যে দেশে পৌনে ৬ ফুটের ঘরে সাড়ে ১১ জন মানুষ এবং আধাটি ছাগল বাস করে সেখানে কী করে কোয়ারেনটাইন সম্ভব? মানুষ কি মুরগি যে একই খোয়ারে দীর্ঘদিন বন্ধ করে রাখা যাবে?

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোন এক ‘বুজুর্গের’ জানাজায় জনতার ঢল নেমেছে দেখে আমাদের ফেইসবুক নাম্নি দেশের অধিবাসিরা খুব নাখোশ অবস্থায় আছে। কেউ ক্রুদ্ধ হয়ে বলছে, ওখানকার হাসপাতালগুলো বন্ধ করে দেয়া হোক; ওখান থেকে ডাক্তারদের সড়িয়ে এনে সচেতন নাগরিকদের চিকিৎসা করার জন্য পাঠানো হোক। যারা ভাইরাসে বিশ্বাস করেনা, কিন্তু ‘বিশ্বাসের ভাইরাসে’ গুরুতরভাবে আক্রান্ত, মরুক সেইসব অপজন্মার দল। তছনছ হয়ে যাক ওদের জীবন-সংসার। যৌক্তিকতার ওজন সেখানে যাই হোক কিন্তু এই দাবী খুবই অভিমানী।
“যা শালারা মর”- এমন একটা মনোভাব।তা মরুক, কিন্তু দেবালয় কি আমাদের বাসস্থান থেকে যোজন যোজন দূরে? নাকি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুরত্ব ঢাকা থেকে বহু আলোকবর্ষ?

তৃতীয় বিশ্বের যেখানে সোস্যাল সিকিউরিটি বলে কিছু নেই, যেখানে ঘরে বসে থাকার বিনিময়ে সরকারের চেক চলে আসেনা, সেখানে লোকজন ঘরে বসে থাকলে খাবে কি?
যাদের ফ্রিজভরা খাদ্য, পকেটভরা টাকা ও প্রশস্ত ঘরবাড়ি বা এপার্টমেন্ট আছে তারা হম্বি তম্বি, গালাগালি ও অভিশাপ করতেই পারে কিন্তু কোন কাজে দেবেনা।
তৃতীয় বিশ্বে কোয়ারেন্টিনে থেকেও যে পরিমাণ মানুষ মরবে, কোয়ারেনটিনে না থেকে যে তার চেয়ে বেশি বা কম মরবে, অনুমান ছাড়া আমাদের হাতে সিরিয়াস কোন ডেটা নেই।
আমাদের হাসপাতালগুলোতে যেখানে লোক গিজ গিজ করে, একই ওয়ার্ডে মানুষ মাছির মত, আইসিউ বেডের সংখ্যা পরিমিত, ভেন্টিলেটর নেই, পিপিই নেই, সেখানে বড়মাপের মহামারী ফেইস করার জন্য “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু” ব্যতীত আমাদের আর কী হাতিয়ার আছে? (আমাদের আত্মার অনুরণন, “জয়বাংলা, জয়বঙ্গবন্ধু”- ধ্বনি কোন মন্ত্রীর বাগাড়ম্বরে আজ এমনি প্রতীত হয়, যা একদিন মোশতাক- মোয়াজ্জেমচক্রের মুখেও ধ্বনিত হয়েছিল অসামান্য তীব্রতায়)

অথচ দেশ অচল অবস্থায় না রেখে যদি কল কারখানা ব্যবসা বানিজ্য ট্রান্সপোর্ট খুলে দেয়া হয়, অর্থনীতির চাকা ঘুরতে দেয়া হয় এবং জনগণের জন্য ন্যুনতম আয়ের পথ খুলে দিয়ে যতদূর সম্ভব বেসিক হাইজিন, সোস্যাল ডিস্টেন্সিং, অসুস্থের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা, যাদের ঘর আছে এবং ঘরে থাকা সম্ভব, তাদের ঘরে থাকা ইত্যাদির প্রপাগান্ডা চালানো হয়, তবে মড়ক ও মরণ সমান হলেও দেশের অন্তত অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা যাবে এবং ক্ষুধার্ত ক্রুদ্ধ মানুষকে বিপথে পরিচালনা থেকে বাঁচানো যাবে।

যদি পরিস্থিতি দুর্ভাগ্যজনক হয় এবং অনেক বেশি মানুষ জীবন হারাতে শুরু করে, তাহলে মানুষকে ঠেলে কোয়ারেন্টিনে পাঠাতে হবেনা, যাবার জায়গা থাকলে নিজেরাই কোয়ারিন্টিনে যাবে।
ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যাবে?
হ্যাঁ, সম্ভবত, কিন্তু আমাদের অন্য কোন পথ আছে?
আছে।
কোয়ারেনটিন চালিয়ে যাওয়া এবং গার্মেন্টস ইন্ড্রাস্ট্রি সহ যে যে শিল্পগুলোতে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠির একটি বিরাট অংশ কর্মরত আছে, সেই শিল্পমালিকদের বাধ্য করা তাদের কর্মচারীদের ন্যুনতম বেতন প্রদান করে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। তার জন্য যদি তাদের ভবিষ্যতে ইমপোর্ট বা এক্সপোর্টে কোন কোন সুবিধা দিতে হয় সরকার তা দিতে পারে। এই ব্যবসায়ীরাও এখন বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিন্তু তাদের অবস্থা শ্রমিকদের চেয়ে খারাপ নয়। তারা গত ৫০ বছর ধরে বিপুল পরিমাণ মুনাফা করেছে, সেই টাকাগুলো কোথায়? এই প্রশ্নটিও তাদের করা যায়।
জনগণকে সামান্য কিছু টাকা কিছুদিনের জন্য অগ্রিম হিসাবে ধার দিতে তারা সক্ষম। অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করলেই তারা তা কিস্তিতে ফেরত নিতে পারবে।
এটা কি করা সম্ভব?
বাংলাদেশের ব্যবসায়ি / শাসক শ্রেণি এখনও পর্যন্ত এমন কোন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে নাই, তাই আমি তত আশাবাদী নই।
তাহলে?
কোয়ারেন্টিন তুলে নেয়া দরকার।
আমাদের দেশে, আমাদের বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়ে, আমাদের নেতৃত্ব পশ্চিম থেকে কোয়ারেন্টিনের কনসেপটটি কপি করেছে।অথবা WHO বা অন্য কেউ বাধ্য করেছে।
২.
জানাজায় কেন এত বেশি লোক ?

লিবেরালরা যখন জনগণকে ‘ভোদাই’ ভেবে যুগের পরে যুগ ধরে যেমন ইচ্ছে তেমনভাবে শোষণ ও বঞ্চিত করতে থাকে, তখন জনগণ মধ্যযুগীয় কনজারভেটিভদের কাছে যায়। যখন দেশপ্রেমিকরা নিরন্তর বাগাড়ম্বর, চুরি, সাজাহীন অন্যায় ও প্রতারণা চালিয়ে যেতে থাকে, তখন জনগণের দেশবিরোধীদের কাছে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকেনা।
তা কারো পছন্দ হোক বা না হোক, এটা ঘটবেই।
জনগণের স্মরণশক্তি খুব কম। তারা আজকের নিপীড়কদের হাত থেকে মুক্তি পেতে গতকালের নিপীড়কদের গলা জড়িয়ে ধরে। এমন ঘটনা আমাদের দেশেই বহুবার ঘটেছে।

ইরান যখন রেজা শাহ পাহলবীদের বাপের তালুক ছিল, তাদের নির্মম সাভাক বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে আপাত অনেক উন্নতি সত্ত্বেও জনগণ কট্টর মোল্লাদের পেছনে গিয়েছিল। অথচ
ইরানের প্রি-ইসলামিক সভ্যতা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি প্রাচীন ও ঐশ্বর্যময়। বাংলাদেশের জনগণ দুর্বৃত্ত দলসমূহের তালৈ- বেয়াই ভানুমতির খেলা দেখা ব্যতীত একবারও খেলাফতি
শাসন দেখে নাই।
তারা অতীতে “চোরের খনি”, “কম্বল চোর” ও “চাটার দলের” কথা শুনেছে কিন্তু কাউকেও শাস্তি পেতে দেখে নাই বলেই ‘বুক-ভরা কলিজা’র সেই পাপিষ্ঠের দঙ্গলের হাতে সপরিবারে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুকে জীবন দিতে হয়েছিল।
এখনও করোনার রিলিফের চাউল চুরি হতে দেখছে কিন্তু পরিস্কার ও দ্ব্যর্থহীনভাবে কাউকে শাস্তি পেতে দেখছে না।
এই যে হাজার হাজার ক্ষুধার্ত মানুষকে শত শত মাইল পথ হাঁটিয়ে ঢাকায় এনে আবার পায়ে হেঁটেই গ্রামে পাঠিয়ে দেয়ার নৃশংস নাটকটি করা হল তার জন্য তো কারো ঠোঁট বা কান কাটা যায় নাই। জনগণের একটি বিরাট অংশ হয়তো ভাবতে শুরু করেছে, আমাদের যদি অতীতের শাসনই দেখতে হয়, তবে ১৪০০ বছর আগের খেলাফত কেন নয়? ইসলামী জামেহারিয়ার দুধের নহর বয়, বেহেশতের মেওয়াও করস্পর্শের কাছে চলে আসে।

সুতরাং যেই জনগণ সারাজীবন দেশপ্রেমিক ও দেশবিরোধী রাজনীতিকদের পায়ে পায়ে ফুটবল, তারা যদি কাউকে বুজুর্গ বা ম্যাজিশিয়ান মনে করে তার জানাজায় গণ-প্লাবনের সৃষ্টি করে তাতে এত গোস্বা করার কী আছে?
আমরাই ( মানে স্বাধীনতার পক্ষের প্রায় ফেরেশতারা ) কি তাদের সেদিকে ঠেলে দেইনি?
অর্ধশতাব্দীর বাংলাদেশে কত বড় বড় জানাজায় তারা গিয়েছে, এখন যদি তারা করোনায় মৃত স্ব স্ব আত্মীয়ের জানাজায় না গিয়ে কোন উল্টা ফেরেশতার জানাজায় লাখে লাখে দাঁড়ায়, তাহলে পরাজয়টা কার?

জনগণ মৃত্যুকে ভয় পায়না, আমরা পাই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লোকজন মৃত্যুভয়কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আমাদের স্বাধীনতার চেতনা, ধর্মনিরপেক্ষ ও লিবেরাল বাংলাদেশকে মাটি দিতে দাঁড়িয়েছে। এই হল তার হুশিয়ারী।আমরা শুধু দুধের সরটুকু দেখলাম, তাদের হাঁড়ির দুধের গভীরতা শিঘ্রই দেখবো।

কোন ক্ষমতাই চিরকাল টিকে থাকেনা। বর্তমানে যারা ক্ষমতার ডুগডুগি বাজাচ্ছে তারাও যেতে বাধ্য হবে। কারা ক্ষমতা কেড়ে নেবে? সম্ভবত এরা, যারা করোনায় মরাকে ক্ষুধায় মরার চেয়ে বড় কিছু মনে করছেনা এবং যারা প্রতিক্রিয়াশীল, এমনকি স্বাধীনতাবিরোধীদের নেতৃত্বাধীন হলেও ইসলামী শাসনে অন্তত বর্তমানের চেয়ে মন্দ কিছু দেখছেনা।

আমাদের ক্ষুধায় মরার ভয় নেই, তাই আমরা করোনার ভয়ে মরছি। আমরা এদের শাসাচ্ছি এবং দাবী করছি যাতে এরা সেলফ কোয়ারেনটাইনে ঘরে বসে থেকে না খেয়ে মরে।

ওরা ঘরে বসে মরলে, আমরা নিরাপদে বাঁচবো!

তাইতো পৃথিবীর বহু দেশের রাষ্ট্রনেতা করোনায় আক্রান্ত হলেও বাংলাদেশের একজনও করোনার ছোঁয়া পায়নি। কেন? কারণ তারা জনগণের কাছে যায়না।
“তুমি যদি ক্ষুধার্ত হও, সেলফ কোয়ারেনটিনে যাও, আমাদের কাছে এসোনা”, এই হলো করোনার কদর্য মুখ।

কিন্তু করোনা হল শক্তিশালী আয়না, আমরা সেই আয়নায় নিজেদের মুখ স্পষ্ট দেখতে পাই।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন