স্পিড বাম্পের ঝাঁকুনির দোলায় তন্দ্রা ছুটে গেল। দেখি ডান পাশে বড় ভাই আর বাম পাশে অনন্যা ধবলী। তারও চোখে তন্দ্রার কুয়াসা। সে তন্দ্রা এলে রাশিয়ার ভলখভ নদীর স্বপ্ন দেখে , দেখে লাটিমের মত জলের ঘুর্নি। আর বার্চবৃক্ষের পাতায় নাম ঠিকানাহীন হাওয়ার চান্চল্য । সে আরও স্বপ্ন দেখে তার শৈশব, যখন সে ছিল খুব ছোট এবং তার শিক্ষিকা বর্ণনা করেছিল লেনিন দাদুর মহতী সব গল্প । তারপরে গল্প যখন শেষ হয়েছিল , তার দু চোখে ছিল অশ্রু। শিক্ষিকা প্রশ্ন করেছিল, “তুমি কাঁদছো কেন?”
“লেনিন দাদুর জন্য কস্ট হচ্ছে, সে কেন মরে গেল?”
“স্বপ্ন দেখিয়ে লেনিন কেন মরে গেল ?” তাদের দেশে এটি এখন একটি অচল প্রশ্ন, পেট ফুটো অচল পয়সার মত।
সামনে পেসেন্জার সিটে বসে বড়বৌ খুব করে ঘুমুচ্ছে, তার মৃদু কাসর ঘন্টা শুনতে পাই। সে দেখছে কনকসারের দিঘি আর রাঢ়িখালের আমবাগানে ঘেরা শানবাঁধানো ঘাট। সেই বহু বহু দিন আগে (অথচ মনে হয় এই তো সেদিন ) যেখানে সে স্নান করত ঘুঘুর ডাকে ডাকে ভারী হয়ে ওঠা নির্জন দুপুরগুলোতে । টেলিফোন লাইনের থামের মত লম্বা , ঋজু ও অনড় দুপুর গুলো ছিল তখন।
প্রায়ই তার স্বপ্নের পায়ে পায়ে আসে সেই দৃশ্য: কনকসারের দীঘিতে সে নাইতে নেমেছে সালোয়ার কামিজ পরে ।
তার বয়েস মাত্র ষোল।
তার রূপ-মুগ্ধ হয়ে ছুটে এসেছে এক ঝাঁক চন্চল খলসে মাছ। ওরা একটু দূর থেকে দেখছে, কাছে আসতে সাহস নেই। আর জল ভেদ করে বর্শার মত নেমে এসেছে যে রৌদ্রের রশ্মি তার দ্যুতিগুলো ঝিলিক মারছে তাদের বহু রঙ্গা আঁশে । গ্রীষ্মের তাপ ধুয়ে নিয়েছে জল । ঘাটে ঘাটে বৌরা স্নান করছে, কেউ জল তুলে নিচ্ছে। বাচ্চারা হোল-ডুবানী খেলছে হৈ হুল্লোর করে।
বড় বড় শিরীষ গাছের ছায়ারা জলে সাঁতরাচ্ছে।
তার ঘাটে সে একা । একা অপূ্র্ব মানবী!
ওই খলসের ঝাঁকের মধ্যেই সে দেখতে পায় প্যান্ট শার্ট পরা একজন সুপুরুষ যুবকের মুখ যে তার মনে জাগিয়েছে ভাষাহীন অনুভূতি। বাঁশঝাঁড়ের মাটি ফুড়ে বের হয়ে আসা সুন্দর ও কোমল বেতসের মত।
কি সুন্দর এই কৈশোর পার হয়ে যৌবনে রূপান্তর! মাভৈ মহুয়া মাদকীয় উন্মাদনা দেহে ও মনে । সব কিছু সামনে , সব আশা, ভালোবাসা, ঘর-সংসার ,সাফল্য, সারা জীবন বেঁচে থাকা। জ্ড়া, তাপ, বার্ধক্যহীন অশেষ জীবন।
কিন্তু ইদানিং তার স্বপ্নে যুক্ত হয়েছে ধুসরতা। সে দেখে ছায়ায় পেটের ওপর দেহ ও মাটিতে মাথা রেখে শুয়ে থাকা বৃদ্ধ , ক্লান্ত , বলহীন , দৃষ্টি ও শ্রুতি ক্ষীণ এক নিরীহ কুকুর, যার কাঁচের মার্বেলের মত চোখ। যেখানে আর রং খেলা করেনা,আলো গুলো কেমন ফ্যাকাশে। হাঁটুর ব্যথা জানানী দেয় আর সামনে যাওয়া নয়, প্রকৃতপক্ষে কিছুই আর সামনে নেই, সবকিছু পিছনে, সবকিছু অতিক্রম হয়ে আসা।
যে সুপুরুষ পেছনে লেগে থাকতো বিরক্তিকর মাছির মত সে এখন প্রায় বৃদ্ধ এবং তার থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়।
সে আমার ডান পাশে বসে , সেও ঝিমুচ্ছে।
সে অধরাকে ধরতে চায়। উনিশ শ সাত চল্লিশে বাংলার বুকে করাত চালিয়ে যে রক্ত ও অশ্রুর প্লাবন ডাকা হয়ে ছিল , এখনও সেই অশ্রু টল টল করে অনেকের চোখে। সে সেই অশ্রু সংগ্রহের বাটি হাতে ঘুরে বেড়ায়
পশ্চিম বাংলায়। যে বাংলাদেশে জন্মেছে, বাংলার বাতাসে শ্বাস নিয়েছে , সে বাংলাকে ভুলতে পারেনা। বাংগালির এটা জন্মগত রোগ।
এই নোংরা, লোক গিজগিজে, অন্যায় অবিচার, অপ-রাজনীতি, খুন, ধর্ষনের বাংলা অজানা কি এক মায়ার বাধনে টানে এবং কেউ অস্বীকার করতে পারেনা সেই অভিকর্ষনের যন্ত্রনাকে । ঘুঘুর ডাকে সুখ নেই ,ঘুঘুর ডাকে শুধু বুক পোড়া হাহাকার । অভিভাসী বাংগালির মাতৃভূমির প্রতি টান আসলে রক্তস্রাবী ঘুঘুর ডাক।
“বাবা, মাত্র তো ১৫ টা বছর আমি সেখানে থেকেছি অথচ ৮৪ বছর বয়েস হলো, এই দেশে আছি কত দীর্ঘদিন কিন্তু কেন আজও ভুলতে পারিনা? খুব সকালে ঘুম ভেঙে যায়। গায়ে জোর নেই, উঠতে তো পারিনা , শুয়ে থাকি আর খালি চোখের সামনে ভাসে সেই ঘাট , ডান দিকে বিশাল ঝাউ গাছ আর বামদিকে সূর্যমুখি আম। আমাদের সে বাড়ীটা কি আজও আছে?”
“হ্যাঁ কাকীমা আছে। আপনাদের সেই ঘাট সেই দোতলা বাড়ী আজও আছে। পদ্মায় ভাঙে নাই।”
“শুভ্রর বাপ এখানে এসে কিচ্ছু মুখে দিতে পারতোনা, বলতো এখানকার খাদ্য বাংলাদেশের মত নয়। সেই মানুষটি, এত শিক্ষিত, এত যুক্তিবান , শুধু আবেগের খাঁচায় বন্দী থেকে থেকে ,সারা মাস কিছু না খেয়ে ,শেষে মারাই গেল।”
আমার ঘুম টুটে গেছে। বেলাল বেগ ঢোল পিটাতে পিটাতে চলে গেছে কোথাকার কোথায়। আমি তার ঢোলের শব্দ শুনতে পাইনা আর । আমি তার ঢাকার “লাল-বেলালের ডেরা” খুঁজতে বের হই। সেখানে লাল ভাই বসে আছে, বেলাল বেগ নেই।
“লাল ভাই, বেলাল ভাই কই?”
“আরে তারে পাইবানা, হেই পাগলে টেকনাফ থিকা পায়ে হাইট্টা তেতুলিয়া রওনা দিছে। ”
“বলেন কি? ”
“আরে কইও না, পাগল, একেবারে পাগল,
উঠতেও কয় জয় বাংলা, বসতেও কয় জয় বাংলা, লোকে জয় বাংলা এমনে কয় নি? একটা কারণ তো থাকতে অইব।”
কিছু মানুষ স্বপ্ন দেখতে কখনও পিছু হটেনা।
স্বপ্নই মানুষকে দেয় পাখা ও ইন্জিন , স্বপ্নই পথ খুঁজে দেয়। বেলাল বেগের জয় বাংলা সুসংবাদের , খুশীর , বিজয় ও উৎসবের অভিবাদন, কারণহীন নয়।
গাড়ী নানুরে ঢুকেছে। হাতের বা দিকে দাঁড়িয়ে আছে সোনার প্রলেপ দেয়া কবি চন্ডিদাস ও রজকীনি। চন্ডিদাসের কোকড়ানো চুল ঘাড়ের নীচ পর্যন্ত পৌঁছেছে। গালায় তার মালা আর পরণে ধুতি। রজকীনির অগোছালো চুল এলিয়ে পড়েছে কাঁধে । তার দুই হাতে বালা, পরণে শাড়ী আর গলায় মালা। মুখে যৌবনের বৈভব।
“কানুর পিরীতি বলিতে বলিতে
পরাণ ফাটিয়া ওঠে
শঙ্খবণিকের যেমতি করাতি
আসিতে যাইতে কাটে।”
গাড়ী এগিয়ে চলে কচ্ছপের চার পায়ে। এক চৌরাস্তার মোড়ে আসতেই দেখা গেল হাতের বাম দিকে সরু একটা রাস্তা আর সেই রাস্তার উপরে বড় একটা গেইটে লেখা রয়েছে
: “শুনহ মানুষ ভাই,
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।”
বেলাল বেগের কথা আবার কানে শুনি ,”আমরা সব ইয়োরোপের রেনেসাঁ নিয়ে ভাবে গদগদ , শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে দিই , অথচ এই বাংলার অজ পাড়া গাঁ থেকে উচ্চারিত হয়েছে এই কথা। আপনি ভাবতে পারেন যে এই কথা পৃথিবীর অন্যেরা জানেনা?”
আমি মাথা নীচু করে থাকি। আমি রুশো, ভলতেয়ার , দিদরো, হেগেল, মার্কস , লেনিন নিয়ে হৈ হৈ করা মানুষ। শ্রেনী সংগ্রাম ও শ্রেনী উচ্ছেদ আমার কাছে বেশী আকর্ষনীয় মনে হয় ।
অজ গাঁয়ের চন্ডিদাস নিয়ে কথা বলতে জিভ অসাড় লাগে। আমি বিশেষ উৎসাহ পাইনা। ইগো ফিস ফিস করে মনে করিয়ে দেয় যে আমি একজন শিক্ষিত মানুষ ।
আমরা সেই গেটের নীচ দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাই এক উঁচু ভিটা আর তার পরে কয়েকটি মঠের দিকে। গাড়ী থেকে বের হবার সাথে সাথে বিদেশী সমন্বিত ছোট্ট দলটিকে দেখে পাড়ার স্বাধীন, চিন্তামুক্ত, পৃথিবীর পথে পথে হাঁটা দাম দল শ্যাওলার মত এক দঙ্গল ছেলে পিলে ঘিরে ধরে। আর সেই শিশুদের মধ্যে একজন অতি খাটো বিরবল আমাদের স্থানটির সাথে পরিচিত করিয়ে দিতে থাকে। আমরা বাশুলী দেবীর মন্দির চত্ত্বরে উপস্থিত হই।
কে যেন গাইছে :
“ঘর কৈনু বাহির , বাহির কৈনু ঘর
পর কৈনু আপন , আপন কৈনু পর
রাতি কৈনু দিবস, দিবস কৈনু রাতি
বুঝিতে পারিনা বন্ধু তোমার পিরীতি।”
তীব্র মানবিক অনুভূতির অমিয় গরলে ভরা
কার সে কন্ঠ , কোথা হতে ভেসে আসছে আমি বুঝতে পারিনা।
অক্টোবর ৩, ২০১৭
জয়পুর