সময় এবং সুখের বিষয়টা একে অপরের সাথে জড়িত। আপনি অনেক বেতনের খুব ভালো একটা চাকরি পেলেন, কিন্তু সেই চাকরির প্রথম চেকের থেকে আপনার সন্তান যেদিন প্রথম হাটা শিখলো সেই দিনের কথা বেশি মনে থাকবে। আবার আপনার প্রথম iPhone এর থেকে প্রথম ভালোবাসার কথা বেশি মনে থাকবে। সময় টাকা পয়সার থেকে অনেক দামি, তথাপি সময়ের সেই পরিমান দাম না দিতে পারলেও অন্তত সময়কে টাকা পয়সার মতো মূল্য দিতে পারলে আপনি অনেক এগিয়ে যাবেন এবং অনেক শান্তি পাবেন।

আপনার পকেটে ১০০ টাকা থাকলে হটাৎ করে কেউ যদি এসে বলে আমাকে ৫০টি টাকা দিন। আপনি কিন্তু ধাম করে পকেট থেকে ৫০ টাকা বের করে দিবেন না, কিছু না হলেও অন্তত জানতে চাইবেন কেন বা কি দরকার। কিন্তু আমরা আমাদের সময় ব্যায় করার ক্ষেত্রে ওই জাতীয় কোনো প্রশ্নই মনে আনি না। অযথাই, অস্মরণীও বা অকাজে অনেক মূল্যবান সময় মূল্যহীনের মতো ব্যায় করি।

আমার বাবা গত হয়েছেন দুইযুগ আগে। তারা কথা মনে করতে গেলে তিনি আমাকে কত টাকা দিয়ে কি গিফট দিয়েছিলেন সেগুলি মনে পড়ে না, বরং মনের পর্দায় ভেসে উঠে তার সাথে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে যাওয়া, মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া, পাখি শিকারে যাওয়া, দুপুরে তার ঘুমের আগে তাকে বই পড়ে শোনানো, সন্ধ্যায় গরমের দিনে শীতল পাটির উপর বসে ভাইবোন মিলে তার সাথে গল্প করা, ঈদের নামাজের শেষে দৌড়ে গিয়ে প্রথমে তার সাথে কোলাকুলি ইত্যাদি।

টেলিভিশনে বা রেডিওতে কোনো বিখ্যাত বেক্তি বা সেলিব্রেটির সাক্ষাৎকার শুনলে দেখবেন, তাদেরকে যখন তাদের শৈশবের কথা বলতে বলা হয় তখন তারা তাদের বাবা মা, ভাই বোন বা বন্ধু বান্ধবের সাথে কাটানো ওই জাতিও স্মরণীয় সময়ের কথা বলে। আপনি নিজেও একটু পিছনের দিকে ফিরে তাকান, দেখবেন ওই জাতীয় টুকরো টুকরো স্মৃতিই আপনার মনকে ঘিরে আছে। এবং ঐগুলির মান অপরিসীম। আসুন তাই সময় ব্যায় এর ক্ষেত্রে একটু Conservative হই, এবং সৎ ব্যবহার করি। ঘড়ির কাটার প্রতিটি সেকেন্ডের সাথে চলে যাচ্ছে এই মূল্যবান সময়।

আপনার ভালো লাগাকে একটু খুঁজে বের করুন, দেখবেন সেই লিস্টে এমন অনেক কিছুই আছে যেগুলির জন্য আপনাকে কোনো অর্থ ব্যায় করতে হবে না। বর্তমান যুগে, বর্তমান সময়ে আমাদের সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভালো লাগাকে খুঁজে বের করা এবং সে জন্য কিছুটা সময় ব্যায় করা খুবই প্রয়োজন। দেখেবন সেটি পারলে শত সংকট বা দুর্দশার মধ্যেও কিছুটা হলেও শান্তি পাবেন।

একটি বাস্তব গল্প দিয়ে শেষ করি। ব্রাম্পটনে আমার এক ক্লায়েন্ট আছে। সে দরিদ্র, সরকারি সীমিত সাহায্যে চলে, তারপর আবার আছে severe মানসিক অসুস্থতা। আমি তার সাথে প্রায় ২/৩ বছর আগে কাজ করা শুরু করি। ড্রিংক করতো, বিড়ি পান করতো আর প্রায় ঝিম মেরে বসে থাকতো। আর সবসময় হতাশার কথা বলতো। বেশ কয়েকমাস কেটে গেলে, তেমন কোনো পরিবর্তন দেখলাম না।

একদিন তার বাসায় যাওয়ার সময় বাসার পাশের গাছের ঝোপে আমাদের দেশের চড়ুই পাখির মতো অনেক পাখির কিচির মিচির শব্দ শুনতে পেলাম, কিন্তু পাখিদের খুব একটা দেখলাম না। বেশ Curiosity জাগলো। পরের দিন গাড়ির থেকে কিছু নাট বের করে ওই গাছের ঝোপের নিচে ছুড়ে মারতেই বেশ কিছু পাখি এসে খাওয়া শুরু করলো। এইটা দেখে হটাৎ মাথায় এক বুদ্ধি এলো। ঐদিন ক্লায়েন্টের সাথে কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, সে কি তার নিয়মিত ড্রিঙ্কের থেকে জাস্ট $৪/৫ সেভ করতে পারবে কি না। ও বললো চেষ্টা করবে। সপ্তাহ খানেক পরে সে আমাকে $৫ এর কেটি নোট ধরিয়ে দিলো। আমি সেদিন তাকে নিয়ে তার বাসার কাছে ডলার স্টোরে গিয়ে কিছু বন্য পাখিদের খাবার কিনে আনলাম, এবং ওর বাসায় রাখতে বললাম। আর বললাম পরের সপ্তাহে আমি একটু সকালে আসবো।

পরের সপ্তাহে তাকে নিয়ে সেই গাছের ঝোপের কাছে গেলাম, এবং তাকে ওই খাবারগুলি দিতে বললাম। সে যথারীতি দিলো, এবং সঙ্গে সঙ্গে ঝোপের মধ্যে থেকে এক ঝাঁক পাখি এসে কিচির মিচির করে খাওয়া সুর করলো। ও খুব মজা পেলো এবং দীর্ধদিন পরে অনেক হাসলো। যাহোক পরবর্তীতে সে নিজেই টাকা সেভ করে প্রতিদিন ভোরে পক্ষীদের খাওয়াতে যায়, এবং আজ প্রায় দু বছর ধরে এই কাজটি সে করে যাচ্ছে। আর পাখিদের খাবার কিনতে গিয়ে তার মদ কেনার পয়সা কমে গেছে, সে জন্যে সে আগের থেকে অনেক কম ড্রিংক করে, এবং একটু কম বিষন্ন থাকে। আর পাখিগুলিও ওকে চিনে গেছে। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো ও যখন বাসা থেকে বের হয়ে বাইরে যায় তখন পাখিগুলি অন্তত ১০/১২ ফুট ওর মাথার উপর দিয়ে উড়ে, তারপর ফিরে আসে। ও খুবিই মজা পায়।

অনেক থেরাপি, অনেক কাউন্সেলিং করেও তাকে কোনো কিছুতে এনগেজ করানো যায়নি অথচ এই জিনিসটি ওকে কিছুটা মানসিক শান্তি যেমন দিয়েছে, তেমনি ওর ড্রিঙ্কও কিছুটা কমেছে। সে জন্য বলেছি যে, আপনার ছোট ছোট ভালোলাগা খুঁজে বের করুন দেখবেন সেগুলির জন খুব বেশি অর্থ ব্যায় হবে না, কিন্তু শান্তি পাবেন অনেক।

ধন্যবাদ।
মুকুল।
টরন্টো।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন