আমাদের ঈদ ছিল অন্য রকম আনন্দের। বাড়ীটা ছিল আমাদের চার কাকার ও আমার বাবার। সাথে আরোও আছেন আমার চাচাত ভাই ও তাদের ছেলে মেয়েরা, সুতরাং ডাল পালা বেড়ে বাড়ীটা জম জমাট। সারাদিন খেলা আর খেলা আমাদের অবসর নাই।

চাচাত বোনেরা শ্বশুর বাড়ী, তাদেরও আনতে হবে ঈদ করার জন্য। তাদেরকে নায়রী আনা হতো। এই কাজটা আমরাই করতাম। দল বেধে চাচাত বোনদের আনতে যেতাম। শুরু হতো বিশ রোজার পর থেকে। বোনেরা না আসলে আমাদের আনন্দ সম্পুর্ন হতো না ।

ঈদের আয়োজনের প্রধান কাজ ছিল বাড়ী ঘর পরিস্কার করা। উঠান, বাহির বাড়ী ও ঘর লেপা। আমাদের গ্রামে কয়েকজন মহিলা ছিলেন যারা এই কাজটা খুব আনন্দ নিয়ে করতেন।
আমাদের কাজ ছিল তাদের ডেকে আনা। বাড়ি ঘর চকচকে, আতপ চাল রেডী, মুড়ি ভাজা হতো রোজার আগেই।

আমাদের গ্রামে দু’জনের নাম ছিল হামেদ। শিক্ষিত হামেদ সে আমাদের কাকা। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার তাই তার মা আদর করে ডাকতেন সামেদ।
আরেক জন হামেদ ফকির। ছয় ফুটের উপরে লম্বা, ওনার চেহারা যেমনই হোক ওনাকে গ্রামের ডাকত চিকা হামেদ। আমরা যে কোন উছিলায় ওনার বাড়ী যেতাম, ওনার অন্ধ বৌকে কাজে ডাকার জন্য। একজন কথা বললে অন্য ৫জন একটা বিশেষ ধরনের শব্দ করতাম। এই নিয়ে বাড়ীতে বহু বার নালিশ আসছে, মিয়া ভাই (বড় চাচাত ভাই) তার ছেলে মেয়ে সহ সবাইকে মৌখিক শাসনের পরে বেত দিয়ে মারছেন, কিন্তু আমরা গোপনেও হলেও ওনাকে ক্ষেপাতে মাঝে মাঝে ওনার বাড়ীতে যেতাম, আর ওনাকে আসতে দেখলে তো কথাই নাই, ওনাকে জোর করে বসার জন্য চৌকি দিতাম। উনি প্রথমেই নালিশ দিত এই বাড়ীর পোলাপানের মতো এতো খারাপ আর নাই। ( আসলেই ভালো ছিলাম না)।

ছওয়াব দিয়ে শুরু হতো ঈদের প্রস্তুতি। ২৬ রোজাতে যেতাম মেন্দী আনতে টিন সামছু ভাইদের বাড়ী। ওনাদের টিনের ব্যবসা ছিল তাই তার উপাধি টিন। বড় গাছ, সারা গ্রামের মানুষ মেন্দি নিত ওই গাছ থেকে। বিকেলে বিশেষ কায়দায় বাটা ওই মেন্দি দিতাম হাতে, আর নখে। ওই রং যদি নখে কোরবানি পর্যন্ত রাখা যেত, ছওয়াবের আর শেষ নাই।

তারপর শুরু হতো কদর নামাজের ছওয়াব। রাতে গোসল করে সেই কাপড় চিপরানো যাবে না। যত ফোটা পানি কাপড় থেকে পর‍বে, তত ছোওয়াব। সেই কাপড় রাখতে হবে গাছের ডালে। এসব আমরা কোথা থেকে আবিস্কার করছি জানি না। এসব করার জন্য আমাদের হুজুর আমিনুদ্দীন বিশ্বাস আমাদের শাসন ও মাই র দুটোই দিয়েছে কিন্তু কাজ হয় নাই। ওয়াদা ছিল কেউ যেন তাকে না বলি, কিভাবে উনি জানতেন আজোও রহস্য। কারন মার খাওয়া থেকে গ্রুপের কেউতো বাদ যেতাম না।

তারপর গন নামাজ নওয়া চাচীর ঘরে। বাড়ীর সব মেয়েরা ওই ঘরেই থাকতাম কারণ আমার চাচী তিন মেয়ে নিয়ে অনেক আগেই বিধবা। সেটাই মেয়েদের থাকার ঘর,আড্ডার জায়গা। আমাদের সেই বোনেরা আসে নায়রী,চাচী সারা বছর ই একা।
নামাজের এক সময় হঠাৎ হাসির শব্দ শুরু হতো। নামাজ ভংগ, আবার শুরু করতাম, এভাবেই রাত শেষ। তখনও কাপড় থেকে পানি পরত,আর বাকী সোওয়াব চলতে থাকত।

২৬রোজায় আব্বা আর মিয়াভাই বাড়ীতে আসতেন। আব্বার ছিল হোন্ডা, সেটাতে চড়ার আশায় সবাই যত তাড়াতাড়ি পারি কাজ শেষ করতাম। আব্বাকে কেউ ভ য় পেত না, সাত ভাই এর সবার ছোট। কারো কুটি চাচা, বা দাদা। আমরা ভয় পেতাম মিয়া ভাইকে। বাড়ির যার ছেলে মেয়েই হোক অকাজ করলে বা নালিশ আসলে মিয়া ভাই এর বেতের বাড়ি।

চাদ দেখার সাথে সাথে শুরু হতো বাজী ফুটানো। শুরু হলো ঈদ। চান রাতে আমরা ছোটরা সবাই এক ঘরে থাকতাম। চাচাত ভাই বোন ভাতিজা ভাতিজি সবাই। সেখানে সারারাত গল্প, ভূতের কয়টা পা কে দেখছে আর আগামী কাল থেকে আবার শয়তান ছাড়া পাবে!! আরোও কত গল্প যে হতো। মাঝএ খানে থাকত হ্যাজাক বাতি আর আমাদের এক বোন আছেন, যিনি ২০ বছরে বিধবা হয়েছিলেন। সেই রাহেলা বুজি সবার দায়িত্বে থাকতেন। এভাবেই ভোর, কার আগে কে গোসল করতে পারে এই প্রতিযোগিতা। যত শীতই থাকুক পুকুরে ডুব দিয়ে গোসল।

ছোট বেলায় আমরা সবাই মা’র বানানো জামা পরতাম। ওটাই ছিল বড় আনন্দের বিষয়। আমরা বাড়ির বড় সবাইকে ছালাম করতাম। তারপর আমার মামা, খালা বাড়ী হয়ে বড় কাকার বাড়ী যেতাম। আমরা দল ধরে থাকতাম সব সময়। ১০ জন। আমরা ছিলাম বাড়ীর তৃতীয় গ্রুপ। কোথাও একা যেতাম না। এই গ্রুপের লিডার ছিল আমার চাচাত ভাই মোস্তফা (পচা) । অনেক সাহসী ছিল, আমার চেয়ে ২ বছরের বড় কিন্তু অনেক মার খেয়েছি খেলার সময় মিথ্যা বলার কারনে।
ও যখন মারত, ওকে শোধ দিতে না পারলে বলতাম তোর মা যেন মরে যায়। সত্যি হঠাৎ ডায়রিয়া হয়ে আমার ধলা চাচী (৫ নাম্বার) চাচী মারা যান ৭৫ এ। তারপর সেই ভাইটিও চুপচাপ হয়ে যায়, সেই দুরন্তপনা থেমে যায় । ক্যান্সারের কাছে হার মানে চলে যায় অন্যপারে ১৭ বছর বয়সে ৮১ সনে। অনেক গল্প আছে, আমার সোনা ঝরা দিনে লিখছি।
ছিল রোজা রাখার প্রতিযোগিতা,কে কয়টা রোজা ভাংলো সেটাও খেয়াল রাখতে হতো। মা যদি ভোর রাতে না ডাকে সেজন্য আমরা মেজো চাচীর ঘরে থাকতাম। বড় বড় দুইটা চকি পাশাপাশি। সুতরাং সমস্যা নাই, রোজাদাররা সবাই সেখানে। ভোর রাতে চাচী ভাত, তরকারী রান্না করে সবাইকে ডাকতেন। রাতে বাথরুমে যেতে খুব ভয় পেতাম, কিন্তু আমার চাচী সারারাত একজনের পর এক জনের সাথে উঠতেন। কোন দিন রাগ হতেন না। যত আব্দার চাচীর কাছে। আমাদের পরিচিত জন সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন আমাদের দেখা একজন শ্রেষ্ঠ নিরংহকারী দয়ালু মানুষ ছিলেন। আমার চাচী ছিলেন ফরিদপুরের বিখ্যাত পাল বাড়ীর মেয়ে।

বুঝতে পারি বেলা অনেক গড়িয়েছে, অনেক অনেক দূরে চলে গেছে আমাদের অনেক প্রিয়জন। লাইন ধরে সাতটা টিনের ঘর,এক লাইনে রান্না ঘর । বিশাল বাহির বাড়ী। মাঝখানে কাচারি ঘর। বাড়ীর সব ছেলেদের আলাদা বাথরুম পুবের ভিটার পাশে। বাড়ীর সামনে বড় রাস্তা ও পাশে দিগন্ত জোরা ফসলের ক্ষেত। চরের ওপাড়ে বাড়ি গুলো খুব ছোট দেখা যেত। নদী ছিল ৪/৫ মাইল দূরে। আজ সব স্মৃতি হয়ে গেছে। তবুও মন বলে আবার যদি আসতো ফিরে সেই দিন!! মনে পরে সব খেলার সাথীদের, খোকন, লিপি, লিনা, আলমগীর, মাসুদ, নাজমা, আলী, মনি, ছরো সবাইকে। চলে যাচ্ছি সবাই দূর থেকে বহু দুরে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন