চির বিদায় প্রিয় খালাম্মা
চির বিদায় প্রিয় খালাম্মা

বাসা থেকে আনা লাঞ্চ সেরে ডেস্কে বসে আছি। ঘন্টা খানেকের বিরতি, তাছাড়া শুক্র বার থাকায় কাজের চাপও একটু কম। সমানে কম্পিউটারের স্ক্রীনে আমাদের গ্রামের বাড়ির সামনের শীতকালে সরিষা ক্ষেতের মধ্যে আমার ভাগ্নে আর ভাগ্নির পাশা পাশি ছবি। আর জানালার বাইরে হালকা মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। এই মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখে ভেজা ভেজা মনে হলেও বৃষ্টির আপাতত সম্ভাবনা নেই। এসমস্ত জিনিস শুধু আমার চোখ দিয়েই দেখছি। কিন্তু মনের চোখ গতকাল থেকে চলে গেছে প্রায় ৪০ বছর আগের থেকে তৈরী হয়ে আশা ছোট ছোট কিছু সুন্দর স্মৃতির দিকে। রুপালি পর্দার মুভির দৃশ্যের মতো সেখানে একের পর এক বয়ে চলছে সেই স্মৃতিগুলি। একাধারে মনটা বিষন্ন লাগছে আবার সেই স্মৃতিগুলি দেখতে বা ভাবতে ভালোও লাগছে। তাইতো বিরতির সময়টাকে এই লেখায় নিয়োজিত করলাম, যদি মনটা হালকা হয়।

গত পরশু সকালটা শুরু হয়েছিল স্বাভাবিক ভাবেই, কিন্তু অফিসে বের হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে একটি ফোনকল এসে Priority চেঞ্জ করে দিলো। এক ক্লায়েন্টের কল, তার বাবা মারা গেছে। কিছুটা অসুস্থ, সরকারের সহায়তায় চলা অতি সীমিত আয়ের একটি যুবক। একদিকে আত্মীয় বলতে এক মাত্র বাবা হারানোর ব্যথা, তারপর আবার তার সৎকারের বিশাল চিন্তা মাথায়। যাহোক দিনের সমস্ত কাজ স্থগিত করে দ্রুত চলে গেলাম তার কাছে। আমার কাজ যদিও Breavment কাউন্সেলিং না তথাপি মাঝে মধ্যে এই ধরনের পরিস্থিতিতে সেটা করতে হয়। তাকে সমবেদনা জানিয়ে, তার বাবার সৎকারের ব্যবস্থার জন্য সমস্ত জায়গায় তার সাথে যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়ে দিনের শেষে বাসায় চলে আসলাম।

বাসায় এসে দৈন্দিন কাজ সেরে দিনের ইতি টেনে ঘুমাতে গেলাম। কিন্তু ঘুনাক্ষরেও ভাবি নি যে, আসছে দিনটাতে আমার নিজের জীবনেই একটি Breavement অপেক্ষা করছে।

রীতিমতো অফিসে গেলাম। দুপুরের দিকে একটি ক্লায়েন্টের ইন্টারভিউ সেরে ডেস্কে এসে বসতেই একটি মেসেজের নোটিফিকেশন চমকে দিলো সব। মেসেজটি ছিল আমার বড়ো ভাইয়ের। তার শাশুড়ি, আমার খালাম্মা ইন্তেকাল করেছেন। উনার শাশুড়ি, আমার খালাম্মা এই বেপারটি একটু পরে বলছি। উনি সাম্প্রতিক বেশ অসুস্থ ছিলেন, এবং আমরা মোটামুটি ধরে নিয়েছিলাম উনি আর আমাদের মাঝে বেশি দিন থাকবেন না, কিন্তু তারপরেও যেই মানুষটি তার স্নেহ, ভালোবাসা এবং আন্তরিকতা দিয়ে দীর্ধঘদিন আমাদের আত্মীয় অনাত্মীয় অসংখ মানুষকে সেবা করে গেছেন তার অন্তর্ধানে মন কি আসলে মানে ! বাইরে শরতের মিষ্টি রোদের আলো থাকলেও হটাৎ করে যেন অন্ধকার নেমে এলো।

এই মহীরুহের মতো মানুষটি ছিলেন আমার বাবার চাকরি জীবনের বন্ধুর সহধর্মিনী এবং পর্ববর্তীতে আমার ভাইয়ের শাশুড়ি। আমার ভাইয়ের বিয়ের অনেক অনেক আগের থেকেই উনার সাথে আমাদের পরিচয়। উনাকে তখন থেকেই খালাম্মা বলে ডাকতাম, এবং উনাদের পরিবারের সাথে নতুন সম্পর্ক হলেও উনি আমাদের সেই খালাই রয়ে গেলেন। আমাদেরকে ঠিক তার আপন বোনের ছেলেমেয়ের মতোই দেখে গেছেন আজীবন। এরপর আমার মায়ের মৃত্যুর পরে আমার মায়ের রোল প্লে করে গেছেন জীবনের শেষ পর্যন্ত। উনার এই চলে যাওয়ায় সুখ এবং দুঃখ দুটোই অনুভব করছি। দুঃখ এই কারণে যে এতো কাছের মুরব্বি এবং মাতৃতুল্য তেমন আর কেউ থাকলো না। সুখ অনুভব এই জন্য করছি যে আল্লাহ তালা আমাদেরকে উনার মতো মাতৃস্নেহতুল্য একজন মানুষকে উপহার দিয়েছিলেন। উনাদের মতো মানুষকে প্রতিদান দেওয়ার মতো তো আমাদের ক্ষমতা নেই, শুধু দোআ করা ছাড়া, তাই ভাবলাম আজকের আমার এই অবসরটা উনার স্মৃতি চরণ করেই কাটাই।

কত শত স্মৃতি আছে সেই ৪০ বছর আগের থেকে। আমার মাকে উনি যেমন ভালোবাসতেন, আমার মাও তেমনি উনাকে ভালোবাসতেন এবং সম্মান করতেন। অনেক আগে উনার বাসায় গেলে, উনার ছেলেমেদের সাথে সকালে চুলার চারিদিকে গোল হয়ে বসতাম। গরম গরম রুটি তৈরী করে দিবে আর আমরা সেগুলি হৈচৈ করে খাবো। চিল্লা চেল্লিও করতাম, বকা খেতাম। কখনো মশারি না টানিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি, হটাৎ করে কারো স্পর্শে ঘুম ভেঙে দেখতাম উনি এসে মশারি টাঙইয়ে দিসছেন। প্রাই তৎকালীন উনাদের বৈঠকখানায় দেখতাম বাইরের কেউ খাসছেন। জিজ্ঞেস করে জানা যেত, হয়তোবা আসে পাশের বাড়ির অথবা বাজারের কারোর ছেলে বাড়ী থেকে রাগ করে এসেছে, সারাদিন খাইনি তাকে খাওয়াসছেন, অথবা হয়তবা উনার ছেলেমেয়ের বা আমাদে কোনো বন্ধু বান্ধব যশোর হয়ে বেনাপোল যাওয়ার পথে যাত্রা বিরতি করেছে, তাদেরকে খাওয়াসছেন।

এলাকার কারো পারিবারিক সমস্যা, নানী, দাদি, চাচী, ভাবি বলে তার কাছে আসছেন সমাধান চাইতে। উল্লেখ আমার বড়ো ভাই, অর্থাৎ উনার জামাই বিয়ের আগে আমার বাবার ওই জায়গা থেকে অন্যত্র পোস্টিং হওয়ার পরে উনাদের বাসায় থেকেই ssc পরীক্ষা দেন। শুধু আমার ভাই না, এমনি অনেক অনেক ছেলেমেয়েই আছে যাদের জীবনের কোনো না কোনো অংশ কেটেছে উনার বাসায় থেকে। উনার এলাকার প্রশাসন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের, সকলের উনি শ্রদ্ধার এবং প্রিয়পাত্র ছিলেন। হয়তো প্রতিবেশীর কারোর small pox এর মতো ছোয়াচে অসুখ হয়েছে কেউ সেখানে জাস্ছে না, উনি খাবার নিয়ে চলে গেলেন। শুধু আমরাই না, আমাদের আত্মীয় স্বজনকেও উনি খুব ভালো চোখে দেখতেন, সে জন্য  আমাদের গ্রামের বাড়িরই লোকজনও  উনাকে চিনতেন।

একেবারে ছোট বেলা থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত উনার বাসা ত্যাগ করার সময় আমরা লাইন ধরে দাঁড়াতাম আমাদের মাথায় উনার দোয়াজড়িত ফুঁ নেওয়ার জন্য। উনার ছেলেমেয়ে সহ যেই উনার বাসায় গেছেন তাদের আমার এই লেখায় সেটি মনে পড়বে। এই ফুঁ নেওয়ার লাইন আর পড়বে না। হয়তোবা শীতের দুপুরে কেবল গোসল সেরে উনাদের উঠানে বসে আছি, হটাৎ পিছন থেকে এসে মাথায় তেল লাগিয়ে বলতে থাকলেন, “পোলাপান মাথায় তেল না নেওয়ার কি ফ্যাশন পাইছে”। আমরা নিজেও যেমন অনেক ভাইবোন ছিলাম, উনারও অনেক ছেলেমেয়ে ছিল তাই খাওয়ার সময় বিরাট হৈচৈ হতো, আর প্রায় তখন উনি বকা দিতেন। উনাদের বাড়ি এখন হিন্দি মুভির আলিশান ম্যানশনের মতো কিন্তু আমার এখনো মনে পড়ে সেই আগের ছোট খাটো রান্না ঘর এবং সেই ঘরে সবাই মাইল খাওয়া দাওয়ার কথা। জীবনে কি পেলাম বা না পেলাম সেটার থেকে বড়ো সন্তুষ্টির বেপার এই যে আমাদের জীবনে ওই সময়গুলি ছিল। সেজন্য আল্লাহতালার কাছে অনেক শুকরিয়া।

আমি ছোট বেলায় মাছের কাটা খেতে পছন্দ করতাম না, কিন্তু উনিই আমাকে শিখিয়ে ছিলেন মাছের মাথা খাওয়ার। আমাদের খালুজানের আমার মায়ের মতো বড়ো জিনিসের আকর্ষণ ছিল তাই বাজারে সমস্ত জেলেদের তার বলা থাকতো যেই বড়ো মাছ ধরুক সেটি যেন তার বাসায় দিয়ে দেওয়া হয়। আর প্রায়ই সেই মাথা আমাকে খেতে হতো। মাছ আমার ভাগে পড়লো আর নাইবা পড়লো সে কায়দা করে আমার প্লেটে মাথাটি দিবেনই। তাছাড়া যখন উনার বাসা থেকে চলে আসতাম তখন মাঝে মধ্যেই হাতের মধ্যে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বলতেন পথে যেন হাবিজাবি না খেয়ে ভালো কিছু কিনে খাই। ওই বাসায় গেলে খুব কম সময়ই প্ল্যান করা সময়ের মধ্যে ফিরে আসতে পেরেছি। “ব্যাডা আর কয়ডা দিন থাইকা যা, আবার কবে আইবি। যখন থাকমু না তখন কেউঁই আর কইবো না। ” বলতাম আপনি না থাকলে হয়তো আর আশাও হবে না।

আমার মা মৃত্যুর পর আমার বেশ ক্রাইসিস ছিল তখন উনি আমাকে অনেক সমবেদনা এবং সহানুভূতি দিয়েছেন। আমরা দুই ভাই বিদেশে আসার পর দেশে উনিই আমাদের বোনদের খবরাখবর নিতেন। এবং যখনই কথা হতো ওদের প্রতি আদর যত্ন বা দায় দায়িত্বের কথা বলতেন। আমি প্রায় ২৪/২৫ বছর আগে ফিনল্যান্ডে পড়াশুনা করতে আসার সময় আমার বাবার মতো উনিও কানে কানে বলেছিলেন, “ব্যাডা যেই কামে যাইতেছ হেই কামডা যেন কইরো ” . আর উনার এবং বাবা মার দোয়ার কারণেই উনাদের সে কথা আমি রাখতে পেরেছিলাম। আমার মা একবার হাঁসের বাচ্চার কথা বলেছিলেন।  আর কি, মা বলেছেন, যে করেই হোক সেটা তাকে ম্যানেজ করতেই হবে। তিনি ঠিকই হাঁসের বাচ্চা জোগাড় করলেন এবং আমাকে বললেন সেটা শার্শা থেকে গোপালগঞ্জ নিয়ে যেতে হবে।  আমি তো নাছোড় বান্দা, ওই টিন-এজ বয়োসে বাসের মদ্ধ্যে কতগুলি হাসের বচ্চা নিয়ে আমাকে এতটা পথ যেতে হবে। যাহোক, উনি বললেন; যা অনেক দোআ দিমুনে, খালার কাছে থেকে নিয়ে জাবি মায়ের কাছে; তোর অনেক ভালো হবে। অবশেষে নিয়ে গিয়েছিলাম। এই ধরনের অনেক অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে। একেবারে শেষ সময়েও উনার কাছে গেলে, তার ছেলেবৌদেরকে সব সময় বলতেন আমাদের প্রতি যেন কোনো আদর যত্নের কমতি না হয়।

তার সাথে আমার আরো একটি বিশেষ সম্পর্ক ছিল। উনি একবার, সম্ভবত ৯২/৯৩ সালের দিকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন।  তাকে ডাক্তারের নির্দেশে যশোর থেকে প্লেনে করে ঢাকায় আনা হলো। তার অনেক ব্লিডিং হসচ্ছিলো, তাই দ্রুত সার্জারির দরকার ছিল। রোজা থাকায় ব্লাড ব্যাংকে বেশি রক্ত ছিল না, আর যাই বা ছিল সেটাও ক্রস ম্যাচিং হসছিলো না।  এমনকি উনার ছেলেমেয়ে কারোর সাথে মিলছিলো না। আমি ঠিক সেদিন নাইট কোচে করে ঢাকাতে গেছি। তখন আমি নিজের রক্তর গ্রূপ কি তাও জানিনা।  উনার সেজো ছেলে, আমাদের প্রিয় পল্টু ভাইকে আমি বললাম ভাই আমি আমার ব্লাড চেক করতে চাই, উনি ধমক দিয়ে বললেন, রাখ আমাদের মিললো না আর তোর।  তাছাড়া আমি তো শুকনা একটা লোক, তাই উনি চাসছিলেন না। যাহোক শেষে দুজন গেলাম সন্ধানীতে। চেকিং এর পর দেখা গেলো, শুধু রক্তের গুরুপেরই মিল হলো না, ক্রস মাচিংও ঠিক হলো।  আমি সঙ্গে সঙ্গে রক্ত দিয়ে, সেগুলি নিয়ে চলে গেলাম।  তাৎক্ষণিক উনার অপারেশন হলো এবং উনি আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে গেলেন। এর পর উনার শরীরে উপর দিয়ে আরো অনেক অনেক ঝামেলা গেছে কিন্তু উনার প্রচন্ড মনোবল নিয়ে উনি টিকে গেলেন গত কাল অবধি। রক্ত আমি আরো ২ বার দিয়েছি দেশে এবং বিদেশে, কিন্তু আমি জানি না সেটি কার কাছে গেছে, কিন্তু এক্ষেত্রে যেহেতু জানতাম তাই কেন যেন একটি টান অনুভব করি, আর আজকে বার বার মনে হসছে, সে টান বোধ হয় ছিড়ে গেলো।

আমি বার বার যে কথাটি বলি যে, আমি যদি কখনো homeless বা penniless হয়েও যাই তারপরেও আমি আমাকে অনেক ধনী মনে কোরবো কারণ আমার জীবনে আমার বাবা মা সহ উনাদের মতো কিছু মানুষ ছিল এবং তাদের সাথে আমার কিছু মধুর স্মৃতি ছিল। আমার ব্রেনের স্মৃতি ধরণের ঘরটি যতদিন অটুট থাকবে ততদিন থাকবে ওই স্মৃতিগুলি। আর সেগুলি নিয়েই কেটে যাবে জীবনের বাকি দিনগুলি। এগুলি অমূল্য সম্পদ যা কি না অর্থ দিয়ে মাপা যায় না।

উনার কথা ভাবতে ভাবতে আজকে যখন গাড়ি চালিয়ে অফিসে আসছিলাম তখন কেন যেন বারে বারে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ” আমিও পথের মতো হারিয়ে যাবো, আমিও নদীর মতো আসবোনা ফিরে আর আসবোনা ফিরে কোনোদিন” .

আমার কেন যেন খালাম্মার কণ্ঠের ক্ষীণ আওয়াজে শুনতে পাসছিলাম, “চোখের আলো নিভলো যখন, মনের আলো জেলে; একলা এসেছিলাম  আমি একলা গেলাম চলে, তোমাদের সবাইকে ফেলে। ”

আজকের এই দিনে আমি আপনাদের কাছে আমার খালাম্মার জন্য দোআ চাসছি যাতে আল্লাহতালা যেন তাকে জান্নাতবাসি করেন, এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জন্যেও দোয়া করবেন যাতে করে আমরা যেন উনিসহ আমাদের বাবামায়ের জন্য প্রতিনিয়ত দোআ করতে পারি এবং উনাদের slefless এবং caring আদর্শকে উজ্জীবিত রাখতে পারি।  নিচের লিংকে হেমন্তের সেই প্রিয় গানটি দেওয়া হলো। গানটি কারো মন ভারী করার জন্য নয়, গানের মধ্যে দিয়ে চিরন্তন সত্যটাকে নিজেদেরকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য। “একা এছেছিলাম, এক যেতে হবে এই ক্ষনিকের পৃথিবীর যাত্রা পৃথিবী থেকে।”

With heavy heart .

মুকুল

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন