২২ বছর আগে আগস্টের ৬ তারিখে মধ্যরাতে ছেড়েছি স্বদেশ। কাচের দেয়ালের ওপাশে ছিল শত প্রিয়জন। আমাদের সবার চোখেই ছিল জল। ঝাপসা চোখে প্রিয় মুখগুলো দূর থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। এক সময় এরোপ্লেনটা ঊড়াল দিল হংকং এর পথে। সাড়ে তিন ঘন্টায় সেই এয়ারপোর্টে পৌছে মনে হয়েছিল, কেন ছেড়ে আসলাম সবাই কে? আমাদের তো বেশী কিছুই দরকার ছিল না, শুধু ভালো ভাবে খেয়ে পরে বেঁচে থাকা সবাইকে নিয়ে।
তারপর সারাদিন সবাই কেঁদেছি এক সাথে এয়ারপোর্টে বসে। কোথায় আমাদের গন্তব্য সেটা জানি। কিন্তু কোথায় সে দেশ!

ক্যাথেপ্যাসেফিকে চড়ে ১১ ঘন্টায় এসে প্লেনটা থামলো এংকোরেজ বিমানবন্দরে। আমরা নেমেছিলাম বাথরুম বিশ্রামে আর প্লেনটা নিল গ্যাস। আবার ১০ ঘন্টা উড়ে চলা। টরোন্টো এয়ারপোর্টে যখন পৌছালাম তখন রাত ১০ টা। এয়ারপোর্টে আমার হাজব্যান্ডের কলিগ খায়রুল ভাই আর ভাবী আমাদের আনতে গিয়েছিলেন, ওনাদের বাসায় মিসিসাগাতে এক রাত থেকেই আমাদের জন্য ভাড়া করা এপার্মেন্ট টরন্টোতে গেলাম। সে এক বিশাল শুন্যতা যেদিকে তাকাই আমার দেশকে খুজে ফিরি। আর সেখান থেকেই শুরু আমাদের ২য় জীবন।

২ বছর টরন্টোতে থেকে চলে গেলাম ছোট্ট সিটি সেন্ট ক্যাথেরিন, নায়েগ্রা ফলসের কাছে। একটা বিল্ডিং এ ২২ টা বাংলাদেশী পরিবার। সবার স্বামী ছাত্র ব্রক ইউনিভার্সিটির আর আমরা সবাই ব্যস্ত বাচ্চা পালন সংসার নিয়ে। আমি একজন যে কিনা কাজ করতাম তখন ওয়াল মাটে। তার আগে টরন্টোতে ২ বছর ম্যাকডোনাল্ডস এ। আমার প্রথম চাকুরী প্রথম উপার্জন অন্য রকম ভালো লাগা। আমাদের বিল্ডিংটা ছিল মিনি বাংলাদেশ।

সামারে যেদিন বিকেলে বাসায় থেকেছি যার ঘরে যা আছে তা নিয়ে মাঠে গিয়েছি, সাথে ফ্লাস্কে চা, আমাদের গল্প আর বাচ্চাদের খেলা, চমৎকার বিকেল গুলো। তারপর পিক নিক, নায়েগ্রাফলস, চিপুয়া নদীতে মাছ ধরা, নায়েগ্রা অন দি লেকে কানাডা আমেরিকা বর্ডারের নায়েগ্রা রিভারের অপুর্ব দৃশ্য দেখে কত সময় কেটেছে আমাদের।

দীর্ঘ ৮ বছর সেখানে, চমৎকার সাজানো আপেল,আংগুর, পিয়ার্স বাগানে ঘেরা গার্ডেন সিটিতে। বাসার কর্তারা যখন এক রুমে দেশের রাজা উজিরের গল্প আর ভালো চাকুরী ছেড়ে আসার আফসোস করে। আমরা মহিলারা খুব এঞ্জ য় করেছি সময় গুলো। সারাদিন ঘরে বাইরে কাজ করে আমাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড করে সময় রাখিনি পিছনের ফ্রাস্টেশনের। যে যত ভালো চাকুরী করুক এখানকার স্ট্যান্ডার্ড অফ লিভিং সবার সমান, বা একটু এদিক ওদিক। এটাই আমার ভালো লাগে। কারোরটা দেখে কারো হিংসা নেই।

আবারোও ফিরে এলাম সব মায়ার বন্ধন ত্যাগ করে। আমাদের আগেই অনেকে পাড়ি দিয়েছেন আমেরিকায়, কানাডার অন্য প্রভিন্সে, অটোয়ায়। আমি এলাম গ্রেটার টরন্টোতে মিসিসাগায়। ২য় কন্যা ভর্তি হলো টরন্টো ইউনিভার্সিটির মিসিসাগা ক্যাম্পাসে। বড় মেয়ে আগেই ম্যাকমাষ্টার ইউনিভার্সিটি আর ওদের বাবা তারোও ২ বছর আগে গিয়েছে ইউএস এ চাকুরী নিয়ে। ততোদিনে আমার টিচিং এসিস্টেন্ট এর ২ বছরের ডিপ্লোমা শেষ করে নায়েগ্রা স্কুল বোর্ডে চাকুরী পেয়েছি। সাথে উইকেন্ডে ওয়াল্মার্টের চাকুরীটাও আছে। সব ছেড়ে চলে এলাম নতুন শহরে।
এখানে আছি আজ ১২ বছর। চাকুরীটাও পেয়ে গেছি পিল ডিস্ট্রিক্ট স্কুল বোর্ডে। আছি একটা হাইস্কুলে, স্পেশাল এডুকেশ নে। আমার বাসা থেকে কাজের দুরত্ব মাত্র ১ কি.মি।

বড় মেয়ে এখান থেকে গ্রাজুয়েশন করে আমেরিকাতে গেল মেডিক্যাল কলেজে পড়াশুনা করতে। রোটেশন, রেসিডেন্সি সব শেষ করে Henry Ford Hospital এ ফ্যামিলি মেডিসিনের ডাক্তার ও ফ্যাকাল্টি মেম্বার এখন। , মেজো মেয়েও ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টো থেকে গ্রাজুয়েশন করে পোস্টে গ্রাড করে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজার (Teach Data)আর ছোট কন্যা অন্টারিও স্কলার হয়ে ভর্তি হলো কুইন্স ইউনিভার্সিটি, সেখান থেকে গ্রাজুয়েশন, মাস্টার্স করে এখন আছে ফেডারেল গভঃ জবে। Department of Innovative science and Technology. ইতিমধ্য দুই মেয়ের বিয়েও হয়েছে। সদ্য আমরা নানা নানী হয়েছি।

আর ওদের বাবা ১৪ বছর ইউএস এ চাকুরী করে এখন অবসরে। সোনার বাংলায় ফিরে যাবার ইচ্ছা আছে মনে. ……। সে ইচ্ছায় বাড়ীও করেছে ফরিদপুরে। পরবাস তার ভালো লাগে না।

এখানে প্রচন্ড সংগ্রামের মধ্যদিয়ে এগুতো হয়েছে আমাকে / আমাদের। আমাদের পিছনে ফেলে এসেছি বিশাল এক সংসার। তাদের নিজেদের আজ সংসার হয়েছে কিন্তু আমাদের দায়িত্ব আর কোন দিন শেষ হলো না।
তবুও বলব অনেক অনেক ভালো আছি। আমাদের বিশাল বাড়ী নাই, মাথা গোজার ঠাই আছে। ব্রান্ডের গাড়ী নাই, তবুও চমৎকার গাড়ী আছে। ব্যাংকে ব্যালেঞ্চ নাই তবুও মনে কোন দুঃখ নাই। এখানে কারোও টা দেখে কেউ হিংসা করে না। আমার যা আছে সেটাই আমার জন্য পরম পাওয়া। এখানে প্রায় সবারই এক অবস্থা। কিন্তু সবাই ভালো আছি, অনেক টাকা নাই কিন্তু মনের দৈনতা নাই।

এই দেশটা থেকে অনেক পেয়েছি, আমি নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবতে পারি, আমার কথার মুল্য আছে, আমার জীবনের দাম আছে, আমার জন্য রাস্ট্র অন্ন, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মানবাধিকার সব নিশ্চিত রেখেছে। এখানে বসে বসে খেতে কেউ আসে না, আমরা ট্যাক্স পে করছি আর সরকার সেই টাকা দিয়ে লো ইনকাম মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে।
যে আমি রাস্তায় বের হতে ভয় পেতাম সেই আমি এখন ১০ ঘন্টা একা ড্রাইভ করে ওয়াশিংটন, শিকাগো চলে যাই। নিজের ভিতরে এক বিশ্বাস কাজ করে।আমি যখন পারি একাজ সবাই পারবে।
এদেশের প্রতিটি জিনিসকে ভালবাসতে শিখেছি, গাছ পালা,ফুল, পাখী, মানুষ সবাই সবার জন্য। এখানে স্কুলে এই কথাগুলো অনেক বার শেখানো হয় ছেলে মেয়েদের। তোমার মাথার উপরে ছাদ, টেবিলে গরম রুটি, শীত নিবারনে আছে গরম ব্লাংকেট আর কি চাই জীবনে!? বাবা মায়েরাও এই শিক্ষাই দেন তাদের সন্তানদের নিজের সত উপার্জন দিয়ে চলো সুখী তুমি হবেই। ভালো লাগে, বিশ্বাস করি অন্তর দিয়ে।

I Love to be a Proud Canadian. God bless Canada.

 

 

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন