ফারুক আহমেদ – পার্থ, অস্ট্রেলিয়া থেকে :-

অফিস থেকে ফিরে আমার সাড়ে চার বছরের ছেলের প্রশ্ন শুনে অবাক হলাম – ‘বাবা তোমার কাছে ফরটিএইট ডলার আছে?’ ঠিক শুনলাম তো? নিশ্চিত হতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ফরটি এইট ডলার?’ সে মাথাঝাঁকায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম – ‘কী করবি?’ সে হাসে, কিছু বলে না। আমার নয় বছরের মেয়ে বলল-  ‘বাবা, ও আমার কাছেও ফরটি এইট ডলার চেয়েছে।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কখন?’ ‘আমি স্কুল থেকে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে।’ -সে উত্তর দেয়।

স্ত্রীর কাছে বৃত্তান্ত জানলাম। সে মেয়েকে স্কুলে নামিয়ে ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিল শপিংমলে। সেখানে সে কম্পিউটার গেম দেখেছে যার দাম ফরটি এইট ডলার। ওর মা বলেছে হবে না, তার কাছে ফরটি এইট ডলার নেই। তাই সে ফরটি এইট ডলারের কথা জনে জনে জিজ্ঞেস করে বেড়াচ্ছে।

ছাত্রজীবনের কথা মনে করিয়ে দিল ছেলেটা। নেশাগ্রস্ত বন্ধুরা সন্ধ্যা হলে টাকার জন্য ঘুরত- ‘পঞ্চাশটা টাকা ধার দে দোস্ত, এ মাসের টাকা আসলেই দিয়া দিব।’ আমি মনে মনে বলতাম, কতবার তো নিলি, দিলি তো না। মুখে বলতাম, ‘আদম আলীর কাছে যা, গতকাল ওর টাকা আসছে।’ আদম আলী বলতো, ‘দোস্ত, ক্যান্টিনের আর দোকানের বাকি শোধ করে কিছুই হাতে নাই।’ কেউ না কেউ ধার দিত। হয়তো ধার পেত না। মাঝে মাঝে শুনতাম ট্রাংকের তালা ভেঙে টাকা চুরি হয়েছে – নেশা বলে কথা!

ছেলে-মেয়েদের কম্পিউটার গেম কি নেশা? পাঠক, একটা ঘটনা বললে কিছুটা অনুমান করতে পারবেন।

গতকাল অফিসের এক ইংরেজ সহকর্মী ফেসবুকে তার ষোলো বছরের ছেলের ছবি দেখালো। পুলিশের ভ্যানে, নিজের ছবি নিজে তুলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে- ‘লুক আই এম কট বাই পুলিশ ফর ভেহিকলথেফট’। গর্বিত হাসি, রক স্টারদের মতো চুল, ভ্রুতে দুটো রিং ঝুলছে। বিষয় কি? সেই ছেলে মাদকাসক্ত, চারমাস আগে বাড়ি থেকে চলে গেছে। গত সপ্তাহে ফোনে আমার সহকর্মীকে হুমকি দিয়েছে- পেটে ছুরি চালিয়ে মারবে। আমি বললাম- ‘থামাও যেভাবে পারো। অন্য কিছুতে আসক্ত কর- স্পোর্টস, বই, সিনেমা, এমনকি মেয়েবন্ধু।’ সব চেষ্টাই নাকি ব্যর্থ। অনেক দেরি হয়ে গেছে। সে কি কিছুই পছন্দ করে না মাদকছাড়া? করে, শুধু গেম- আর কিছু না। মাদক আর গেম তার সমান তালে চলে- একটা ছাড়া আরেকটা নাকি অচল। তার মানে কি এক নেশা থেকে আরেক নেশা হতে পারে? গাঁজা থেকে ইয়াবা, ইয়াবা থেকে হেরোইন? ঠিক তেমনি গেম থেকে মাদকাসক্তি?

অনেকে বলেন, ‘গেম খেললে আইকিউ ভালো হয়।’ আমি বলি- আইকিউ কি শুধু এই প্রজন্মের  মানুষের মাথায় আর গত হাজার-হাজার বছরে জ্ঞানী-গুণীদের আইকিউ ছিল না? তারা বলেন, ‘শুধু গেম কেন? ইন্টারনেট তো জ্ঞানের ভাণ্ডার। সেখানে কিছু শিখুক।’ সমস্যা হচ্ছে ছেলে-মেয়েদের (বিশেষ করে বয়সন্ধির পর) ভালো গ্রহণ করার চেয়ে খারাপের দিকে উৎসাহ থাকে বেশি। ইন্টারনেট তো এখন পর্নোগ্রাফির ভাণ্ডার! নগ্ন বিজ্ঞাপনে ছেয়ে আছে ইন্টারনেট। একটা ভালো শিখলে দশটা খারাপ দেখবে। অজানার প্রতি কৌতূহল। অতি উৎসাহী অনেকে বলেন, ‘এদের মাঝ থেকে নিউটন-আইনস্টাইন তৈরি হবে।’ আমি বলি, নিউটন-আইনস্টাইন তৈরি হয় না- তাঁরা জন্মাম।

তাহলে কি তারা কম্পিউটার শিখবে না? শিখবে, কিন্তু অভিভাবকদের নজর রাখার কোনো বিকল্প নেই। আমি ভাগ্যবান যে, একুশ বছর বয়সে প্রথম কম্পিউটার টিপেছিলাম। অক্ষর চাপলে দুই সেকেন্ড পরে সাদাকালো স্ক্রিনে তা দেখা দিত। বিশ বছর তো এর উপরেই সংসার চালাচ্ছি- ভেতরে বাইরে উল্টেপাল্টে দেখলাম। সাধারণ ব্যবহারের জন্য যেটুকু দরকার তা শিখতে লাগে দু-এক সপ্তাহ। গেমের কোনো ভালো ফল আমি দেখি না।

অনেক বাবা-মা বলেন- বাচ্চারা বাসায় বিরক্ত করে। তার চেয়ে একটা কিছু নিয়ে থাকুক। বাবা-মা একটু শান্তিতে থাকতে পারেন। এই শান্তি বড় অশান্তির কারণ হতে পারে। বড় হয়ে যে বাবা-মার পেটে ছুরিচালাবে না ফরটি এইট ডলারের জন্য এটা বলি কি করে? চোখের সামনেই তো দেখতে পাচ্ছি এমন ঘটনা। আমরা ভাবি আমাদের ছেলে-মেয়েরা লক্ষী, লাজুক। কথা তিক্ত হলেও সত্যি যে, প্রতিটা মাদকাসক্ত ছেলে-মেয়েদের বাবা-মা এমনটাই ভাবতেন। আমার সেই ইংরেজ সহকর্মীর ধারণা যে, তার ছেলে লাজুক ছিল। তাই সে নেশার মাঝে আত্মবিশ্বাস খুঁজেছে। মাত্র তিনমাসে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেয়ছে। তিনি আর তার স্ত্রী কিছু বুঝে ওঠার আগে। এখনও তারা বিশ্বাস করতে পারেন না- যেন একটা দুঃস্বপ্ন দেখছেন তারা। ঘুম ভেঙে দেখবেন সব আগের মতো – তাদের মেধাবী ছেলে স্কুলে যাচ্ছে, পড়াশুনা করছে আর গেম খেলছে।

এখনকার ছেলে-মেয়েদের পরিবেশের সঙ্গে আমাদের ছোটবেলার ব্যবধান অনেক। আমাদের ছোটবেলায় খেলার মাঠ ছিল, বাইরে নিরাপত্তা ছিল। এখন নেই। ঢাকার অবস্থা অকল্পনীয়। এরশাদের আমলে দেখতাম হরতালের সময় ছেলেরা রাস্তা দখল করে ক্রিকেট খেলত – মানিক মিয়া এভিনিউতে দলে দলে নেমে যেত। ঢাকার মাঠগুলো ফাঁকা থাকত না বিকালে। মফস্বল শহরগুলো ছিল খেলার জন্য স্বর্গ। এ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা বাসায় বসে কী করবে? বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা যায়। বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ সাহিত্যিকদের লেখা পড়বে না, তা কী করে হয়? রঙ পেন্সিল হাতে ধরিয়ে দেওয়া যায়, আঁকাআঁকি বিষয়টা সুন্দর। লেগো বুক দেওয়া যায়। বাবা-মা একটু সময় পেলে গল্প করতে পারেন। লুডু খেলা যেতে পারে সবাই মিলে। বাইরে বেড়াতে যাওয়া যায়। আরও অনেকভাবে তাদের গেমের কৃত্রিম আনন্দ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সর্বক্ষণ যোগাযোগ রাখা, একসঙ্গে সময় কাটানো।

ছেলে-মেয়েরা এত দ্রুত পরিবর্তন হয়, বিশেষ করে খারাপের দিকে যে, বাবা-মা টের পাওয়ার আগেই অনেক দূরে চলে যায়। ফিরিয়ে আনা অসম্ভব হয়ে যায়। তখন বাবা-মায়ের প্রতিদিন কাটে দুঃস্বপ্নের মতো। ঘুমিয়ে দেখা দুঃস্বপ্ন ভেঙে যায়, আমরা বাস্তবে ফিরে আসি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু জেগে দেখা দুঃস্বপ্ন ভাঙে না।

১ মন্তব্য

  1. খুবই সময় উপযোগী এবং প্রয়োজনীয় লেখা. ধন্যবাদ ফারুক ভাই.

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন