আমার চাকুরী জীবনের একটা বড় অংশ অতিবাহিত হয়েছে ব্রিটিশ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা অ্যাকশন এইড বাংলাদেশে। জাতীয় উন্নয়ন সংগঠন ব্র্যাক এ চার বছর কাজ করার পর অ্যাকশন এইড ছিল আমার পেশাগত জীবনে দ্বিতীয় কর্মস্থল। এরপর কাজ করেছি কানাডার অন্টারিওর মিনিস্ট্রি অফ হেলথ প্রমোশন সহ আরো অনেক অলাভজনক প্রতিষ্টানে । কেন জানিনা অন্য কোথাও Sense of Belongingness খুব একটা তৈরী হয়নি। এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম অ্যাকশন এইড। ষোলো বছর আগে ছেড়ে আসা অ্যাকশন এইড এর প্রতি এখনো অনুভব করি ব্যাখ্যাতীত, অদ্ভুত এক টান। আমার কাছে স্মৃতিঘেরা, মায়াভরা এক সংগঠন। যে সংগঠন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা প্রাক্তন সহকর্মীদের এখনো টানে, একই প্রগাঢ় মমতায়। বোধ করি এই অমোঘ টানেই প্রাক্তন প্রিয় সহকর্মীরা ২৫ সেপ্টেম্বর অয়োজন করছেন “গণ জুম আয়েত” নামের এক পুনর্মিলনী অনুষ্টানের। বাংলাদেশ, এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত অ্যাকশন এইড বাংলাদেশে কাজ করা প্রাক্তন সহকর্মীরা অংশগ্রহণ করবেন এই অনুষ্টানে । সহকর্মী সঞ্জয়দা (সঞ্জয় চক্রবর্তী) জানতে চেয়েছেন কোনো স্মৃতি, ঘটনা, অভিজ্ঞতা বিনিময় করা যায় কিনা। সঞ্জয়দার উৎসাহ, তাগিদেই এই লেখা।

১৯৯৮ সালের এপ্রিল মাস। অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর টন ভ্যান ঝুটফেন। Food Security বা খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি তখন ধীরে ধীরে উন্নয়ন জগতের ‘buzz word’ হয়ে উঠছে । হঠাৎ একদিন টনের Executive Assistant আলবিনা আজিম নাতাশা আপার কাছ থেকে ফোন, “হাসান ভাই, আসেন, টন আপনাকে দেখা করতে বলেছে”। টম জানালো খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে অ্যাকশন এইড ইন্ডিয়া কান্ট্রি অফিস একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করেছে। মূল আয়োজক তৎকালীন ইন্ডিয়া কান্ট্রি ডিরেক্টর অমিতাভ মুখার্জী,পলিসি এডভোকেসি ইউনিট এর বিনু টমাস, সহযোগিতায় ডক্টর বন্দনা শিবা ও তার প্রতিষ্টান। টনের পরামর্শ হচ্ছে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে একটি পেপার তৈরী ও উপস্থাপনা করতে হবে । বিষয়বস্তু নিয়ে কিছু দিক নির্দেশনাও পেলাম। বুঝলাম শুধু সমস্যার ফিরিস্তি দিলে হবে না, এই বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ ও সম্ভাবনার উপর জোর দিতে হবে। টনের সাথে যারা সরাসরি কাজ করেছেন তারা জানেন কতটা খুঁতখুঁতে স্বভাবের মানুষ ছিলেন এই ডাচ ভদ্র্লোক। জার্মানদের মতো ‘perfectionist’ না হলেও তার সন্তুষ্টি অর্জন খুব সহজসাধ্য ছিলো না। যাহোক অনেক চেষ্টা ও প্রায় দশ বারোটা ড্রাফট সম্পাদনার শেষে উপস্থাপন যোগ্য একটি সেমিনার পেপার তৈরী করতে সমর্থ হই। এই পেপার তৈরী করতে যেয়ে আমি আবিষ্কার করি অন্য এক টনকে। আপাত দৃষ্টিতে ছাঁচাছুঁলা এক মানুষের মধ্যেও যে কিছু বিশেষ নীতিবোধ কাজ করে তা দেখে বিস্মিত হই। সেমিনার পেপার সংক্রান্ত সম্ভবত দ্বিতীয় মিটিঙে টন সেই সময়কার নিদিষ্ট কিছু বেসরকারি সংগঠনের নেতৃবৃন্দের আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশকে উপস্থাপনের বিষয়ে তার আপত্তি নিয়ে কথা বলেছিলো। তার বক্তব্য হচ্ছে কিছু মানুষ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তার দিক থেকে একেবারে তলানিতে পৌঁছে গেছে’ এরকম একটি চরম নেতিবাচক ইমেজ প্রতিষ্টায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। সব যুক্তি তথ্য, উপাত্ত এই আঙ্গিকেই প্রস্তুত করেন। টনের ভাষায়, “ all of their efforts are geared towards projecting a bleak future of Bangladesh when it comes to issues of food security. Yes I do understand the constraints this country faces but you cannot tell half of a story and take credit for full. It will be unfair just to highlight the challenges and not to discuss the effort, initiatives and potentials that exists in this country. Remember at the end of the day this is the country that gave you birth. You can not prove yourselves great while being used as a tool of humiliation to your own country”। আন্তর্জাতিক পরিসরে সমস্যা তুলে ধরতে যেয়ে দেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বানিয়ে দেশের মর্যাদা ক্ষুন্ন করে দেয়ার নাম যে দেশপ্রেম নয় – এই সবক নুতন করে পেলাম ভিনদেশী এক বসের কাছে।

এরপর গড়িয়ে গেছে অনেক বছর। ২০০৫ সালে ছেড়ে এসেছি অ্যাকশন এইড। ষোল বছর ধরে বসবাস করি টরোন্টোতে। মাঝে মাঝে টরন্টোর বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা ডেনফোর্থে ধূমায়িত চায়ের কাপ নিয়ে পাশের টেবিলে চায়ের কাপে তুফান উঠার আওয়াজ শুনি। বিচিত্র ব্যক্তিত্বের সমাহার এখানে। কেউ কেউ বাংলাদেশের দলীয় রাজনীতির আকাশে বৃষ্টি হলে টরোন্টোতে ছাতা মেলে ধরেন। আবার কেউ কেউ মেতে উঠেন বাংলাদেশ কতটা জঘন্য, আবর্জনাময় একটি দেশ, সেই তর্কে। শুধু চায়ের টেবিলে নয়, অনেক অনলাইন ফোরামেও অনেকে ফেলে আসা বাংলাদেশকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন। অবাক হই এই ভেবে যে নিজের জন্মদাত্রী দেশের প্রতি মানুষ এতটা অকৃতজ্ঞ হয় কিভাবে। অনেক কিছু বলতে চাইলেও কিছুই বলা হয়না । শুধু কানের কাছে প্রতিধ্বনিত হয় হাজার হাজার মাইল দূর থেকে ভেসে আসা টন ভ্যান ঝুটফেনের কণ্ঠস্বর, “নিজের দেশকে খাটো করে তুমি কখনো বড় হতে পারবে না”।

সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন