ফ্লোরিডা থেকে:-

দুপুর, রোদ খা খা করছে। পরিস্কার সাদা উঁচু নীচু পাহাড়-পর্বতময় আকাশ । আমি অফিসের রোগী দেখা সেরে বনের নদী তীরে বেন্চে এসে বসেছি। দুহাত দূরে জল, জলে কুমীর, তবে এখন লুকিয়ে আছে কোথাও। অনেক গুলো খলসে মাছ লেজ ও পাখনা নাড়িয়ে সাঁতরাচ্ছে , একটা কচ্ছপ টুপ করে উপরে উঠে এল, আমার সাথে চোখাচোখি হতেই আবার ডুব দিয়ে ছুটলো, আমি জলে একটি রেখার পলায়ন দেখলাম। কুমারী কোন মেয়ে হবে হয়তো, একাকী বনে আমার সাথে দেখা করতে চায়নি। কি জানি আমার কমরেডরা মাইন্ড করে বসে কিনা , ওদের আবার এই সব নিরিবিলি মেলা মেশা বা তা নিয়ে লেখা লেখিতে অনেক আপত্তি।

দু’টা একটা পাখী গাইছে,মঙ্গলবার দুপুর,বাকিরা হয়তো কাজে। এইতো একটা মস্তবড় তেলাপিয়া মাছের মত মাছ কাছে এল , তারপর কোমর দুলিয়ে সেও দিল চম্পট।
ধীরে বাতাস বইছে, রক্ষে ,তা নইলে টাই খুলে দিতে হতো, আমি টাই বাঁধতে পারিনা, বৌকে একসপলয়েট করি । বৌটা ভালো, মাছগুলোর মত , কথা কম বলে, ফুল টুল নিয়ে ব্যস্ত থাকে, আর খেতে দিতে কিপ্টামী করে, বলে “একা একা বুড়ো হতে চাইনা, যত খাবে,তত তাড়াতাড়ি মরবে “। কেন জানি বন্ধুদের চাইতে কখনও কখনও বৌ ভালো বলে মনে হয়,অবশ্য ভুলও হতে পারে।

আজ এক বৃদ্ধ এল তার ৭ বছরের নাতিকে নিয়ে। এই প্রথম আমার অফিসে। বৃদ্ধের চামড়া কুচকানো মুখ অথচ কি একটা অদ্ভুত আলো সে ই মুখে। কেমন একটা চুম্বকের শক্তি। সে এসেছে কারণ নাতি স্কুলে ভালো করছেনা, খালি নড়চড়া দৌড়ঝাঁপ করে, কথা বলে। যেখানে চুপ করে বসে শিক্ষকের প্রতি মনোযোগ দেবে তা না করে ক্লাশে ডিস্টার্ব করে। এই চলছে দু বছর ধরে, আগের স্কুল থেকে বের করে দিয়েছে , এখন অন্য স্কুলে যায় কিন্তু সমস্যা একই।

বিহেভিয়ার থেরাপি চলছে কিন্তু কাজ হচ্ছেনা। আমরা চিরকাল বহু বান্দরামী করেছি কিন্তু সে ছিল অন্য যুগ, অন্য দেশ।
এই দেশে বাচ্চাদের একটা অতি পরিচিত রোগ আছে, বলা হয় এডিএইচডি(ADHD) কেউ বলে রোগ কেউ বলে রোগ না । এখানে বহু কমরেড আছে যারা এর চিকিৎসার ঘোর বিরোধী অষুধ দিয়ে, কারণ অষুধে নাকি ব্রেইনের ক্ষতি হয় অথচ মেডিকাল রিসার্চ , FDA বলে অন্য কথা। এরা চেচামেচি করে, সমস্যাটির সমাধান কি তা বলেনা। আমার কাছে রোগী আসে, তারা বিতর্ক শুনতে চায়না, কনক্রিট চিকিৎসা চায়।

দেখলাম ওর তাই , একেবারে গাইডলাইন মেনে ADHD। আমি একজন সাধারণ ডাক্তার ,নীচু ঘাসের চেয়েও নীচু । আমি কি করি?

বৃদ্ধের কাছে জানতে পেলাম যে ৫ মাস বয়েস থেকে মা ওকে ছেড়ে চলে গেছে, বাইপোলারের রোগী, ড্রাগ এডিক্ট। সেই থেকে থাকতো বাবা, দাদা, দাদী এবং কাকার সাথে। চার মাস আগে দাদী মারা যায়, তার ১৩ দিন পরে কাকা মা হারানোর কষ্ট সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে। তার একমাস পরে ওর বাবা মা এবং ভাই হারানোর দু:খে আত্ম হত্যা করে। এখন সে আছে এই বৃদ্ধের সাথে।
বৃদ্ধের মুখে এক বিস্ময়কর আলো।
প্রশ্ন করি তুমি কেমন আছো?
সে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে , ” One day at a time”
বললাম, তোমার নাতীর “এডিএইচডি” যা এতগুলো মৃত্যু দ্বারা খুব বেশী ডিকমপেনসেট (decompensate) করেছে।
বললাম ,”কি করতে চাও ? অষুধ দেয়া যায়, কাজ করবে কি করবে না আগে থেকে বলা মুশকিল, অনেকেই এই অষুধ পছন্দ করেনা, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অনেক। ”
বলে , “তুমি ডাক্তার, তুমিই বল, ওকে তো স্কুলে যেতে হবে।”
অষুধ দিলাম। বৃদ্ধ আমার হ্যান্ড স্যাক করে বেরিয়ে গেল কিন্তু কেনই জানি আমার মনে পড়ে গেল “The old man and the sea” গল্পের বুডো সান্তিয়াগোর কথা।

আচ্ছা সে যদি মারা যায় , এই ছেলেটির কি হবে এই বিশাল পৃথিবীতে ,সম্পূর্ণ একা ?

আমি আমার দু:খে বিচলিত । আমার বন্ধু ও কমরেডরা আমার গল্পের চরিত্র গুলোর নাগরিক অধিকার নিয়ে রৌদ্রদগ্ধ বাংলার রাজপথ ছেড়ে ইওরোপ আমেরিকার এয়ার কন্ডিশন্ডড ময়দানে ময়দানে মিছিল করা শুরু করেছে। যদিও আমার গল্পের নায়ক নায়িকারা বলছে ,”শিহাব তুই ওদের কথা শুনিসনা , তোর মনে নাই ওরা প্যারিসের রাস্তায় মার্সেল গাইতে গাইতে বা রাশিয়ার শহরে শহরে ইন্টারন্যাশনাল গাইতে গাইতে কবি সাহিত্যিক মুক্তবুদ্ধির যেই ওদের অর্ডার মত লিখে নাই তাদেরকে হত্যা করেছে। ওরা নষ্টামী করতে ভয় পায়না, নষ্টামী নিয়ে লেখায় ভয় পায় ।”
আমি আমার বন্ধুদের না হারাতে চেয়ে কেঁদে কেঁদে ধরীত্রিকে অভিযোগ করি, ধরিত্রি হেসে চুপ করে থাকে।

আমি চুপ করে বসে আছি। রোদ চিক চিক করছে। ডানেলন নদীর বুকে স্রোতের কুচকানী সেই বৃদ্ধের মুখের মত। সারসটি পাখা ঝাপটে উড়ে চলে গেল।
আমার মধ্যে অস্থিরতাটা কাটেনি ,আমি মনের গহীনে অন্ধকারে হাতড়াই।

আচ্ছা আমাদের দেশের প্রগতিশীলরা এত অনুদার কেন? কেন তারা বিশ্বাসই করেনা যে তারাও ভুল করতে পারে ?
সারাদিন দেয়াল ঠেলে ঠেলে সন্ধ্যায় গামছা দিয়ে ঘাম মুছে ভাবে “কি পরিশ্রমটাই না করলাম”
সেই ১৯২১ সালে এম. এন রায় থেকে শুরু করে, এখনও ঠেলছেন, ঠেলছেন, ঠেলছেন
অথচ …..

দেয়াল এক ইন্চিও নড়ে নাই!

শাহাব/অক্টোবর ১৮,২০১৬

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন