গ্রীষ্মের ঝলমলে দিনগুলোকে পেছনে ফেলে প্রকৃতি এগিয়ে চলছে তার আগুন-রঙা হেমন্তের পোশাকে নীলাভ কঠিন শীতের দিকে। তাই ভোর সকালে ও সন্ধ্যে বেলায় উত্তরমেরুর কনকনে হাওয়া যখন হাড় নাড়িয়ে দিয়ে যায় তখন দিনের আলো লজ্জাবতী নববধুর মতই একটুখানি দেখা দিয়ে দিগন্তের আড়াল হয়। আর তাই শত বাউন্ডুলে পিপাসার্ত মন খোঁজে সৌন্দর্য্য।

এই শহরে বসবাসরত একজন সাধারন মিলেনিয়ালের মতই কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ে অগাধ জ্ঞান ধারন করি না। এ নিয়ে আমার বিশেষ মনোকষ্ট বা অপরাধবোধও নেই- এটি আমাদের প্রজন্মের একটি সাধারন সমস্যা। তবে ইতিহাসের কিছু কিছু মানুষ রয়েছেন যাদের কাজ আমার বেঁচে থাকাকে অনুপ্রানিত করে। তাঁদের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই একজন চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গগের প্রতি একটি অন্যরকম প্রেম সর্বদা কাজ করেছে।

ছোটবেলায় আমার মেরিনার নানা যিনি বহু দেশ ভ্রমন করেছিলেন, তিনি নেদারল্যান্ড থেকে “স্টারি নাইট” এর প্রিন্টে একটা নোটবুক এনে দিয়েছিলেন আমাকে। দেশ ভ্রমণকারী “ইবনে বতুতা” সেই নানাভাই এর গল্প বলব আরেকদিন তবে জানতামই না এত সুন্দর দৃশ্যের আঁকিয়ে কে ছিলেন। নানাভাই বলেছিলেন ভ্যাগ গগ। নামটা যেমন বিচিত্র ছিল ছবিটা ছিল তেমনই আকর্ষনীয়। তাই একটা অদম্য কৌতুহল সবসময়ই কাজ করত। বহু বছর পরে আমার এই প্রিয় শহরে যখন দেখলাম সেই ভ্যান গগকে নিয়ে একটি এক্জিবিশন হচ্ছে তখন আমার কৃপণ মন একশবার নিষেধ করা সত্বেও হার মেনে যায় সেই ছোট্ট মমর কৌতুহলের কাছে। যদিও ইতিমধ্যে ভ্যান গগের বেশ কিছু ছবি এবং প্রকৃত “স্টারি নাইট” দেখার সুযোগ মিলেছিল তবু অক্টোবরের এক পূর্ণিমাবেস্টিত শুক্রবার সন্ধ্যায় চলে গেলাম ডাউনটাউনের “টরন্টো স্টার” বিল্ডিং এ। সাথে নিলাম পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে।

“তারা তোমায় ভালবাসতে পারেনি
যদিও তোমার ভালোবাসা ছিল অন্তহীন
আর যখন, আশা ছিল দৃষ্টিসীমার বাইরে
তারকামণ্ডিত, নক্ষত্রের রাত্রে
ব্যার্থ প্রেমিকের শেষ আশ্রয়ের খোঁজে-
করেছিলে আত্মহনন।”

ডন ম্যাক্লেনের জনপ্রিয় এই গানটিতে বর্ননা করা হয়েছে চিত্রকলার অন্যতম বিখ্যাত শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গগের জীবন নিয়ে। ভ্যান গগ আশ্চর্য এক মানুষ ছিলেন, যিনি ক্ষনজন্মা হয়ে অত্যন্ত দুর্ভাগ্য নিয়ে অতিথী হয়ে এসেছিলেন এই পৃথিবীতে। দারিদ্র, কঠিন মানসিক ব্যাধি, অপুষ্টি এবং কষ্ট ছিল তাঁর নিনৈমিত্তিক সাথি। মাত্র বারো বছরের আঁকিয়ের জীবনে তিনি এঁকেছেন ২০০০ এরও বেশি ছবি তান্মধ্যে বিখ্যাত হয়েছে অনেকগুলোই।

তিনি তার সাহসী, নাটকীয় ব্রাশ স্ট্রোকের জন্য খ্যাতি পেয়েছিলেন যা প্রকাশ করেছিল তাঁর অপার্থিব আবেগ এবং তার রচনায় আন্দোলনের অনুভূতি যুক্ত করেছিল। চিত্রশিল্পের সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারার সূচনা হয় তার মধ্যে দিয়ে। তাঁর চিত্রকর্মে স্মৃতি, কল্পনা এবং রূপকথার অসাধারন এক জগত ফুটে ওঠে। সাদা কালো, আলোছায়া এবং রঙের চমৎকার ব্যবহার আপ্লুত করে যে কোনও শৈল্পিক মনকে। শিল্পী জীবনের অনেকটা সময় মানসিক হাসপাতালের কাটিয়েছেন।একবার নিজের কানও কেটে ফেলেছিলেন। বড় অভিমানী এই শিল্পী নিজের মাঝে একরকম যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন জীবনের অনেকটা সময় এবং এর পরিনতিতে আত্মহননের পথ বেছে নেন তিনি।

টরন্টোর “ইমরসিভ ভ্যান গগ” প্রদর্শনী পোস্ট-ইমপ্রেশনবাদী চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গগের কাজগুলিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে।মজার ব্যাপার হল, এটি কোনও সাধারন প্রদর্শনী ছিল না, দেওয়ালে লাগানো সুস্পষ্টভাবেফ্রেমযুক্ত কাজের পরিবর্তে বরং গ্যালারিটি নিজেই একটি সীমাহীন শোতে রূপান্তরিত করে, যেখানে দর্শকরাও প্রদর্শনীর একটি অংশ হয়ে দাঁড়ায়।

গ্যালারিটির বিশাল দেয়াল এবং মেঝেতে ভ্যান গগের চল্লিশটি চিত্রকর্ম সহ প্রায় চারশ চিত্রের সমন্বয়ে চারদিকে জীবন্ত পরিবর্তন দেখা যায়। এগুলি আলো, অ্যানিমেশন এবং সংগীত দ্বারা এমনভাবে পরিবেশিত হয় যেন মনে হয় চিত্রকর্মগুলোর মাঝে মিলিয়ে যাচ্ছি। গ্যালারির ৬০০ স্কয়ার ফুটের বিশাল কক্ষের আকারে চিত্রগুলি এমন স্কেলে প্রজেক্ট করা হয় যাতে করে ব্রাশ স্ট্রোক এবং পেইন্টের ব্লবগুলি পর্যন্ত দেখা যায়। রঙগুলিকেও বিশেষভাবে তীব্র বলে মনে হয়। ছবিকে জীবন দেওয়ার জন্য এক একটি সিরিজের বিভিন্ন অংশ নিয়ে কাজ করা হয়েছে।প্রদর্শনিটিতে ঘাসের প্রতিটি বর্ধিত অংশের দিকে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে দেখলাম যে, প্রতিটি অংশে একাধিক রঙ লাগানো হয়েছে যা অবশ্যই শ্রমসাধ্য ছিল, যেহেতু মূল চিত্রটিপ্রক্ষেপণের চেয়ে আকারে অনেক ছোট। হয়ত বিশালাকরের এই প্রদশর্নীর লক্ষ্য ভ্যান গগের ভাবপূর্ণ ব্রাশওয়ার্ক এবং রঙের প্রাণবন্তব্যবহারের একটি বর্ধিত এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সরবরাহ করা।

ভ্যান গগের বিখ্যাত রচনাগুলি একটি গতিশীল শোতে পুনর্জন্ম হয়েছিল।”Irises”-এ পুষ্পিত হয়েছে ফুল, “Olive Trees” শিকড় থেকে আকাশে বেড়েছে এবংমেঘগুলি ঝড়ো বাতাসের ঘূর্ণায়মান পালকে ঘিরে ধরেছিল। “still life with bible” এর পাতাগুলো উল্টাতে থাকে,”Le Moulin de La Galette” এর উইন্ডমিলের পাখা ঘুরতে থাকে, “Starry Night over the Rhone” এর তারাগুলো একে একে উপরে জ্বল জ্বল করে অস্থির পানির উপরে প্রতিফলিত হয়ে তুলতে থাকে, “Almond Blossoms” এর ফুলগুলো বাতাসের সাথে উড়ে উড়ে ধরে বসে ছবির গাছের ডাল। মনে হয়, একটা সম্পূর্ণ পরাবস্তব জীবনের একটি খামের মাঝে স্থির হয়ে বসে আছি আর দেয়ালের ছবি জীবন পেয়ে ঘটিয়েছে যাচ্ছে নানা রকম ঘটনা।বাস্তব জীবন ও সময় হয় স্থির আর ছবি হয় চলমান।

সাউন্ডট্র্যাকটি চলমান পেইন্টিংগুলোর সাথে মনোরমভাবে সাদৃশ্য ছিল। ব্যারিলিন্ডন চলচ্চিত্র থেকে স্বীকৃত জর্জ ফ্রিডেরিক হ্যান্ডেলের রচিত “Sarabande” স্বাদে”The Yellow House” পেয়েছে তার জীবন। একইভাবে জুড়ে দেওয়া, “The Sower” থেকে সূর্যটি ঘরের চারদিকে আড্ড পিয়াফের ফরাসি গানে” Non, je ne regrette rien “ এর সাথে ঘুরে বেড়ায়, যা নস্টালজিয়ায় আক্রান্তদের জন্য মধ্যে স্মৃতির জীবনের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে।

আমরা দুজন মুগ্ধ চোখে দেখি। মনের অজান্তেই পরস্পরের হাত ধরি অপরূপ সৌন্দর্যে মোহগ্রস্থ হয়ে। হৃদয়ের গহিনে লুকিয়ে থাকা আবেগ নিমেষেই ঝাপসা করে দেয় চোখের দৃষ্টি। কি দারুন মমতায় আঁকা ছবি আর তার উপস্থাপনা।আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লাইভ থিয়েটার দেখার সুযোগ হয়েছে। আমি বলতে গেলে একজন প্রকৃত থিয়েটারপ্রেমী। কিন্তু এমন শো এর অভিজ্ঞতা এটাই প্রথম যেখানে মৌলিক কায়িক শ্রম ও প্রযুক্তি মিলেমিশে একাকার হয়ে অপার্থিব একটি পরিবেশনায় পরিনত হয়েছে।

৩৫ মিনিটের পরপর তিনটি শো শেষ করে যখন থিয়েটার থেকে বের হলাম তখন আমার সঙ্গির চোখের তৃপ্তি আমায় বুঝিয়ে দেয় সেও আমার মতই রহস্যময় ভ্যান গগের পৃথিবীতে বাস করছে। জনশূন্য রাস্তায় পড়ে থাকা শুকনো পাতায় মর্মর ধ্বনি তুলে, খিদে পেটে একে অপরের হাত ধরে হেঁটে চললাম কোনও এক রেস্টুরেন্টের খোঁজে। যেতে যেতে মনে হল, জীবনের বেশিরভাগ দিনগুলো এমন ভালোবাসা ও শিল্পময় হলে মন্দ হত না।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন