ফ্লোরিডা থেকে:-

যা হোক দাদা চলে গেলেন, তার রাগের মাথায় খেললইনা যে দুটি জীবন্ত মানুষকে মুরগীর মত ঝুলিয়ে রেখে তালা বন্ধ করে যে চলে গেলেন তার পরিনতিটা কি হতে পারে ? আর কোন লঘু অপরাধে এমন গুরুদণ্ড দেয়াটা আদৌ সমীচিন কিনা?
আমি ছিলাম অসম্ভব লিকলিকে , আমার কষ্ট করে হাঁটতে হতোনা, বাতাস আমাকে সাহায্য করতো । আর আকাশে পালতোলা যে নৌকা গুলো ছুটে চলতো ,ওরা আমাকে টেনে নিত তাদের অদৃশ্য দড়িতে বেঁধে । তাই না আমি ছিলাম টো টো কেম্পানীর সিইও, জামতলা, সুধীজন পাঠাগার, মিশন পাড়া, কালির বাজার ,আলম খাঁ লেন, বাবুরাইল, শীতলক্ষার তীর কোথায় আমাকে পাওয়া না যেত?

এক অবর্ননীয় যন্ত্রনার রানদাও দিয়ে আমার হাত দুটোর যেখানে শক্ত করে রসিটি বাঁধা ছিল সেখানে পোচ মেরে মেরে কাটছিল কোন এক অদৃশ্য হাত । এবং আমি এই প্রথম দুই হাত বাঁধা ঝুলন্ত অবস্থায় অনুভব করছিলাম কি অসম্ভব ভারী আমার দেহটা। মনে হচ্ছিল আমার হাত দুটো দেহ থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে রয়ে যাবে সিলিংয়ের লড়ায় বাঁধা এবং সংজ্ঞাহীন অসাড় দেহটি ধুপ করে মেঝেতে পড়ে মরে যাবে ।
আমি সেই মুহুর্তে ছিলাম নষ্ট স্বার্থপর, আমার বোনের কষ্টের কথা তখন আমার মনে পড়েনি । আমি ছিলাম অবর্ননীয় যন্ত্রনায় পরিবর্তিত এক আদিম সত্তা, আমার কোষে কোষে সংক্রমিত হচ্ছিল এক ভয়ংকর কিছু, “instinct of self preservation ” । এই ভয়ংকর কিছুটির কারনেই তো কিছু মানুষ পরাজয়কে মেনে নিয়ে নিজেকে বিক্রি করে দেয় , আর কিছু মানুষ স্পার্টাকাসের মত প্রতিবাদে ঝাপিয়ে পড়ে ধ্বংস করে দিতে চায় তাদের যারা শৃংখলাবদ্ধ করে ।

আমাদের সংস্কৃতির একটা বড় দিক হল যে রাগের এসকেলেটর আছে ,ব্রেক নেই। আমরা ঝাল মরিচ খাই এবং যত জোরে রাগ প্রকাশ করি ততই লোকে সমীহ করে । পশ্চিমাদের সব কিছুতেই একটু বেশী বেশী : যে রাগ বাংগালী পুরুষের বীরত্ব বা পৌরুষত্বের অলংকার, তাকে ওরা ভাবে অশালীনতা ; বলে রাগ হল পরাজিত মানুষের হুন্কার। বলে ,যে বক্তব্যের প্রকাশ হয় রাগত স্বরে
কোনদিনই তা অন্যপক্ষের শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারেনা।

না, আমাদের রক্ষা হয়েছিল। আমি প্রয়োজনের তুলনায় লম্বা ছিলাম বলে হাত বাঁধা ঝুলন্ত অবস্থায় সক্ষম হয়ে ছিলাম দূরে আমার পড়ার টেবিলের সামনে যে চেয়ারটিতে বসে আমি পড়াশুনো করতাম তাকে পা দিয়ে সড়িয়ে কাছে আনতে ।
বোনটি কাঁদছিল চিৎকার করে , মা কাঁদছিল বাইরে কোথাও, আর কাঁদছিল আমাদের বাড়ীর বড় বৌ । কিছু কান্নাকে কেউ কখনও নাম দিয়েছিল “অরন্যে রোদন ” বলে, কিছু কান্নাকে বলা হয় “বধির কানে কান্না “ কিন্তু এক্ষেত্রে কোনটিই প্রজোয্য নয় , কারন না অরন্য , না শোনার কান ( সুস্থ বা বধির তা পরের হিসাব ) কোনটাই ছিলনা দুচার পাঁচ মাইলের মধ্যে ।

হ্যা, বোনটি খুব কেঁদেছিল ,এক রত্তি সেই বোনটি, যে কোনদিন বড়ই হলোনা ।
আমি চেয়ারটি কাছে এনে তাতে দাঁড়াতে সক্ষম হলাম কিন্তু অক্ষম আমার দুহাত বাঁধা ,আমি বোনটিকে কোন সাহায্য করতে পারলামনা । যদিও অন্তত আমার দেহের ভার এখন চেয়ারে এবং আমার হাত দুটোর ওপর আর আমার দেহের ওজন বহন করার চাপটি নেই , আমি নাৎসী, হালাকু খান বা ইয়াহিয়ার ক্যাম্পে ঝুলন্ত ,আমার ছোট্ট, ভীষন ছোট্ট,
বেদনায় ক্রন্দনরত, নিষ্পাপ বোনটিকে সাহায্য করতে পারলামনা।
আমি এক পা চেয়ারে রেখে অন্য পা দিয়ে চেষ্টা করতে লাগলাম দক্ষিনের দরজার বাগডাসাটি খুলতে , অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পর সক্ষম হলাম সেটি সড়াতে, দরজাটি হুট করে খুলে গেল। ক্রন্দনরতা বড়বৌ দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল বোনটিকে , পিছু পিছু ক্রন্দনরতা মা । যীশুকে যেভাবে ক্রুশ থেকে নামিয়েছিল কিছু ক্রন্দনরতা নারী ,ঠিক সেভাবেই নামিয়ে আনা হল আমাদের । শুধু যীশুর দেহে জীবনের স্পন্দন থেমে গিয়েছিল , আমরা দুই ক্রন্দনরতা নারীর বুকের স্পন্দন তখনও অনুভব করেছিলাম আমাদের বুকে।

সে অনেক দিন আগের কথা, সেই প্রাগৈতিহাসিক কালে , যখন পরিবারের একজন মানুষ আর একজন মানুষকে ভালোবাসা সত্ত্বেও মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলতোনা , গভীর ভালোবাসা সত্ত্বেও কঠিন দৈহিক শাস্তি দেয়ায় বিব্রত বোধ করতোনা, “শাস্তি না দিলে মানুষ হবেনা” এমন একটি ভ্রান্ত ও নৃশংস ধারনা সমাজ এবং পরিবার কর্তৃক আরোপিত হয়ে বিভৎস করে দিত হৃদয়ের অন্ত:স্থল। যখন শিশুকে শিশু মনে না করে মনে করা হত ছোট একজন পরিনত মানুষ। পরিনত ও অপরিনতের যে ভিন্ন বোধী তা সেই যুগে বোঝা ছিল ল্যাটিন বোঝার চেয়েও কঠিন ।

যে ভাই আমাদের সেই অমানসিক নির্যাতন করেছিল যাকে আজ “চাইল্ড এবিউজার” বলা যাবে নির্দ্বিধায় এবং যে কোন সভ্য দেশে জেল জড়িমানা সহ কঠিন শাস্তি হবে ,সেই ভাই তার সারাজীবন আমাদের আগলে রেখেছেন অন্তহীন ভালোবাসায়। আর আমাদের ছোট্ট সেই বোনটি যে নাকি বড় হয়েছিল আমি চলে যাবার পর ,পেয়েছিল আমার সেই ভাইয়ের মঙ্গলময় হাতের স্পর্শ কিন্তু যে মেঘপাখী হবে তাকে মানবিক স্পর্শ কি থামাতে পারে?

হ্যা ,আমি চলে গিয়েছিলাম । কখনও কখনও চলে যাওয়াটাই সমাধান বলে মনে হয় বলে। কখনও কখনও জীবন একশ লক্ষ লাউড স্পিকারে চিৎকার করে বলে , “যাও , চলে যাও, তোমাকে যেতে হবে।” তখন জীবন নাৎসির চেয়ে ও বড় নাৎসি , স্ট্যালিনের চেয়েও বড় স্ট্যালিন এবং তুমি , তুমি একজন তুচ্ছ ,নগন্য, পিঁপড়ের চেয়েও ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র মানুষ , নতজানু হও, নতজানু হয়ে জীবনের বিষ পান করো চুপ করে,তারপরে মাথা নীচু করে চলে যাও, আর ফিরে আসো না।

দ্রুতি ছিল ওর বাহন, তাই আমলা পারা গার্লস স্কুলের সেই লিকলিকে ছাত্রিটি দৌড় , ছালা দৌড় , বিস্কুট দৌড় , চামুচ দৌড় ইত্যাদিতে মেডেল নিয়ে আসতো । আমার সেই বোনটি বড় হয়ে নাকি হয়েছিল ভীষন পরিশ্রমী। বিয়ে হয়ে গেল স্কুল পাশ করার পরে অথচ ও সাধারন বাংগালির গৃহবধু হতে চাইলোনা। গো ধরলো আরো পড়াশুনো করবে । অথচ মাথা তেমন ভালোনা, বুঝতও না কিছু, মনেও রাখতে পারতোনা। তবু পরাজয় মেনে নেয়ার মানুষ সে ছিলনা । আমরা সবাই পরিশ্রমী অথচ আমাদের ছোট হয়ে ও এত বড় হল কি করে ? দৃষ্টান্ত রেখে যাবে বলে? নারায়নগন্জ থেকে ঢাকা যেয়ে ক্লাশ করতো প্রতিদিন, বাসের ভীড়ে ,গরমে হাসফাস করে ঘামে স্নান করে। ডিগ্রী পাশ করেছিল । তারপর শিখেছিল কম্পিউটার , টাইপিং , তারপরে চাকরী।

আমি চার বছর পরে তৃতীয় বর্ষ মেডিকাল স্কুল শেষ করে দেশে এসেছিলাম । ও তখনও চাকরিতে ঢোকেনি। ওকে দেখে মনে হল কেমন যেন অচেনা ,কেমন যেন আগের মত নয়, কিন্তু কোথায় পরিবর্তনটা বুঝে উঠতে পারলামনা। ভাবলাম ক’বছর দেখিনি হয়তো এ কারনে ওকে ভিন্ন মনে হচ্ছে। সবাই তো বদলেছে এত গুলো বছরে । যে হামাগুড়ি দিত সে হাঁটে, যে স্কুলে যেত সে কলেজে বা ইউনিভার্সিটিতে, যে শহর আমাকে চিনত তার ঝাপসা হয়ে এসেছে আমার মুখ । যে ভালোবাসতোনা তার বিয়ে হয়ে গেছে ,আর যে ভালোবেসে চিঠি দিতো তার ততদিনে সয়ে গেছে সব অনুপস্থিতি। অথচ ধিক আমার শিক্ষার, ধিক ধিক , আমি ততদিনে তত্ত্বগত ভাবে জানতাম “এক্রমেগালী” নামক রোগটির কথা । বাস্তব রোগী তখনও দেখিনি অথচ আমার বোন তখন এক্রমেগালীর খুব প্রাথমিক পরিবর্তন গুলো নিয়ে হেঁটেছে আমার সামনে, আমি চিনতে পারিনি। যদি পারতাম …..

আমি জীবনে বহু জটিল রোগ খুব প্রাথমিক পর্যায়ে ধরে জীবন রক্ষা করতে পেরেছি , কত মায়ের মুখে ফিরিয়ে দিয়েছি হাসি এবং প্রতিটি ডাক্তারের জীবনে রয়েছে এই একই সাফল্যের কত বলা না বলা ইতিহাস । অথচ আমার বোন আমার চোখ এড়িয়ে চলে গেল !

আমি চলে গেলাম ,ওর শুরু হল সমস্যা ,শরীর ভরে ফোঁড়া উঠতে লাগল, তারপর ঘন ঘন যেতে হতো বাথরুমে। গায়ের চামরা হয়ে গেল কেমন কুমিরের চামরার মত।এত সুন্দর মায়াবী মুখ কেমন হয়ে গেল রুক্ষ্ন, কই চলে গেল সেই মুখের কমনীয়তা ,চোয়ালগুলো বেড়িয়ে এল। ধরা পড়লো দুই ধরনের ডায়াবেটিস : মেলিটাস ও ইনসিপিডাস। ইনসিপিডাসের ঠিকুজী খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেল এডভান্সড ব্রেইন টিউমার। যেন হাজার লক্ষ বজ্র এসে ঝাপিয়ে পড়লো আমাদের টিনের চালে ।দু:খের কোন সুসময় নেই, দু:খ তার ডাইনীর চোয়াল উচিয়ে আসে ঠিক তখনই যখন তার আসার কোন প্রয়োজন নেই।

অপারেশন করা হল একবার, কিন্তু কাজ হলোনা, আবার হলো। ব্লাড ট্রান্সফিউশন দিল হেপাটাইটিস সি । তারপর ব্রেইন টিউমার, ডায়াবেটিস ,হেপাটাইটিস সি এই তিন পিচাশিনী ধীরে ধীরে ওকে চড়িয়ে দিল সেই বুনো হাঁসের পিঠে । ও খিল খিল করে হাসতে হাসতে উড়ে চলে গেল ।
আমি রইলাম দূরে । হ্যা , দূরেই । এত হাঁটি অথচ দূরত্বের শেষ হয়না ।

যে ঘরে হুহু করে হাওয়া বইত, সেখানে গুমোট গরম বাসা বেঁধে থাকে । একজন মানুষ যখন চলে যায় তার স্থান কেউ না কেউ দখল করে নেয়, সেই স্থান আর আগের মত থাকেনা। দিন বয়ে যায় আপন গতিতে, রাত ও চাঁদ ঘুরে ঘুরে আসে , ঘুরে চলে যায়।

বোন ,আমার তোর কথা কিচ্ছু মনে নেই।

আমার একটা ভীষন ভারী দরজার লোহার সিন্দুক আছে, আমি সেখানে তোর স্মৃতিগুলো লুকিয়ে রেখে দিয়েছিলাম।
এখন আর চাবিটি খুঁজে পাইনা ।

বোন ,আমার তোর কথা একটুও মনে পড়েনা ।

শুধু যখন বৃষ্টি হয় ,আমার মনে হয় তুই যে মেঘ পাখী হয়ে আছিস আকাশে, ওই জলের ফোটা গুলো তোর চোখ থেকে ঝরে ঝরে আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে যায় ,আমি চুপ করে থাকি , আমি কি করবো বল ? আমার যে তোর কথা কিচ্ছু মনে নেই ।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন