প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ, হ্যাপি নিউ ইয়ার, পহেলা বসন্ত, ভালোবাসা দিবস প্রভৃতি সময়ে মাস মিডিয়াতে অনেক তর্ক/বিতর্ক হয়ে থাকে। আমি আড়ালে এসব বিতর্ক উপভোগ করি। আমি ব্যাক্তিগতভাবে এসব তর্ককে জনাথন সুইফটের সেই বিখ্যাত গালিভার্স ট্রাভেলস গল্পের ডিম ভাঙ্গার কৌশল নিয়ে লিলিপুট ও ব্ল্যাফেসকো-র মধ্যে যুদ্ধের মতো দেখি। কারণ আমি মনে করি, কালচার বা সংস্কৃতি ও ধর্ম হচ্ছে সহ অবস্থান কিন্তু কখনোই কালচার বনাম ধর্ম নহে।

আসুন জনপ্রিয় উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া কালচারের সংজ্ঞা পর্যালোচনা করি:

‘Culture is an umbrella term which encompasses the social behavior and norms found in human societies, as well as the knowledge, beliefs, arts, laws, customs, capabilities, and habits of the individuals in these groups. Wikipedia ‘
অর্থ্যাৎ এর বাংলা করলে দাঁড়ায় : সংস্কৃতি হল একটি ছাতা যা মানব সমাজে পাওয়া সামাজিক আচরণ এবং নিয়মাবলী, সেইসাথে এই গোষ্ঠীর ব্যক্তিদের জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, আইন, রীতিনীতি, ক্ষমতা এবং অভ্যাসকে অন্তর্ভুক্ত করে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, মহামান্য উইকিপিডিয়া কৌশলগতভাবে চালাকির আশ্রয় নিয়ে ধর্ম শব্দটিকে এড়িয়ে যেয়ে বিশ্বাসের উপর দিয়ে গিয়েছেন। সত্যিকথা বলতে আমি নিজেও তা করতে চাই, কারণ ধর্ম কে নিয়ে লিখতে হলে অগাধ জ্ঞান গরিমার দরকার হয়, গবেষণার দরকার হয় তা আমার নেই বললেই চলে।

ইন্টারনেট ঘেটে কালচারের আরেকটি ইন্টারেস্টিং সংজ্ঞা পেলাম :

Culture can be defined as all the ways of life including arts, beliefs and institutions of a population that are passed down from generation to generation. Culture has been called “the way of life for an entire society.” As such, it includes codes of manners, dress, language, religion, rituals, art. norms of behavior, such as law and morality, and systems of belief.

(source : https://sphweb.bumc.bu.edu/otlt/mph-modules/PH/CulturalAwareness/CulturalAwareness2.html )

উপরের সঙ্গায় উইকিপিডিয়ার মতো কালচারকে সঙ্গায়িত করতে ধর্মকে রেখে ঢেকে না রেখে একেবারে ঝেড়ে কেশে বলা হয়েছে, ধর্মকে কালচারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তথাকথিত প্রগতিশীল লেখকেরা এটিকে কাজে লাগিয়ে পহেলা বৈশাখ, হ্যাপি নিউ ইয়ার, পহেলা বসন্ত, ভালোবাসা দিবস প্রভৃতি সময়ে ধর্মকে লেলিয়ে দিয়েছে, অপরদিকে কট্টর ধার্মিক গোষ্ঠীর লোকজনেরা ধর্মকে ঢাল হিসাবে ব্যাবহার করে সেসব লেখকদের লেখাকে প্রতিবাদ করতে যেয়ে অনেকসময় মানব হত্যার মতো জঘন্য কাজে জড়িয়ে পড়েছে।

এসব তর্ক বিতর্কের মধ্যে দিয়ে জন্ম হয়েছে দুইটি তত্ত্বের, তথাকথিত প্রগতিশীল তত্ত্ব ও তথাকথিত মৌলবাদী তত্ত্ব। বিশেষকরে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে শুধু বাংলাদেশেই না সারা বিশ্বে বাংলাদেশিরা এই সমস্যাটিকে এতবেশি priority দিয়ে থাকেন যার কারণে আমাদের হাজার হাজার মৌলিক সমস্যাগুলি আড়ালে পরে যায় এবং অন্য গোষ্ঠীর লোকজনেরা এটিকে নিয়ে তামাশা করে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তথাকথিত প্রগতিশীল তত্ত্ব ও তথাকথিত মৌলবাদী তত্ত্ব-এর কোনোটার পক্ষেই যেয়ে অতি বাড়াবাড়িকে প্রশ্রয় দিতে অপরাগ।

মধ্যপন্থীরা সেই উইকিপিডিয়ার মতো কৌশলের আশ্রয় নিয়ে ছেলে মেয়েদের দুটি করে নাম রাখার কালচারের সৃষ্টি করেছেন, ভালো নাম ও ডাকনাম। যেমন: ধর্মের প্রতি ভক্তি রেখে ছেলের ভালো নাম রাখা হয়েছে সৈয়দ আমির উদ্দিন , আবার জন্মের সময় ফুটফুটে চেহারা দেখে ডাক নাম রাখা হয়েছে ফুলের নামে, ‘পলাশ’। শুধু এখানেই থেমে থাকিনি, আমি অনেক সুবিধাবাদীদের দেখেছি উনারা জন্মদিন পালনের ঘোর বিরোধী হয়েও নাতি নাতনিদের জন্মদানে কেক কাটার মুহূর্তে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি এসব স্ববিরোধিতার বিপক্ষে।

তবে একথা ঠিক, কালচারের ক্ষেত্রে ‘সময়’ একটি অত্যন্ত ইম্পরট্যান্ট বিষয়। একটি সময়ে বাংলাদেশে যেসব ছেলেরা রাস্তা ঘাটে হাফ প্যান্ট পড়তো তাদেরকে পাগল বলা হতো। এখন দেশের প্রতন্ত অঞ্চলেও ছেলেরা যেমন হাফ প্যান্ট পরে মহিলারাও ম্যাক্সি পোড়ে ঘুরে বেড়ান। বহু বছর আগে এই উপমহাদেশে হিন্দুরাও যেমন মাথায় টুপি পড়তেন, মুসলমানরাও ধুতি পড়তেন। এখানেই কালচারের মহাত্ম।

শিক্ষা দীক্ষা অনেকসময় ধর্মীয় গোড়ামীকে এবং কুসংস্কারাচ্ছন্নকে জয় করে। একসময় বাংলাদেশে শবেবরাতের রাতে হালুয়া রুটির কালচার ছিল। ছোটবেলায় দেখতাম সারাদিন কষ্ট করে হালুয়া রুটি রান্না করে আমাদের মা বোনেরা সহ আমরা অনেকেই সারা রাত জেগে নফল নামাজ পোড়ে সকালের ফজর নাম কাজ্বা করতাম। অথবা গানের সুরে ইয়া নবী সালামালাইকা সুর করে দলবদ্ধভাবে উচ্চস্বরে দরূদ শরীফ পাঠ করতাম যা কালে ভদ্রে এখন আর তেমন দেখা যায় না।

আবার এ কথাও ঠিক কিছু কিছু শিক্ষা আমাদেরকে হ্যাপি নিউ ইয়ারের রাতে পার্টিতে হাতে মদের গ্লাস ধরে দিয়ে অশালীন নাচানাচি করতে শেখায়, আমি এই শিক্ষাকে গ্রহণ করি না।

এবার আসুন আরো ডিটেলস ভাবে কালচারের কেমিস্ট্রি পর্যালোচনা করি। কালচারকে একাডেমিক ভাবে বুঝতে হলে আমাদেরকে দুইটি বিশেষ টার্মকে ভালো ভাবে বুঝতে হবে, “Assimilation and Acculturation সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে। ‘Assimilation describes the process of social, cultural, and political integration of a minority into a dominant culture and society.” (https://courses.lumenlearning.com/cochise-sociology-os/chapter/assimilation/)
অর্থ্যাৎ, ধরুন এক সময়ে বাংলাদেশের গ্রামের আলোবাতাসে বেড়ে ওঠা ছেলে মেয়েরা অথবা শহরেও আমরা যারা বেড়ে উঠেছি আমরা সকালে গরম ভাত খেয়ে স্কুলে গিয়েছি বা আমাদের বাবারা কাজে গিয়েছেন, অথচ সময়ের ব্যাবধানে এই আমরাই পরবর্তীতে পাউরুটিতে জেলি লাগিয়ে ডিম ওমলেট খেয়ে অথবা স্যান্ড উইচ খেয়ে এখন কাজে যাচ্ছি বা আমাদের ছেলে মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, আবার সেই আমরাই মাঝে মাঝে ছুটির দিনে বা সব ভাইবোন এক সাথে হলে সকালে খিচুড়ি খেয়ে মজা করছি, হৈচৈ করছি। অথবা প্রবাসের আলোকে যদি বলি, আমাদের অনেকেই আমরা প্রবাসে সরকারি ছুটির দিনে THANKS GIVING DAY -তে টার্কি খাচ্ছি, আমাদের ছেলে মেয়েরা অনেক সময় স্কুলে Halloween এর দিনে মুখোশ পোড়ে স্কুলে যাচ্ছে আবার আমরাই আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে  দেশীয় আদব কায়দা শেখাচ্ছি, মুরুব্বীদেরকে দেখলে সালাম/আদাব দেয়া শেখাচ্ছি এসব হচ্ছে Assimilation এর উদাহরণ, এক কথায় আমরা প্রবাসে ডোমিনান্ট কালচারের স্রোতে গা না ভাসিয়ে আমাদের অরিজিনাল কালচারকে শুধু সম্মানই করছি না , আমাদের দেশীয় কালচারের প্রাকটিসও করছি।

অপরদিকে Acculturation হচ্ছে আমাদের অরিজিনাল কালচারকে জলাঞ্জলি দিয়ে একেবারে নতুন কালচারের সাথে মিশে যাওয়া। আপনারা অনেকে শুনে অবাক হবেন, ব্রিটেনের বর্তমান প্রাইম মিনিস্টার মি. বরিস জনসন এর গ্রেট গ্রান্ড ফাদার একজন টার্কিশ মুসলিম ছিলেন। https://www.snopes.com/fact-check/boris-johnson-turkish-muslim/

“Acculturation can be defined as the ‘process of learning and incorporating the values, beliefs, language, customs and mannerisms of the new country immigrants and their families are living in, including behaviors that affect health such as dietary habits, activity levels and substance use.”
(https://www.sciencedirect.com/topics/neuroscience/acculturation)

এবার চলুন কালচারের রাসায়নিক রূপ দেখি:
আমরা হাইস্কুলে শিখে এসেছি
H2SO4 + Zn = ZnSO4 + H2
অর্থ্যাৎ জিঙ্কের সাথে সালফিউরিক এসিডের রাসায়নিক বিক্রয় ঘটিয়ে দুইটি সম্পূর্ণই নতুন জিনিস জিঙ্ক সালফেট ও হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরী হয়, ঠিক একই ভাবে, আমাদের অসাবধানতায় তৈরী হতে পারে-
বাংলাদেশি কালচার + ইংলিশ কালচার = বাংলিশ কালচার
কিন্তু আমরা এ সমীকরণ বিশ্বাস করি না, আমরা দাঁড় কাক হয়ে ময়ূরের কালচারে গা না ভাসিয়ে আমরা বিশ্বাস করি,

বাংলাদেশি কালচার + ইংলিশ কালচার = বাংলাদেশি কালচার ও ইংলিশ কালচার

আসুন আমরা ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল ভাগ বিভক্তির উর্ধে এক মানব জাতির কালচারের ছায়ায় থেকে সবার কালচারকে সম্মান করি, পাশাপাশি ভাবে আমাদের বাচ্চাদের শেখাই যাতে আমাদের বাচ্চারা যেন পাশ্চাত্যের কালচারের স্রোতে গা না ভাসিয়ে আমাদের অরিজিনাল কালচারকে শুধু লোক দেখানো সম্মানই করতে না শিখে, আসুন, বাচ্চাদের নিয়ে আমরা সবাই আমাদের দেশীয় কালচারের প্রাকটিসও যাতে করি সে বিষয়ে খেয়াল রাখি, এই হোক আমাদের New Year’s resolution !!!

HAPPY NEW YEAR
শুভ নব বর্ষ

পূর্ববর্তী নিবন্ধজীবনের সংগ্রাম-পর্ব ১১
পরবর্তী নিবন্ধশুভ ইংরেজি নববর্ষ, ২০২২। নতুন বছরের ইরাদা (Resolution).
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন