প্রায় ৩৭ বছর আগের দেখা এক বন্ধুর সাথে কথা হলো। মাঝখানে এতোগুলা বছর কেমন আছে জানা হয়নি, সুযোগও ছিল না। অপরিচিত ম্যাসেঞ্জার কল ধরব কিনা সন্দিহান ছিলাম। আমাকে চিনতে পারছো? আমি নুপুর? আমি চিনতে পারিনি আসলেই।
ওইযে সারদায় পড়তাম! ২য় বর্ষেই বিয়ে করেছিলাম রাজেন্দ্র কলেজের আরিফকে। মনে আছে, এতোগুলো বছর! কেমন আছো? তেমনভাবে আর জানা হয়নি তোমাদের খবর। তবে শুনেছি আরিফ ভাই কোন একটা ব্যাংকে চাকুরী নিয়েছিল বিয়ের পরে। ছিলে এই শহরেরই কোথাও।
নুপুর, কেয়া, বেবী ওরা থাকত ছাত্রী হোস্টেলে। বেবীর বাড়ী মধুখালী,তোমার মোকসেদপুর, আবার কে যেন নড়াইল এর ছিল। আমি প্রায় প্রতিদিন যেতাম হোস্টেলে, কলেজের ভিতরে লাগানো। বিকেলে ক্লাস থাকলে রেস্ট নেয়া যেত।
হ্যা সেই যে হোস্টেল থেকে পালিয়ে বিয়ে করলাম। বাবা, ভাই এটা মেনে নেয়নি। আসলে আমাদের বাড়ী একই এলাকায় হওয়াতে, সমস্যা আরোও জটিল হলো। আমি যখন ক্লাস টেনে আরিফ তখন ইন্টারমিডিয়েট, সেই সময় আমাদের ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা। কৃষক পরিবারের সন্তান আরিফ, আমার বাবার পাটের গুদাম আর বাজারে অনেক ব্যবসা। তাদের সন্মানে হানি হবে এই ছেলের সাথে সম্পর্ক রাখলে, অনেক চাপ ছিল বাড়ী থেকে। পাত্র দেখা শুরু করেছে, তাই পালিয়ে বিয়ে ছাড়া উপায় ছিল না।
কেমন আছো এখন? কেমন কাটলো পিছনের দিন গুলো?
দুজনের অনেক কথা জানার আর শোনার আছে। এরপর মাঝে মাঝেই নুপুরের সাথে কথা হয়, আরিফ ভাইয়ের সাথেও হয়েছে দু’দিন। জীবনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছে এক সাথে।
আরিফ ও তার বাবার নামে নারী অপহরনের মামলা হয়েছিল, যেটা করেছিলেন নুপুরের বাবা। এই পালিয়ে বেড়ানোর কারনেই লেখাপড়া আর হয়নি ওর। আরিফ বি.এ পাশ করেই ব্যাংকে চাকুরী পেয়ে যায়। এর মধ্যেই তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম। মারা যান আরিফের বাবা। তখন থেকে সংসারে যুক্ত হয় তিন ভাই বোন। অবস্থাপন্ন ঘরের আদুরে মেয়েটির নিজের দিকে তাকাবার সময় আর নাই, নিজের সন্তান, দেবর ননদের দেখাশুনা করে খুব ক্লান্ত লাগে। মায়ের কথা মনে হয়, আর ১০ টা সাধারণ মেয়ে যেমন বাবার বাড়ী যায়, নানা, নানির আদর পায় নাতী নাত্নীরা সে ভাগ্য আর হয়নি নুপুরের,তার সন্তানদের । অনেক বার দেখতে চেয়েছে বাবাকে, বাবা মেয়ের মুখ দেখতে চাননি। ওপাশ থেকে চোখ মোছার দৃশ্যটা স্পষ্টই ভেসে উঠে।
যাক যেদিন গেছে মনে করো না। তোমার সন্তানেরা কে কি করে?
তিন ছেলে মেয়ে, বড় ছেলে হঠাৎ করেই লেখাপড়া করা অবস্থায় মালয়েশিয়া চলে যায়। বিয়ে করে ওখানেই সেটেল্ড। ১০ বছরে দু’বার এসেছে দেশে। ওদের একছেলে।
আরেক ছেলে ঢাকায়, খুব যেতে বলে, ভীষণ অসুবিধা তাদের বাচ্চা রেখে চাকুরী করতে। ছেলে প্রাইভেট কোম্পানির ম্যানেজার, বউ ডেন্টিস। কিছুদিন ছিলাম, ওদের মেয়ে দেখাশুনার জন্য। আমার অনেক কিছুই বউ এর পছন্দ না। ওরা আধুনিক যুগের, চিন্তায়তো অমিল থাকবেই। তাই বলে আমরা তো বাচ্চা মানুষ করেছি, আমি কিছু মনে না ক রলেও ওদের বাবার ভীষণ আপত্তি। আরিফের কথা জীবনে অনেক পরিশ্রম করেছো, নিজের দিকে তাকাবার সময় ছিল না। এখন ওদের সংসার ওদের দেখতে দাও, আমরা দোয়া করব প্রান খুলে।
মেয়ে এখানেই একটা প্রাইমারী স্কুলে আছে। সকালে ২ বাচ্চা রেখে যায়, স্কুল থেকে ফেরার পথে নিয়ে যায়। খুব ভালোইতো আছো, নাতি, নাত্নীদের নিয়ে।
আমার কিছুতেই মন খারাপ হয় না, কিন্তু সন্তানদের অবহেলাটা বুকের ভিতর দুমড়ে মুচড়ে দেয়। দেবর, ননদ তাদের সংসার নিয়ে ভালো আছে। এই ভাইয়ের বিয়ের কারনে বাবাকে অপমানিত হতে হয়েছে, বাবা মারা গেছেন। সেই কথা অনেক বার বড় ভাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। যাক এসব বাদ দেই , আমরা এখন দাদী, নানী। সত্যি কতটা সময় পিছনে ফেলে এসেছি দেখতো! আমাদের সেই পিছনের গল্প, এইতো সেদিন তাইনা! কিন্তু কতটা পথ পাড়ি দিয়েছি, তাকাও পিছনে!
আসলে তোমাকে একটা গল্প বলব, তারজন্য আমাকে আরেকটু সময় দিবে? আরে আমার কথা শুনতে ভালো লাগে, আর তা যদি হয় প্রিয় কোন স্বজনের। গল্পটা অন্য রকম, আমার ছেলে, মেয়ে, জামাই, বউ আত্মীয় স্বজন অনেকে এটাকে ভালো চোখে দেখেনি, কিন্তু আরিফ এসব কথায় পাত্তা দেয় না।
আমাদের একটা জমি আছে শহর থেকে একটু দূরে, সারাজীবন ভাড়া বাসায় থাকি, তাই ছেলে মেয়েরা চেয়েছে ওদের বাবা যেন রিটায়ারমেন্টের টাকা দিয়ে বাড়িটা করে। সে রাজী না, শুধু বলে সময় হলে দেখা যাবে। দুই বছর আগে সে আগেই রিটায়ারমেন্টের সিদ্ধান্ত নিল। শুধু বলে তোমার স্বপ্ন পুরুনে বাকী কাজ গুলো করব। আমাকে খোলাসা করে কিছু বলে না। দুই বছর আগে বড় ছেলে বউ নিয়ে মালয়েশিয়া থেকে আসলে, ছোট ছেলে বউ, মেয়ে জামাই আমার দেবর ননদদের ও দাওয়াত দেই ।
আমি আগের দিন থেকে রান্নার জোগাড় করতে থাকি। সকালে উঠে ফজর নামাজ পড়ে আরিফ বলে তোমাকে রান্না করতে হবে না। কাচ্চি বিরিয়ানি আর মুরগীর রোস্ট মিষ্টি আমি অর্ডার দিয়ে এসেছি। ১১ টায় তুমি আমার সাথে বাইরে যাবে। আমি অবাক হই, বলে কি! এমন করছে কেন!!
শেষ পর্যন্ত ফরিদপুরের নক্সীকাথা থেকে নক্সা করা লাল জামদানী কিনে নিয়ে গেল চাঁদনীতে। ওখানকার মেয়ে গুলো আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছে, এই বয়সে এই মহিলাকে সাজাতে হবে!
খুব অস্বস্তি নিয়েই রিক্সা থেকে নামলাম বাসায়। ছেলে মেয়ের চোখ কপালে, মা আব্বু এসব কি করছে এই বয়সে? আমাদের তো সমাজ আছে নাকি?
আমার কথা হারিয়ে গেছে, লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। ওদের বাবা এগিয়ে এলো, এর মধ্যে আমাদের উঠনে সবাই জড়ো হয়ে গেছে কি হচ্ছে এসব দেখার জন্য।
তোমরা সমুদ্র, পাহাড়,চা বাগান, দেখতে যাও, পৃথিবীর সৌন্দর্য্য উপভোগ করো প্রিয়জনকে সাথে নিয়ে, আর সেটাই করা উচিৎ।
তোমার মা, আমি জীবনে দু’জনকে ভালো করে তাকিয়ে দেখারই সুযোগ পাইনি, সেই যে আমার শূন্যহাত ধরেছে! আমারও তো অনেক শখ ছিল, ভালো একটা শাড়ীও তোমার মাকে দিতে পারিনি কোনদিন। আমিই তোমার মাকে সাজিয়েছি, স্বপ্ন পুরন হবার জন্য নয়, নতুন করে বাঁচব বলে।
আমার বাড়ী করার সাধ্য নাই শহরে, যে জমিটা আছে সেটা তোমাদের তিন ভাইবোনের জন্য রেখে দিলাম। আর আমি প্রতি মাসেই যে বাড়ীতে যেতাম গত এক বছর ধরে, আমি একটা পুরানো বাড়ী কিনে ঠিক করেছি এতোদিন ধরে।
তোমার মা নুপুরকে চিঠি লিখেছিলাম সেই প্রথম প্রেমের, আমাদের দুজনেরই ইচ্ছা আর স্বপ্ন ছিল, দিগন্ত জোড়া মাঠের পরে, শান্ত নদী পাড়ে হাত ধরে হাটব। থাকব একান্ত নিরালায়। সাথে থাকবে আমার মা, তোমার মায়ের মা। তোমরা তোমাদের জীবন চালাবে তোমাদের মতো করে। আমরাতো আছিই।
তারপর থেকে আমি, আরিফ, মা আছি সেই মেঠো পথের ধারে শান্ত নদীর পাড়ে। যেখানে বর্ষার ধ্বনি আর টিনের চালে শুনি ঝম ঝম বৃষ্টির শব্দ।
আছি বন্ধু অনেক ভালো, আমি বনলতা হয়ে।
ফোনটা রেখেও আচ্ছন্নে ছিলাম, সেই ভালোবাসা এখনো তেমনি আছে!
অনেক অনেক ভালো থেকো বন্ধু, একজীবনে আর কি চাই!
ভালোবাসার চেয়ে বড় কিছু আছে কি! চোখটা ভিজে আসে ওদের সুখে, কি নির্ভরতা! কত স্নিগ্ধ ভালোবাসা!