বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস এর ব্যাপক বিস্তারে মানুষ আজ দিশেহারাবিশ্বের ১৮৪ টিরও বেশি দেশ এখন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। সারা দুনিয়ার মানুষ আতঙ্ক গ্রস্ত !! তাই চারিদিকে এখন করোনা ভাইরাস বা কভিড -১৯ নিয়েই সকল প্রচার মাধ্যমে  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে নানাবিধ বিচারবিশ্লেষণ। সম্প্রতি, ইতালিতে করোনা ভাইরাস তথা  কভিড -১৯ এর ব্যাপক বিস্তারের বিষয়ে চলছে বিভিন্ন ধরণের  আলাপ- আলোচলা।এ ভাইরাসে আক্রান্ত দেশগুলির মধ্যে ইতালিতে মৃত্যুর সংখ্যা সর্বাধিক। উল্লেখ্য ,আজ পর্যন্ত ইতালিতে মৃতের সংখ্যা ১৭ হাজারেরও অধিক। 

ইতালি ইউরোপের উন্নত দেশগুলির একটি। সেদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাও খারাপ নয়। তারপরও করোনার ব্যাপক বিস্তারে দেশটি এখন পর্যুদস্ত। অনেকে বলেন সময় মত পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে সেখানে করোনার বিস্তার। কিছুদিন আগে ইতালির প্রধানমন্ত্রীর একটি ছবিসহ বক্তব্য দেখেছি। তিনি হতাশা ব্যাক্ত করে বলেছেন ,”আমাদের যা করণীয় তার সবই করেছি ,বাকি সমাধান আকাশেআকাশে বলতে তিনি মহান সৃষ্টি কর্তাকেই বুঝিয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

ইতালিতে দেশের মানুষ ও সরকার যখন এ মহামারীতে পর্যুদস্ত তখন আবার একশ্রেণীর মানুষের কিছু উদ্ভট ও মনগড়া কথাবার্তা ইতোমধ্যে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় তুলেছে। তাদের কেউ কেউ এটাকে বলছেন, এটা মহানবী (সঃ)কে অবমাননার শাস্তি পাচ্ছে  ইতালিয়ানরা। (উল্লেখ্য , ইতালীতে san petronio basilica নামক গির্জায় Giovanni da modena ব্যঙ্গচিত্রটি মুহাম্মদ (স:)কে নিয়ে আঁকা। ১৪১০ সাল থেকে তা রক্ষিত থাকলেও তা স্থানীয় মুসলিমদের নজরে আসে ২০০১ সাল থেকে। তখন স্থানীয় মুসলিমরা প্রতিবাদ করলেও সরকার তাদের উপর দমন পীড়ন করে স্তব্ধ করে দেয়। বিশ্ব মুসলিম কোনো প্রতিবাদ করেনি

স্পেনেও মুসলমানদের অত্যাচার বা অবমাননার জন্যই নাকি তারা শাস্তি পাচ্ছে। এ ধরণের আরো অনেক ধর্মান্ধ মতামত ব্যাক্ত করছেন অনেকে ।  এ সব আলোচলা-সমালোচনা ভিত্তিহীন ও অবাস্তব  !! তাদের কথা যদি সত্যি হয় তবে সৌদি আরবে বা আশেপাশের অন্যানো দেশে করোনা ভাইরাস এর আক্রমণ কেন ?? বিশ্বের অন্যানো মুসলিম দেশের অনেকেই তো করোনার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে এবং দিন দিন সেটা বেড়েই চলেছে। আজ পর্যন্ত সৌদি আরবে করোনা ভাইরাস এ আক্রান্তের সংখ্যা ৩১২২ ও মৃতের সংখ্যা ৪১।

আমি আসলে কোন ইসলামী চিন্তাবিদ বা আলোচক নই। ধর্ম বিষয়ে আমার জ্ঞানও সীমিত।  তা সত্ত্বেও এসব অবাস্তব ও ভিত্তিহীন বিষয় আলোচনা-সমালোচনা কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছি না। ।  করোনা ভাইরাস ও রোম তথা ইতালিকে এক সরলরেখায় দেখিয়ে যারা তাদের দুর্গতিতে সমবেদনা না দেখিয়ে শাস্তির কথা বলছেন তাদের বিরোধিতা করছি। 

তবে আমার প্রাক্তন চাকুরী জীবনের সহকর্মী ও বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদগণ অনেকেই এ বিষয়ে কিছু কিছু লিখছেন। তাদের অনেকেই এ সব ভিত্তিহীন ও অবাস্তব আলোচনা-সমালোচনার যথাপোযুক্ত জবাবও  দিচ্ছেন। সম্প্রতি , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ডঃ যুবায়ের এহসানুল হক তার একটি লেখায় রোম বা তার সাথে করোনা ভাইরাস এর সংযোগের অপচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন । তিনি বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক। আল-কুরআনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা- পর্যালোচনা ,আল-কোরআনের আলোকে ভীনগ্রহে প্রাণের অস্তিত্তের সম্ভাবনা ও আরো বেশ কিছু বিষয়ে তার জ্ঞানগর্ভ লেখনী ইতোমধ্যে প্রচুর সুনাম অর্জন করেছে। পবিত্র কোরআন ও তার তফসিরের আলোকে তিনি করোনা ভাইরাস এর সাথে ইতালি বা রোম কে সসম্পৃক্ত করে যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটি আমি হুবহু নিচে উল্লেখ করলাম:…

” সূরা রূমএর রূম অর্থ ইতালি নয়। এবং সূরা রূমএর রূম এর অর্থ রোম শহরও নয়।

সূরা আররূমএর রোমান কারা

(১) আলিফ লাম মীম। (২) রোমানরা পরাজিত হয়েছে (৩) নিকটবর্তী ভূমিতে; কিন্তু তারা এই পরাজয়ের পর শীঘ্রই বিজয়ী হবে (৪) কয়েক বছরের মাঝে। 

সুরা আলরূমের দ্বিতীয় আয়াতে বর্ণিত রোম শব্দের অনেক রোমাঞ্চকর ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে, কেউ বলছেন এর মানে ইটালি, আবার কেউ বলছে এর মানে হল ইটালির রাজধানী রোম। দুই ব্যাখ্যার সাথেই করোনাকে সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। অনেক জ্ঞানীর পোস্টেও এমন স্থুল ব্যাখ্যা দেখা যাচ্ছে। এটি হয়ত কালিক অস্থিরতা। 

ইতিহাস তাফসির একসাথে উপস্থাপন করছি। 

বর্তমান ইটালির রাজধানী রোমকে কেন্দ্র করে একাকালে বিশাল প্রতাপশালী একটি সাম্রাজ্য গড়ে ওঠেছিল। লম্বা কাহিনী। জুলিয়াস সিজার রোমের সিনেটের ক্ষমতা খর্ব করে সম্রাট হতে পারেননি। পরে অগাস্টাস সিজার ২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ইউরোপ, এশিয়া আফ্রিকার অনেক বড় ভূখণ্ডজুড়ে ছিল এই সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি। রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম খ্রিস্টান সম্রাট কন্সট্যান্টাইন ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী স্থানান্তর করে রোম হতে বাইজেন্টিয়াম শহরে নিয়ে আসেন। সংস্কারের পর সম্রাটের নামে বাইজেন্টিয়াম শহরের নতুন নাম দেয়া হয় কন্সট্যান্টিনোপল। 

সাম্রাজ্যের বিশালতার কারণে সম্রাট কন্সট্যান্টাইন তার সাম্রাজ্যকে দুই ভাগ করে দুই পুত্রের মাঝে বণ্টন করে দেন: পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য, যার রাজধানী ছিল রোম শহর, পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য, যার রাজধানী ছিল কন্সট্যান্টিনোপল। 

কিন্তু অচিরেই আসল রোমান সাম্রাজ্য তথা পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতন হয় (৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে) কিন্তু পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য টিকেছিল আরো প্রায় এক হাজার বছর, (১৪৫৩ সাল পর্যন্ত) 

অর্থাৎ কুরআন নাযিল হওয়ার সময় রোমকেন্দ্রিক রোমান সাম্রাজ্যের কোন অস্তিত্ব ছিল না। কন্সট্যান্টিনোপলকেন্দ্রিক পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য তখনও বিদ্যমান। তবে এই সাম্রাজ্যের আরেকটি নাম চালু হয়ে যায়: বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য, কারণ এটির রাজধানী শহরের পুরনো নাম ছিল বাইজেন্টিয়াম। তবে আরবরা এসব ভাগাভাগিতে কান দিত না। তারা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে রোমান সাম্রাজ্য নামেই চিনত। এজন্য কুনিয়ার বাসিন্দা মৌলানা জালালুদ্দিনকে রূমী বলা হয়, এমন নয় যে, তার বাড়ি ছিল রোমে। 

রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবদ্দশায় পারস্য রোমান সাম্রাজ্যের মাঝে যুদ্ধ লেগেই থাকত। এক পর্যায়ে পারসিকরা অব্যাহতভাবে জয় পেতে থাকে। ৬১৩ সালে পারসিকরা দামেশক দখল করে নেয়, ৬১৪ সালে জেরুসালেম ৬১৫-১৬ সালে মিশর দখল করে নেয়। এমনকি তারা কন্সট্যান্টিনোপল অবরোধও করে। এই সূরা যখন নাযিল হয়, হিজরতের সাত বছর আগে, তখন পারসিকদের জয়জয়কার। মক্কার কুরাইশরা উল্লসিত, মুসলমানরা বিষণ্ণ; পারসিক রোমানদের যুদ্ধে মুসলমানরা রোমানদের সমর্থন করত, কারণ তারা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস করত, তাঁদের নবি ঈসা () পক্ষান্তরে কুরাইশরা পারসিকদের সমর্থন করত। পারসিকদের বিজয়ে কুরাইশরা উল্লসিত হয়। তখন মুসলমানদের সান্ত্বনা দিয়ে আয়াতগুলো নাযিল হয়। 

এখানে কুরআনের মুজিযাও রয়েছে। বলা হয়েছে রোমানরা অচিরেই বিজয়ী হবে। সূরা রূম নাযিল হওয়ারবা ৭ বছর পর ঠিকই ৬২২ সালে বাইজেন্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস তারসুসের যুদ্ধে পারসিকদের পরাজিত করেন। কুরআন যে আল্লাহর বাণী, তা প্রমাণিত হল। 

সারকথা: সূরা রূমে উল্লেখিত রোমানরা বলতে কন্সট্যান্টিনোপলকেন্দ্রিক পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য বা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য বোঝানো হয়েছে। ইটালিও বোঝানো হয়নি, ওই দেশের রাজধানী শহর রোমও বোঝানো হয়নি। 

পুনশ্চ: সেই কন্সট্যান্টিনোপল শহর উসমানি তুর্কিরা দখল করে নেয় ১৪৫৩ সালে। তাই বিজয়ী সুলতান মুহাম্মদকে ফাতিহ বলা হয়। বিলীন হয়ে যায় হাজারবর্ষী বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য। বাইজেন্টিয়াম শহরের নাম আবারো পরিবর্তিত হয়, নতুন নাম হয় ইস্তাম্বুল, এটি এখন খ্রিস্টানদের শহরও নয়, রোমানদেরও নয়। ১৪৫৩ সাল থেকে ১৯২২ পর্যন্ত এটি ছিল উসমানি সালতানাতের রাজধানী।”

সূরা রূম- এর রূম এর শানে নুযুল এর মধ্যে রোম তথা ইতালি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার কোনো লানত বা অভিশাপের  কথা বলা হয়নি। এমনকি মহানবী (সঃ ) ও রোমানদের কোন অভিসম্পাত করেছেন বলে কোথায়ও উল্লেখ নাই। এ ছাড়া ডঃ যুবাইর এহসানুল হক তার আলোচনায় যে রোমানদের কথা বলেছেন সেটা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য বা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য বোঝানো হয়েছে। তার প্রদত্ত সূরা রোম এর ব্যাখ্যা ও তফসির থেকে আরো জানা যায় যে ইতালি বা রোম কে একক ভাবে করোনা  ভাইরাস এর সাথে সম্পৃক্ত করা অনুচিত। যাইহোক , এখন করোনার প্রভাব থেকে মুক্ত নয় বিশ্বের কোনো দেশেই। সারা বিশ্বই এখন এই মহামারীতে আক্রান্ত ও সকল মানুষ অসহায় – ভীত-সন্ত্রস্ত।

আমরা জানি, দুর্যোগ বা মহামারী  কোন সময় বলে কয়ে আসে না। যখন আসে তখন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইতোপূর্বে বিশ্বে এ জাতীয় ঘটনার নজির আমরা কমবেশি সবাই জানি। তাই কোনো ধর্মীয় একপেশে দৃষ্টি কোন থেকে বিচার-বিশ্লেষণ ও মানুষকে বিভ্রান্ত না করে সবাইকে আন্তরিক হতে হবে এ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য। নিজের পরিবারকে ভাইরাস আক্রান্ত হাওয়া থেকে নিরাপদ ও সেই সাথে অপরকে নিরাপদ রাখতে হলে দেশের সরকার বা চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন তা যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে। আইসোলেশন বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে যতদিন না পরবর্তী নির্দেশনা পাওয়া যায়। আসুন মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে সমবেত ভাবে এ বিপদ থেকে পরিত্রানের জন্য প্রার্থনা করি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন