আমার ভাতিজার নাম মাশরুর জামান মুগ্ধ। আমিও যেদিন পড়াশুনার উদ্দেশ্যে ইউরোপ পাড়ি জমালাম তার ঠিক কমাস পরেই ওর জন্ম। এখন সে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের কিনসিওলজির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। যদিও তৎকালীন সময়ে ফোন বা অন্য যোগাযোগের মাধ্যম কম ছিল তাই চিঠি পত্র এবং মাঝে মাঝে দেশে গিয়ে দেখা করা ছাড়া সম্পর্ক গাঢ় করার কোনো উপায় ছিল না। যাহোক তা সত্ত্বেও আল্লার রহমতে সম্পর্কটা এখনো বিশস্ত এবং বন্ধুসুলভ। আমার ধারণা ছেলেমেয়েদেরকে ছোট থেকে এমন কিছু দিকে আগ্রহ গড়ে তোলা দরকার যাতে ক্ষতির কারণ কম থাকে এবং প্রকৃতি এবং মনুষত্বের দিকে নজর থাকে তাই তার ছোট বেলা থেকেই একসাথে আমরা অনেক এধরণের একটিভিটিস করে আসছি। এগুলির মধ্যে যেমন বাইকিং , হাইকিং, বোটিং , মুভি দেখা , ক্যানু ভ্রমণ ইত্যাদি। সময় এবং বেস্ততার কারণে খুব বেশি সম্ভব না হলেও এখনো ঐধরণের কিছু কিছু জিনিস করে থাকি। আর বাচ্চারা যখন কোনো কিছু করে অপার আনন্দ লাভ করে তখন আমার কাছে দেখতে খুব ভালো লাগে, যাদের বাচ্চা আছে বা বাচ্চাদের সাথে চলার অভিজ্ঞতা আছে তারা এবিষয়টি খুব ভালো করে জানবেন। আর আপনি যখন কোনো আউটডোর এক্টিভিটিস করবেন তখন তাদের অজান্তেই তারা ডিটেল নজর রাখা, কালেকটিভ ভাবে চিন্তা করা, ক্রাইসিস হ্যান্ডেল করা , ক্রিয়েটিভ কাজ করা এবং একটি ডিসেন্ট ফ্যামিলি টাইম এর মূল্যের কথা বুঝতে পারে যেটা একাডেমিক্যালি শিখতে অনেক কসরত করতে হয়। যেমন ধরুন আমার পেশার অন্যতম একটা বিষয় হলো ক্রাইসিস হ্যান্ডেল করা এবং প্রব্লেম সল্ভ করা আর এই কাজের সবচাইতে অন্যতম বিষয় যেটা আমি সব সময় আমার স্টুডেন্টদেরকে বলে থাকি, তা হলো মাথা ঠান্ডা রাখা। শুনতে খুব সোজা মনে হলেও ক্রাইসিস এর সময়ে আমরা আমাদের নরমাল কোপিং ম্যাকানিজম ভুলে যাই। এবার ফিশিং ক্যাম্পিংয়ে গিয়ে আমাদের ছোট খাটো একটা ক্রাইসিস হয়েছিল, সেক্ষেত্রে আমি ইসছা করেই একটু এক্সপেরিমেন্ট করছিলাম যে ভাতিজা কিভাবে রিএক্ট করে, তবে তার নাম মুগ্ধ হলেও আমি নিজেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম তার ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করা দেখে। এছাড়াও প্রায় ৫/৬ বছর আগে আরো একটি ক্যাম্পিংয়ে গিয়ে আমার ক্যানু ডুবে যাওয়ার ঘটনায়ও এর প্রমান দেখেছি। এটা বলার কারণ এই যে তাকে নিয়ে শুধু ঘোরা ফেরাই হয়নি, এর মাধ্যমে তার কিছু স্কিলও তৈরী হয়েছে।
যাহোক কথা না বাড়িয়ে আমাদের ট্রিপের কিছু তথ্য দেই , যারা বেপারটি জানেন না তাদের জন্য উপকার হবে।
আলগোনকুইন পার্ক টরোন্টো শহর থেকে উত্তরে প্রায় তিন ঘন্টার পথ। পার্কটি কানাডিয়ানদের কাছে অনেক নাম করা। হাইওয়ে ৬০ এই পার্কটির পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে চলে গেছে , এবং রাস্তাটি খুব scenic .এখানে প্রায় ৭ টি ক্যাম্পগ্রাউন্ড এবং অনেক ডে use এর জাগা আছে। এখানে ক্যাম্পিংয়ে গেলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোক দেখতে পাবেন। যেমন আমাদের এবারে ক্যানু ট্রিপের সঙ্গী ছিল একটি ফ্রান্স এবং ইতালির পরিবার।
ক্যানু সম্মন্ধে যাদের ধারণা নেই তাদের জন্য, ক্যানু হলো বাংলাদেশের ডিঙ্গি নৌকার মতো। কানাডার এটি একটি ঐতিহ্যবাহী ট্র্যাডিশন। এই পার্কে বেশ কয়েকটি portage store বা outfit আছে যেখান থেকে আপনি স্বল্প মূল্যে ক্যানু ভাড়া করে পার্কের ভিতর দিয়ে লেক ধরে ভ্রমণ করতে পারেন, মাছ ধরতে পারেন, বা দূরবর্তী কোনো দ্বীপে ক্যাম্পিং করতে পারেন। এবং এই ভ্রমণে আপনার দেখা মিলবে কানাডার অনেক বন্য প্রাণীর যেটা দেখলে আপনার চিড়িয়াখানায় যাওয়ার থেকে ভালো লাগবে।
গত ভিক্টোরিয়া ডে উইকেন্ড এ আমরা যদিও ক্যানু ভাড়া করে নিজেরা ভ্রমণ করেছি , এবার আমরা গাইডেড ট্যুরে গিয়েছিলাম। মাত্র $৩৮, ক্যানু , লাইফ জ্যাকেট , বৈঠা, এবং সমস্ত সেফটি ইকুইপমেন্ট include .
আমরা এ টুরটি করেছিলাম আলগোনকুইনের ক্যানু লেকের পারে Portage Store থেকে। ওখানে পৌঁছনোর পর সব কিছু বুঝে নিয়ে গাইড আমাদেরকে আমাদের টুর সঙ্গীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। অবাক হলাম দেখে ইতালিয়ান এবং ফ্রেঞ্চ পরিবারে দুটি খুদে সদস্যও ছিল যাদের একজনের বয়োস এক বছরের কম।
প্রথমে কিছুক্ষন বৈঠা চালিয়ে গেলাম একটি দ্বীপে বালিকাদের ক্যাম্পে , সেখানে পৃথিবীর সব থেকে বড়ো কানুটি দেখতে পেলাম। তারপর বালকদের ক্যাম্পে। এর পর খুব অল্প পানির ধার ধরে যেতে যেতে হটাৎ চোখে পড়লো একটি মুস , এর আগে এতো কাছে থেকে এই প্রাণীটি দেখি নি , যদিও রাস্তার পাশে বা ছবিতে দেখেছি। আমরা সবাই আস্তে আস্তে ক্যানু থামিয়ে ছবি তুললাম। ও একবার আমাদের দিকে তাকিয়ে আবার নিজের মনে পানির ছোট ছোট শাপলা খেতে লাগলো।
ওখান থেকে গেলাম আরো অনেক ছোট ছোট্ট দ্বীপে। মাঝে মাজেই এদেশের জাতীয় পাখি লুন দেখতে পেলাম , লুনের ছবি এক ডলারে আছে বলেই ডলারকে আমরা লুনি বলি। আরো কিছু বিরল পাখি এবং প্রাণী দেখলাম।
আবহটা খুব ভালো ছিল , তাছাড়া লেকের মধ্যে সুন্দর একটি মিষ্টি হওয়া গায়ে লাগছিলো। পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ছোটো বেলায় মামাদের বাড়িতে নৌকায় যাওয়ার কথা মনে হসচিলো , আর ভাতিজাকে তখন সেই অভিজ্ঞতার কথা বলছিলাম। তখন জাস্ট ভ্রমণে নৌকা চড়িনি , প্রয়জনে চড়েছিলাম। এভাবে সারাদিন ঘুরে শেষে কানাডার বিখ্যাত আর্টিস্ট Tom Thomson এর নাম রাখা একটি ছোট দ্বীপে সবাই নেমে বাথরুম সেরে হট চকলেট তৈরী করে তার সাথে কিছু কিছু স্নাক্স করে বিকাল নাগাদ ফিরে আসলাম Portage Store এ। আমার লেখার হাত অতো ভালো না তাই ভালো লাগার বা আঁনন্দের বেপারটি ঠিক ভালো করে লিখতে পারলাম না , তবে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি আপনারা কেউ এই ট্রিপে গেলে হতাশ হবেন না। আপনি যদি ক্যানু না চালাতে জানেন কোনো সমস্যা নেই , ওরা আপনার ক্যানুতে একজন গাইড দিবে। সাথে আপনার ছোট বড়ো যেকোনো বয়োসের বাচ্চাদের নিতে পড়েন ওরা খুব মজা পাবে এবং অনেক কিছু শিখবে। আমরা অন্টারিও এবং টরোন্টোতে থাকায় এক ধরণের লাকি যে ইউরোপ আমেরিকা বা অন্য কোনো প্রভিন্স থেকে সময় নিয়ে আলগোনকুইনে যেতে হয় না।
ওখানে ফুল ডে, হাফ ডে, দুদিন বা ৩/৪ দিনের ও ট্রিপ আছে , আপনার পছন্দমতো ট্রিপ টি বেঁচে নিয়ে ঘুরে আসুন দেখেবন অনেক ভালো লাগবে। গুগল-এ Algonquin Portage Store লিখলে সব তথ্য পেয়ে যাবেন। আগামী মাস পর্যন্ত ওদের ট্রিপ চলবে, অতএব সময় আছে; চলে যান কোনো একদিন।
মুকুল
টরন্টো
২৫ আগস্ট ২০১৬
ছেলেমেয়েদের গাইড শুধু তার মা বাবা নয় , তার আত্মীয় স্বজন সবাই….ঘুরে বেড়ানো ও অন্যানো রিক্রেয়েশনাল এক্টিভিটির মাঝেও তাদের শিক্ষা বা দিক নির্দেশনা দেয়া যায়। আমি নিজে এ কাজটা করার খুব একটা সুযোগ না পেলেও যারা এটা করে তাদের সব সময় উৎসাহ দেই।
🙂
ইন্টারনেট আর টেক্সটিং এর খপ্পর থেকে ছেলেমেয়েদেরকে বের করে প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে এসে বাস্তব জীবনের পাঠদান নিঃস্বন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ. অনেক ধন্যবাদ মুকুল ভাই আপনার লেখা এবং এর বিষয়বস্তুর জন্য.