নিউ ইয়র্ক থেকে:-

মেঘ আর কুয়াশায় ঢাকা ঘুমন্ত দার্জিলিং!

sinha11b

জলপাইগুড়ি থেকে কুয়ের সং পর্যন্ত রাস্তা খুব একটা সুবিধের নয়। তবে এর পরের রাস্তা মোটামুটি ভাল।পাহাড়ি রাস্তা, সাপের মত একেবেকে গিয়েছে,তার উপর রয়েছে কুয়াশা। গাড়ী যতই দার্জিলিংয়ের দিকে এগোচ্ছে, রাস্তার উচ্চতা ততই বাড়ছে। সেই সাথে সাথে বাড়ছে কুয়াসা আর মেঘের খেলা। এক সময় দেখলাম, আমাদের গাড়ীর পাশাপাশি যাচ্ছে, দার্জিলিং টয় ট্রেন। ছোটখাটো মাত্র কয়েকটি বগির ট্রেন। ষ্টীম ইঞ্জিন চালিত!

গাড়ী চলছে- আমরা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দু’পাশের দৃশ্য দেখছি। আমাদের একপাশে পাহাড় অন্যপাশে গভীর খাদ। খাদের দিকে তাকালেই ভয় হয়, ওখানে কোন কারণে গাড়ী পড়ে গেলে নির্ঘাত মরন।উদ্ধারকারীদেরও পৌঁছাতে বেগ পেতে হবে।

ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম- ‘এখানে এক্সিডেন্ট হয় কেমন ?
ড্রাইভার বললো,’বৃসটি-বাদলার দিনে একটু ঝামেলা হয়।রাস্তা-ঘাঠ পিচ্ছিল হয়ে যায়।তার উপরে মাঝে মাঝে আসে পাহাডী ধ্বস!তবে এক্সিডেন্ট খুব একটা হয় না!গত বছর হয়েছিল একটা!কি জানেন বাবু,ভগবানই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যান’।
আমি বললাম- ‘তাতো অবশ্যই’।
আমি এখানকার ড্রাইভারদের উপর ভীষণ ইমপ্রেসড। তবুও মনের ভেতর কিঞ্চিত শংকাও হলো।

দ্বিধা ও শংকা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, সেই মুহুর্তেই আমাদের ট্যাক্সি থেকে ১০-১৫ গজ দূরেই দেখলাম এক ঝাঁক মেঘ, উড়ে আসছে আমাদের দিকেই। আমি চট করে গাড়ীর জানালা খুলে ফেললাম।মেঘ ঢুকে পড়লো এপাশের জানালা দিয়ে। শরতের পেঁজা তুলোর মতে মেঘ, আমাদেরকে হালকাভাবে ভিজিয়ে দিয়ে ওপাশের জানালা দিয়ে বেড়িয়ে গেল। আমরা রীতিমতো রোমাঞ্চিত, উত্তেজিত ও মুগ্ধ! এতকাল আকাশে ছেড়া ছেড়া মেঘ দেখেছি, ওরা ছিল স্পর্শের বাইরে, অধরা!আজ একেবারে ধরে দেখলাম। চোখে মুখে হিমশীতল এক অনুভূতি!

ড্রাইভার জানালো আমরা এখন সমুদ্র পৃসঠ থেকে পাঁচ হাজার ফিট উপরে।আরো উপরে উঠবো।সাপের মতো আঁকাবাঁকা পথে এগিয়ে যাচছে গাড়ী।দূর থেকে দেখলাম একটি পাহাডী ঝরনা।গাডীটা ঘুরতে ঘুরতে ওই ঝরনা পাশ দিতেই যাচছিলো।ড্রাইভারকে অনুরোধ করলাম গাড়ী থামাতে।ড্রাইভার যথারীতি গাড়ী থামালো।আমরা গাড়ী থেকে নামলাম।রাস্তা থেকে পা হেটে এগিয়ে গেলাম ঝরনার একেবারে কাছে।বিশাল দু’টো পাহাডী রক। ওই রকের ফাঁক দিতেই বেরিয়ে এসেছে এই ঝরনার।আমরা রকের পাদদেশে হাঁটু গেরে বসলাম।ঝরনার জল হাত দিলাম!ছডিয়ে দিলাম ওই জল আমাদের চোখে ও মুখে।কি স্বচ্ছ আর পরিচ্ছন্ন সেই জল!

আমি দৌড়ে গাডীতে ফিরে এলাম।ওখান থেকে ফ্লাস্ক ভর্তি চা আর বিস্কিট নিয়ে ফিরলাম ঝরনার পাশে।এবার ড্রাইভারকেও নিয়ে এসেছি।তিনজনে মিলে ঝরনার পাশে বসে হলো আমাদের ‘চা-চক্র’!

চা-চক্রের পর আবার পথচলা!সমুদ্র পৃসঠ থেকে গাড়ীর উচ্চতা আরো বেডেছে!

আমরা যখন দার্জিলিং শহরে ঢুকলাম তখন দুটো বেজে গেছে। তবে বাইরে তাকালে মনে হবে কিছুক্ষণ আগে ভোর হয়েছে। আকাশে সূর্য্য নেই, আছে মেঘ। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘেরা ভেসে বেড়াচ্ছে। কিছু কিছু মেঘ থেমে আছে পাহাড়ের গায়ে গা লাগিয়ে, কিছু কিছু মেঘ দৌড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে পাহাড়গুলোকে পাশ কাটিয়ে। এখানে সেখানে জমে আছে হালকা কুয়াশা। চারপাশে একটা সাধুতা ও মৌনতা দুইই আছে!আমরা উঠে পডলাম একটা হোটেলে।ওখানে দুপুরের খাবার খেয়েই ছোটখাটো একটা ঘুম!

ঘুম ভাংগলো সন্ধ্যের একটু পরে! মেঘ কেঁটে গেছে। আকাশে তারা দেখা যাচ্ছে, জম্পেশ একখানা চাঁদও। আমরা বসে আছি আমাদের রুমের বেলকনিতে। হাতে ধূমায়িত ‘দার্জিলিং টি’! সঙ্গে রয়েছে গরম গরম সিঙ্গারা। এখানকার চা উৎকৃষ্ট মানের,এই চা কে বলা হয় ‘শ্যাম্পেন অফ দি টি’।

‘শ্যাম্পেন অফ দি টি’তে চুমুক দিতেই দরজায় টোকা পডলো।দরজা খুলে দেখি আমাদের হোটেলের ম্যানেজার।ম্যানেজারকে আমন্ত্রন জানালাম আমাদের সাথে চা-চক্রে।ম্যানেজার রাজি হলেন সানন্দে।আসলে আমরা যেখানে উঠেছি ওটা কোন কমারশিয়াল হোটেল নয়!এটা একটা মনোরম বাডী।সাজানো গোছানো।বাড়ীর মালিক থাকেন কলকাতায়।বছরের একটা মাস তিনি পরিবার পরিজনসহ এখানে এসে ছুটি কাটান।বাকী এগারো মাস বাড়িটি পর্যটকদের কাছে ভাডা দেওয়া হয়।বাডীতে ম্যানেজার,বাবুরচী ও দেখাশুনার করার লোক রয়েছেন বেশ কয়েকজন।আমাদের ড্রাইভার ভক্তরাজই আমাদেরকে এই বাডীতে নিয়ে এসেছে।বাড়ীটি মনোরম ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন।পারিপারশিক দৃশ্যাবলীও খুব সুন্দর।তাই আমরা উঠে পডলাম এখানেই!

বাড়ীর কিছু নিয়ম আছে।প্রতি রাতে আমাদের কাছে বাবুরচী আসেন। জানতে চান পরদিন সকালের নাস্তার ম্যানু।দুপুরের ও রাতের খাবারের ম্যানু।ভেজেটেরিয়ান ও নন-ভেজেটেরিয়ান দু’ধরনের ম্যানুই আছে।শুধু বললেই হবে এটা এটা খাবো।বাকীটা বাবুরচীর কাজ।

আমাদের ম্যানেজার এর নাম পৃথীরাজ সাহা।ওর জন্ম দার্জিলিং।বেডে উঠাও এই দার্জিলিংয়েই।জীবনে কোনদিন দার্জিলিংয়ের বাইরে যাননি।এমনকি কোলকাতাও নয়!এটা যখন শুনলাম ওখন পৃথীরাজ সাহাকে জিজ্ঞেস করলাম,’দার্জিলিংয়ের বাইরে কোথাও যান নি কেন’?
পৃথীরাজ সাহা বললেন,’কি জানেন দাদা,ভগবান তৈরি করেছেন আমাদের এই গ্রাম।দার্জিলিং তার নাম!এর আলো-বাতাসেই বেডে উঠেছি।কখনো হেসেছি,কখনো কেঁদেছি!কোলকাতা তো মানুষের তৈরি শহর।শহরে গেলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে’!

আমি বললাম,’আপনি তো কখনো কোলকোতায় যান নি!না গিয়ে কিভাবে বুজলেন যে ওখানে গেলে দম বন্ধ হয়ে যাবে’?
পৃথীরাজ বললেন,’একবার জলপাইগুড়ি গিয়েছিলাম দু’দিনের জন্যে।ওখানেও ওরা দিব্যি শহর বানিয়ে ফেলেছে। আমার ভাল লাগেনি।একদিন বাদেই চলে এসেছি’!

আমি মনে মনে বললাম ‘মানুষ যে কত বিচিত্র ধরনের হয়’!

সিনহা মনসুর
চলবে… …

১ মন্তব্য

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন