তু রাজ্য শাসন ছিল তার আত্মার পীড়ন । সে চেয়েছে প্রজাদের শিক্ষা দিতে, জ্ঞান চর্চা ও বিতরন করতে। দৃষ্টির আড়ালে অদৃশ্য যে মহাবিশ্ব তাকে জানার উদগ্র কামনা তাকে জাগিয়ে রাখতো রাতের পর রাত। সে গড়ে তুলে বিশ্বের সেরা মান মন্দির , নিখুঁত ভাবে গননা করে দেয় সৌর বৎসরের দৈর্ঘ্য : ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা ৮ সেকেন্ড ( +৫৮ সেকেন্ডের হেরফের ) যা ছিল উত্তর কালীন কোপার্নিকাশের হিসাবের চেয়ে ও সুক্ষ্ণ ।
২ বছর আগে মারা গিয়েছিল হেরাতের ক্ষমতাধর পিতা শার রুখ যার ছত্রচ্ছায়ায় সে পেরেছে তার রাজ্য শাসনের পাশাপাশি জ্ঞানচর্চা চালাতে। কিন্তু সেই মহীরুহের মৃত্যুর সাথে সাথে নড়বড়ে হয়ে উঠেছিল তার সিংহাসন। তার পক্ষে সম্ভব হয়নি ক্ষমতা লোভী আত্মীয়দের নিবৃত্ত করা। ভেবেছিলেন মক্কায় শেষ দিন গুলো কাটিয়ে দেবেন নিরিবিলি , কিন্তু আত্মজ আবদ আল লতিফ পাঠিয়ে দিল মৃত্যু। পবিত্র মক্কার পথে বাম দিক থেকে এক কোপে তার পিতার ঘাড়ের তিন নম্বর ভার্টিব্রাটিকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হল ধর থেকে।
আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল , তার নাম জানতে আমার মোটেও ইচ্ছে হলনা , সে রক্ত বমি করতে করতে উচ্চারণ করল “উলুক বেগ”।
“আমার রক্ত রাজকীয় রক্ত , যে রক্তে প্রতিটা কণিকা বহন করে আভিজাত্য , লোভ ও বিশ্বাসঘাতকতা পাশাপাশি।”

কিন্তু আমার পেটের ভিতরে ভীষন ভাবে মোচড় দিতে লাগলো বর্ষার ঘোলা জলের পদ্মায় যেমন মোচড় খায় জল। কালবোশেখীর মেঘ যেমন সামান্যতে শুরু হয়ে আস্তে আস্তে ঘন হতে হতে সমস্ত আকাশ আচ্ছন্ন করে ফেলে, আমার মধ্যে তেমনি এক তীব্র বমনেচ্ছা ডালপালা মেলতে লাগল , আমি চিৎকার করে দৌড়ে পালিয়ে এলাম ।
চলবে
শাহাব/মে ৭,২০১৬

 

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন