অফিস ছুটির পর প্রায় প্রতিদিনই প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রীর গ্রোসারী শপিং সেড়ে বাড়ি ফেরে দিব্যেন্দু। কিন্তু আজ তেমন কোনো প্রয়োজন ছিলনা। ডেনফোর্থ রোড ক্রস করতেই মনে মনে বলে, নাঃ একবার ঘুরেই আসি। ঝিঙে-পটলের দাম যে হারে বাড়ছে, একেবারে আগুন। টাচ্ই করা যায় না। দেখি, টাটকা শাক-সব্জী কিছু পাওয়া যায় কি না।

এইভেবে গাড়ি পার্ক করতেই চমকে ওঠে দিব্যেন্দু। বুকটা ধুক্ করে ওঠে। খানিকটা দূরত্বের ব্যবধানে হঠাৎ কার যেন পলকমাত্র দৃষ্টিপাতে থমকে দাঁড়ায়। অনি”ছাসত্তে¡ও ওর অবাধ্য চোখের দৃষ্টি আর্কষণ করতেই স্বগতোক্তি করে ওঠে,- ভদ্রমহিলাকে কোথায় যেন দেখেছি। খুব চেনা চেনা লাগছে। দীর্ঘদিনের অদেখায় ঠিক ঠাহর করতে পারছে না। আবছা মনে পরছে, হুবহু সেই শুভ্র মসৃণ, লাবণ্যময়ী চেহারা। নিখুঁত কোমড়ের গড়ন, নিতম্ভ। উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত ডাগর চোখের চাহনি। চঞ্চল প্রাণবন্ত, ছন্দময় পদচারণা। কি আশ্চর্য্য, টোলপড়া গোলাপগালের সেই রহস্যাবৃত দুষ্টুমিষ্টি হাসি। জনৈক মহিলার বাম পাশের গজদন্তটিও দিব্যেন্দুর নজরে এড়ায় না। সে এক শ্বেতাঙ্গ রমণীর সাথে অন্তরঙ্গ আলাপনে মর্শগুল হয়ে আছে। হাউ ইস দ্যাট্ পসিবল? হু ইস দিস লেডি? ইস সী হীয়ার?

মনে পড়ে দিব্যেন্দুর, একদিন কথা প্রসঙ্গে এক্স-গার্লফ্রেন্ড লাবণী গর্ব করে বলেছিল,-সুশীলসমাজে অতি সুপরিচিত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত একজন বিশিষ্ঠ প্রভাব-প্রতিপত্তিশীল ব্যক্তি ওর পিতৃদেব। প্রচুর ধন-সম্পত্তির মালিক। স্বার্থের বিনিময়ে অসাধ্য সাধন করা একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব। তিনিই পারেন। যাকে স্বচোক্ষে দেখার কখনো সৌভাগ্য হয়নি। হয়তো তারই পূর্ব পরিকল্পিত, ষড়যন্ত্র। কে জানে! দিব্যেন্দুর মতো তৎকালিন একজন মিডেল ক্লাসের হতভাগ্য দরিদ্রের সংর্স্পশ থেকে, ওর জীবন থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন করার এটাই ছিল তার একমাত্র রিজন।

আজ দীর্ঘদিন পর লাবণী নামটি উচ্চারিত হতেই সব এলোমেলো হয়ে গেল দিব্যেন্দুর। ওদিকে মর্নিংএ অজ্ঞাত মহিলার ফোন কল্ রিসিভ করার পর থেকে বারবার লাবণী নামের একটা মিষ্টি গন্ধ্যে বুকের ভিতর কেমন অস্থির হয়ে উঠছে। কিন্তু পরক্ষণে ওর অতীত মনঃশ্চক্ষে ভেসে উঠতেই বিষাদে ভরে গেল মন। ইচ্ছে করছে, জনৈক মহিলার সম্মুখে দাঁড়িয়ে কৈফেয়ৎ চাইতে। জবাবদিহী করতে। ঘটনার প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করতে। কি অপরাধ করেছিল দিব্যেন্দু? অহেতুক এতবড় কঠিন আঘাত হেনে কেন ওর জীবন থেকে সড়ে গিয়েছিল? আর কেনইবা এতকাল আত্মগোপন করেছিল?

কন্তু নাঃ, অদৃষ্টের দোহাই দিয়ে যে ভুল একবার সে করেছে, দ্বিতীয়বার আর নয়। তাছাড়া জনৈক মহিলা পরস্ত্রীও হতে পারে। যদি নাও হয়, এতকাল পর কিইবা এসে যায়। দিব্যেন্দু হার মানতে শেখেনি। আজও মানবে না। পুরুষ মানুষ হয়ে একজন মহিলার কাছে নত স্বীকার করবে! ভালোবাসা ভিক্ষে চাইবে! আত্মমর্যাদায় নতুন করে আঘাত হানবে! কেন করবে দিব্যেন্দু? কেন নিজেকে ছোট করবে? আর প্রশ্রয় দেওয়া নয়। কিছুতেই নয়। তবু অবুঝ মন কিছুতেই মানতে চায় না। দ্বিধা আর দ্বন্দের টানাপোড়ণে প্রচন্ড আলোড়ণ সৃষ্টি করে ওর মধ্যে। মরচে ধরা স্মৃতিরা সব চোখের সামনে এসে ভীঁড় করে। কানে বাজজে, ভ্রমরের মতো গুনগুন সুরের লাবণীর মধুর গুঞ্জরণ। হাসি-কলোতান।

অবলীলায় দিব্যেন্দু পারলো না, নতুন করে ভালোলাগার মধুর আবেশে মনকে ধরে রাখতে। বাধা দিতে। এতো কিছু ঘটে যাবার পরেও আবেগের প্রবণতায় ভালোলাগা আর ভালোবাসার তীব্র অনুভূতিগুলি এতকাল কোয়ায় যে ওর লুকিয়ে ছিল, পিছন ফিরতেই অস্ফুট একটা খুশীতে ভরে গেল ওর বুক।

ঠিকই অনুমান করেছিল। কিন্তু কখন যে গুটি গুটি পায়ে লাবণীর সন্নিকটে এগিয়ে যাচ্ছিল টের পায়নি। চোখ পাকিয়ে দ্যাখে, শরতের শিশির ভেজা সবুজ মখ্মলে ঘাসের প’রে চঞ্চল প্রজাপতির মতো ছুটে বেড়ানো সেই প্রাণবন্ত দুষ্টুমিষ্টি কিশোরী কন্যা লাবণী আজ পূর্ণ যুবতী। রমণীও বলা যায়। কি শান্ত-স্নিগ্ধ-কোমনীয় ওর রূপ-রঙ। প্রেমের মহিমায় দ্বীপ্ত, মমতাময়ী এক বিদূষী নারী। সেই অবিরল অবয়ব রূপে সশরীরে ষ্ট্যাচুর মতো জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে দিব্যেন্দুর সম্মুখে দাঁড়িয়ে। ওকে চেনার উপায় নেই। চেহারায় আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। আভিজাত্য ও মার্জিতই বটে। পরনে ব্লু-জিন্সের প্যান্ট, কমলা রঙের টপ, হাফ্ জ্যাকেট। বেশ লাগছে ওকে দেখতে। দারুণ মানিয়েছে। শ্বেতাঙ্গদের মতো দুধসাদা গায়ের রঙ, একেবারে ফেটে পড়ছে। কাতর চোখের দৃষ্টি মেলে কিছু বলার ব্যাকুলতায় ঠোঁটদুটো কাঁপছে। সেই সঙ্গে লজ্জা আর অব্যক্ত আনন্দের সংমিশ্রণে অশ্রু  কণায় চোখের তারাদু’টি মুক্তোর মতো চিক্চিক্ করছে। দিব্যেন্দুকে দেখামাত্রই ব্যগ থেকে সাদা রঙের একটা স্কার্ফ বের করে গায়ে-ঢাকা দেয়। কিন্তু কেন? আজ ওর কিসের অভিনয়? কিসের পরোওয়া! কি জাহির করতে চায় লাবণী? কি বলতে চায়? চায় কি সে?

মনে মনে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয় দিব্যেন্দু। ক্ষণপূর্বে যে অকপট সারল্য ওর চোখেমুখে দেখা গিয়েছিল, মুহূর্তে তা মিলিয়ে গেল। গম্ভীর হয়ে থাকে। ইচ্ছে হচ্ছিল প্রকাশ্যে লোকালয়ে চিৎকার করে বলবে,-চিনতে আমিই ভুল করেছিলাম। লাবণী তুমি ছলনাময়ী। তোমার হাজারটা রূপ। তুমি গিরগিটির মতো রঙ বদলাও। পিতার অবাধ স্বাধীনতা অপব্যবহার করে পুরুষ মানুষের মন নিয়ে তুমি খেলা করো। এতেই তোমার একমাত্র সুখ, আনন্দ। সহৃদয়ে ভালো তুমি কখনোই বাসতে পারো না। প্রকৃত নারী তুমি নও। নারীজাতির কলঙ্ক, ভ্রষ্টাচারী!

কিন্তু দিব্যেন্দু তা বলতে পারলো না। পারলো না লাবণীকে আপমান করতে, ওকে অপদস্থ  করতে। ওর মাথাটা হেট করে দিতে। ওর নারীত্ব ক্ষুন্ন করে দিতে। বিবেকের তীব্র দংশণে নীরব নির্বিকারে সহে গেল। মনকে শান্তনা দিয়ে বলল,-একান্তে নিভৃতে নিবিড় করে জীবনে নাইবা পেলাম। নাইবা হোলো ওর প্রেয়সী, প্রিয়তমা, ঘরণী। ভালোবাসার অপর নামই তো বলিদান, সেক্রিফাইস। নিঃস্বার্থ প্রেম, ভালোবাসা জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য্য। মনকে করে পবিত্র, প্রভাবিত। আমারা কি বন্ধু হতে পারি না!’

কিন্তু মানুষের মন বড় বিচিত্র। সহজে পোষ মানে না। দিব্যেন্দুর মনের অবস্থাও ঠিক তদ্রুপ। বিদেশের মাটিতে হঠাৎ এক্স-গার্ল ফ্রেন্ড লাবণীর মুখোমুখি দর্শণে ইমোশনাল হয়ে পড়া খুবই স্বাভাবিক। চোখেমুখেও একরাশ বিস্ময়, উ”ছাস। চোখে চোখ পড়তেই মনে মনে বলে,-হোয়াট্ এ সারপ্রাইজ! আই কান্ট বিলিভ।

পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে কটাক্ষ দৃষ্টিতে লাবণীর মুখপানে একপলক চেয়ে আপনমনে বিড়বিড় করে ওঠে।-অমন করে দেখছ কি লাবণী! এতো মাসুম, ইনোসেন্ট হোওনা। ভাবছো ভুলে গিয়েছি। নো, নেভার। তোমার বিহেইভ কোনদিন ভুলবো না। একদিন তুমিই বিনা নোটিশে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলে আমার জীবন থেকে। মরিয়া হয়ে কারণ জানতে চাইলাম, তুমি নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে। কি অপরাধ করেছিলাম? বলো লাবণী বলো, আজ চুপ করে থেকো না, কিছু বলো! একদিন এভাবেই ক্ষণিকের অন্ধমোহে বশীভূত হয়ে আমার মতো একজন অনভিজ্ঞ মানুষ নিজের ষ্ট্যাটাস, সামাজিক অবস্থান ভুলে গিয়ে বেমালুম বদলে গিয়েছিলাম। ছুঁতে চেয়েছিলাম আকাশের চাঁদ। আসলে সেটা যে মায়া মরীচিকা ছল, চোরাবালির চড়, বেদনার উপত্যকায় বসে কল্পনায় শুধু স্বপ্নের জাল বোনা, সুখের তাজ গড়া, সেদিন বুঝতে পারিনি। যখন হাত বাড়ালাম, দেখলাম সব শূন্য। কিছুই স্পর্শ করা যায়না। চারদিকে কূয়াশার মতো ধোঁয়া, ধূসর মরুভূমি। চোখে পথ দেখা যায় না। দিগি¦দিক নির্ণয় করা যায়না। আর সেটা বোধগম্য হতেই হৃদয় থেকে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে বিশ্বাস, ভালোবাসা, আশা-ভরসা। আজ পারবে তা ফিরিয়ে দিতে? পারবে নতুন করে আমায় ভালোবাসতে? বলো বণী, বলো। জানি, আজ জাহির করবার মতো তোমার কাছে কিছু আর অবশিষ্ঠ নেই।

কন্তু কি বলবে বিমূঢ়-ম্লান লাবণী! শূন্য দৃষ্টিতে হাঁ করে চেয়ে থাকে। গভীর তন্ময় হয়ে ডুবে গিয়েছে কল্পনার সাগরে। বুকের ভিতর আজও কি যন্ত্রণা নিয়ে ওযে বয়ে বেড়াচ্ছে, তা দিব্যেন্দুইবা জানবে কেমন করে! কেমন করে জানবে লাবণীর অপারগতার কথা। ওর ব্যর্থতার কথা। তবু সে নিজেই অপরাধী। দুদিনের আন্তরিকতা ও কুশল বিনিময়ের অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলিকে মামুলি বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল, সেকথা আজও লাবণীর মনে আছে বৈকি! অথচ পরিণত বয়সে তা প্রেম-ভালোবাসা নয় বলেও উড়িয়ে দিতে পারেনি। পারেনি অন্য কোনো পুরুষকে ওর সুকোমল হৃদয়ে পে্িরমকের আসনে ঠাঁই দিতে। বরাবর মনে-প্রাণে চেয়েছিল সারাজীবন দিব্যেন্দুর হৃদয়ে একান্ত ভালোবাসার ফুল হয়ে থাকতে। দিব্যেন্দুর পরিচয়েই পরিচিতা হতে। নির্লজ্জ বেহায়ার মতো সেকথা আজ বলবে কেমন করে! কিইবা মূল্য আছে তার। আজ এতকাল পর অভাবনীয়ভাবে আচমকা সশরীরে দিব্যেন্দুর দর্শণে ভূত দেখার মতোই চমকে ওঠে। বিশ্বাসই হ”িছল না নিজের চোখদুটোকে। বিস্ময়ে অভিভূতর মতো হাঁ করে থাকে। রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে কণ্ঠস্বর। কিছু বলবার তাগিদে প্রচন্ড উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। অথচ মুখ ফুটে একটা শব্দও উচ্চারিত হয়না। মনে মনে বলে,-তুমি তো জানো দেব, তোমার নিজেরও বোন আছে। মেয়েদের জীবন ঠিক হাতে গড়া পুতুলের মতো। মেয়েরা সরীসৃপ প্রাণীর মতো আজীবন অন্যের উপর নির্ভরশীল। সে পিতা-মাতাই হোক না কেন, অন্যের পরিকল্পনায় পরিচারিত হয় মেয়েদের জীবন। বিশেষ করে যাদের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা থাকেনা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করবার সাহস থাকেনা। কত দুর্বল ওরা, কত অসহায়। কিছু বলতে পারেনা। আর পারেনা বলেই আমাদের দেশে বিবাহ-বন্ধন সূত্রে আবদ্ধ হয়ে সামাজিক স্বীকৃতিকে অপব্যবহার করে দোকানীর দ্রব্য-সামগ্রীর মতো মোটা কড়ির বিনিময়ে ক্রয়-বিক্রয় হয় শত শত অসহায় অবলা নারী, নারীর জীবন। শ্রুতিকটূ হলেও কথা সত্য। যেখানে ভালোবাসার কোনো ঠাঁই নেই। জীবনের চাওয়া-পাওয়ার কোনো মূল্য নেই। যারা নিরবে নিঃভৃতে মাথাকূটে কেঁদে মরে। শুধু কি তাই, জীবনের পরম আকাংখিত চাওয়া-পাওয়ার স্বপ্ন দেখাও নিষিদ্ধ। জন্মাবধি চিরকাল পরাধীনতার শিখলে কারাবন্দী। অগত্যা, বোবা অনুভূতির গহীন অনুতাপ অনুশোচনায় দ্বগ্ধ হতে হতে একদিন নিঃশ্ব হয়ে ঝোরে যায় তার অন্তরের অন্তরালে প্রস্ফূটিত নিরব ভালোবাসার ফুল। আজ অস্বীকার করি কিভাবে, সেখানে লাবণীও একজন। কিশোরী বয়স থেকে মাতা-পিতার কঠোর শাসনের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ হয়ে থাকা লাবণীর নিজের ই”ছা বা মতামত প্রকাশ করবার স্বাধীনতাটুকুও কখনো ছিলনা, আজও অবধি নেই। তাই চেয়েছিলাম বাড়ি থেকে পালিয়ে তোমার হৃদয়গহরে আশ্রয় নিতে। নিজেকে সঁপে দিতে। কিন্তু পারিনি। তুমি বিশ্বাস করো দেব, আমায় চার-দেওয়ালের বদ্ধঘরের ভিতরে নজর বন্দী করে রাখা হয়েছিল। কত অসহনীয় যন্ত্রণাময় মুহূর্ত আমায় যাপন করতে হয়েছিল। যেদিন স্বদেশ ত্যাগ করি, সেদিন নিরুপায় হয়ে ছুটে গিয়েছিলাম তোমায় জানাতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, হন্যে হয়ে তোমায় খুঁজেছি, কোথাও তোমার দর্শণ মেলেনি। সেদিনই বুঝেছিলাম, তোমার দেখা আর মিলবে না। তোমার নাগাল কোনদিন পাবো না। কিš‘ বিধাতার লীলা বোঝা ভার। সেদিন কি জানতাম, সাত-সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে এতদূরে এসে আজ তোমার সাথে একেবারে মুখোমুখি দেখা হবে! এ তো কল্পনারও অতীত! অথচ মাত্র কয়েক ফুট দূরত্বের ব্যবধান। আজ কারো মুখে কথা নেই। দুজনই নিজ নিজ জগতে বিচরণ করছে। কি বলবে, কোথা থেকে শুরু করবে, কিছুই স্থির করতে পারছে না।

অবলীলায় নানা দ্বন্ধ-দ্বিধা, সংকোচ আর সংশয়ের সংমিশ্রণে চোখের পাতাদুটো নূয়ে পড়ে লাবণীর। ওর ঠোঁট কাঁপে, বুক কাঁপে। ক্রমান্বয়ে নিঃশ্বাস প্রঃশ্বাসের আনা গোনায় সময় বয়ে যায়। মনে মনে বলে, চেহারা আর বেশভূষা অনেক বদলে গিয়েছে দিব্যেন্দুর। যেন কোনো এক অজ্ঞাত অপরিচিত কূলশীল ব্যক্তি। প্রচন্ড উৎসুক্য হয়ে লাবণীর অতীত সম্বন্ধ্যে অবগতর জন্য অপেক্ষা করে আছে। কিন্তু কিভাবে বলবে লাবণী, পাত্রপক্ষ আগমন বার্তা পাঠিয়েছে। আগামী মাসের ফাষ্ট উইকে পাত্রপক্ষ পাত্রী দেখতে আসবে। পিতা অমলেন্দুর মনোনীত পাত্র। কোনমতেই রিজেক্ট করা যাবেনা। কোনো অপিনিঅন চলবে না। কবুল করতেই হবে। পিতার আজ্ঞা অমান্য করা, লঙ্ঘন করা এতবড় স্পর্ধা লাবণীর নেই। কিন্তু এ বিবাহ ঠেকাবে কেমন করে? আজ এতকাল পর দিব্যেন্দুকে এতো কাছে পেয়েও আবার হারিয়ে যাবে ওর জীবন থেকে? এরপর দেখা হবার কোনো সম্ভাবনাও নেই! তা’হলে? তবে কি সারাজীবন অনুতাপ, অনুশোচনার আগুনে জ্বলে পুড়ে দ্বগ্ধ হয়ে একেবারে নিঃশ্ব হয়ে যাবে লাবণী?

ইতিমধ্যে হঠাৎ সেই পরিচিত দিব্যেন্দুর দরাজ গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বরে চমকে ওঠে লাবণী। ওর সংবেদনশীল দৃষ্টি লক্ষ্য করে স্বাভাবিক হয়ে বলল,-‘কেমন আছো লাবণী? এতকাল কোথায় ছিলে? এ্যাঁ! দ্যাখো তো, কেমন চিনে ফেললাম। ভারি মিষ্টি লাগছে তোমায়। কি, চুপ করে আছো, কথা বলবে না। দেখো, আমি কিন্তু অপরাধী নই। বলো সত্যি কি না! কি, বলছো না যে! আজ আর চুপ করে থেকো না বণী! কিছু বলো!’

অপ্রত্যাশিত দিব্যেন্দুর আবেগ মিশ্রিত বাক্যশ্রবণে মনটা মোমের মতো গলে একদম নরম হয়ে গেল লাবণীর। ধীরে ধীরে ক্ষমা প্রার্থীর দৃষ্টিতে মুখ তুলে দিব্যেন্দুর মুখের দিকে তাকায়। অস্তাচলে ঢলে পড়া কুসুমের মতো ক্লান্ত সূর্য্যরে নিস্তেজ কিরণে মুখখানা ওর আরো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। ততক্ষণে ডেনফোর্থ রোডের চারদিক জনসমুদ্রে ছেয়ে গিয়েছে। সব চেনা জানা পরিচিত মুখ। হাওয়ায় ভেসে আসছে বহু পরিচিত মানুষের কণ্ঠস্বর। বুকের ভিতরটা কেমন ধুকধুক করছে। সাহসই হচ্ছেনা কিছু বলবার। হঠাৎ কেউ দেখে ফেললে যে মহা কেলেঙ্কারী হয়ে যাবে! পাত্রপক্ষের কানে একবার পৌছে গেলে আর রক্ষা থাকবে না।

ইতিমধ্যে বাতাসে হঠাৎ লাবণীর স্কার্ফটা দিব্যেন্দুর মুখের উপর উড়ে এসে পড়তেই চোখে চোখ পড়ে যায় দুজনের। দিব্যেন্দু লক্ষ্য করে, ভীত সন্ত্রস্ত্রে আড়ষ্ঠ হয়ে ষ্ট্যাচুর মতো হয়ে আছে লাবণী। কি যেন বলতে চাইছে।

ক্ষণিকের নিরবতা ভঙ্গ করে দিব্যেন্দু। মুখ থেকে স্কার্ফটা সরিয়ে বলল,-‘অযথা ভয় পেওনা লাবণী। তোমাকে জবাবদিহী করতে হবে না। কোনো কৈফেয়ৎ আমি চাই না। টরোন্ট শহরে কবে এসেছ, কার সাথে এসেছ, কিছুই জানতে চাইবো না। শুধু এইটুকু বলো, বরমালা কার গলায় দিলে? কে সেই ভাগ্যবান পুরুষ?’

এতক্ষণ পর ফোঁস করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে লাবণী। ঠোঁটের কোণে একটা বিষন্নময় হাসি ফুটিয়ে বলে,-‘হুঁম দিতে আর পারলাম কই! এখনো তো মালাই গাঁথা হলো না!’

বিস্মিত হলেও লাবণী যে কুমারী, অবিবাহিতা, বুঝতে দেরী হলো না। খুশীও হলো মনে মনে। কিš‘ তা বুঝতে দিলো না। ইতিমধ্যে হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন ডাক দিতেই ডিষ্ট্রাক্ট হয়ে যায় দিব্যেন্দু। একটি জরুরী বিষয়ে জনৈক ব্যক্তির সাথে কনভারসেশনে মর্শগুল হয়ে পড়ে। ইত্যবসরে কখন যে লাবণী অদৃশ্য হয়ে গেল, খেয়ালই করেনি।

কিন্তু যে কথা বলতে চেয়েছিল, তা তো বলাই হলো না লাবণীর! তা’হলে! বাড়ি এসে কিছুতেই স্বস্তি পায়না। রাতেও ঘুম হয়না। সারারাত এপাশ ওপাশ করে বিছানায়। মনে মনে ভাবে, আর কিছুদিন পর দুঃস্বপ্নের মতো অন্ধকারে ছেয়ে যাবে ওর জীবন। কতগুলি অচেনা অপরিচিত মানুষের সম্মুখে পুতুলের মতো সেজে বসতে হবে। হুকুম করলেই হেঁটে চলে দেখাতে হবে। পাত্রীর সার্বিক গুনাবলীর নমুনা দেখাতে হবে। রিকোয়েষ্ট করলে, দু-একটা গানও গেয়ে শোনাতে হবে। -উফ্ঃ, অসহ্য!

রাগ হয় বিধাতার ওপর। বেশ ভালোই তো ছিল। রাতের দুঃস্বপ্ন ভেবে এতকাল দিব্যেন্দুকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। মুছে ফেলেছিল স্মৃতির পাতা থেকে। তবে কেন আজ জীবন্ত হয়ে ওর জীবনে পুনরায় দেখা দিলো! কেন এমন হলো! এ কেমন বিধাতার অগ্নিপরীক্ষা? হে ঈশ্বর, এতো নির্দয়, কঠোর তুমি হোয়ও না। এতোবড় শাস্তি আমায় দিওনা। শুধু একটিবার দিব্যেন্দুকে মিলিয়ে দাও।’

সারারাত ভেবে কূল পায়না লাবণী। এতো বড় শহর, চারিদিকে এতো মানুষজন, দিব্যেন্দুকে কোথায় খুঁজবে। কোথায় খুঁজে পাবে। কেমন করে ওর ঠিকানা খুঁজে পাবে। কোথায় থাকে, কার সাথে থাকে, ওর প্রফেশন কি, কিছুই তো জানা হোলো না। ওর ফোন নাম্বারটাও পাওয়া গেল না। তবে কি এ জনমে ওর দর্শণ কোনদিন আর পাবেনা! ও’কি সত্যিই অন্যের ঘরণী হয়ে বিরাজ করবে। ভাবতেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো লাবণীর। বিষন্নতায় ছেয়ে গেল মন-প্রাণ, সারাশরীর। ভালোবাসার সমস্ত ইচ্ছা-আবেগ-অনুভূতিগুলি অনুতাপের আগুনে পুড়ে যেন সব ছাই হয়ে গেল। অগত্যা, হৃদয়ের দুকূল অশ্রæজলে প্লাবিত করে জীবন্ত লাশের মতো পড়ে থাকে নির্জন অন্ধকার ঘরে।

(চলবে)

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন