রাস্তাগুলোর বুকের উপরে এমন খোঁড়াখুঁড়ি আবহমানকাল থেকেই সেই নৈমিত্তিক ব্যাপার! ‘জীবন ঢেউএর নিচে হাবুডুবু খাওয়া নিত্য পরাজিত মানুষগুলোর অদম্য স্পৃহার স্রোত বয়ে যায় নগরীর প্রান্ত থেকে প্রান্তেঅদ্ভুত এক প্রাণ শক্তিতে তারপরও তারা হেসে উঠে কখনো অট্টহাসিতে

জয়

প্রকাশ্য দিবালোকে আকাশমুখী অট্টালিকাগুলোর সীমান্ত থেকে সীমান্তে কথা চালাচালি হয় উঁচু নিচু তফাতেরউন্নতির (?) সোপান গান গায় ব্যাস্ত সরণীর মোড়ে মোড়ে! কোথাও জানালায় গুটানো পর্দার ঋজু পথ গলে চোখে পড়ে মোমের আলোর নিচে সাজানো কেক হয়তো জন্মদিন কারোর। কিংবা বিবাহবার্ষিকী সেই চিরাচরিত বেশ। সবকিছুতেই তো সেই পুরনো পরিচিত গন্ধ তবু কেন যেন বহুদিনের জানা এই নগরীটাকে ইদানীং খুব অপরিচিত মনে হয় নরাধমের

ভালোবেসে রক্ষা করতে গিয়ে খুব, মানুষ কখনো হারিয়ে ফেলে তার সব কূল‘! 

ইদানীং এই বোধটা প্রায় সারাক্ষণই তার মস্তিষ্কে বাসা গেড়ে থাকে সাথে জনজীবনের প্রতি ক্রমবর্ধমান বীতশ্রদ্ধা! অবসর সময়ের প্রায় সবটাই তাই এখন বনেবাদাড়ে কাটিয়ে দেয় সে হাঁটতে হাঁটতে ছোট কোনো বুনো ফুল গাছের একদিকে বেশ কয়েকটি ফুল এবং দূরের একটি শাখায় একাকী একটি মাত্র ফুল দেখলে দাঁড়িয়ে থেকে তার নিঃসঙ্গতাকে অনুভব করে অনেক অনেকক্ষণ ধরে!

একটা তরীকে মাঝ সাগরে ডুবিয়ে দিতে একটা ঢেউ কখনো যথেষ্ট, আবার একটি মাত্র বৈঠায় ভর করেই কখনো কোনো নৌকা পাড়ি দেয় অকূল সমুদ্র কোনো অলীক মিথ নয় সহজ বোধ ঘটে যাচ্ছে অহরহ এই ধরাধামে তবুও আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে রক্তাক্ত করে যাই পরস্পরকে কখনো হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই নিজেই এর যতোটা না দৃশ্যমান, অদৃশ্য রয়ে যায় তারও শতগুণ বেশি অন্তর্গত ক্ষতে! খুব যে বস্তু কেন্দ্রিক মানুষ  নরাধম তাও নয় তবুও নিদেজাগরণে সম্প্রতি এইসব বিষয়গুলোই মস্তিষ্কের বিবরে খুব বুদবুদ তোলে তার

ডানের উঁচু নিচু ফাঁকা প্রান্তরের দিকে তাকালে মনে হয় কোনো আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে এখনো ধোঁয়া উড়ছে সেখানে হয়তো সদ্য নিভে যাওয়া লাভার উত্তাপ এখনো বয়ে নিয়ে যাচ্ছে বহেমিয়ান বাতাস। দক্ষিণপশ্চিমের এদিকটায় ঘন সবুজ বন তারই মাঝ দিয়ে পায়ে হাঁটার পথ কুয়াশা আর আবছায়া আঁধারের চাদর মুড়ি দিয়ে চলে গেছে এদিকসেদিকে এমন জায়গা জীবনে কখনো দেখেছে বলে মনে করতে পারে না নরাধম ইতিউতি দুএকজন যে মানুষ দেখা যাচ্ছে তাদের বেশভূষাও কেমন অপরিচিত হয়তো সেকেলে বহু হাজার বছর পেছনের  হতবিহ্বল দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তার চোখে পড়ে ফুলপরীর মতো একটি ছোট্ট মেয়ে দুলে দুলে হেঁটে যাচ্ছে একাকী! তার হাঁটার ভঙ্গিটা যেন ভীষণ পরিচিত, ভীষণ মায়াকাড়া! তার কাছাকাছি হওয়ার জন্যে প্রাণটা আনচান করে উঠলো তার  দ্রুত চলতে শুরু করে সে পথ ধরে কিন্তু কী যে হলো তার ডান পাটা যেন এগোতেই পারছে নাকেমন ভারী ভারী লাগছে সে প্রাণপণে চেষ্টা করছে কোনোরকমে তাকে টেনে হিঁচড়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে কিন্তু মেয়েটির সাথে তার দূরত্ব কিছুতেই কমছে না! মায়াভরা শিশুটা অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগলো বাঁকের মুখে! অথচ কিছুতেই সে তার গতি বাড়াতে পাড়ছে না! তার নিঃশ্বাস দ্রুত হতে লাগলো সে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে! ঘুমটা তার ভেঙে গেলো তখনি! সাইড টেবিলের ঘড়ির কাঁটায় তখন ভোর তিনটা বেজে বিশ মিনিট প্রস্রাবের চাপ অনুভূত হচ্ছে বেশ এই সময়ে প্রায় প্রতি রাতেই সে জেগে উঠে এই কারণে 

বাথরুম থেকে ঘুরে এসে আরও কিছুক্ষণ সে এপাশওপাশ করলো বিছানায় কিন্তু ঘুম আর আসে না বিষয়টা এখন যেন নৈমিত্তিক রুটিনের মতোই হয়ে গেছে তার ছুটির সকাল গোটা সপ্তাহ এই দিনটার জন্যেই সবাই অপেক্ষায় থাকে একটু বেলা করে বিছানা ছাড়বে বলে  তাই যতোটা কম শব্দে পারা যায় সেভাবেই সে কিচেনে গিয়ে নিজের জন্যে চা বানিয়ে নিলো খানিকটা

নিয়নের মৃদু আলো অর্ধেক চাঁদ দক্ষিণ আকাশে হেলে আছে পরিস্কার নভোমণ্ডলে বেশকিছু নক্ষত্রও জেগে আছে এখনো এইসব বাদ দিলে প্রায়ান্ধকার পাড়া ঘুমিয়ে আছে সারা সপ্তাহের ক্লান্তি গায়ে মেখে হুসহাস দুএকটা গাড়ি ছুটে যাচ্ছে হয়তো কোনো লেট কল শেষ করে ইদানীংকার জীবন জিজ্ঞাসা, কিছু বড় ভুল, আত্মশুদ্ধির যুদ্ধ এবং সদ্য দেখা স্বপ্ন, সবকিছু মনের অরণ্যে কেমন ওলটপালট করে আসতে লাগলো নরাধমের। এই নিয়ে ভাবতে ভাবতেই সে এগিয়ে চললো  ঊষার দিক চিহ্নকে সামনে রেখে

ছোটো দু’টা রাস্তার সংযোগস্থলের কোণাটায় মাঝারি আকৃতির এই ম্যাগনোলিয়া গাছটা নরাধমের অতিপরিচিত অতিপ্রিয় এবছরের মতো এতো ফুল বিগত বছরগুলোতে কখনো ফোটেনি ঝরা ফুলের চাদরে ঢেকে আছে গাছের নিচটা ফুটপাত পার হয়ে রাস্তার উপরেও বেশ কিছু ফুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে এখনো তরতাজা হঠাৎ কী হলো কে জানে? সে ভাবলো আহা একটু পরেই গাড়ির চাকা এই ফুলগুলোকে পিষ্ট করে ফেলবে তার চেয়ে বরং এগুলোকে কুড়িয়ে গাছের নিচে অন্য ফুলদের সাথে রেখে দিলে আরও কিছুটা সময় সতেজ থাকবে ওরা চায়ের মগটা হাঁটা পথের পাশে রেখে দুইহাতে ফুল কুড়াতে নেমে পড়লো সে উত্তরদিকে থেকে ধেয়ে আসা গাড়িটার ড্রাইভারের চোখজোড়া হয়তো তখন ঘুমের আবেশে ক্লান্ত রাস্তার বিধিবদ্ধ গতির চেয়ে একটু দ্রুতই যাচ্ছিলো সে হয়তো শেষ রাতের তাড়া কিংবা মদ্যপ মাতাল সে! হয়তোবা অন্যকিছু হয়তোবা তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কোথাও এই সংকেত  ছিলো না যে রাতের এই সময়ে এখানে এমন একজন লোক—!

দেখতে পায়নি সে নরাধমকে! ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে আরেকটু যেন জেগে উঠলো লোকটা! খানিকটা হতবিহ্বল! নিমেষ থেমে চারপাশটা আরেকবার দেখে নিলো নাহ্ আর কোনো চোখ নেই! গ্যাস প্যাডেল জোরে চাপ দিয়ে দ্রুত পালিয়ে গেল সে! প্রায় বিশ ফুট দূরে ছিটকে গিয়ে নরাধমের দেহের বেশিটাই তখন ফুটপাত জুড়ে পায়ের দিকের কিছুটা অংশ শুধু রাস্তায় হাতের সামনে তখনো পড়ে আছে কয়েকটি ম্যাগনোলিয়া ফুল খুব বেশি ভাষাহীন ওরা, খুব বেশি বিমূঢ়! বহুদিনের ব্যবহৃত চায়ের মগটা বুক চাপড়াচ্ছে কান্নায়! তার খোলা মুখের ছোট্ট জানালা দিয়ে তখনো উড়ছে এক ধূমায়িত জীবনের দীর্ঘশ্বাস! কোনো এক নরাধমের দীর্ঘশ্বাস!

নিশ্চিত, একটু পরেই পুলিশি তদন্তের খাতায় লেখা হবে হিট এন্ড রান (Hit and Run)! হয়তো তারা ড্রাইভারকে সনাক্ত করতে পারবে কী পারবে নাকোনো সহৃদয় ব্যাক্তি হয়তো পরে কখনো অকুস্থলে রেখে যাবে একটি গোলাপকিন্তু কী লেখা ছিলো নরাধমের জীবনের শেষ দিনগুলোর ভাবনার স্রোতে, কেমন ছিলো তার শেষ নিঃশ্বাসের রং, জানবে না কেউ কোনোদিন

কোনোদিনই আর!!

(‘নক্ষত্রহীন রাতের আকাশএর একটি উপস্থাপন / A presentation by ’Starless Night Sky’ )

_____© ফরিদ / অক্টোবর ২৪, ২০২২

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন