গত এক সপ্তাহে কানাডার বিভিন্ন অঞ্চলে যথা ব্রিটিশ কলোম্বিয়া,নিউফাউন্ডল্যান্ড, আলবার্টা, সাস্কাচুয়ান, কুইবেক, ওন্টারিও  প্রচন্ড শীত ও বরফ পড়েছে।প্রচন্ড শীত,হিমশীতল বৃষ্টি,বরফ ও  ঝড়ো আবহাওয়ার কারণে হাজার হাজার বাড়ি ঘর বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটছে যা আজও  পুরাপুরি কানেকশন দিতে পারে নি।  শুধু কানাডায় নয়, আমেরিকার অনেক রাজ্যে বরফ এবং ঠান্ডা পড়েছে;জলবায়ুবিদরা একে  “আবহাওয়া বোমা” বলে অভিহিত করেছেন। এইতো কেবল শীত শুরু হয়েছে, এই শীত মার্চের শেষের দিক পর্যন্ত চলবে। প্রতিদিন টেলিভিশনে আবহাওয়া সতর্কতামূলক  সংবাদ দেখতে হবে, তার উপর নির্ভর করে সতর্কতা নিতে হবে।         

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে তীব্র  আবহাওয়ার কারণে  লক্ষ লক্ষ বাসিন্দা প্রভাবিত হয়েছে; শীতকালীন ঝড় দেশের একাধিক অংশে তিক্ত ঠান্ডা ও  তুষারঝড়ের তাণ্ডবলীলা দেখিয়েছে।  এই তীব্র আবহাওয়ার দরুন আশ্রয়হীন মানুষ  সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়েছে। কানাডা ও আমেরিকায়  হাজার হাজার শেল্টার খোলা হয়েছে।  এই শীত ও ঝড়ে কানাডা এবং আমেরিকায় কিছু লোক মারা গিয়েছে। যারা গৃহহীন, তারা বিশেষ করে চরম তাপমাত্রায় দুর্বল হয়ে অসুস্থ্য হয়ে  পড়ে এবং জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা নিতে হয়।     

১৯৮৬ সনে আমি যখন নিউজার্সি, আমেরিকা এবং কানাডা ইমিগ্রেশন নেয়ার জন্য দরখাস্ত দেব দেব ভাবছিলাম , সে সময় আমার  এক রুমমেট আমাকে তার কানাডার অভিজ্ঞতার আলোকে বলতেছিলো যে “আমার এখনও কানাডার ঠান্ডার কথা মনে পড়লে মাথাব্যাথা শুরু হয়।”  আমি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করছিলাম যে কানাডার শীত সম্পর্কে তোমার কি অভিজ্ঞতা আছে ?  সে বলে আমি এক বৎসর নিউফাউন্ডল্যান্ড ছিলাম  এবং অতিরিক্ত ঠান্ডার জন্য আমেরিকায় চলে এসেছি ।  আমি অবাক হয়ে ভাবছি  ইম্মিগ্রাশনের জন্য দরখাস্ত কি দেব ? আমার আর এক রোমমেট  “জাফর” বলে, “আরে দাদা দরখাস্ত দাও, হলে পরে চিন্তা করো।”  আমি বলাম, তোমার কথাই ঠিক, দরখাস্ত পাঠিয়ে দিলাম। আর না দিয়েই বা কি করবো? আমেরিকায় তো আমি উদ্বাস্তু , যেখানেই সুযোগ পাই,চলে যেতে চেষ্টা করবো।   আমার দরখাস্ত দেয়া দেখে আরো ও দুইজন ও  দরখাস্ত পাঠিয়েছিল।  ওদের একজন শামসুল ইসলাম আমার ১০ দিন পরে ক্যুবেক এসে ইমিগ্রেশন নিয়েছে।  ওর পরিবারের সঙ্গে আমাদের  এখনো ও যোগাযোগ আছে।  

১৯৮৮ সন থেকে এ দেশে আছি এবং শীতের বহু অভিজ্ঞতা, কত আর বলি।    

একবারের এক ঘটনা,ভোর ৭টায় আমার কাজ, ৫ টায় ঘুম থেকে উঠে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাচ্ছি , ঠান্ডা, সাদা পেজা তুলার মতো  হাঁটু পরিমান বরফ, তাছাড়া বরফ পড়া বন্ধ হয় নি।  কিন্তু কাজে যেতে হবে।  

ঘুম থেকে উঠে তৈরী হয়ে বাহিরে গিয়ে সরাসরি গাড়ি স্টার্ট দেয়ার কোনো উপায় নেই।  এক হাটু পরিমান বরফ, গাড়ি ও নিজের ড্রাইভওয়ে পরিষ্কার না করলে গাড়ি বের করা যাবে না।  আমার স্ত্রী, মেয়ে রুমকি এসে  হাত দেয়াতে তাড়াহুড়া করে গাড়ি স্টার্ট দিতে পারলাম।  রাস্তার এমন অবস্থা, একটু জোরে ব্র্যাক দিলে গাড়ি অন্যদিকে মোড় নিয়ে কারো গাড়ি ধাক্কা দেবে, অতিরিক্ত সতর্কতার মধ্যে ধীরে ধীরে ব্র্যাক না দিয়ে চালাচ্ছি, নতুবা অন্য গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে ঝামেলায় পড়তে হবে।  কোনো রকমে আস্তে আস্তে হাইওয়ে ৪০১ ঢুকেছি। মিউনিসিপ্যালিটির লোক  রাস্তা একদিকে পরিষ্কার করে, অন্যদিকে স্নো পড়তেছে এবং কিছুই দেখা যায় না। লোকাল লেন ও একই সমস্যা, তা ছাড়া ঘন ঘন স্টপ সিগন্যাল, মহাসড়কে কোনো সিগন্যাল নেই ;সে যাই হোক,  ১৫ মিনিটের রাস্তা দেড় ঘন্টা লেগেছে; অফিসের নিকটে গিয়ে টিমহর্টন্স গিয়ে কফি ও ব্রেকফাস্ট নিয়ে অফিস গিয়ে দেখি অনেকেই আসে নি। একজন তাকিয়ে  বলে আসতে পারলে? হেঁসে বললাম, না এসে তো উপায় নেই।   

এ তো একদিনের কথা, ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এ দেশে আবহাওয়ার কোনো নিশ্চিয়তা নেই।  একদিকে স্নো , অন্য দিকে ঝোড়ো আবহাওয়া, ঘরের চালে  একজাতীয় সিঙ্গেলস দেয়া হয়, একটু জোরে বাতাস আসলে উড়িয়ে নিয়ে যায়।  এ হলো বাংলাদেশের আগের দিনের ছনের ঘর, প্রতি ৫/৭ বৎসরে একবার ছাদের সিঙ্গেলস  পাল্টাতে হয়।  -২৫ সি(সেন্টিমিটার)  থেকে -৩০ সি(সেন্টিমিটার)  ঠান্ডায় ছাদের সিঙ্গেলস বাতাসে উড়িয়ে নিলে, এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায়  মেরামতের লোক পেতে মেলা ঝামেলা ।  গত কয়েক বৎসরে আমি কয়েকবার এ অবস্থায় পড়েছি।  

তবে এ দেশে শীতে সাধারণত ছোট ছোট ছেলে মেয়ে বা বয়স্করা সর্দিকাশি বা জ্বরে ভোগতে তেমন  দেখা যায় না। বরফ দেখলে এ দেশের ছেলেমেয়েরা ঘরে থাকতে চায় না, বাহিরে যাবে এবং বরফ নিয়ে খেলবে, এটা তাদের একধরণের আনন্দ।  তীব্র ঠান্ডা এবং বরফে কোনোরকম পোকামাকড় বা বাতাসে দূষিত ময়লা থাকে না। এ দিক থেকে চিন্তা করলে বলা যায় যে শীত  মানুষের শরীরের জন্য ভালো। 

এখানে এত এত ঠান্ডায় construction শ্রমিক  দিনরাত কাজ করে , ক্লান্ত হয় না।  একদিকে বরফ পড়ে, অপর দিকে মিউনিসিপালিটি শ্রমিক   রাস্তায় স্নো পরিষ্কার করে লবন ছিটিয়ে দিয়ে থাকে, তা না হলে রাস্তায় গাড়ি চলাচল বা হাঁটা চলা যায় না। পুরুষ মহিলা সবাই যত অসুবিধাই হোক না কেন,কাজে যেতে হয়;  গাড়ির চাকা ও থেমে থাকে না। 

 টরন্টো, নিউয়র্কের  মতো শহরগুলিতে ২৪ ঘন্টা বাস চলাচল করে, প্রায় প্রতিটি বাস স্টপে জনগণের সুবিধার জন্য প্লাস্টিক বা গ্লাস দিয়ে ছাউনি দেয়া থাকে, যা প্রচন্ড বাতাস থেকে যাত্রীদের রক্ষা করে। তবে ভোরে বা বিকেলে ঠাঁসাঠাঁসি করে ও এই ছাউনির মধ্যে জায়গা হয় না , বাহিরে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকে।  বাস থামলে সবাই উঠতে চেষ্টা করে,যদি ও অনেক সময় জায়গা হয় না।  তবে বাসে হিট (উত্তাপ) দেয়া থাকে এবং মোটামোটি আরামদায়ক।  বাস, গাড়ি,বাড়ি,শপিং প্লাজা বা কলকারখানা সর্বত্রই হিট (উত্তাপ) দেয়া থাকে। 

মানুষ স্বাচ্ছন্দে বাসায়,শপিং মলে ঘোরাঘোরি করে।  অতিরিক্ত ঠান্ডা বলে কেউ বাসায় বসে থাকে না।  এ দেশের মানুষ কর্মঠ,কাজ করতে ভালো বাসে, এমন ঠান্ডার  দেশে ২৪ ঘন্টা  কলকারখানা চলে। 

 মহাসড়কে দিন/রাত্রি বিরাট বিরাট যানবাহন চলছে তো চলছেই।  কানাডা বা আমেরিকা থেকে বড়ো বড়ো ট্রাক  বোঝাই মালামাল  আসতেছে বা যাইতেছে।  বর্ডারে গেলে দেখবেন লম্বা লাইন, মনেই হয়ে না যে এই দুর্যোগে কেউ ব্যবসা বন্ধ করে বসে থাকে।  মহাসড়কের  পার্শে গড়ে উঠেছে ,টিমহর্টন্স,ম্যাকডোনাল্ডস, কেন্টাকি,আরও কত কি ফাস্ট ফুড রেস্টুরেন্টস ; লোকজন ট্রাক,গাড়ি, বাস থামিয়ে  বসে আরামচে খেয়েদেয়ে ওয়াশরুম সেরে চলে যাচ্ছে হাজার হাজার মেইল দূরে।গাড়িতে   GPS আছে কেউ কাউকে কতদূর বা কিভাবে যেতে হবে জিজ্ঞেস করে না।  দুনিয়া কতখানি অ্যাডভান্সড হয়েছে ,না দেখলে বুঝা যায় না।    

প্রচন্ড শীত আর বরফে এখানকার বনজ পশুপাখি অনেক দুর্দশার মধ্যে থাকে।  বাসা থেকে বের হলেই নজরে পড়ে শপিং মলে এখানে সেখানে শত শত কবুতরের ভিড়।  অনেকে দোকান থেকে পাখির খাবার নিয়ে  মাটিতে দেয়া মাত্রই  শত শত পাখি চারিদিকে জড়ো হয়ে খাওয়াশুরু করে , এ দেশের পাখি কাউকে ভয় পায়  না।    কারণ হিসাবে বলা যেতে পারে যে এ দেশে লাইসেন্স ব্যাতিত মাছ ধরা বা পশুপাখি শিকার করা নিষিদ্ধ।  টরন্টো শহরের আনাচে কানাচে  অসংখ্য হরিণ, দেখতে কি সুন্দর ? কেউ ওদের আঘাত করে না। অসংখ্য রাজ্ হাঁস রাস্তা পার হচ্ছে  আপন মনে, যানবাহন দাঁড়িয়ে ওদের পার হওয়ার সুযোগ করে দেয়।  আপনি আঘাত করবেন,কেউ আপনার গাড়ির নম্বর পুলিশ কে দিলে সঙ্গে সঙ্গে বিপদে পড়ে যাবেন।  এ দেশের আইন কানুন মানুষের জন্য এবং তা অক্ষরে অক্ষরে সবাই মেনে চলে।   

শীতে মনেই হয়ে না যে এ দেশে কোনো কালে গাছপালা ছিল বা আছে ; আসুন গ্রীষ্মে, এ দশের প্রকৃতির শোভা  দেখে যান , চারিদিকে সবুজ আর ফুলে ফলে সাজানো কানাডার অপূর্ব রূপ।   এ দেশের প্রকৃতির শোভা দেখবেন আর পার্কে , লেকের পাড়ে প্রিয়জন, বন্ধুবান্ধব,ছেলেমেয়েদের  নিয়ে বসে গল্প করেবন বা বনভোজন করবেন ?  চমৎকার সময়, এখানকার নায়াগ্রা ফলস, ব্লু মাউন্টেন,প্রিন্স  এডওয়ার্ড আইল্যান্ড, নিউফাউন্ডল্যান্ড , আরও কত কি সুন্দর সুন্দর স্থান,  কি সুন্দর দৃশ্য, দেখবেন আর আনন্দ পাবেন।  

সমাপ্ত

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিজ্ঞান, ওয়েদার এবং আমার প্রার্থনা
পরবর্তী নিবন্ধএক ভিন্ন স্বাদের হ্যাপি নিউ ইয়ার
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন