করোনার টিকা  গ্রহণ বিষয়ে আমার কখনো কোন সংশয় ছিল না। আমি প্রতীক্ষায় ছিলাম কখন আমার টিকা গ্রহণের সুযোগ আসবে। বয়সের মানদন্ডে টিকা পেতে সময় লাগবে তা সহজেই অনুমেয় ছিল। প্রতিদিনের খবরে দেখছিলাম কানাডার মধ্যে অন্টারিওতে, বিশেষ করে টরন্টো সিটিতে করোনায় সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি। হবে না কেন? টরন্টো জনবহুল নগরী। যেখানে মানুষ বেশি বসবাস করেন সেখানে সংক্রমণের হার বেশি হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অন্টারিও সরকার এ সব জনবহুল এলাকায় টিকা প্রদানে বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করছে না কেন? প্রায়ই আমার এ কথা মনে হত। হঠাৎ এক দিন শুনলাম, হ্যাঁ সক্রমণের হার বিবেচনায় নিয়ে এখানকার সরকার ”হট স্পট” এ বসবাসকারীদের জন্য “পপ-আপ ক্লিনিক” করবে এবং ”হট স্পট” এ বসবাসকারী প্রাপ্ত বয়স্ক (১৮+) সকলেই টিকা গ্রহণ করতে পারবেন। কোন আগাম এপয়ন্টমেন্টেরও প্রয়োজন নেই। মনে হলো, সরকার যেন জনগণের মনের কথা শুনতে পেরেছে। আমি যে এলাকায় বসবাস করি সেটা সরকার নির্ধারিত ”হট স্পট” এর মধ্যে পড়েছে। সুতরাং এবার “পপ-আপ ক্লিনিক” আমাদের এলাকায় কখন আসবে তার জন্য অপেক্ষার পালা। 

আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে “পপ-আপ ক্লিনিক” এর অভিজ্ঞতার কথা শুনলাম। হয় ভোর বেলা লাইনে দাঁড়াতে হবে, নতুবা লাঞ্চের সময়ে যেতে হবে। তাঁর পরামর্শ, সময় নিয়ে যেতে হবে। লম্বা লাইন হয়। আমাদের এলাকায় “পপ-আপ ক্লিনিক” এর আয়োজন বিষয়ে একদিন আগে জানতে পারলাম। তখন রোজার মাস। বউয়ের সাথে পরিকল্পনা করলাম। আমি সেহেরী খেয়ে একটু ঘুমিয়ে সকাল ৭ টায় “পপ-আপ ক্লিনিক” এ যাব। যদি লাইন ছোট থাকে, তবে বউকে ফোন করে জানাব তখন সে যাবে। যদি অপেক্ষারত মানুষের সংখ্যা বেশি মনে হয় তখন আমি ফিরে আসব। বলা প্রয়োজন, বাসায় সকাল বেলা আমাদের ছয় বছর বয়সী মেয়ে ঘুমে থাকবে। তাই আমরা পরিকল্পনা করেছি, যে কোন একজন গিয়ে লাইনে দাঁড়াব। টিকা প্রদানের দিন আমি সকাল ৭ টার দিকে “পপ-আপ ক্লিনিক” এ গেলাম। বিশাল লাইন। কমপক্ষে ৫০০ জন অপেক্ষমান। কম্বল, বালিশ, চেয়ার নিয়ে সবাই অপেক্ষা করছে। তাঁদের প্রস্তুতি দেখে মনে হলো মাঝ রাত থেকে তাঁরা সেখানে অপেক্ষা করছিল। গাড়ি পার্কিংয়েরেও কোন জায়গা নাই। অপেক্ষা করলে অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে। তাই বাসায় ফিরে আসলাম। দেখি আমার বন্ধুর দ্বিতীয় পরামর্শটি কাজে দেয় কিনা। লাঞ্চের সময় আবার যাব।

লাঞ্চের সময় আবার গেলাম। এবার বউকে সাথে নিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি চার-পাঁচ জন দাঁড়িয়ে আছেন। মনে হয় বন্ধুর পরামর্শ কাজে দিয়েছে। বউকে বললাম আমি গাড়ি পার্কিং করে আসি। তুমি গিয়ে লাইনে দাঁড়াও। গাড়ি পার্কিং করলাম। গাড়ি থেকে বের হব। এমন সময় বউ ফোন করল। টীকা নাই। টীকা দেয়া শেষ। ৫০০ টীকা নিয়ে এসেছিল। দুপুর ১২ টার মধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছে। তুমি গাড়ি নিয়ে চলে এসো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কয়েকজন যে দাঁড়িয়েছিল? তাঁরা কেন দাঁড়িয়ে আছে? বউ জানালো, তাঁরা কোভিড টেস্ট করার জন্য অপেক্ষা করছে; টিকার জন্য নয়। ব্যর্থ মিশন! বাসায় চলে আসলাম।

খবর পেলাম বাসার কাছে সপ্তাহ খানেক পর আরেকটি “পপ-আপ ক্লিনিক” আসবে। এবার মিস করা যাবে না। পরিকল্পনা অনেকটা আগের মতই। শুধু সময় একটু এগিয়ে নিলাম। সেহেরীর পর ঘুমাবো না। ফজরের  নামাজ পড়ে বের হয়ে গেলাম। মনে হলো, আমি ছাড়া আর কেউ সেখানে থাকবে না। এবারের “পপ-আপ ক্লিনিক” এ হয় আমি প্রথম টিকা পাব না হয় আমার বউ প্রথম টিকা পাবে। রাস্তায় বের হয়ে আমার ধারনা পাল্টাতে লাগলো। চারদিক থেকে মানুষ আসছে। প্রত্যেকের হাতে চেয়ার। টিকা দেয়া শুরু হবে সকাল ৮:৩০ মিনিটে। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। তাই সবাই সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে বের হয়েছেন। প্রথম হওয়ার স্বপ্ন বাদ দিয়ে ১০০০ জনের একজন হতে পারব কিনা সে চিন্তা করতে করতে আগাতে লাগলাম। লাইনে যখন দাঁড়ালাম তখন সকাল ৫:৩০ টা। আমার সামনে কমপক্ষে ৩০০ জন। আচ্ছা তাঁরা কখন এসেছেন? ইশ, প্রথম ব্যক্তিকে যদি আমি এই প্রশ্নটি করতে পারতাম। বউকে ফোন দিলাম। তাড়াতাড়ি চলে এসো। আজ টিকা পাব, কারণ ফাইজারের ১০০০ টিকা এখানে দেয়া হবে। তবে “পপ-আপ ক্লিনিক” এর স্টাফরা রেজিস্ট্রেশন করবে; একটি সিরিয়াল নম্বর দিবে। তোমাকে সেসময় এখানে থাকতে হবে। বউ কিছুক্ষণ পর চলে আসল। সকাল ৯:২৫ পর্যন্ত দু’জন সেখানে গল্প করে সময় কাটালাম। প্রথম ডোজ টিকা পেলাম। মিশন সাকসেসফুল!

আমার বউ বাসায় এসে দুপুরের দিকে দু’জন প্রতিবেশীকে ফোন দিলেন। সেই দু’জন টিকা নিয়েছেন কিনা খোঁজ নিলেন। তাঁরা দু’জন ৩০ মিনিটের মধ্যে টিকা নিয়ে চলে আসলেন। খবর শুনে আরেক ভাই গেলেন। টিকা পেলেন না। ততক্ষণে ১০০০ টিকা দেয়া হয়ে গিয়েছে।

তারপরে আরো কয়েক বার আমাদের এলাকায় “পপ-আপ ক্লিনিক” হয়েছে। ততদিনে অনেকের টিকা নেয়া হয়ে গিয়েছে। শুনেছি তখন আর টিকা প্রত্যাশিদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় নাই।

এবার আমার মেয়ের পালা। বার বছরের বেশি বয়সী শিশুদের টিকা দেয়ার ঘোষণা আসল। সে হিসাবে আমার বড় মেয়ে টিকা নিতে পারবে। মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলাম সে টিকা নিতে চায় কিনা। সে টিকা নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করল। স্কুল থেকে কয়েকটি “পপ-আপ ক্লিনিক” এর তথ্য দেয়া হলো। মে মাসের ২২ তারিখে বাসার কাছে একটি এবং ২৩ তারিখে মেয়ের স্কুলে একটি “পপ-আপ ক্লিনিক” বসবে। ২২ তারিখে যেখানে “পপ-আপ ক্লিনিক” হবে তার পাশেই আমার এক প্রাক্তন সহকর্মীর বাসা। সকাল ১১ টার দিকে তাঁকে ফোন দিলাম। তিনি জানালেন সকালে লম্বা লাইন ছিল। টিকা পেতে প্রায় দু’ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। ১২ টার দিকে ভিড় কম হতে পারে। চান্স নেয়ার পরামর্শ দিলেন। মেয়েকে নিয়ে ১২:৩০ টার দিকে গেলাম। ছোট লাইন। আমার মেয়ের সামনে মাত্র ৪ জন। আধা ঘন্টার মধ্যে আমার মেয়ের টিকা দেয়া হয়ে গেল। বের হওয়ার সময় দেখলাম লাইন একটু লম্বা হয়েছে। প্রায় ২০- ২৫ জন।

আমরা সবাই স্বাভাবিক জীবন যাপনের অপেক্ষায় আছি। কবে আসবে সেই করোনাপূর্ব সময়ের মত স্বাভাবিক জীবন। করোনার টিকা সেই স্বপ্ন পূরণের প্রচেষ্টামাত্র। টিকা গ্রহণের সুযোগ আসলে, কষ্ট করে হলেও আপনি আপনার টিকা গ্রহণ করুন। বৃহত্তর প্রচেষ্টায় শামিল হন।

এস এম জাকির হোসেন
ব্যরিস্টার অ্যান্ড সলিসিটর, টরন্টো।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন