ছোটবেলায় এই New years resolution বা নতুন বছরের ইরাদা কথাটি খুব একটা শুনিনি, অথবা শুনে থাকলও তেমন খেয়াল করা হয়নি। তবে জিনিষ্টি গুরুত্বপূর্ণ বটে। অনেকেই  বেশ ঘটা করে বা উৎসাহসহকারে নতুন বছরের দিনটি আসতেই বিভিন্ন ধরণের ইচ্ছা বা পরিকল্পনা করে থাকেন, এবং শোনা যায় অনেকেই নাকি এই পরিকল্পনা বা লক্ষ ঠিক রাখতে পারেন না এবং আবারো আর একটি বছর আসে, আবারো নতুন পরিকল্পনা হয়, এইভাবেই চলতে থাকে। তবে আবার অনেকেই তাদের পরিকল্পনা বা লক্ষ্যমতে এগিয়ে যেতে পারেন।

আমি মনে করি, এই জাতীয় পরিকল্পনা, লক্ষ, ইচ্ছা বা ইরাদা যাই বলি না কেন খুব বড়োসড়ো বা জটিল কিছু না করে ছোট ছোট কিন্তু অর্থবহ এবং অর্জনযোগ্য কিছু করা ভালো। তাতে করে এই ছোট ছোট ইচ্ছা/পরিকল্পনা গুলি সম্পন্ন হওয়া একটু সহজ হয় এবং এই সম্পন্ন হওয়ার আনন্দ নিজেকে অনেক উদ্যোগী বা self-motivated করে তুলে, যা কি না সামনের জটিল বা কঠিন সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে।

বিশেষ করে আমাদের জন্য বিগত দুটি বছর খুব জটিল বা heavyweight ছিল, এবং সেক্ষেত্রে নতুন কোনো পরিকল্পনাতো দূরে থাক, জীবনটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই ছিল কঠিন। যাহোক পরমকরুণাময়ের কৃপায় আমরা পার করে দিলাম সেই সংকটপূর্ণ দুটি বছর। নতুন বছরের শুরুটাও যে খুব একটা সংকটমুক্ত তা ঠিক নয়, তবে সময় থেমে থাকছে না, নতুন সময় আসছে এবং আসতে থাকবে অন্তত কেয়ামত পর্যন্ত। তাই আমাদেরকে আশাহত হলে চলবে না। আমি মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর একটা উক্তি এই সময়ের জন্য খুব Relevant বলে মনে করি। “I hated every minute of training, but I said, ‘Don’t quit. Suffer now and live the rest of your life as a champion.” – Muhammad Ali

ঠিক তেমনিই আসুন আমরা সবাই এই সময়টাকে ধৈর্যসহকারে পার করে দেই সে যত কষ্টই হোক অথবা এই কঠিন সময়কে যত অপছন্দ করিনা কেন। মোহাম্মদ আলীর মতো এখন ধৈর্যের সাথে সময়টা পার করলে সামনের দিনগুলি অনেক ভালোভাবে পার করতে পারবো। কেন এরকম হলো বা কেন এরকম হচ্ছে, বিগত শত বছরের মধ্যে এমন সংকটতো দেখা দেয়নি, তাহলে কেন আমাদের সময় ইত্যাদি চিন্তা বা প্রশ্ন না করে, আসুন আমরা এই সংকটময় সময়টাকে Accept করে বা মেনে নিয়ে আমাদের সাধ্য ও সামর্থ দিয়ে পার করে দেই, এবং খোঁজার চেষ্টা করি “মন্দের ভালো”. ক্রাইসিস কারোরই কাম্য নয়, তবে কমবেশি সব ক্রাইসিস এর মধ্যেই কিছু না কিছু ভালো জিনিস লুকিয়ে থাকে। একটু মনোযোগ দিয়ে খোঁজার চেষ্টা করুন দেখবেন পেয়ে যাবেন।

যাহোক ফিরে যাই নতুন বছরের ইরাদা বা  New years resolutionএ। আমার মতে নতুন কোনো পরিকল্পনার আগে খুঁজে দেখুন গত বছরে পসিটিভ বা ভালো কিছু হয়েছে কিনা। যদি সেরকম কিছু থেকে থাকে তাহলে নতুন বছরের প্রথম resolution হোক সেই পজিটিভ জিনিষগুলিকে কন্টিনিউ করা, তারপর যদি সময় বা ইচ্ছা থাকে তাহলে আপনি ছোটোখাটো এবং Achievable বা অর্জনযোগ্য কিছু Resolution করতে পারেন। নেগেটিভ কোনো চিন্তা বা ভাবনা যদি একেবারে নিজের বা পরিবারের সেফটি/সিকিউরিটির প্রশ্ন না হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তার জন্য বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে বরং সেই সময়কে আপনার জীবনে ঘটে যাওয়া পজিটিভ বিষয়কে ভেবে কাটান। আর একা একা দুশ্চিন্তা বা দুঃসময়কে না ভেবে আপনার পরিচিত কোনো পজিটিভ মানুষের সাথে কথা বলুন বা সময় কাটান। আপনাদের অনেকের হয়তো মনে আছে মেহেদী হাসানের সেই বিখ্যাত গজল, “তানহা তানহা সোচ মাত কার, মার্যায়ী তু”. সংকটকময় বা দুঃসময় সবসময় একা কাটানো ঠিক না। এখন যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ তাই আপনি ঘরে বসেই যোগাযোগ করতে পারেন আপনার পছন্দের মানুষের সাথে।

যাহোক, শেষ করি আমার নিজের কিছু বিগত বছরের মন্দের ভালো এবং আগত বছরের ইরাদা নিয়ে। আপনাদের সকলের মতো আমারো বিগত বছরে অনেক ঝামেলা ছিলো। তার মধ্যে সবথেকে কঠিন সময় কেটেছে গত সামারে আমার কিছুদিন হাসপাতালে কেটেছিল সেই সময়।  COVID কালীন Hospitalization একটা বাড়তি বিড়ম্বনা। যাহোক তার পর রিকভারিতে লেগেছে আরো একমাস। বেশ কঠিন সময় গেছে। যাহোক  আল্লাহর রহমতে এবং অসংখ মানুষের শুভকামনা বা দোয়ার বরকতে সুস্থ হয়ে উঠেছি অপেক্ষাকৃত দ্রুত এবং আগের থেকে শরীরটা বলতে গেলে বেশি ভালো, আলহামদুলিল্লাহ। এখন আসি মন্দের ভালো বিষয় নিয়ে।

COVID কালীন সংকটের মধ্যেও ছোট ছোট কিছু পজিটিভ জিনিস ঘটেছে। যেমন গত বছর এক ভাগ্নে এবং ভাগ্নির কোনোধরনের জটিলতা ছাড়া বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে এবং তারা এখন ভালো আছে। আমার এক ছোটভাই সমতুল্য বন্ধুকে নিয়ে একটি প্রজেক্টের পরিকল্পনা ছিলো সেটি আল্লাহর রহমতে গত স্প্রিঙে বাস্তবায়িত হয়েছে। আর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মন্দের ভালো বিষয়টি ছিল আমার একেবারে ব্যক্তিগত। বরাবরই আমার খুব সকালে ওঠা এবং ফজরের নামাজ সময়মতো পড়া একটা কঠিন কাজ ছিল এবং অধিকাংশ দিনই ব্যার্থ হতাম। তবে স্বাভাবিক জীবনযাপন সে জন্য থেমে থাকে নি।

যাহোক বেশ কয়েক বছর আগে হটাৎ করে রবিন শর্মার জাস্ট ১০ মিনিটের একটি Utube Video চোখে পড়ে। ভিডিওটি বেশ কয়েকবার দেখি। তারপর সেই ভিডিওর সূত্র ধরে তার লেখা 5 AM Club বইটি পড়ি। সেখানে উনি বলেছিলেন আপনার জীবনে নতুন করে কোনো কাজকে অভ্যেসে পরিণত করতে হলে কি করতে হবে, এবং উনি উনার গবেষণায় দেখিয়েছেন পৃথিবীর বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের মধ্যে একটি জিনিস খুবই কমন, সেটি হলো উনারা সবাই অনেক সকালে উঠেন। এই সকল মানুষদের মধ্যে রাষ্ট্রনায়োক, বড়ো বড়ো কোম্পানির CEO, বিলিওনার, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, নামিদামি এথলেট, ধর্মগুরু ইত্যাদি বিভিন্ন পেশার মানুষ রয়েছেন। উনাদের সবারই সকাল শুরু হয় অনেক সকাল থেকে। উনি যাদের নিয়ে গবেষণা করেছেন তারা সবাই সকাল ৫টাতে উঠেন এবং দিন শুরু করেন।

যাহোক উনি বলেছেন কোনোকিছুকে অভ্যেসে পরিনিত করতে হলে একই জিনিস আপনাকে মোটামুটি ৬৬ দিন একইভাবে করে যেতে হবে, তখন আপনার মস্তিষ্কের মধ্যে Automaticity তৈরি হয়ে যাবে এবং তখন আপনার আর কষ্ট করে জিনিসটি করতে হবে না, অটোমেটিক্যালি হতে থাকবে, কিন্তু শুরু করাটা হবে বেশ কঠিন এবং মেসি। তবে লেগে থেকে ৬৬দিন সম্পর্ণ করতে পারলে আপনি কামিয়াব হবেন। শুরুর সময় আমার জন্য কঠিন এবং মেসি হলেও আমার অভ্যাস তৈরী হয়ে যায় ৩০/৪০ দিনের মাথায়। তারপর আর কোনো কষ্ট হয়নি। প্রতিদিন সকাল ৫-৬টার মধ্যে ঘড়ির অ্যালার্ম ছাড়াই ঘুম ভেঙে যায়, এবং সাথে সাথে ৫/৭ মিনিট একটু mindfulness প্রাকটিস, তারপর ফজরের নামাজ এবং ২০/৩০ মিনিট হালকা ব্যায়াম, ১০ মিনিট দিনের প্ল্যান তৈরী করা এবং ১৫/২০ মিনিট কোনো কিছু পড়া, শোনা বা দেখা। তারপর সকালের নাস্তা এবং দিনের শুরু। অভ্যাসটি হয়ে যাওয়ার পরে নিজেকে বেশ accomlished মনে হতো, এবং তখন থেকেই আমার কাছে দিনের সবথেকে সুন্দর সময় হলো সকালের ওই ২ঘন্টা। চারিদিকে শুনশান নীরব, আপনি পৃথিবীর কিছুসংখক লোকের কাতারে সকালের অনাবিল সৌন্ধর্য উপভোগ করছেন যখন বাকিরা আছে ঘুমে আচ্ছন্ন। বর্ণনাতীত একটি ফিলিং।

এইভাবে চলছিল, এবং বাংলাদেশে গিয়েও এর ব্যাতিক্রম ঘটেনি। যাহোক এই অভ্যেসটির ব্যাতিক্রম ঘটে COVID শুরুর কয়েকমাস পরের থেকে। এবং সেইকারণে মনের মধ্যে সবসময় কিছুটা লুজার লুজার অনুভব হতো। ঠিক এইরকম চলতে থাকা অবস্থায় গত সামারে stomach ইনফেকশনএর কারণে হাসপাতালে যেতে হয়। সমস্যা সমাধান হলেও শরীর অনেক দুর্বল হয়ে যায়, শরীরে এনার্জি কমে যায়, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, গলা বসে যায়। বলতে গেলে একটা টোটাল মেসি অবস্থা। হাসপাতাল ত্যাগের পরে ডাক্তার কোনো ধরণের ওষুধ দেননি। বলেছেন আস্তে আস্তে শরীর স্বাভাবিক হবে তবে, খাওয়া দাওয়া এবং দৈনন্দিন এক্টিভিটিস শরীরকে মানিয়ে চালিয়ে যেতে হবে।

যাহোক এই hospitalization আমার কাছে কেন যেন মনে হলো সৃষ্টিকর্তার একধরনের wake up call. শরীর এমন দুর্বল হয়েছিল যে আমার ১০০ গজ হাটতে সময় লাগতো ১০/১৫ মিনিট। বেড থেকে উঠে ওয়াশরুমে যেতে লাগতো প্রায় ৭/৮ মিনিট। অথচ প্রায় প্রতিদিন আমি ৮/১০ কিঃমিঃ হাটতাম বা দৌড়াতাম, অথবা কয়েকশো মিটার সাঁতার কাটতাম। অফিস থেকে sick leave শেষ হওয়ার সাথে সাথে চিন্তা করলাম ইরাদা বা resolution এর জন্য আমাকে নূতন বছরের নতুন দিনের অপেক্ষা করলে চলবে না। আস্তে আস্তে হটাৎ করে থমকে যাওয়া অভ্যেসকে ফিরিয়ে আনতে হবে। শুরু করলাম অল্প অল্প করে, এবং আল্লাহর রহমতে দ্রুতই সাফল্য এলো। আজ ঠিক ৩ মাস হলো, শরীর এবং অভ্যেশগুলি পুরা ফর্মে এসে গেছে। এখন কোনো ধরনের এলার্ম ছাড়া ঘুম ভেঙে যায় সকাল ৫টা থেকে ৫:৩০ এর মধ্যে। ৫/৭ মিনিট Mindfulness প্র্যাক্টিস করে, ফজরের নামাজ পড়ে চলে যাই আমাদের বিল্ডিঙের নিচতলায় জিমে। ঠিক ২৫/৩০ মিনিট ট্রেডমিলে দৌড়ে, গোসল সেরে দিনের প্ল্যান তৈরি করে, সকালের নাস্তা এবং অফিসে সাথে করে নিয়ে যাওয়ার নাস্তা রেডি করে শুরু করি দিন। এতে করে শরীরের হারিয়ে যাওয়া এনার্জি এবং মনের শক্তিও ফিরেএসেছে। আগের ডায়েটেও ফিরে আসতে পেরেছি। এইটা হলো আমার জন্য সবথেকে গত বছরের শ্রেষ্ট “মন্দের ভালো”। আল্লাহকে ধন্যবাদ একটি সমস্যার মধ্যে দিয়ে আমাকে wake up call দেওয়ার জন্য।

আপনি সবকিছু ঠিকঠাকমতো বা নিয়মমতো করলেও জীবনে সঙ্কট বা আকস্মিক ঝামেলা আসতে পারে, তবে সেক্ষেত্রে আপনার মন ভেঙে পরবে না এবং আপনি Regret ফিল করবেন না। তাই আপনার সাধ্য এবং সামর্থমত জীবনকে গুছিয়ে চলুন, ভালো থাকবেন মনে এবং দেহে। আর আপনারা যদি আমাকে, আমার এই নতুন বছরের resolution সমন্ধে তবলতে বলেন তাহলে এই যে থমকে যাওয়া জিনিষগুলি শুরু করেছি ৩ মাস আগে থেকে তা যেন নতুন বছরে এবং আগত আরো বছরগুলিতে চলমান থাকে সেই কামনা করি, এবং সেটিই আমার নতুন বছরের ইরাদা বা Resolution.

আপনারা সবাই ভালো থাকেন, সুষ্ট থাকেন এবং পাবলিক হেলথ গাইডলাইন মেনে চলুন।
আল্লাহ আপনাদর মঙ্গল করুন।
মুকুল।
টরন্টো।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন