নিউ ইয়র্ক থেকে:-

প্রবেশ নিষেধ!
কাঠমুন্ডু আসা অবধি শুনে আসছি ‘পশুপতিনাথ’ মন্দিরের কথা। হোটেলের ম্যানেজার বলেছে, গতকাল ট্যাক্সি ড্রাইভার কাম গাইডও বললো। তাই মনস্থ করছি আজ যাবো ‘পশুপতিনাথ’!monsur2c

হিন্দু ধর্মালম্বীরা বিশ্বাস করেন ভগবান শিব এর অনেক গুলো রূপ। এই অনেকগুলো রূপের মধ্যে এক রূপে তিনি ‘পশুপতিনাথ’। অর্থ্যাৎ ‘Lord of the animal’!

এই মন্দির সম্পর্কে প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনী রয়েছে। প্রচলিত আছে যে, একবার শিব ও পার্বতী কাঠমুনডুর বাগমতী নতীর তীরে ভ্রমণ করতে এসেছিলেন। নদী তীরবর্তী উপত্যকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুদ্ধ হয়ে দুজনেই হরিণের বেশ ধরে ওই এলাকায় ঘুড়ে বেড়াতে থাকেন । এ নিয়ে দেবতারা পড়লেন মহাফাঁপরে। অনেক কষ্টে শিবকে খুঁজে পেলেও দেবাদি দেব শিব এই স্থান থেকে যেতে নারাজ।

শিব হরিণের বেশে ঘুড়েছেন, তাই পশুদের অধিকর্তা হিসাবে তিনি পরিচিত লাভ করলেন!তারপর থেকেই এখানে শিবকে পশুপতিনাথ হিসেবে পূজা করা হয়ে আসছে। এই মন্দির কবে প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সে সম্পর্কে কোনও সঠিক তথ্য পাওয়া যায় নি। তবে ইতিহাসবিদদের মতে চতুর্থ শতাব্দী থেকেই এই জায়গায় মন্দিরটির অস্তিত্ব ছিল।

আমরা দাঁড়িয়ে আছি বাগমতী নদীর এপারে। নদীর ওপারেই পশুপতিনাথ মন্দির । নদী খুব বেশী চওড়া নয়।তবে খরস্রোতা।এপার আর ওপারকে সংযুক্ত করেছে একটি সেতু। ইচ্ছে হলেও এই সেতুর ওপারে যাওয়া যাবে না! মন্দিরের ভেতরে ঢোকা যাবে না! হিন্দুধর্মালম্বী ছাড়া অন্য কারোরই এই মন্দিরে ঢোকার অনুমতি নেই।

তাই দূর থেকে আমরা মন্দিরটি অবলোকন করলাম।প্যাগোডা রীতিতে তৈরী এই পশুপতিনাথ মন্দিরটি চারকোনা। কাঠের কারুকার্য ও কৌণিক গঠন সব কিছুতেই নেপালের ঐতিহ্য ও স্থাপত্যের ছোঁয়া। মন্দিরটির সারা গায়ে সোনা ও রূপার কারুকাজ রয়েছে। হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তি খোদাই করা আছে মন্দিরের দেওয়ালের সর্বত্র।

দুস্তর বিশিষ্ট ছাদ তামার তৈরি । তার উপর সোনার প্রলেপ দেওয়া আছে। মন্দিরটির প্রধান দরজা চারটি। প্রতিটি দরজাই রূপা দিয়ে মোড়া। প্রত্যেকটি দরজার পাশে সোনা দিয়ে বিভিন্ন দেবতাদের মূর্তি খোদাই করা আছে। মন্দিরের এক পবিত্র কক্ষে রয়েছে কালো পাথরের তৈরি ছয় ফুট দীর্ঘ শিবলিঙ্গ।যার চারটি মুখ আছে। সেই চারমুখগুলি হল বিষ্ণু, সূর্য, পার্বতী ও গণেশ। মন্দিরের চূড়া সোনা দিয়ে মোড়া। পশ্চিমের এক দরজার সামনে একটি বিশাল ষাঁড়ের মূর্তি রাখা আছে। যার নাম নন্দী। মুর্তিটি ব্রোঞ্জের তৈরি। তাতে সোনার প্রলেপ দেওয়া আছে। মন্দিরের ছাদের নিচের দিকে হিন্দু দেব-দেবীদের নানান মূর্তি রয়েছে। যেমন, শিব-পার্বতী, গণেশ, কার্তিক ও যোগিনীদের মূর্তি। এছাড়া রামায়ণ, পুরাণের বিভিন্ন কাহিনী- চিত্র এখানে খোদাই করা রয়েছে!

দূর থেকে আরো দেখলাম, যত্র তত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য বানর। সুযোগ পেলেই ওরা কেড়ে নিচ্ছে মানুষের হাতের খাবার, লাফাতে লাফাতে কখনো ঢুকে পড়ছে মন্দিরের ভেতর, আবার কখনো বা লাফিয়ে চলে যাচ্ছে এক বিল্ডিং থেকে আরেক বিল্ডিং। বানরগুলো মন্দিরে ঢুকে পড়ছে, কেউ ওদের বাধা দিচ্ছে না। বোধহয় ওদের ঢোকার অনুমতি আছে, ওদেরতো আর জাতবালাই নেই!জাতবালাই যা আছে তাতো শুধুই মানুষের!

নিজের চোখে দেখিনি কখনো তবে লোকমুখে শুনেছি, পবিত্র মক্কায় ও নাকি একই নিয়ম! বিধর্মীদের প্রবেশ নিষেধ। কেন? এই কেনর উত্তর আমার জানা নেই। আমাদের বিদ্রোহী কবি বহু আগেই এর উত্তর দিতে চেয়ে বলেছিলেন- ‘ধর্ম-আনেনি কো মানুষ, মানুষ এনেছে ধর্ম!’

পশুপতিনাথ মন্দিরে রয়েছে আরো কঠিন কিছু নিয়ম-কানুন, এই মন্দিরে মোট পুরোহিত চারজন। সবাই সাউথ ইন্ডিয়ান। এই চার পুরোহিত ছাড়া আর কারো অধিকার নেই শিবমূর্তি স্পর্শ করার। বহু শতাব্দী ধরেই চলে এসেছে এই নিয়ম।

monsur2b

বাগমতী নদীর তীরে আরো দেখলাম সারি সারি চিতার বেদী। আরেক পাশে দেখলাম সারি সারি ছোট ছোট মন্দির। চিতার উপরের তৈরি করা হয়েছে ওই মন্দিরগুলো।তাই ওগুলোর নাম ‘চৈতা মন্দির’! ‘চৈতা মন্দির’-এ সম্ভ্রান্ত পরিবার ও রাজ পরিবারের মৃতদের দাহ করা হয়!

চিতার বেদী ও ‘চৈতা মন্দির’ দু’জায়গাতেই দাহ করা হচছে! আমি কখনো শ্মশানঘাট দেখিনি।আজ দেখলাম খুব কাছ থেকে। অনেকগুলো চিতা তৈরি করা হয়েছে। কোনটা জ্বলছে, কোনটাতে কেবল আগুন দেয়া হয়েছে,কোনটা একেবারে নূতন!

পুরোহিত মন্ত্র পড়ে যাচ্ছেন!চিতার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে!কোনোটা থেকে ধোঁয়া উঠছে,কোনোটা থেকে মাথার খুলি ফেটে যাওয়ার শব্দ আসছে। এইসব শব্দ ছাপিয়ে কখনো কখনো কানে আসছে পিতাহারা সন্তানের কান্না। সন্তান হারা পিতার কান্না। অথবা স্বামী হারা স্ত্রীর কান্না! সন্তান চিতায় আগুন দিচ্ছেন।আবার আগুন দিচ্ছেন বাবাও!

বাগমতী নদীর তীরে ওই শ্মশানঘাটে দাডিয়ে আমার মনে পডলো সেই গান:

‘এই তো জীবন
হিংসা বিবাদ লোভ ক্ষোভ বিদ্বেষ
চিতাতেই সব শেষ
হায় চিতাতেই সব শেষ
এই তো জীবন!

কেন দিসরে চুমুক তবে বিষয়ের বিষে
সবই তো ধুলোয় যাবে মিশে
থাকবেনা গায়ে তোর
ঝলমলে দামী ওই বেশ
চিতাতেই সব শেষ
হায় চিতাতেই সব শেষ
এই তো জীবন’!

আমরা যখন গাডীতে ফিরলাম ততক্ষনে সূর্যটা কিছুটা হেলে পডেছে পশ্চিমে।গাড়ী চলছে পাহাডী রাস্তায়।দুপাশে বন-বনানী আর গাছ-গাছালী। ওই গাছ-গাছালীর ফাঁক-ফোকর দিয়ে সূর্যের আলো এসে পডছে আমাদের চোখে ও মুখে।সূর্যের সাথে চলছে আমাদের লুকোচুরি!আমরা কেউই কোন কথা বলছি না।

monsur2a

শেষ বিকেলের ওই নরম আলোতে মা তাকালেন আমার দিকে।নীরবতা ভংগ করে মা বললেন,’শ্মশানঘাটে কাঁদছিলি কেন’?
আমি বললাম,’কাঁদলাম কই,মনে হয় চোখে ধূলো পডেছিলো’!
মা বললেন,’শীতকালে ধূলো আসবে কোথা থেকে’?
আমি বললাম,’দু:সময়ের ধূলো তো, ওর আবার শীত-বসন্ত কি’!

পড়ন্ত বেলায় আঁকাবাঁকা পাহাডী পথে এগিয়ে চললো আমাদের গাড়ী।সাথে সাথে আমাদের নীরবতাও!

চলবে… … …

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন