দীর্ঘকবিতা
জাদুঘর থেকে বলছি
অনিরুদ্ধ আলম

পর্ব ১২।।     

ইনকাদের পাঁশুটে দিনের কাব্য পাঠ্যপুস্তক হিসেবে মনোনীত হলে, প্রত্নতত্ত্বের বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেল বোমারু বিমানের পাইলট। রোদসী তন্বীর চিবুকে লেগে-থাকা শেষবিকেলের একটুকরো রোদকে কেড়ে নেবে কি সন্ধ্যার অসংযমী সংশয়? বর্ষপঞ্জীর আঠাল জালকে ফাঁকি দিয়ে দুদ্দাড় বেড়ে চলে বিলম্বিত রোদের স্নায়ুবিক বয়স।  

রাজমহলি সারস আর জোছনার মেলামেশা থেকে যে-ছায়ার ফলন হয়, তাকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল ধুলোদের ভাঙা খুলি, খুলির ভেতর লুকানো গ্রীষ্মের বিক্ষিপ্ত আসা-যাওয়া। 

কেউ-কেউ মাছরাঙার ফেলে-যাওয়া লুকোচুরিতে ডুব দিয়ে খুঁজে নেয় ছাতিম গাছের সাশ্রয়ে অঙ্কুরিত সবুজ পৃথিবী। যেভাবে দ্ব্যর্থহীন জলপ্রপাতের বাকলে লেখা হয়ে গিয়েছিল একটি ডাকনাম নায়াগ্রা। 

গোপী বাড়ির স্বনামধন্য পাতকুয়োটার অজানা নয়– কেমন করে ঝরাপাতার পাতলুন ছুঁয়ে হলুদ ঘাসের ডগা ধীমান আশায় বুক বাঁধে। অজপাড়াগাঁয়ের শহরমুখী সড়কটা কী-এক গভীর টানে মুখ ঘুরিয়ে আলটপকা ছুটে গিয়েছিল রামসাগরের দিকে! মিতভাষী রেস্তোরাঁয় বসে তালপাখার ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে দৃষ্টিভঙ্গী-বিশেষজ্ঞ চারুনেত্রা প্রথম বুঝল– বটফলের যৌনতার সঙ্গে গাধাদের গলা সাধার তুলনা অর্থহীন। 

আর মৌনতা? সে তো তালাত মাহমুদের বিস্ময়কর সুরতরঙ্গে বোনা নাগরিক বিনয়!   

একটানা নৌকাময় জীবনে কখনো আঁকি নি অর্থপূর্ণ উড়োজাহাজের ছবি। ডিঙি যথারীতি উড়ুক্কু মাছের আদর্শিক গুরু হলেও হতে পারে। ইয়ার-দোস্তির দাবি নিয়ে মাঝির ছায়া সুবাহ বাংলার শুশুকদের শিখিয়েছিল– কীভাবে হেমন্তে মেঘজলসার নেমন্তন্ন পেতে হয়। কেন যে তারা উচ্চাভিলাষী হতে শেখে নি! 

এঁদোপচা গলিটি দেখে নি পিচ-ঢালা সৈকত। খুব শখ ছিল একদিন এক-প্রাচীন রাজপথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আশীর্বাদ চেয়ে নেবে। যখন কোনো বৈষ্ণবী ‘আমার সাধের লাউ বানাইলরে বৈরাগী’ গাইতে-গাইতে এ পথ দিয়ে যায়, তখন মেরুদণ্ড-নড়বড়ে সাঁকোর দু’ পাড়ে বিবাগী নুড়ি-পাথরগুলো চড়ুই পাখি হওয়ার বাচিক কসরতে ব্যস্ত।  

সুবিন্যস্ত টিলাগুলো পেরুতেই, ঘাসের খুপরির ভঙ্গীমাতে বড়লেখার ভূমিপুত্র একটা নিতান্ত মেঘ মাথার ওপর নেমে এল। ঘোড়ার খুরধবনি জানে কীভাবে পেতে হয় হুজুগপ্রবণ বাতাসের সমাদর। পশুপালনের সমসাময়িক অভিজ্ঞতা পুঁজি করে কেরানির চাকুরি খোঁজে কে ওই স্বপ্নাহত যুবক? বাঁশপাতাতে চাটাই বোনা যায়। এমন উপনিবেশিক খুসসুটি জনপদে ছড়িয়ে পড়লে বেতচাষীদের কপালে দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। আমিনরা মনযোগী হয়ে ওঠে মহিষ-চরানো মাঠে বতুয়াশাকদের আবাসিক পরিসীমা জরিপে।    

অরুণিমা পাথরের পরগাছা-প্রেতাত্মা কার্তিক দ্বীপে ডানাওলা সাপের সলাজ দেবতাদের কেমন স্বজন? জাঁতি-আতঙ্কে মজা সুপুরিরা যখন থরহরি-কম্প, তখন হঠাতি খবর এল এবার ব্যাপারির পানের বরজে মড়ক লেগেছে। খবরটা বিদ্যুৎবেগে ছড়িয়ে পড়তেই, কাজলা নদীর মহালে সুপুরিবনের পাতায়-পাতায় ভর করল শাদা বকের উড়াল। 

কালাকাল না-ভেবে, হাতির পিঠে সওয়ার হয়ে কোন সে দেবদূত মাঠেঘাটে দেখে রাখে লাল হাঁসদের সাঁওতালি বিচরণ? তামাকের পতিত ক্ষেতে দিকভ্রান্ত মৌসুমি বায়ুর সুবাদে কে বুনেছিল ফনিমনসার কাড়ি-কাড়ি অবগাহন? ওর কুটিরে কি খড়ের ক্লান্ত ছাদ ফুঁড়ে আরব্য রজনীর অনতিক্রম্য জোছনা চুয়ে পড়ে? এঁটেল মাটিতে গড়া দার্শনিক বন্দুকে শুধু নীলগাইদের অমর শত্রুদেরকেই শিকার করা যায়। 

পাড়াগাঁয়, খরগোশের জুলজুলে কালো চোখের স্নিগ্ধতাতে ভর করে সন্ধ্যা নামত। এখনো বেশ মনে করতে পারি। ঢেঁকিছাঁটা চালের মতো স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে একখানা বাঁকা চাঁদ সন্ধ্যার আকাশে কোনোরকমে ঝুলে আছে। ভাবখানা এমন, এই বুঝি টুপ করে ঝরে পড়বে বিলের আশ্চর্যবোধক লাতিন জলে। 

বিলের ওপাড়ে শেষ কবে গিয়েছিলাম?– এমন কিছু নিয়ে ভাবতে আমার খুব ভালো লাগত। ওপাড়েই বসে প্রতি বছর বৈশাখী মেলা। শেষবার যখন মেলায় যাই কিনেছিলাম একটা মাটির ঘোড়া। মাটির ঘোড়াটা বুকে জড়িয়ে কত রাত যে ঘুমিয়েছি! চোখ বুঝলেই শুনতে পেতাম দূর থেকে ভেসে আসছে হ্রেষাধ্বনি। অনস্তিত্বের হ্রেষা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে। বাড়ির উঠোনে এসে মীমাংসিত ঘোড়া থামতেই, ওতে চেপে বসতাম। এ তো যেনতেন ঘোড়া নয়। পঙ্খিরাজ ঘোড়া। উড়ছি তো উড়ছি। কোথায় চলেছি পঙ্খিরাজে চড়ে? এ ছোটার কি শেষ নেই? গন্তব্য যে মেলে না!  

কোনোকোনো আকাঙ্ক্ষার বুঝি গন্তব্য থাকতে নেই! আর ফেরা হয় না দীপান্বিত নদীটার তীরে। ভুলে যাই ওই নদীতীরে নৌকায় বসে একদিন একটি যুক্তিসঙ্গত সারস হতে চেয়েছিলাম। 

সারস দেখলেই ভাবতাম– জীবনটা বড়ো সুন্দর। মোরগ ফুলের চেয়েও অধীর-ঝলমলে ব্যস্ততায় দুরন্ত এ জীবন। 

অনুক্ষণ আঁধার-ঘনিষ্ঠ ছলনার ধোপদুরস্ত ছাই নিয়ে ছিপ নৌকার ঘরকন্না চলে না জোছনার তেপান্তরে। মহিষের রক্তাক্ত ক্ষুরধ্বনি ছেয়ে এখনো কি ঠিকরে পড়ে নীলকুঠি ছেড়ে-আসা পোড়া মাংসের ম্রিয়মাণ স্বাদ? সৌভাগ্যক্রমে কাচপোকার খেলাঘর কি তিল ধারনের জন্যে নিবিষ্ট শিশিরের মৌলিক কৌটা? ওখানে পাশা খেলে হলুদ ঘাঘরা-পরা নক্ষত্রচূর্ণের দলছুট আলো। পৃথিবীর মেধাবী ভালবাসারা ওদের সন্তান।

পাষাণ সমুদ্রে আভিযানের উদগ্র বাসনা অন্তরে জিইয়ে রেখে একদিন গৃহবাসী শামুকের বিহ্বলতায় কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম। গোলাপি রঙের কুকুর আর কালো কবুতরের মুখাপেক্ষী হয়েও অপরিচিত হেমন্ত মুচড়ে দিতে পারে নকল সুখের সকল ফলাফল। মোহিনী হেরার উৎসাহে সংসারী হয় ত্রিনয়না বেলপাতার সংশয়। কখনো পিতলের ঘড়াতে অঙ্কুরোদগম হতে-হতে পুচ্ছ নাচিয়ে উড়ে চলে পিপাসার অশুভ সত্তা মুহুর্মুহু। 

বাগদত্তা নদীও যখন নিরুদ্দেশে হারায় সুপুরুষ সাগরের বংশপরিচয় জানতে, তখন অভিসারের প্রতিটি পদচিহ্ন রাধার যাপিত তীর্থযাত্রা। 

সুমাত্রার প্রচ্ছন্ন মশলাঘ্রাণে শায়িত কিছু হাওয়া তোমার আঁচলে চিত্রল হল। তুমি বলেছিলে,  ‘তোমার টবের বর্ষাতীত ফুলগুলো শমপাপড়ি জাতীয় মেঘদের অবহেলার ফসল নাও হতে পারে।’

সংক্রান্তি-মেলার উদারতাকে পুঁজি করে সাক্ষীবিহীন ড্রাগনফুলেরা বিশ্রাম নিতে জানে না। লাবণ্য-খোঁচিত জন্মদাগ ওদের মুকুটহীন অহংকার। কে ক্ষেতে-খামারে ছড়িয়ে দিল বৃষ্টির বীজ। একদিন অঙ্কুরতি হবে সবুজের নিরঙ্কুশ সংক্রমণ প্লাবন-ধারাতে। 

শ্রাবণস্নেহে আলু ভর্তার অধৈর্য পেলবতা মরিচের কুচিকুচি ঝালে অমসৃণ হয়ে ওঠে। শিশির বিন্দুর ঔজ্জ্বল্য নিয়ে সকাল আসে। উচ্চমাধ্যমিক মাঠটাই ধীরে-ধীরে টিলা হয়ে উঠেছে। 

মোটেও তাত্ত্বিক নয়! কিঞ্চিত খোঁড়া শালিকদের মিনতি পৌঁছাবে কোনো একদিন মাঠে একলা পড়ে-থাকা প্রজ্ঞাবান তীরের কাছে, ‘বিদগ্ধ ধনুকের সন্ধান পেলে বিদ্ধ করো ফাঁদ-বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কোনো শিকারীর সুচতুর মাধ্যমাকে।’ 

আমাকে কথা দিয়ে তোমার কথা না-রাখার একটি সোনালি শোক হোক-না অবিরল। ময়ূরী, আবারো বললে, ‘আরেকটু নতজানু হও। দেখবে– তোমার হারানো আংটিটা ঠিকই খুঁজে পাবে।‘ 

আমি ভুল করে জামরুল ফুল হয়ে ফুটে রইলাম। (চলবে…)

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন