নিউ ইয়র্ক থেকে:-

হিমালয়ান ইনষ্টিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিংও হিটলার এর টেলিস্কোপ!

sinha13b

সকাল এগারটা নাগাদ আমরা এলাম বার্চ হিলে। বার্চহিল সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৬৮০০ ফিট উপরে। এখানে রয়েছে ‘হিমালয়ান ইনষ্টিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং।’ পন্ডিত জওহার লাল নেহেরু ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় এই ইনষ্টিটিউট গড়ে তোলেন ১৯৫৪ সালে। এর প্রথম ফিল্ড ডিরেক্টর ছিলেন এভারেস্ট বিজয়ী বিখ্যাত পর্বতারোহী তেনজিং শেরপা।
তেনজিং শেরপার জন্ম তিব্বতে, বেড়ে উঠেছেন নেপালে আর জীবনের বেশীর ভাগ সময় কাটিয়েছেন ভারতে।

আমরা এখন দাডিয়ে আছি হিমালয়ান ইনষ্টিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং-এর দোর গোড়ায়।বিশাল হলুদ রংয়ের বিল্ডিং।ওই বিল্ডিং-এ দেয়ালে খোদাই করা একজন পর্বত আরোহীর ছবি।তার নিচেই বড বড করে লেখা,’May you climb from peak to peak’!

১৯৫৪ সালের ৪ নভেম্বর ভারতের তৎকালিন প্রধান মন্ত্রী জওহারলাল নেহেরু এই বিল্ডিং-এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।বিল্ডিং-এর উপরে দেখলাম লমবালমবিভাবে অনেকগুলো দড়ির ঝোলানো।

আমাদের গাইডকে জিজ্ঞেস করলাম,’ওগুলো কি’?
গাইড বললেন,’পর্বত আরোহী যখন পর্বতে যান তখন দডি দিয়ে তারা বিভিন্ন ধরনের ‘Knot’ তৈরি করেন।ওগুলো তাদের ঝুলে থাকতে এবং এক উপত্যকা থেকে অন্য উপত্যকায় যেতে সাহায্য করে।হিমালয় এক্সপিডিশনে পর্বত আরোহীরা যে ধরনের ‘Knot’গুলো ব্যবহার করেছেন এখানে তারই কিছু নমুনা দেখানো হয়েছে।

এর পরে গাইড আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ‘Waterman Knot’, ‘Overhand Knot’ এবং ‘Triple Bowline on the Bight knot’ এর সাথে!

হিমালয়ান ইনষ্টিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং-এর প্রধান তিনটি শাখা:
ট্রেনিং উইং,অ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ উইং এবং মিউজিয়াম।ট্রেনিং উইং-এ রয়েছে পর্বত আরোহণের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা। এখানে শুধু ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীরাই অধ্যয়ন করেন না। এখানে ট্রেনিং নিতে আসেন বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীরাও! পর্বতবিদ্যার কলাকৌশল এর উপরে এখানে বেসিক ও এ্যাডভানস ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিবছর এখানে ষোলটি স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি কোর্সের প্রশিক্ষন দেয়া হয়।

এ্যাডমিন বিল্ডিং খেকে পায়ে হেটে আমরা এলাম মিউজিয়ামে। মিউজিয়ামের দুটো পার্ট।মূল মিউজিয়ামে একতলায়। দোতালায় আছে ‘Mount Everest & Mount Makalu Museum’! এটা হচছে মাউন্টেইনিয়ারিং-এর উপর ভারতের সবচেয়ে পুরোনো মিউজিয়াম।

মূল মিউজিয়ামোর প্রবেশ পথেই রয়েছে প্রধান মন্ত্রী জওহারলাল নেহেরু, পশ্চিম বংগের মূখ্য মন্ত্রী হরেন মুখার্জি,বিধান চন্দ্র রায় এবং এভারেস্ট জয়ী তেনজিং-এর ছবি।

সামনে এগুলোই চোখে পডলো হিমালয়ের বিশাল মডেল।ওখানে দেখানো হয়েছে হিমালয়ের সব বড বড চূডোগুলো।একটু আগাতেই চোখে পডলো হিমালয় আরোহীদের সব ব্যবহার্য জিনিসপত্র।এই তালিকায় আছে স্নো এক্স ,হাতুডীও লনঠন,ওয়্যারলেস,গ্যাস ল্যাম্প ও অক্সিজেন সিলিনডার।

মিউজিয়ামে দেখলাম হিমালয়ের দূর্লভ কিছু চিত্র, দালাইলামার সংরক্ষিত চিঠি আর হিটলারের টেলিস্কোপ! এই টেলিস্কোপ দিয়ে তারা দেখা যায়, দেখা যায় হিমালয়ের বিভিন্ন খানাখন্দ ও পাহাড়ী উপত্যকা।নেপালের কমান্ডার-ইন-চিফ মহারাজা জুড সমসের জং বাহাদুরকে একটি টেলিস্কোপ উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন হিটলার। পরবর্তীতে এই টেলিস্কোপের মালিক হন তার পুত্র জেনারেল সমসের জং বাহাদুর রানা। ১৯৬১ সালে জেনারেল সমসের জং বাহাদুর রানাএই টেলিস্কোপটি হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনষ্টিটিউটে উপহার হিসেবে পাঠান। তখন থেকে এই টেলিস্কোপটি এখানেই আছে।

খালি চোখে বিশাল এই পৃথিবীকে খুবই ছোট করে দেখেছিলেন হিটলার, নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন একেবারে তার হাতের মুঠোয়। আজ তারই দেয়া টেলিস্কোপে ছোট ছোট পাহাড় আর বনভূমিকে বিশাল করে দেখছি আমরা। কি অদ্ভুদ বৈপীরত্য!

কুসাং শেরপা!
হাঁটতে হাঁটতে আমরা চলে এলাম বিশাল একটা রুমে। এই রুমের দেয়ালে টানানো রয়েছে অসংখ্য ছবি। এই ছবির মানুষগুলো একেক সময় এভারেষ্ট জয় করেছেন। ইন্ডিয়ান আর্মি ও এয়ারফোর্স এর কিছু কিছু অফিসারের ছবিও দেখলাম দেয়ালে টানানো আছে। এরা বিভিন্ন সময়ে এই ট্রেনিং ইনষ্টিটিউটে থেকে পর্বত আরোহনের উপর উচ্চতর ট্রেনিং নিয়েছেন এবং হিমালয়ের বিভিন্ন এক্সপিডিশনে অংশ নিয়েছেন। ঘুরতে ঘুরতে আমরা একটি ছবির সামনে এসে দাঁড়ালাম।

আমাদের গাইড বললেন ‘এই ছবিটি হচ্ছে কুসাং শেরপা’র।কুসাং শেরপা ছিলেন এই ইনষ্টিটিউটের একজন ট্রেইনার। পরবর্তীতে তিনি পাঁচ বার হিমালয় জয় করে বিশ্ব রেকর্ড তৈরি করেছিলেন।’
আমি বললাম ‘টু থামস আপ টু কুসাং শেরপা’!
উপস্থিত পর্যটকেরা সমস্বরে বলে উঠলেন- ‘উই ডু দ্যা সেইম।’

সনতু লারমা!
কথা বলতে বলতেই দৃশ্যপটই এলেন সনতু লারমা।সনতু লারমা এই ইনষ্টিটিউটের একজন ট্রেইনার।তিনি বিনীতভাবে আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন পর্বত আরোহনের উপর আমাদের কোন প্রশ্ন আছে কিনা?

একজন আমেরিকান ট্যুরিসট সনতু লারমাকে জিজ্ঞেস করলেন,’হিমালয়ে ‘ডেথ জোন’ জিনিসটা কি?
সনতু লারমা বললেন,’হিমালয়ের উচ্চতা ২৯০২৮ফিট।২৬০০০ফিটের উপর খেকেই শুরু ডেথ জোন।এই জোনে অকসিজেনের পরিমান আশংকাজনকভাবে কমে যায়।অকসিজেনের স্বল্পতার কারনে পর্বত আরোহীদের কনসেনট্রেশন কমে যায়, দৃসটি শক্তি কমে যায়।তাই তাদের জন্যে প্রয়োজন হয় কৃত্রিম অকসিজেনের।দীর্ঘ সময় এই অকসিজেনের অভাব ঘঠলে চিনতা শক্তিও হ্রাস পায়।ওই সময় পর্বত আরোহীরা ভুল করে ভুল সিদধানত নিয়ে বসেন।তখনই ঘঠে বিপত্তি।পড়ে গিয়ে মৃত্যু’!

আমি বললাম,’পর্বত আরোহীরা কি ধরনের খাবার নিয়ে যান’?
সনতু লারমা বললেন,’সাধারণত আমরা প্রতিদিন ২০০০ ক্যালরি বার্ন করি।কিনতু পর্বত আরোহীরা জন্য এর পরিমান ৬০০০ ক্যালরি।কাজেই খাবারের তালিকায় থাকতে হবে ক্যালরিপুসট খাবার।এই খাবারের মধ্যে আছে এনার্জি বার,বিস্কিট, চকোলেট,নাট,বিফ জারকি,পিনাট বাটার ও হ্যাম।পর্বত আরোহীরা সথে করে নিয়ে যান অনেকগুলো স্নোব্যাগ।ওই ব্যাগের মধ্যে স্নো জমিয়ে ওগুলোকেও ওরা পান করেন’!

এবারে গাইড আমাদেরকে দাড করিয়ে দিলেন একটি বিশাল ছবির সামনে।ছবিটি জর্জ ম্যালোরি ও এনড্রু আরভিং-এর।দু’জনেই ব্রিটিশ।১৯২৪ সালে এ দু’জন পর্বত আরোহী ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে এভারেস্ট এক্সপ্রিডিশনে যান।দু’জনই নিঁখোজ হন।

অনেক বছর পরে হিমালয়ের চুঁডো থেকে কয়েকশত ফিট নিচে জর্জ ম্যালোরির মৃতদেহ পাওয়া যায়। এনড্রু আরভিং-এর কোন হদিশ পাওয়া যায়নি।মুত্যুর আগে এই দুই পর্বত আরোহী কি এভারেস্ট জয় করতে পেরেছিলেন?এটি এখনও বিরাট রহস্য!অমিমাংশিত সত্য!

গাইডের কথা শুনে আমি মনে মনে ভাবছিলাম:
যুগ যুগ ধরে মানুষএভারেস্ট জয়ের নেশা মেতেছে।এই নেশায় কত ক্ষয়, কত জরা আর কত মৃত্যু!চাঁদনি রাতে মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছে চাঁদের দিকে! একসময় হাত বাডিয়েছি ওই দিকে।জয় করতে চেয়েছে চাঁদকেও।এখানেও কত ক্ষয়, কত জরা আর কত মৃত্যু!কিনতু তারপরেই থামেনি মানুষ।চূড়ান্ত বিজয়ের ওই শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত!এই হচছে মানুষ!এই অদম্য স্পৃহাই মানুষকে ‘মানুষ’ নাম দিয়েছে।করেছে অতুলনীয়া!

চিনতা করতে করতেই আমি মিউজিয়াম বাইরে চলে এলাম।চারপাশে হাল্কা কুয়াসা।পাহাড়ের গায়ে জমে আছে মেঘ।গাছের ডালে জমে আছে মেঘ।দার্জিলিংয়ের আকাশেও উডাউডি করছে মেঘ! প্রকৃতিও হয়ে উঠে মানুষের মতো রহস্যময়!

রহস্যময় ওই বিকেলে আমার মনে পড়ে আরনেসট হেমিংওয়ের ‘ওলড ম্যান এন্ড দ্যা সি’র সেই বিখ্যাত উক্তি:
‘A man can be destroyed but not defeated’!

sinha13a

সিনহা মনসুর
চলবে… …

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন