আব্দুল করিম রাত দুইটা বাজে আপন মনে হেলে দুলে বাসার সামনে এসে ঘরে কোনো আলো না দেখে  রাগে ফোঁস ফোঁস করতে  লাগলো। সে জোরে ঘরের দরোজায়  আওয়াজ করে গালি গালাজ শুরু করে।ভিতর থেকে রোজি ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে কাঁপতে কাঁপতে তাড়া তাড়ি দরজা খুলতেই করিম তাকে ধাক্কা দিয়ে বলে ,” তুমি এখন ঘুমাচ্ছ ? তুমি জানো না আমি এখন ঘরে আসবো এই বলে গালি গালাজ শুরু করে । ”  বড়ো মেয়ে রোকেয়া ঘুম থেকে উঠে বলে ,”আব্বু ! এখন রাত ২টা বাজে ।” করিম ধমক দিয়ে বলে ,” তুই দালালি করিস এই বলে করিম রেগে গালি গালাজ শুরু করে ।”  ছেলে নসু  ঘুম থেকে উঠে বলে আব্বু তুমি রোজ রোজ দেরি করে ঘরে ফিরো, আমরা রাতে ঘুমাতে পারি না । করিম ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে বলে ,”তুই এক পয়সা ও তো রোজগার করোস  না ।শুধু ঘরে খাস আর রাস্তায় ঘুরা ঘুরি করিস । আব্বু,আমি কি রোজগার করবো, আমি তো এখন ও স্কুল ফিনিস  করিনি ।তোর পড়া  শুনা লাগবে না,কাল থেকে কাজ খোঁজ কর । আমার একা রোজগারে সবাইকে  খাওয়াতে পারবো না । ঠিক আছে  আব্বু,তুমি না খাওয়াতে পারলে আমরা যা পারি করবো । তবে তুমি দোকান বন্ধ করে ঘরে চলে আসবে,রোজ রোজ দেরি করে আসবে না । ছেলেকে  গালে দুই  থাপ্পড় মেরে বলে , আমার রোজগারে খাস আর আমার সঙ্গে সবাই মিলে ঝগড়া করিস  । ঘর থেকে বের হয়ে যা, এই বলে করিম রান্না ঘর থেকে এক লাঠি নিয়ে এগিয়ে আসলে সবাই চিৎকার শুরু করে। বাড়িওয়ালা  রশিদ সাহেব  ঘুম থেকে তার স্ত্রীকে জাগিয়ে বলে ,” চলো,চলো,গিয়ে দেখি কি হচ্ছে?  রোজ রোজ  চিৎকার আর চেঁচামেচি ভালো লাগে না। ”  রশিদ সাহেব ঘরের দরোজায়  আওয়াজ করে বলে রোজ রোজ  রাত তোমাদের ঝগড়া , আমরা ঘুমাতে পারি না । তোমরা বাসা ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে যাও।  গত তিন  মাস তোমরা ঘর ভাড়া দিতে পারো নি, মুরুদ নাই সংসার জুড়েছো, ঘর ভাড়া আর স্ত্রী ছেলে মেয়েদের খাওয়া দিতে পারো না ,ওই দিকে তুমি রোজ রোজ নেশা করে ঘরে আসো।  কাল সকালে বাসা ভাড়া দিয়ে এখন থেকে চলে যাবে।  তোমাদের চিৎকারে মহল্লার লোক ঘোমাতে পারে না।    যদি তোমরা বাসা না ছাড়ো, তাহলে তোমাদের পুলিশ ডেকে বের করে দেব ।  এই বলে বাড়িওয়ালা ,তার স্ত্রী  চলে যায় এবং  রোজি  গিয়ে ভাত  বেড়ে দিয়ে ভয়ে বসে থাকে নিচের দিকে মুখ করে । করিম বাড়িওয়ালার  ধমকানি  শুনে সুবোধ বালকের মতো খেয়ে গিয়ে শুয়ে পড়ে ।  করিম দোকান ভাড়া দিতে  পারে নি গত তিন মাস থেকে, কারণ দেরি করে ঘর থেকে বের হওয়ায় তার বেচা কেনা সে রকম হয় না । বিকেলের দিকে দুই থেকে তিন ঘন্টা সে ঘরে এসে  শুয়ে থাকে এবং রাতে যা বিক্রি হয় তা নিয়ে জুয়া খেলে উড়িয়ে দেয় । সে কার কাছ থেকে শুনেছে জুয়া খেলে অনেকে বড়ো লোক হয়েছে ,তাই জুয়ার  নেশা  ছাড়াতে পারে না।

করিমের মদের  নেশা ও জুয়া খেলা নিয়ে সংসারে অনেক অশান্তি। রোজি খেয়ে ,না খেয়ে চোখের পানি ফেলে ছেলে মেয়েদের নিয়ে অনেক কষ্টে আছে  । করিম মদের নেশায় স্ত্রী ও ছেলে মেয়েদের মারধর করে ঘর থেকে বহু বার বের করে দিয়েছে। মদের নেশার ফলে,  সকালে ঘুম থেকে উঠতে অনেক দেরি হয় ,যার ফলে তার দোকানে  বেচা বিক্রি অপেক্ষা ক্রিত কম ।  ছেলে নসু   এগিয়ে আসলে তাকে মারধর করে ঘর থেকে বের করে দেয় ।  কয়েকবার  নসুকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে  এবং সে বেহায়ার মতো আবার ঘরে ফিরে আসে ।  করিমের অত্যাচারে রোজি অসুস্থ হয়ে পড়েছে ।  রোজি এবং তার ছেলে মেয়েরা নামাজ পড়ে প্রার্থনা করে  ঘরে শান্তির পরিবেশের জন্য ।
রাত্রে বাড়িওয়ালার ধমক খেয়ে করিম কিছুটা ভয় পেয়েছে ,সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে  ভাবে,” আজ বাড়িওয়ালাকে কিছু টাকা দেয়া প্রয়োজন ,” নতুবা আজ বাসা ছাড়তে হবে । করিম দোকান খোলার পূর্বে রাজগঞ্জ ও চকবাজার তার পরিচিত কিছু দোকানদারকে অনুরোধ করে  কিছু টাকা ধার দেয়ার জন্য।  কেউ তাকে ধার দিতে রাজি হয় নি,কারণ, সে পূর্বের মাল খরিদের টাকা ও ফেরত দিতে পারে নি। তা ছাড়া দোকানদার জানে যে তার নেশা ও জুয়ার সমস্যা রয়েছে এবং কেউ তাকে বিশ্বাস করতে পারে না।   বাড়িওয়ালারা স্ত্রী তার স্বামীকে বলে  ওদের এ মাস থাকতে দাও ,ওরা মাসের  মাঝখান দিয়ে কোথায় যাবে?

রশিদ সাহেব তার স্ত্রীর কোথায় সম্মতি দেয়।  করিম বিভিন্ন দোকান থেকে মাল বাকিতে এনে ব্যবসা করে ।  প্রতিদিন জুয়া খেলে ,আর মনে করে যদি আজ জিতে, তাতে কিছু টাকা পরিশোধ করবে।  কিন্তু তার ঋণের পরিমান বেড়েই চলেছে।  করিম এখন বুঝতে পারে যে তার ঘর সামলানো আগে দরকার । তাই সে জুয়াড়িদের সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখতে চায় না । কিন্তু জুয়ার পার্টনাররা তার পিছু ছাড়ছে না ,বরং একের পর এক তার দোকানে এসে  টাকার জন্য  তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে।   এক সন্ধ্যায় সে দোকান বন্ধ করে বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়েছে, তারা এসে তাকে আক্রমণ করে তার নিকট থেকে যা কিছু টাকা ছিল জোর পূর্বক নিয়ে তাকে পুলিশ রিপোর্ট করলে বিপদ হবে  বলে ধমক  দিয়ে চলে যায় । সে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে গেলে রোজি ও ছেলে মেয়েরা তাকে পরদিন দোকানে যাইতে নিষেধ  করে ।  কিন্তু দোকান না খুললে তার দোকানের বকেয়া ভাড়া ,বিভিন্ন দোকানের পাওনা ও বাড়ি ভাড়া কি ভাবে দিবে?

রোজি এবং তার ছেলে মেয়েরা এ নিয়ে রশিদ সাহেবের সঙ্গে আলাপ করলে সে এবং তার স্ত্রী বলে তোমরা এখান  থেকে অন্যত্র চলে যাও, নতুবা এখানে বিপদে পড়বে । রোজি ও ছেলে মেয়েরা কান্না কাটি করে  রশিদ সাহেবকে বলে,” আমরা এ অবস্থায় কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো ? আপনারা দয়া না করলে আমরা থাকতে পারি না।“  এ বিপদের দিনে কে তাদের  সাহায্য করবে? ঘরে খাওয়া নাই ,বাড়িওয়ালা ও তার স্ত্রী ঘর থেকে কিছু চাল,ডাল ও তরকারি নিয়ে এসে করিমের স্ত্রীকে রান্না করে  ছেলে মেয়েদের খাওয়াতে বলে।  রশিদ সাহেব  রাজগঞ্জ গিয়ে অন্যান্য দোকানদারের  সঙ্গে করিমের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করে ,তাকে জুয়াড়িদের হাত থেকে বাঁচাতে অনুরোধ করে।  দোকানদার সমিতির লোকেরা জুয়াড়িদের বিরুদ্ধে কি কি ব্যবস্থা নেয়া যায় এ নিয়ে আলাপ আলোচনা করে।  সমিতি সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা এই মহল্লা থেকে জুয়াড়িদের আড্ডা সরিয়ে দেবে  তবে  এক শর্তে করিম  ওদের সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখবে না।  করিম বলে ,” আমি অতীতে যা করেছি ,আর ভবষ্যতে করবো না। “সে ভয়ে ভয়ে দোকানে আসে  এবং রাতে তার  ছেলে নসু  এসে দোকান বন্ধ হওয়ার পর নিয়ে যায়।    যদি ও দোকান সমিতির লোকেরা বলেছে জুয়াড়িরা তাকে  আর আক্রমণ করবে না।  তথাপি কোনো নিশ্চয়তা নাই।  কারণ সে  জুয়াতে হেরে গিয়ে অনেক টাকা দেনাদার হয়েছে ।  আজকাল ওদের কাউকে দোকানে আসতে দেখা যায় না।কিন্তু মূল সমস্যা তার চারিদিকে সবাই পাওনাদার।  বাড়িওয়ালাকে তিন মাসের ভাড়া দেয়া হয় নি। বাড়িওয়ালা তার পরিবারের অবস্থা অনুধাবন করে সময় দিয়েছে।

নসু  নবম শ্রেণীর ছাত্র ,মেয়েরা ক্লাস সেভেন ও ক্লাস ফাইভের ছাত্রী।  সংসার চালিয়ে তাদের স্কুলের পড়াশুনার খরচ চালানো ওর পক্ষে সম্ভব নয়।  এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নসু মনের দুঃখে একদিন বাড়ি ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছে,তার কোনো খবর পাওয়া যায় না।  স্কুলে তার ক্লাসের ছেলেরা বা টিচার ,এমন কি পাড়ার কেউ তার কোনো খবর জানে না।  তার মা রোজি  শুধু কান্না কাটি করে অস্থির হয়ে পড়েছে এবং  মসজিদে, মাদ্রাসায় ও দরগায় চাদকা দিয়ে তার জন্য দোআ করাইতেছে ।   এমন কি তার ফিরে আসার জন্য হুজুর ও ফকির দিয়ে তদবির করানো হয়েছে।  কেউ কিছু বলতে পারতেছে না।  সবাই সন্দেহ করতেছে যে তার বাবা করিমের সঙ্গে  যে সব জুয়াড়িদের সংঘর্ষ রয়েছে ,এটা তাদেরই কারসাজি।  হয়তো মেরে ফেলেছে অথবা কোথায় ও লুকিয়ে রেখেছে এবং জুয়ার টাকা আদায়ের একটা পন্দি করা হয়েছে।  ওদের কারো কারো সঙ্গে দোকানদারদের জানা শুনা রয়েছে।  ওরা চেষ্টা করতেছে ,কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারতেছে না।  পুরা পরিবার ও বাড়িওয়ালা নসুর  নিখোঁজের সংবাদে দুঃখে ভেঙে পড়েছে । নসু  সকালে স্কুলের নাম করে ঘর থেকে বের হয়েছে ,সে স্কুলে যায়নি এবং ঘর থেকে এক কাপড়ে বের হয়াছে । তা ছাড়া প্রতি দিন সে তার ছোট বোনদের সঙ্গে করে বের হয় ,কিন্তু আজ কাউকে কিছু না বলে সে ঘর থেকে বের হয়েছে । গত রাতে তার বাবা কে দোকান থেকে নিয়ে আসার পর খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে এবং ঘরে কোন ঝগড়া হয়নি ।কাজেই তার ব্যাপারে কিছুই সন্দেহ করা যাচ্ছে না । স্কুলে টিচার প্রতিটি ক্লাসে স্টুডেন্টসদের নসুর ব্যাপারে কোনো খবর জানে কিনা স্কুলে জানাতে বলা হয়েছে । রোজি,ও নসুর বোনেরা কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে পড়েছে । রোজি সঙ্গে সঙ্গে রোজা রাখা শুরু করেছে এবং সারাক্ষন তার নিরাপদ ফিরে  আসার জন্য ফরিয়াদ করতেছে । হুজুরেরা, নখে কালি  দিয়ে তুলা রাশির লোক দিয়ে দেখা এবং দরগাতে তার নিরাপদ চলে আসার জন্য মানত করা হয়েছে।

করিম কি করবে ভেবে ঠিক করতে পারতেছে না। তার মনে সন্দেহ রয়েছে যে তার সঙ্গে জুয়াড়িদের সম্পর্ক রয়েছে এবং তাদের পাওনা টাকা সে দিতে পারতেছে না। হয়তো বা তারা তাকে লুকিয়ে রেখেছে তাই বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের কে বলতেছে যে তারা তার কোনো খোঁজ জানে কিনা।কিন্তু জুয়াড়িদের দুই একজন তাকে পরিষ্কার বলেছে যে তাদের কোনো আক্রোশ তার ছেলের উপর নাই। তারা  কোনো খোঁজ জানে না এবং তার খবর জানলে তাকে বলবে। কিন্তু মানুষের মন, অনেকে করিমকে বলতেছে যে জুয়াড়িরা ব্যাতিত আর কোনো সন্দেহ নাই । এই করে এক মাস চলেছে  ,সকলে তাকে পরামর্শ দিতেছে যে পুলিশ রিপোর্ট করার জন্য কিন্তু করিম একজন জুয়াড়ি এবং সে জুয়াড়িদের  সঙ্গে উঠা বসা করে,যদি পুলিশ রিপোর্ট করে তা হলে তার নিজের ও অনেক অসুবিধা হবে হয়তো পুলিশ তাকে আর্রেস্ট করে নিয়ে যাবে,সে জন্য সে পুলিশ রিপোর্ট করে নি । আস্তে আস্তে করিম ,স্ত্রী রোজি এবং তার মেয়েরা মন থেকে নসুর আশা   ছেড়ে দিয়েছে। করিম কোনো রকমে দোকানীদের  সহযোগিতায় আস্তে আস্তে দোকানে কিছুটা সুবিধা করতেছে। তাছাড়া অন্যান্য দোকানদাররা ও বাড়িওয়ালা তাকে অনেক সাহায্য করাতে  সে মোটামোটি কাজ করে দুই বেলা রুটি ও  ঘর ভাড়া দেয়ার ব্যবস্থা করে নিয়েছে।

মেয়েরা পড়া শুনায়  মনোযোগ দিয়ে স্কুলে ভালো করতেছে। করিম সকাল হলেই দোকান খোলে আর দিনের ১২টা বাজে দোকান বন্ধ করে ঘরে আসে এবং দুপুরের খাবার পর ২/৩ ঘন্টা ঘুমিয়ে বিকেলে পুনঃ দোকান খোলে এবং রাত ৮টার দিকে   দোকান বন্ধ করে ঘরে ফিরে। আস্তে আস্তে সে বাড়িওয়ালার ভাড়া, দোকানের ভাড়া দিয়ে দৈনন্দিন বাসা খরচ বহন করে চালিয়ে যাচ্ছে।  কিন্তু তার মন থেকে নসুর স্মৃতি ভুলতে পারছে না।  সে ভাবে যে কোনো দিন ছেলে ফিরে আসবে আর  মা বাবার দুঃখের অবসান ঘটাবে।  কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ততই লোকজন বলা বলি করছে যে নসু আর ফিরে আসবে না।  এই করে অনেক দিন  পার হলো।  কিন্তু নসুর কোনো খবর নাই।   বড়ো মেয়ে স্কুল শেষ করে কুমিল্লা মহিলা  কলেজে ভর্তি হয়েছে।  রোজি মন থেকে ছেলের স্মৃতি মুছে ফেলতে পারে নাই। তার মনে সদাই ফিরে আসার আলো দেখছে। মাঝে মধ্যে সে রাতে স্বপ্নে  ও দেখে নসু ফিরে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। রোজি আশায়  বুক বেঁধে রেখেছে।    সর্বদা নামাজ পড়ে চোখের পানি ফেলে ছেলের নিরাপদ ফিরে আসার জন্য।
নসু বাবা মায়ের ও বোনদের করুন অবস্থা সহ্য করতে পারে নি।  বাবার চিৎকার ,”তোরা ঘর থেকে বের হয়ে যা।  আমি তোদের খাওয়াতে পারবো না। “ প্রতি রাতে বাবা নেশা করে ঘরে ফিরে, আর অত্যাচার শুরু হয়।  মা ও বোনরা কান্না কাটি শুরু করে ,চারিদিকের লোকজন চিৎকার শুনে এসে বলে ,”অসহ্য,আমরা এখানে রাত ঘুমাতে পারবো না।  ” বাড়িওয়ালা এদেরকে বের করে দেবে ,আর না হয় থানায় গিয়ে করিমের বিরুদ্ধে কেস দেবে ।  বাড়ি ভাড়া,দোকান ভাড়া তা ছাড়া জুয়াড়িরা পাওনা টাকার জন্য যে কোনো সময় হামলা করতে পারে।    ভোরে সে কাঁদতে কাঁদতে স্কুলে না গিয়ে হাটতে হাটতে রেল  স্টেশনের দিকে চলে যায়। সে ভাবতে পারছে না কি করবে।   যেই না ট্রেন স্টেশনে এসে দাঁড়ালো ,সে কিছু চিন্তা না করে ট্রেনে  উঠে পড়লো।  সে নিজে ও জানে না কোথায় যাবে।  ট্রেন চলছে আর সে একটা সিটে বসে পড়লো, চিন্তা করতে লাগলো যে কোথায় যাবে এবং কে তাকে আশ্রয় দেবে?  এক সময়  টিকেট চেকার এসে বলে ,”টিকেট চাই। ” সে কিছুই বলে না,চুপ করে নিচের দিকে চেয়ে থাকে । আবার বলে ,”টিকেট  দেখাও।  “অন্য প্যাসেঞ্জার  বলে  ,” ও ছোট ছেলে কোথা  থেকে টিকেট দেবে ? ” টিকেট চেকার বলে তুমি ,”কোথায় যাবে?” কিছুই বলে না।  শেষে তাকে টিকেট চেকার এক  স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে বলে তুমি পরবর্তী ট্রেনে ফিরে যাবে ।সে দেখে কুমিল্লার মতো এটা ও একটা শহর।  সে হাটতে শুরু করলো এবং কোথায় যাবে কিছুই বুঝতে পারে না।  এদিকে অনেক সময় অতিবাহিত হলো সে কিছুই খায় নি।  তাই সে এক রেস্টুরেন্টের নিকট গিয়ে ঘুরা ঘুরি করতে লাগলো।    রেস্টুরেন্টের মালিক  আব্দুল গনি তাকে দেখে মনে করলো যে এই ছেলে নিশ্চয় অসহায়। তাই তাকে ভিতরে ডেকে খাইতে দিলো।  খাওয়ার পর তাকে জিজ্ঞাসা করলো তুমি কোত্থেকে এসেছো? সে কিছুই বলে না।  তার বই খাতা দেখে মনে করে যে নিশ্চয় এই ছেলে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে।তাকে ছেড়ে না দিয়ে এখানে কাজে লাগিয়ে দিয়ে পরে খোঁজ নিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেবে ।   তাকে জিজ্ঞাসা করে তুমি কাজ করবে ? সে মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়।  সে নিজের পরিচয় না  দিয়ে রেস্টুরেন্টের মালিকের নিকট কাজ ও থাকার অনুরোধ করে। গনি  তার অন্যান্য কাজের ছেলেদের সঙ্গে কাজে লাগিয়ে দিয়ে কাজ শিখতে বলে ।  নসু ছেলেদের সঙ্গে বলেছে যে তার কাজের দরকার ,তাই তারা রেস্টুরেন্ট থালা বাসন এবং টেবিল পরিষ্কারের কাজে লাগিয়ে দিলে সে ভালো ভাবে কাজ করে।  কয়েকদিন কাজ করার পর গনি  তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে জিজ্ঞাসা করে,”তুমিতো তোমার পরিচয় গোপন করেছো । বাড়ি ফিরে যাবে না? ” সে মাথা নেড়ে বলে যাবে না।   গনি  বলে,”আমি তোমাকে ঢাকায় অন্য একটি রেস্টুরেন্টে পাঠিয়ে দেব,  সে মাথা নেড়ে বলে ,রাজি। তাই তাকে ঢাকা মালিকের অন্য রেস্টুরেন্টে পাঠিয়ে দেয়। সে কাজে খুবই মনোযোগী এবং সহজ সরল । রাতে কাজ শেষ করে নসু রেস্টুরেন্টে ঘুমায় অন্যান্য কাজের ছেলেদের সঙ্গে। যেটুকু সময় পায়  সে তার বই নিয়ে বসে পড়াশুনা করে।  রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার আজিম তাকে পড়াশুনায় মনোযোগী দেখে জিজ্ঞেস করে ,তুমি পড়াশুনা  না করে রেস্টুরেন্টের কাজে কেন আসলে ? সে বলে টাকা পয়সার অভাব এবং বাবা আমাদের তিন ভাই বোনকে খাওয়া ও পড়াশুনা করানোর  মতো অবস্থা নাই।

গনির  বাবা আব্দুল লতিফ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার ,মাঝে মধ্যে রেস্টুরেন্টে এসে খোঁজ খবর নেয়।  হোটেল ম্যানেজার আজিম , নসু সম্পর্কে বিস্তারিত সব কিছু লতিফ সাহেবকে বলে,” মা বাবা তাকে পড়াশুনা করাতে পারে না বলে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। ”  লতিফ সাহেব তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে , ” তুমি কেন পড়া শুনা না করে এখানে এসেছো? ” সে বলে ,আমরা ভাই বোন তিন জন বাবার সামান্য রোজগারে আমাদের পড়াশুনা করানো সম্ভব হয় না।  সে জন্য এখানে চলে এসেছি। ” তুমি রেস্টুরেন্টের কাজ করে কি ভাবে পড়া শুনা করবে ? নসু পেল পেল করে লতিফ সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।  লতিফ সাহেব বলে , “দেখি কি করতে পারি ?”  লতিফ সাহেব নসুর হাতের লেখা এবং পড়াশুনার আগ্রহ দেখে নসুকে একদিন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে তার বাসায় নিয়ে যায়।  নসুকে বলে তুমি স্কুল থেকে এসে সামান্য বাসার কাজে সাহায্য করবে এবং রাতে আমার নিকট পড়াশুনা করবে।  নসু শুনে আনন্দে কেঁদে ফেলে এবং বলে দাদা আমি পড়া শুনা মনোযোগ দিয়ে করবো । লতিফ সাহেব তার বউমা রিনাকে   বলেছে নসুকে দিয়ে সকালে বাজার করাবে  এবং সে স্কুলে যাবে।  লতিফ সাহেব  দু একদিন বাজারে গিয়ে নসুকে বাজারের কেনা কাটা শিখিয়েছে।  তার পর থেকে সে একাই  বাজারে গিয়ে সব কিছু নিয়ে আসে।   লতিফ সাহেব তাকে নিয়মিত স্কুলের হোমওয়ার্ক  দেখে দেয়এবং অনেক সময় তাকে দিয়ে এক্সট্রা কাজ করায় যাতে সে স্কুলে ভালো করতে পারে।

লতিফ সাহেব  তার বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইলে ,সে  ঠিকানা  না দিয়ে বলে ,”আমার কেউ নাই। ”    তুমিতো বলো , “আমার কেউ নাই। ” আবার ভাইগা যাবে না তো ? নসু বলে দাদা ‘আমি কখনই যাবো না ,” তাকে বাজারে পাঠালে সে বাজার করে ও টাকা পয়সা অবশিষ্ট যা থাকে ফিরিয়ে দিয়ে দেয়। বাসার সবাই তার উপর খুব সন্তুষ্ট।  গনি ও রিনা  তার উপর বাসা রেখে দিয়ে এখানে সেখানে বেড়াতে গেলে সে বাসা দেখে শুনে রাখে নিজের মনে করে।  কিন্তু তার মনের দুঃখ সে পড়াশুনা করতে পারলো না।  লতিফ সাহেব তার দায়িত্ব নেয়াতে সে খুবই খুশি।  নসু লতিফ সাহেবের দেখা শুনা ,কাপড় ধোয়া,বিছানার বেড সীট পাল্টিয়ে দেয়া,সকালের নাস্তা, গোসলে সাহায্য করা ,ঘর ঝাড়া মুছা করা ,ডাইনিং টেবিল ,ড্রয়িং রুম ,কার্পেট পরিষ্কার করা ,বাগানের গাছ কেটে ছোট করা ,যাবতীয় কাজ করে তার পড়া শুনা করে স্কুলে যায়।  এই করে তার দুই বৎসর শেষ করে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে ভালো রেজাল্ট করে।  বাসার সবাই তার পরীক্ষার রেজাল্টে খুশি হয়ে নসুকে কলেজে  ভর্তি করিয়ে  দেয়।   বাড়ির সবাইকে বলে,” তোমরাই আমার বাবা মা ,তোমরা ব্যাতিত আমার আর কেউ নাই। ”  মাঝে মধ্যে দরকার হলে তাকে রেস্টুরেন্টে পাঠিয়ে দিয়ে কাজ করায় । গনি ও রিনা এবং ছেলে মেয়েরা কক্স বাজার ,সিলেট ও এখানে সেখানে গেলে তার জন্য এটা সেটা নিয়ে আসে।     মূলতঃ সে এখন বাসার সব কিছু কতৃত্ব নিয়ে দেখা শুনা করে।
নসু ভাবে আমার ভাগ্য  আমাকে এ সুযোগ দিয়েছে ,আমি ভাবতে ও পারিনা এত ভালো মানুষ দুনিয়াতে আছে যারা পরের উপকার করে।  রিনা  তার গ্রামের  এক মেয়ে গোলজারকে এনে কাজ শিখিয়ে বাসার রান্নার কাজে লাগিয়েছে. এখন দুজনে মিলে মিশে বাসার কাজে সাহায্য করে।  গোলজার ও অনেক দিন এ বাসায়  কাজ কর্ম করে।  রিনা মনে করে তাদের দুই জন্যে অনেক সুন্দর করে তাদের পরিবারের কাজ কর্ম করে।  তাদের আর বেশি কিছু চিন্তা করতে হয় না।  ছয় বৎসর বয়সে গোলজারের বাবা মারা যায়। তার মা ও  আরো দুই ভাই রয়েছে যারা দিন আনে দিন খায় অবস্থার মধ্যে রয়েছে।  গোলজারের  বয়স যখন দশ বৎসর তখন তার মা তাকে এ বাসায় কাজ করার জন্য রেখে যায়।  সে থেকে সে এ বাসায় আছে এবং তাদের ঘরের কাজে সাহায্য করে।

লতিফ সাহেব অবসর প্রাপ্ত পুলিশ অফিসার ,যিনি এই বৃদ্ধ বয়সে ছেলের সংসারে থাকেন ।  এরা দুইজন কাজ শেষ করে দাদার ঘরে বসে  এবং দাদার কাছ থেকে গল্প শুনে।  দাদা বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে বদলি হয়েছে এবং তার নিকট থেকে অনেক ধরণের অভিজ্ঞতার কথা শুনে থাকে।  লতিফ সাহেবের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে ওরা সবাই বিবাহিত ও নিজের সংসার নিয়ে ব্যাস্ত। স্ত্রী সালেহা  চার বৎসর হয় বৃদ্ধ জনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেছে।  লতিফ সাহেব গত দুই বৎসর হলো হজ করেছে এবং মসজিদ আর বাসার জায়নামাজ নিয়ে ব্যাস্ত  থাকেন।  নসু  মাঝে মাঝে মা বাবার কথা চিন্তা করে এবং ভাবে একবার গিয়ে ওদের অবস্থা দেখে আসবে।  কিন্তু সে তিন/চার বৎসর হয় তাদের ছেড়ে এসেছে আর একবার ও দেখা করতে যায় নাই।  এদিকে রিনা  গত দুই বৎসর নসুকে  ৫০ টাকা করে মাসিক বেতন দিয়ে একটা ব্যাঙ্ক একাউন্ট ওর নামে  খুলে দিয়েছে ।  সে প্রতি মাসে বেতনের টাকা এই একাউন্টে জমা করে।

নসু  বাসার সবাইকে সত্য কথা বলেছে যে তার মা বাবা আছে ও অত্যন্ত গরিব এবং একবার ওদের খোঁজে যাবে। কিন্তু সে কাজ ও পড়াশুনা নিয়ে অনেক ব্যাস্ত থাকে। দাদা লতিফ সাহেব নসুকে বলেছে যদি কলেজ ফাইনালে ভালো রেজাল্ট করে তাকে ইউনিভার্সিটি ভর্তি করিয়ে দেবে।  লতিফ সাহেব মনে মনে খুব খুশি যে শেষ বয়েসে একটা ছেলেকে লেখা পড়া শিখিয়ে মানুষ করবে ।  দেখতে দেখতে তার চার বৎসর অতিক্রম করেছে এবং নসু  সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে উনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে  মা বাবার খোঁজে যাবে। কলেজে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে সে বাসায় ও রেস্টুরেন্টে কাজ করে সময় অতিবাহিত করে।  দেখতে দেখতে পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলে সে দ্বিতীয় বিভাগে পাস্ করে এবং দাদা লতিফ সাহেব তাকে জগন্নাথ উনিভার্সিটিতে  অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি করিয়ে দেয়।
সে বাসার সবাইকে বলেছে তার মা বাবার খোঁজে যাবে। সবাই খুশি যে সে অনেক ধর্য ধরে এই  দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছে এবং এখন দেশে তার মা বাবার খোঁজে একবার যাওয়া দরকার।    তাই সে ব্যাঙ্ক থেকে  কিছু টাকা উঠিয়েছে ।  রিনা  ও দাদা লতিফ ২০০ টাকা দিলে সে মনের আনন্দে কমলা পুর স্টেশনে গিয়ে টিকেট কেটে ট্রেনে উঠে কুমিল্লা রেল স্টেশনে গিয়ে  একটা রিক্সা নিয়ে তাদের পুরানো বাসার ঠিকানায় গিয়ে উপস্থিত হয়।   বাসায় গেলে এলাকার  সব লোকেরা এসে জড়ো হয়।  সবাই তাকে দেখে অবাক।  মা ও তার বোনেরা তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে। সে নিজে ও মাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে কাঁদতে থাকে  এবং বলে আমি আজ অনেক খুশি তোমাদেরকে পেয়ে । সে কিছু   সময় বাসায় বসে বাবাকে দেখতে রাজগঞ্জ যায় এবং বাবা তাকে দেখে কেঁদে ফেলে এবং বলে তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?  বাবা বলে তোমার মা পাগলের মতো হয়ে গিয়েছে ,তোমাকে না পেয়ে এবং রোজ রোজ কান্না কাটি করে ও বলে যে আমার ছেলে কে আমি যেদিন দেখবো সেদিন আমি নিশ্চিন্তে ঘুমাইবো।  বাবা আনন্দে দোকান বন্ধ করে নসুকে  নিয়ে বাসায় চলে আসে ।  রশিদ  ও তার স্ত্রী বলে আমরা ওদের এতদিন তোমার জন্য এখানে থাকতে দিয়েছি।রশিদ সাহেব জিজ্ঞাসা করে ,”নসু,তুমি কোথায় ছিলে এবং কি করো ? নসু বলে ” আল্লাহ আমাকে এক ভালো মানুষ মিলিয়েছে যারা আমাকে সাহায্য করে এবং আমি স্কুল শেষ করে ,কলেজে দুই বৎসর পড়া শুনা করে জগন্নাথ উনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি।  ওরা অনেক ভালো মানুষ এবং আমার পড়া শুনার সুযোগ করে দিয়েছে।  শুনে সবাই খুশি এবং বলে তুমি পড়া শুনা শেষ করে সবাইকে দেখবে।  নসু বলে ,অবশ্যই।    রশিদ সাহেব বলে,” আমরা তোমার মা বাবাকে এখান থেকে সরাই নি যে জন্য তুমি তাদের খুঁজে পাইতে সুবিধা হয়েছে। ” নসু হাসতে হাসতে বলে ,”আপনারা ও অনেক ভালো মানুষ। ”      বাবা মা ও বোনেরা বলে তুমি এত দেরি কেন করলে আমরা তো এর মধ্যে তোমার জন্য কাঁদতে কাঁদতে  মরে ও যেতে পারতাম।    আমরা যদি এখানে না থাকতাম,তা হলে তুমি আমাদের খুঁজে পেতে না।  সে সংসারের অবস্থা জেনে খুবই খুশি হয়েছে এবং বলে আমি নিজে ও তোমাদের কিছুটা সাহায্য করব।  দুই বোনকে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে বলে এবং বলে তোমরা পড়াশুনা বন্ধ করবে না।  সে এক সপ্তাহ কুমিল্লা থাকার পর পুনরায় ঢাকা চলে আসে এবং তার দাদা ও সবাইকে তার মা বাবার খোঁজ দেয় যে সবাই ভালো আছে।
ক্রমশ :

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন