জীবন ও জীবিকার স্রোত মানুষকে টেনে নিয়ে যায় বহুদূর, দেশ থেকে দেশান্তরে। ঘরকুনো যে মানুষ তার নিজের আশেপাশেই  ভালো করে তাকিয়ে দেখার তাগিদ অনুভব করেনা, সেই একই মানুষ কোন এক অদম্য মনোবলে পাড়ি দেয় সাত সমুদ্র তেরো নদী। হয়তো নুতন কোনো আশায়। কোনো নুতন দিনের স্বপ্নে। বুঝা কঠিন যে এটি কি প্রকৃতির নিয়ম না ভাগ্যচক্র। আমার কাছে এর কোনোটাই মনে হয়না। বরং মনে হয় অবস্থা এবং অবস্থান পরিবর্তনের তীব্র বাসনা মানুষের সহজাত। পরিবর্তনের স্পৃহা আছে বলেই জগৎ সংসার কখনো স্থবির নয়, থেমে থাকে না মানুষের জীবনও। যে যার জায়গা থেকে সবাই পরিবর্তনের চেষ্টা করে। কেন জানিনা এই অবস্থান পরিবর্তনের তাগিদ আমিও অনুভব করি ২০০৩ সালে। মাথায় চেপে বসে  ‘উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ যাত্রার’ ভূত।  হেলথ এন্ড এন্ড সোশ্যাল পলিসি নিয়ে মাস্টার্স পড়বো বলে চলে আসি লন্ডন, ইংলেন্ডে। তখনও ভাবিনি যে এর মধ্য দিয়েই আমার জীবনে নুতন এক অভিযাত্রার শুরু। ২০০৩ সালে যে ঘর ছেড়ে আসি, সে ঘরে আর কখনোই ফিরে আসা হয়নি সেভাবে। দেড় বছর পর লন্ডনের পাঠ চুকিয়ে ফিরে আসি ঢাকায়। নয় মাস ঢাকায় থেকে আবার অভিবাসী হয়ে পাড়ি জমাই কানাডায়। এর পর গড়িয়ে গেছে অনেক বছর। প্রথম দিকে অনেক চরাই উৎরাই পার হলেও আলহামদুলিল্লাহ, জীবন এখন অনেক স্থিতিশীল। আল্লাহ্পাক তার অসীম করুনায় মিলিয়ে দিয়েছেন আর এক ঠিকানা। দ্বিতীয় ঠিকানা মিললেও সব সময়ই মনে রাখার চেষ্টা করি নিজের শিকড়, যেখান থেকে উঠে এসেছি আজকের আমি। মনে রাখি ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ  নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে বলা ভারতের প্রখ্যাত লেখক, কূটনৈতিক এবং রাজনীতিবিদ শশী থারুরের একটি বিখ্যাত উক্তি, “If you don’t know where you have come from, how will you appreciate where you are going?”
প্রবাসের  হাজারো ব্যস্ততা এবং যান্ত্রিক জীবনের মাঝেও ভিড় করে ফেলে আসা স্মৃতিমাখা  শৈশব, কৈশোর। উদ্বেলিত হয়ে উঠে মন। মাঝে মাঝে ভাবি তেরো বছর আগে এক ঠিকানার খুঁজে ছেড়ে এসেছি আর এক আদি ঠিকানা। আমাদের ঠিকানা আসলে কোনটি ? ফেলে আসা শ্যামল, সবুজ বাংলাদেশ যেখানে শায়িত আছেন আমার পূর্বপুরুষেরা, না আমার মতো হাজারো অভিবাসীকে আপন করে নেয়া কানাডা ?  নাকি অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে ? এর উত্তর আমার জানা নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‘ছুটি’র নায়ক ফটিকের কথা মনে আছে ? নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে উদগ্রীব এক কিশোর শেষ পর্যন্ত পাড়ি জমায় না ফেরার দেশে। অসীম আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করলেও গল্পের নায়ক ফটিক, বাড়িতে, তার মায়ের কাছে আর ফিরে যেতে পারেনি। পরবাসী জীবনে একসময় হয়তো আমাদেরও ছুটি মিলবে, কিন্তু তখনও কি পারবো ফিরে যেতে, সেই আদি ঠিকানায় ?

সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে

2 মন্তব্য

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন