রেবেকা স্কুল ও কলেজ জীবনে সাইন্স নিয়ে পড়াশুনা করেছে । সে স্কুলে শিক্ষয়িত্রী হিসাবে কাজ করে, তার ছেলে মেয়েদের পড়াশুনার সাথে সাথে নিয়ম শৃঙ্খলা শিখিয়েছে । এ ছাড়া অংক, বিজ্ঞান ও ইংরিজী পড়াশুনা করাতে সাহায্য করে । সে সব সময় ওদের স্কুল হোম ওয়ার্ক দেখাশুনা, বিশেষ করে অংক, বিজ্ঞান ও ইংরিজী শিক্ষার প্রতি নজর রেখেছে । রেবেকা এবং রহমত ছেলে মেয়েদের শিক্ষা দিয়েছে,” তোমরা কখনও পড়া শুনায় ফাঁকি দেবে না । ” যে সব ছেলে-মেয়ে পড়া শুনায় ফাঁকি দেয়, জীবনে ভালো করতে পারে না । ” মা বাবার ভালো মন্দ চিন্তা-ভাবনা সবই ছেলে মেয়েদের ঘিরে । রেবেকা মেজাজ ঠাণ্ডা করে ছেলে মেয়েদের পড়াশুনা ও দেখা শুনা করতেন। ছেলে মেয়েরা খাওয়া দাওয়া নিয়ে কোনো অভিযোগ করতো না । সংসারের অভাবের জন্য ওরা ভালো কাপড় চোপর পড়তে পারেনি এবং এ নিয়ে কোনো অভিযোগ ও করেনি ।

রেবেকা এবং রহমত ছেলে মেয়েদের কোনো অন্যায় দেখলে আস্তে বুঝিয়ে দেন । ছেলে মেয়েরা ওর চোখের ভাষা বুঝে নেয় । রহমত নিজেও কোনদিন রেবেকার কোনো ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেনি । ছেলে মেয়েরা কোন কিছু রহমতকে বললে, সে বলে তোমার আম্মুকে জিজ্ঞেস করো। মজিদ, আজিজ ও সাকিলা দুই-দুই বৎসরের ছোট বড়ো । ওদের মধ্যে ছিল সুসম্পর্ক , একটা চকলেট কিনলে ও ওরা ভাগ করে খাবে । তিন ভাইবোন সিনেমা দেখতে যাওয়া এবং বসে বসে চিনা বাদাম কিনে খোসা ফেলে শেয়ার করে খাবে। এ ভাবেই ওরা মা বাবার কাছ থেকে শৃঙ্খলা শিখেছে।

দেশে সবে মাত্র ইলেক্শনের গরম হাওয়া বইতে শুরু করেছে । দেশের কলেজ ও ইউনিভার্সিটি গুলি উত্তপ্ত। এরা উঠতি বয়স্ক ছেলে মেয়ে বিভিন্ন সভা সমিতি গুলিতে যোগদান করে অতিরিক্ত সময় দিচ্ছে ও রোজ রোজ দেরি করে ইউনিভার্সিটি থেকে ঘরে ফিরে । এ নিয়ে রেবেকা ও রহমত অনেক চিন্তিত । মজিদ ও আজিজ ঘরে আসলে রেবেকা বলে তোমরা কেন দেরি করে ঘরে আসো?

মজিদ ও আজিজ বলে আম্মু আমরা বড়ো হয়েছি। তুমি আমাদের জন্য চিন্তা করে অসুস্থ হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা ইউনিভার্সিটি ক্লাস করে লাইব্রেরি ওয়ার্ক করি। তাছাড়া দুই জনে ছাত্র পড়িয়ে ঘরে আসতে দেরি করি । রেবেকা বলে সবাই বলা বলি করে দেশের অবস্থা ভালো নেই। সে জন্য দেরি করে আসলে আমরা দুশ্চিন্তা করি । চারিদিকে হই চৈ, দেশে গন্ডগোল হতে পারে। সে জন্য বলি কাজ সেরে সোজা সোজি ঘরে চলে আসবে।

সাকিলা ইডেন কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্রী ,ক্লাস করে মজিদ ও আজিজের সঙ্গে ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি করে ঘরে চলে আসে। সে বলে আম্মু,’ তুমি কেন আমাদের বিশ্বাস করো না ? আমি প্রতি দিন ওদের সঙ্গে লাইব্রেরিতে হোম ওয়ার্ক করে ঘরে আসি। ‘ ওরা ছাত্র পড়াতে যায় এবং সে জন্য আসতে দেরি হয়। রেবেকা বলে , দেরি হতে দেখলে আমার দুশ্চিন্তা হয় । সাকিলা বলে মন খারাপ করলে ওদের তুমি ইউনিভার্সিটি না পাঠিয়ে ঘরে বসিয়ে রাখো, তাহলে আর ভয় লাগবে না । রেবেকা বলে তুই মুখে মুখে ফাজলামি করিস ,, তোকে জোরে একটা চড় মারবো। সাকিলা হাঁসে এবং বলে সব সময় কথায় কথায় বল,” তোকে জোরে একটা চড় মারবো। ” সাকিলা হাঁসে এবং রেবেকাকে জোর করে ধরে আদর করে।তুই কথায় কথায় আমার সঙ্গে ফাজলামি করছ । তোকে আমি কি বলবো?

আচ্ছা আম্মু, আর দুষ্টামি করবো না । আম্মু তুমি বুঝতে চাও না । ওরা দুই জনে অনেক আজ করে । মজিদ ও আজিজ ঘরে ফিরে আসলে সাকিলা বলে, শুনছ ” আম্মু কারফিউ দিয়েছে। মজিদ বলে, যেমন! তোমরা কাল থেকে আর দেরি করতে পারবে না । সকাল সকাল ঘরে ফিরে আসবে। ” ওরা হাঁসে ।

কেন আম্মু ?

তোরা দেখস না চারি দিকের কি অবস্থা। সারা শহর কি রকম রাজনৈতিক উত্তপ্ত হাওয়া বইতেছে । ওসব বাদ দাও । আমাদের অনেক খিদে পেয়েছে। আজ কি রান্না করেছো?

ইলশা মাছ দোপিঁয়াজা , আলুর ভর্তা এবং ডাল । মজিদ বলে আব্বু তুমি চাঁদপুরের মানুষ সে জন্য ইলশা মাছ বেশি পছন্দ করো। রহমত বলে কেন তোমরা ইলশা মাছ পছন্দ করো না ?
করি, তবে তোমার মতো করি না ।

তোমরা কোন মাছ বেশি পছন্দ করো ?

আমরা কাতল, রুই, পাঙ্গাস এ সব বড়ো বড়ো মাছ পছন্দ করি। তুমি কি সব সময় খাওয়াতে পারবে?

না, আব্বু আমরা দুষ্টামি করি। তুমি যা আনো, আর আম্মু যা রান্না করে তাই পছন্দ করি। সকালে ঘর থেকে খেয়ে গেছো , বিকেলে কিছু খেয়েছ?

আম্মু ,তুমি রুটি আর ভাজি দিয়েছিলে এবং আমরা দোকান থেকে চা নিয়েছি । তন্মধ্যে ,রেনু এবং নাজমুল আবার এসে ভাগ বসিয়েছে । রেবেকা হাসে এবং বলে ওরা খুব সরল , কোনো কিছু মনে করে না, যখন যা দেই খেয়ে নেয় এবং না করে না । সাকিলা বলে ওরা নিজে ও এটা সেটা দোকান থেকে কিনে এবং আমাদের সঙ্গে শেয়ার করে। বাবা বড়ো লোক পয়সার অভাব নেই। ঘর থেকে অনেক পয়সা নিয়ে আসে । মাঝে মধ্যে ক্লাস না থাকলে রেনু নিউ মার্কেট যায় আমাকে নিয়ে এবং চমচা, সিঙ্গারা ও চা খাবে । আমি যদি পয়সা দিতে চাই, রাগ করে বলে আমি তোমাদের বাসায় গিয়ে আন্টির হাতের রান্না না খেলে পেট ভরে না ।

রহমত ছেলে মেয়েদের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে এবং মনে মনে বলে এরা একালের ছেলে মেয়ে। এরা আমাদের চেয়ে অনেক বুদ্ধি রাখে যা আমি কোনো দিন ও দেখি নি বা শিখি নি। আমি সে যুগে পরের বাড়ি খেয়ে এবং ছেলে মেয়ে পড়িয়ে স্কুল কলেজে গিয়ে যা শিখেছি তা বই পুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এরা সব কিছু দেখে শুনে শিখে ।

খাওয়া দাওয়ার পর একটু আলাপ করে মজিদ ও আজিজ দুই জনে তাদের রুমে গিয়ে টেবিলে অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশুনা করে। সাকিলা কোনো কিছু না বুঝলে তার রুম থেকে এসে ওদের সঙ্গে আলাপ করে। অনেক সময় মাঝ রাতে ওরা কিচেনে এটা সেটা রান্না করে খায়।রেবেকা না ঘুমালে, ওরা বলে আম্মু তুমি কি চা খাবে?

রেবেকা বলে না আমি খাবো না । অথবা কোনো কোনো সময় গিয়ে ওদের সঙ্গে এটা-সেটা শেয়ার করে।

পরদিন মজিদ রেবেকাকে বলে,আম্মু আমরা আগামী মাসে ইউনিভার্সিটি থেকে ছাত্র ছাত্রী এবং কিছু টিচার মিলে ইন্ডিয়া শিক্ষামূলক ট্যুরে যাবো।

কাল রাত বলো নি কেন?

ভাবছি আস্তে আস্তে বলবো।

কত দিনের জন্য যাবে?

তিন সপ্তাহের জন্য। এটা তো খুবই খুশির খবর ।

কিন্তু তোমাকে কত টাকা দিতে হবে?

আমার নিজস্ব কিছু জমানো টাকা আছে । তোমাদের কিছু দিতে হবে না ।

রেবেকা বলে,দেব কিছু ।

মজিদ বলে সে দেখা যাবে, দিলে সামান্য কিছু দেবে।

বিকেলে রহমত কাজ থেকে আসলে রেবেকা বলে মজিদ অগামী মাসে ভারতে স্টাডি ট্যুরে যাবে ।

রহমত বলে , সে তো অনেক খুশির খবর। আসা যাওয়া এবং পকেট খরচের জন্য কত টাকা দিতে হবে? মজিদ বলেছে , ওর নিজস্ব কিছু জমানো টাকা আছে এবং ইউনিভার্সিটি ও তাদের খরচ বহন করবে কিনা জানে না । সে দেখা যাবে।

বিকেলে মজিদ ঘরে আসলে রেবেকা বলে, তোমার আব্বু অনেক খুশি হয়েছে এবং টাকা লাগলে আমরা দেবো । আম্মু এ নিয়ে চিন্তা করবে না । আমরা অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে আলাপ করে দেখবো । তাছাড়া নাজমুল এবং আমি একত্রে কেনা কাটা করবো। আমরা দুই জনে ছোট ছোট দুইটা লাগেজ নেবো। আব্বুর একটা হ্যান্ড ব্যাগ আছে ওটা আমি নেব। কিছু কাপড় চোপড় লাগবে । সে দেখা যাবে , এখন ও এক মাসের উপর আছে।

বিকেলে নাজমুল এবং মজিদ ক্লাস থেকে বের হয়ে বলে দেখি একটা লিস্ট তৈরী করি কি কি জিনিস আমাদের কিনতে হবে। ওরা ইউনিভার্সিটি মধুর ক্যান্টিনে বসে চা ও হালকা খাওয়া সেরে বসে একটা লিস্ট তৈরী করে । টিচার যাওয়ার রুট ঠিক করেছে। আমরা এখান থেকে সবাই স্টিমারে খুলনা, তারপর বাসে যশোহর বেনাপোল বর্ডার পয্যন্ত গিয়ে ও পারে ট্রেন ধরবো। ট্রেনে শিয়ালদহ স্টেশন পয্যন্ত গিয়ে এক রাত্র হোটেলে থাকবো । আমাদের জন্য ইউনিভার্সিটি থাকার ব্যবস্থা করবে। ইউনিভার্সিটি ফান্ড আছে এবং কিছু পয়সা দেবে ।

ওরা আলাপ করে দুইজনে খানিকটা সময় রেস কোর্স গিয়ে বসে ফেরিওয়ালার নিকট থেকে বাদাম কিনে খোসা ছড়াচ্ছে আর বই খুলে আজকের পড়া নিয়ে আলাপ করছে। একটা ছোট্ট মেয়ে জীর্ণ চেহেরা হাত পেতে বলে ,’ সারা দিন না খেয়ে আছি ।’ নাজমুল ও মজিদ পকেট থেকে দুই টাকা দিয়ে বিদায় দেয়। মজিদ বলে “দেখো মেয়েটি কি রকম রোগা , বোধ হয় সারাদিন না খেয়ে আছে ! ” তুমি আর আমি পরিশ্রম করে পড়াশুনা করে হয়তো কিছু করবো। এরাও তোমার আর আমার মতো মানুষ, এদের জন্য কেউ কি ভাবে?

দোস্ত, তুমি ঠিক বলেছো। এই বলে ওরা নিজেদের কাজে মনোযোগ দেয় ।

আজ রেনু ও সাকিলা ক্লাসের শেষে দুই জনে টিচার স্টুডেন্ট সেন্টারে গিয়ে একটা গানের অনুষ্ঠান উপভোগ করে। শিল্পী ছিল ফিরোজা বেগম ও আরও কয়েক জন ছাত্র ছাত্রী । সাকিলা বলে ফিরোজা বেগমের গান আমার খুবই ভালো লাগে। রেনু বলে আমারও । পরে দুই জনে সাকিলার বাসায় এসে দেখে রেবেকা রান্না শেষ করে ঘর পরিষ্কার করে বাগানে গাছে পানি দিতেছে। সাকিলা বলে আম্মু তুমি আজ কি রান্না করেছো ?

রেবেকা বলে গুঁড়া মাছ, শাক, ডাল। তবে কালকের পুরানো তরকারি আছে। সাকিলা চা তৈরি করে মুড়ি পিয়াজ, চানাচুর ও সরিষার তৈল দিয়ে মেখে বাগানে গিয়ে বসে খেয়ে রেনুকে বিদায় করে। রেবেকা বলে, রেনু নিজের মনে করে এসে খেয়ে যায় । আমার খুব ভালো লাগে। সাকিলা বলে আম্মু আমি এবং ভাইয়া ওদের বাসায় গেলে ও তাই করি। রেবেকা বলে, ভালো, আমি পছন্দ করি। আমি কোনো আনুষ্ঠানিকতা পছন্দ করি না । এতে মানুষের আন্তরিকতা বুঝা যায়। সাকিলা বলে , আম্মু সব লোক এক রকম নয়, আমাদের কিছু কিছু বন্ধু আছে ওরা অনেক আনুষ্ঠানিক নিয়ম কানুন মেনে চলে । ওদের বাসায় যেতে হলে আগে থেকে বলতে হবে । কারণ ওদের অনেক ধরণের ব্যস্ততা থাকে। যেমন সীমা আন্টিদের বাসায় হুট্ করে যাওয়া যায় না, আঙ্কেলের অনেক ধরণের ব্যস্ততা থাকে। ওরা রুটিন মোতাবেক চলাফেরা করে এবং আমি ওদের বাসায় অস্বস্তি বোধ করি । তবে আরিফ এবং নাবিলা আমাদের অনেক পছন্দ করে। রেবেকা বলে, ওটা তুমি মনে মনে ভাব। ওরা আমাদের অনেক পছন্দ করে। আমরা গেলে ওরা সব সময় বাহির থেকে খাওয়া এনে আপ্পায়ন করায়।

পর দিন সাকিলা সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে রাফাতের সঙ্গে দেখা। রাফাত বলে আমি কয়েক দিন তোমার কলেজ গেটে গিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি। সাকিলা হাসতে হাসতে বলে কেন ?

মেয়েদের কলেজের গেটে অযথা দাঁড়িয়ে থাকলে সিকিউরিটি মনে করবে, “তুমি বখাটে ছেলে।”

কেন আমাকে ছাড়া থাকতে পারো না ?

রাফাত বলে আজ কলেজে না গেলে হয় না?

বাদ দাও, একদিন না গেলে চলবে। আজ না, অন্য একদিন এই বলে সাকিলা পাস কাটিয়ে ইডেন কলেজের গেট থেকে ভিতরে চলে যায়।ভিতরে ঢুকার পথে রেনুর সঙ্গে দেখা। রেনু বলে ও কে তোমার সঙ্গে কথা বলছিল?

সাকিলা অন্য মনস্ক অবস্থায় পাস কাটিয়ে ক্লাসে চলে যায়। রেনু ওর দিকে তাকিয়ে মুখের রং ফ্যাকাসে দেখে আর কিছু না বলে চুপ করে ক্লাসে ঢুকে । রেনু মনে মনে লজ্জিত হয়, ওটা তার ব্যাক্তিগত ব্যাপার, আমার কিছুই বলা উচিৎ ছিল না । বিকেলে ক্লাসের শেষে সাকিলা বলে এই ছেলেটা আমাদের পূর্বের ভাড়া বাসার প্রতিবেশী। রেনু বলে ও কি করে?

সাকিলা বলে কিছুই করে না ভবঘুরে ।রেনু বলে ওকে দেখলেও ভবঘুরে মনে হয়। সাকিলা বলে আমি এড়িয়ে চলি। কিন্তু সে আমার পিছু পিছু থাকে।

রেনু বলে,সাকিলা এ সব বখাটে ছেলে পেলেদের সঙ্গে কথা না বলে সব সময় এড়িয়ে চলা ভালো। খালা-আম্মা শুনলে অনেক রাগ করবে। তা আমি জানি এবং সব সময় ওকে বলে ও থাকি। কিন্তু সে একটু একটু করে এগুচ্ছে। ওর সঙ্গে আর কথা বলবে না । তাছাড়া তুমি এখন কলাবাগান থাকো না । তোমার ওর সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা না । কিন্তু সাকিলা সব কিছু রেনুর কাছ থেকে লুকিয়ে ওর সঙ্গে মাঝে মধ্যে সিনেমা দেখতে যায় এবং এখানে সেখানে ঘুরা ঘুরি করে।

এ দিকে মজিদ , নাজমুল ও দলের অন্যান্যদের ভারতে যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এসেছে । ইউনিভার্সিটি থেকে ওদের যা যা কেনা কাটা করা দরকার তার একটা লিস্ট দিয়েছে । মজিদ তার কেনা কাটার লিস্ট নিয়ে ঘরে এনে রেবেকাকে দিয়ে বলে আম্মু, তুমি একবার আমার সঙ্গে বাজারে যাবে এবং আমি নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে কিনে নেবো। রেবেকা রেগে গিয়ে বলে, তোকে একটা চড় মারব আবার যদি বলিস তোর পকেটের পয়সা দিয়ে কিনবি। মজিদ হেঁসে বলে থাক, তুমি যা ভালো মনে করো। রেবেকা মজিদের শার্ট, প্যান্ট ও টুকিটাকি জিনিস আগেই কিনে রেখেছে এবং কিছু কিছু জিনিস কেনা দরকার। মজিদকে নিয়ে গিয়ে কিনে নিয়ে এসে ওর আব্বুর হ্যান্ড ব্যাগ ঠিক করে বলে দেখো তোমার আর কি লাগবে?

আম্মু আমার আর কিছুই লাগবে না ।

বিকেলে নাজমুল এসে বলে আন্টি তুমি কি ওর জিনিসপত্র সব কিনে ফেলেছো?

রেবেকা ব্যাগ খুলে সব কিছু দেখিয়ে বলে আর কিছু কি লাগবে?

নাজমুল বলে আন্টি তুমিতো সবই গুছিয়ে ফেলেছ। আমি তো এখনও ব্যাগ-ই কিনি নি। রেবেকা বলে তুমি মজিদকে নিয়ে দোকান থেকে আর একটা ব্যাগ নিয়ে এস।

কিছুক্ষণ পর রেনু ও সাকিলা এসে দেখে রেবেকা মজিদের ব্যাগ গুছচ্ছে। রেনু বলে আন্টি তুমি তো দেখি সবই গুছিয়ে ফেলেছ। আমরা তো ভাইয়া র কিছুই এখন পয্যন্ত গুছাই নি।রেবেকা বলে তোমাদের ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা। আমরা দামে সস্তা দেখে শুনে জিনিসপত্র কিনি। তোমরা লাট-বেলাট, চিন্তা করোনা । পছন্দ হলে কিনে নাও পয়সা-কড়ি যাচাই করা দরকার মনে করো না। রেনু হাঁসে, বলে আন্টি তা না । সবাই দর কষাকষি করে জিনিসপত্র কিনে। আমরা ও তাই। আম্মু একটা জিনিস পছন্দ হলে অনেক দোকান দাম যাচাই করে কিনে।

মজিদ ও নাজমুল এলিফ্যান্ট রোড গিয়ে সুটকেস কিনে আসতে শিক কাবাব ও নান রুটি নিয়ে এসে বলে চলো সবাই যার যার খাওয়া নিয়ে বসে যাও । রেবেকা বলে তুমি আমাদের বাসায় এসে বাহির থেকে খাওয়া আনবে কেন?

নাজমুল বলে আন্টি আমাদের মন চেয়েছে আজ বাহির থেকে খাবো। তোমার হাতের রান্না তো সব সময় খাই। রহমত ও আজিজের জন্য রেখে সবাই খেয়ে বাগানে বসে গল্প করে নাজমুল ও রেনু বাসায় চলে যায়।রহমত অফিস সেরে বাজার করে ঘরে ঢুকতেই দেখে নাজমুল ও রেনু চলে যাচ্ছে। নাজমুল সালাম দিয়ে বলে আঙ্কল আমরা অনেক সময় ছিলাম। আপনি গিয়ে আরাম করেন।

নাজমুল ও রেনুর বাবা অবসর প্রাপ্ত সৈয়ীদ আশরাফ খান এবং মা সাকিনা আখতার। বনানী নিজেদের বাসা। আশরাফ খান সরকারি চাকুরী জীবি এবং সারা জীবন বিভিন্ন শহরে বদলি হয়ে ছেলে মেয়েদের পড়া শুনা করিয়েছেন । ওদের অঢেল পয়সা কড়ি ছিল না । তবে ছেলে মেয়েরা অভাব দেখে নি।

ইউনিভার্সিটি থেকে ওদের যাওয়ার সব রকম ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং পরদিন সকাল ৮টার মধ্যে রওয়ানা দিতে হবে। রহমান, রেবেকা ও ছেলে মেয়েরা সকাল ৭টার দিকে উপস্থিত । কারও কারও উপস্থিত হতে দেরি হলে সবাই ১০টার দিকে রওয়ানা হয়। ওদের কে বিদায় দিয়ে রেবেকা ও রহমান ঘরে ফিরে আসে এবং সাকিলা ও আজিজ ক্লাসে চলে যায়। সদর ঘাট থেকে ওরা স্টিমারে খুলনা এবং ওখান থেকে বাস নিয়ে বেনাপোল বর্ডার এবং ট্রেনে কলিকাতা হাওড়া স্টেশন পৌঁছতে রাত ১০টা বাজে। যেহেতু ওরা স্টুডেন্টস এবং স্টাডি ট্যুরে যাবে, সে জন্য বেনাপোল চেক পোস্টে বেশি ঝামেলা হয় নি।কলিকাতা আগে থেকে ওদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রাতের খাবার পর সবাই যার যার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন বিকেলে হাওড়া স্টেশন থেকে ওরা ট্রেনে রওয়ানা হয়। লম্বা জার্নি করে ওরা পর দিন মুম্বাই ইউনিভার্সিটি গিয়ে পৌঁছে। ইউনিভার্সিটি থেকে আগেই ওদের থাকা খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে ছাত্র ছাত্রীদের কোনো রকম অসুবিধা হয় নি। ওদের সঙ্গে একজন মহিলা সহ তিন জন টিচার সর্বক্ষণ ছিল। তাছাড়া মুম্বে ইউনিভার্সিটি থেকে দুইজন টিচার গাইড হিসাবে সব সময় ছিল। মুম্বে ইউনিভার্সিটি কারিকুলাম এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটি কারিকুলাম মিলিয়ে ওরা শিক্ষা মূলক আলোচনা করে । ছাত্র-ছাত্রীরা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ও অনেক চিত্র তারকাদের সঙ্গে দেখা করে ওদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে খুঁটিনাটি জেনে নেয়। যদিও এটা তাদের ইউনিভার্সিটি কারি -কুলামের মধ্যে ছিল না । টুরিস্ট বাস নিয়ে সবাই মুম্বাই সমুদ্র সৈকত ও বিভিন্ন আকর্ষণীয় স্থানগুলি দেখে মুগ্ধ হয়।

১০দিন মুম্বে থাকার পর ওরা দিল্লী গিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক এলাকা যেমন লাল কেল্লা, কুতুব মিনার ও ঐতিহাসিক স্থান গুলি দেখে দিল্লী থেকে আগ্রা বাসে গিয়ে সারা দিন থেকে তাজমহল, আগ্রা পোর্ট ও অন্যান্য স্মৃতি দেখে পুনরায় দিল্লী চলে আসে।

এবার তাদের ফেরত জার্নি । দিল্লীতে আরও একদিন থেকে ট্রেন লম্বা জার্নি দুই দিকের দৃশ্য দেখতে দেখতে ওরা এক সময় কলিকাতা চলে আসে। কলিকাতা তাদের দুই দিন বিরতি এবং এ সময় ওরা ইউনিভার্সিটি, মেমোরিয়াল ও ঐতিহাসিক এরিয়া দেখে পুনরায় ট্রেন যোগে পেট্রাপোল স্টেশন নেমে বেনাপোলে বর্ডার পয্যন্ত এসে ইমিগ্রেশন ও কাস্টম চেকিং এর পর খুলনা গিয়ে স্টীমার যুগে ঢাকা পৌঁছে। এত লম্বা জার্নি করে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে, ফলে সবাই দুই দিন ক্লাসে যেতে পারে নি।

তাদের এই ভ্রমণ কাহিনী একটা প্রজেক্ট হিসাবে সাবমিট করার কথা নিদৃষ্ট সময়ের মধ্যে যা তাদের ক্লাস assignment হিসাবে দিতে হবে। ১০দিন সময় পেয়েছে assignment তৈরি করে সাব মিট করার জন্য । সবাই লেখা নিয়ে ব্যস্ত এবং ফাইনাল পরীক্ষার দিন ক্ষণ দুই মাস পর। মজিদ এবং নাজমুল ইউনিভার্সিটি আবাসিক হলে থেকে বাকি সময় পরীক্ষার জন্য তৈরী হয়। সময় মতো ওদের পরীক্ষা হয়ে গেলো।
ক্রমশ:

পূর্ববর্তী নিবন্ধএখনো বনলতা
পরবর্তী নিবন্ধঅবসর
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন