দৈনিক সমাচার পত্রিকা এমন একটি পত্রিকা যেখানে আমার লেখা সবচেয়ে বেশি ছাপা হয়েছে। অনেক লেখা। হরেক রকমের লেখা! দৈনিক সমাচার পত্রিকার পাতায় সবচেয়ে বেশি লেখা ছাপা হবার মূল কারণ দুটো। প্রথমতঃ দৈনিক সমাচার পত্রিকাটি ঢাকার পুরানা পল্টনের মোড় থেকে প্রকাশিত হতো। সহজেই পত্রিকা অফিসে যেতে পারতাম। লেখা জমা দিতে পারতাম। প্রকাশিত লেখার পত্রিকার কপি সংগ্রহ করা যেতো সহজে। দ্বিতীয়তঃ ঐ পত্রিকার সাংবাদিক আমিনুল আহসান ভাই। তিনি ছিলেন দৈনিক সমাচার পত্রিকার মফস্বল সম্পাদক। সাহিত্যের পাতাও দেখতেন তিনিই।

সাংবাদিক আমিনুল আহসান ২০১৮ সনের ০৬ নভেম্বর সকাল ১০টায় ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। তিনি অত্যন্ত সাদাসিধা জীবনযাপন করতেন। ফর্সা- ছিপছিপে গড়নের আমিন ভাই ঢাকা শহরে কোনোদিন রিক্সায় চড়েননি, হেটে-হেটেই চলাফেরা করতেন। কাধে ঝোলানো  থাকতো বাংলা একাডেমির বার্ষিক সাধারণ সভায় পাওয়া ব্যাগ। আর বেশিরভাগ সময়ে দুটি শার্টই অদলবদল করে পড়তে দেখেছি তাকে।

দৈনিক সমাচার পত্রিকায় প্রকাশিত আমার অসংখ্য লেখার নথিটি হাতে নিয়ে কেন যেন শুধু আমিনুল আহসান ভাইয়ের কথাই মনে পড়ছে। প্রতিটি লেখার সাথে তার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সে যেন আমার  সাথে কথা বলছে । সহজ সরল একটি মানুষের মুখচ্ছবি কেবল আমার মানসপটে ভেসে ওঠছে।

দৈনিক সমাচার পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা সমুহের আলোচনার পূর্বে আমিনুল আহসান ভাই সম্পর্কে আরও কিছু বলতে চাই । কিছুটা আবেগের বশবর্তী হয়ে, আর বাকীটা সাংবাদিক আমিনুল আহসান ভাইয়ের প্রতি দায়বদ্ধতা হিসেবে।

আমিনুল আহসান ভাইয়ের পদবি ছিল দৈনিক সমাচার পত্রিকার মফস্বল সম্পাদক। তবে, তিনি প্রায় সকল বিভাগই দেখাশোনা করতেন। তিনি সমাচার পত্রিকার সাহিত্যের পাতাও দেখতেন। কাগজে কলমে না হলেও, দৈনিক সমাচার পত্রিকার প্রকৃত সম্পাদক ছিলেন আমিনুল আহসান।

সাংবাদিক ও সু-সাহিত্যিক আমিনুল আহসান ভাই খুব আস্তে আস্তে কথা বলতেন। তিনি মৃদু হেসে, কম কথায় চুম্বকের মতো আমাদের টানতেন। সবসময় লেখা চেয়ে নিয়ে নিজের কাছে জমা রাখতেন। সময় মতো ছেপে দিতেন এবং পত্রিকার সংখ্যাটি যত্ন করে রেখে দিতেন। সাক্ষাৎ হওয়া মাত্রই বিনাবাক্য ব্যয়ে প্রথমেই প্রকাশিত লেখার পত্রিকার কপি হস্তান্তর করতেন। বিশেষ দিবসের পূর্বেই বলতেন, অমুক বিষয়ের উপর লেখা চাই। আমিও চেষ্টা করতাম, পারতপক্ষে আমিনুল আহসান ভাইকে বিমুখ করিনি। চাহিদা অনুযায়ী সবসময়ই লেখা দিতাম।

 এখন দৈনিক সমাচার পত্রিকাটি  র     কী অবস্থা জানি না। তাঁর মৃত্যুর পর আর ঐদিকে যাওয়া হয়নি। আমাদের নিকট, দৈনিক সমাচার পত্রিকার মূল আকর্ষণ ছিলো সাংবাদিক আমিনুল আহসান ভাই। সাংবাদিকদের মধ্যে তার মতো সাদা মনের মানুষের সংখ্যা বোধ হয় খুবই কম। বিনয়ী ও সৎ সাংবাদিক বলতে যা বোঝায় তা-ই ছিলেন তিনি। অনেক বড় বড় পত্রিকায় চাকুরির সুযোগ পেয়েও তিনি তা গ্রহণ করেননি, সমাচারেই থেকে যান। অভাব অনটনের মধ্যেও আদর্শ ধরে রেখেছেন, চরিত্র হারাননি। নির্লোভ নিরহংকারী একটা মানুষ ছিলেন আমাদের আমিনুল আহসান ভাই।

আমিনুল আহসান যেন একাই দৈনিক সমাচার পত্রিকাটি চালিয়ে যাচ্ছেন। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও তিনি পত্রিকা অফিসে আছেন। তিনি সাপ্তাহিক ছুটিও নিতেন না। হরতাল-অবরোধ, ঝড়-বৃষ্টি বা অন্য কোনো কারণে কেউ অফিসে নেই কিন্তু আমিনুল আহসান আছেন। কাজ করে যাচ্ছেন।

সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অফিস-সময় হলেও তিনি রাত ৮ টার আগে কোনো দিনই বের হতেন না। বাসায় যেতে যেতে কোনো দিন রাত ১২ টাও বাজতো। তার বাসা ছিল পুরান ঢাকার এক গলির  ভেতর। কম টাকায় বাসা ভাড়া পেতে তিনি এ পথ বেছে নিয়ে ছিলেন। এছাড়া, পুরানা পল্টন থেকে হেটে হেটে অনায়াসেই বাসায় যেতে পারতেন।

এরকম নিবেদিতপ্রাণ সংবাদকর্মী ও ভালো মানুষ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলা একাডেমির বার্ষিক সাধারণ সভায় তাকে আর দেখা যাবে না। পাশাপাশি বসে আলোচনা শুনবো না, খাওয়া দাওয়া হবে না। গল্পগুজবও আর হবে না। আর কোনো দিন বইমেলায় একসাথে বইয়ের স্টলে স্টলে ঘুরবো না। ভাবতে খুবই কষ্ট হচ্ছে!

দৈনিক সমাচার পত্রিকা অফিসে গেলেই আমিনুল আহসান ভাই চা খাওয়াতেন। ঘন দুধের কড়ামিষ্টি চা। কোন পিয়ন কিংবা সহায়ক কর্মী অফিসে উপস্হিত না থাকলেও এর ব্যত্যয় ঘটতো না। ছোটছোট স্পেশাল চায়ের কাপ ছিলো ওখানে। দেড়কাপ চা তিনজনে ভাগা ভাগি করে খেতে বেশ ভালোই লাগতো।

অত্যন্ত কম কথা বলতেন আমিনুল আহসান। কিন্তু তার উপস্থিতিই আমাদের জন্য ছিলো একটি বিরাট কিছু । আল্লাহপাক তাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্ব্বোচ্চ স্হানে দাখিল করুন।                                                   

সাংবাদিক আমিনুল আহসান ০৬ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে আমাদের ছেড়ে অপর পারে পাড়ি জমান। অসুস্থ ছিলেন তিনি দীর্ঘদিন। আর্থিক অভাব-অনটন ছিলো বিধায় উপযুক্ত চিকিৎসাও হয়নি তার । কোথাও হাত পাতেননি, সাহায্য চাননি। তিনি প্রচার বিমুখ ও অন্তর্মুখী চরিত্রের মানুষ ছিলেন। তাই তার অসুস্থতার কথা গণমাধ্যমে   ফলাও করে প্রচারিত হয়নি। কেউ সাহায্য নিয়ে এগিয়েও আসেননি। তার জীবনের শেষ দিনগুলো ছিলো খুবই কষ্টের।

আমিনুল আহসান বাংলা একাডেমির জীবন সদস্য ছিলেন। বাংলা একাডেমির লেখক অভিধানে তার বিষয়ে লেখা আছে –

লেখক আমিনুল আহসান।। পিতার নামঃ নছিম উদ্দিন সরকার, মাতাঃ আমেনা খাতুন ; পত্নীঃ মনোয়ারা বেগম। জন্মস্হান ও জন্মতারিখঃ পার আমলাগাছি, গাইবান্ধা, ৩০ জানুয়ারি ১৯৫২। শিক্ষাঃ স্নাতক (কলা), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭৪)। পেশাঃ সাংবাদিকতা। মফস্বল ও সাহিত্য সম্পাদক, দৈনিক সমাচার, ১১ পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০। প্রকাশিত গ্রন্থঃ ইসলামি গীতি মঞ্জুরী (১৯৬৯) ; এক কুমারীর গল্প (১৯৯৭)। নাটকঃ মারাঠা বিদ্রোহ (১৯৭৩)। সম্পাদনাঃ নির্বাচিত কবিতা (১৯৮৩) ; জীবনানন্দ নিবেদিত কবিতাবলী (১৯৯৪)। পুরস্কারঃ কথাশিল্পী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮০) ; কবি জসীম উদ্দীন স্মৃতিসংঘের কলম সেনা পুরস্কার (১৯৮৩) ; কবি বন্দে আলী মিঞা স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৫) ;লায়ন পুরস্কার (১৯৯৭) ; ভাস্কর নাট্যদল পুরস্কার (২০০০)।

(সূত্রঃ বাংলা একাডেমি লেখক অভিধান, বাংলা একাডেমি,  ঢাকা। প্রথম প্রকাশঃ ফাল্গুন ১৪০৪ / ফেব্রুয়ারী ১৯৯৮।

পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৭।)  আমিনুল আহসান ভাইয়ের মৃত্যুর পর দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার ০৭ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত  একটি খবরের উল্লেখ করছি। খবরটি হলো,

‘দৈনিক সমাচারের মফস্বল সম্পাদক আমিনুল আহসান (৭০) গতকাল সকাল ১০টায় বার্ধক্যজনিত রোগে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি

 স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে গেছেন। আমিনুল একাধিকবার দৈনিক সমাচারের ইউনিট প্রধান ছিলেন। গাইবান্ধার ঢোলভাঙ্গারপাড় আমলাগাতীতে মরহুমের লাশ দাফন করা হয়।

সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের শোক : প্রবীণ সাংবাদিক, ডিইউজে সদস্য দৈনিক সমাচারের মফস্বল সম্পাদক আমিনুল আহসানের ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) নেতৃবৃন্দ। এক শোকবার্তায় বিএফইউজে সভাপতি রুহুল আমিন গাজী ও মহাসচিব এম আবদুল্লাহ এবং ডিইউজে সভাপতি কাদের গনি চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মো: শহিদুল ইসলাম বলেন, আমিনুল আহসান ছিলেন সাদা মনের নিভৃতচারী একজন সংবাদকর্মী, তার মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। শোকবার্তায় তারা মরহুমের রূহের মাগফিরাত কামনা করেন ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।’

বাংলা একাডেমির লেখক অভিধান থেকে নেয়া আমিনুল আহসান ভাইয়ের একটি ছবি দিলাম। কেউ হয়তো ছবি দেখেও তাকে চিনতে পারেন।

              (চলবে)

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন