সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।  

মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা নববর্ষ উদযাপন শুরু করেছিলেন বাঙ্গালী কৃষক, শ্রমিক, মজুরদের  কাছ থেকে কর  সংগ্রহ করার জন্য এবং এর সঙ্গে বাংলা ক্যালেন্ডারকে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু  করেছিলেন। প্রথমে এই বাংলা ক্যালেন্ডারের ডিজাইনটা একটু জটিল  ইসলামী ক্যালেন্ডারের মতো, হিজরী  তারিখ লেখা  ছিল। পরে  মহারাজা ও রাজদরবারের গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের পরামর্শে ক্যালেন্ডার প্যাটার্ন পরিবর্তন  করে। সে থেকেই বাংলা নববর্ষ পালিত হয়ে আসছে। সম্রাট আকবর সব ধর্মের লোকদের সমানভাবে ভালো বাসতেন এবং “দ্বীনে- ইলাহী” নামে একটি আলাদা ধর্ম প্রচার করতে চেয়েছিলেন।   

 হাল খাতা উৎসব:

এটি একটি উৎসব যা বাঙালি  দোকানদার ব্যবসায়ীরা পহেলা বৈশাখে  নতুন খাতা খোলার মাধ্যমে উদযাপন করেন। নুতন বৎসরের প্রথম দিনে দোকানদার বা ব্যাবসায়ীরা মিষ্টি বিতরণের মাধ্যমে পুরানো খাতার বকেয়া আদায় করে নুতন খাতায় নাম উঠায়   আমরা নিজেরাও ছোট সময়ে দাদা, বাবা বা চাচাদের সঙ্গে গিয়ে দোকান থেকে মিষ্টি খেতাম। দোকানদার দোকান সুন্দর করে সাজিয়ে কাস্টমারদের মেহমানের মতো  সাদরে  আহবান করে মিষ্টি বিতরণ করে পুরানো খাতা দেখে বকেয়া পাওয়না আদায় করে নুতন খাতায় নাম উঠাতে দেখেছি। এই উৎসব সে যুগে দেশের প্রতিটি বাজারে দোকানে দোকানে দেখা যেতো।  তবে এর সঙ্গে পান্তাভাতের কোনো মিল খুঁজে পাই না। 

বৈশাখী মেলা :

আমাদের গ্রামে কোনো হিন্দু ছিল না; পাশের প্রতিটি গ্রামেই হিন্দু ছিল।  আমি যে স্কুলের ছাত্র ছিলাম, এই স্কুলে অনেক হিন্দু ছাত্র ছিল যাদের সঙ্গে ছিল অন্তরঙ্গতা। গ্রামের আরও ছেলেরা একত্রে মেলাতে গেলে ওদের সঙ্গে দেখা হতো এবং মেলা থেকে ঘুড়ি, বাঁশি এবং  দুই পয়সা, চার পয়সা  দিয়ে ছোটোখাটো খেলনা বা মিষ্টি জাতীয় কিছু কিনে বাড়িতে নিয়ে আসতাম।  সারাক্ষন মুখে বাঁশি দিয়ে আওয়াজ করে মা চাচী বা অন্যান্য ছেলেমেয়েদের আনন্দ দিতাম। ওটা ছিল আমার মতো আরও কিছু ছেলেদের খেলা, এই বাড়ি সেই বাড়ি গিয়ে আনন্দে মাতিয়ে তুলতাম।

 কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় যে যাদের নিয়ে আনন্দ করতাম, তাদের অনেকেই  আজ  ওপারে পারি জমিয়েছেন, ভাবতে অবাক লাগে সময় কিভাবে এত দ্রুত শেষ হয়। এইতো শুনলাম আমার ছোট চাচাতো ভাইশহীদযার সঙ্গে ছিল আমার অনেক সখ্যতা আজ ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে ইন্তিকাল করেছেন।  তার আত্বার মাগফেরাত কামনা করি।   হয়তো আমি একদিন ভাবে বিদায় নেবো এই সুন্দর পৃথিবী থেকে।         

পান্তাভাত :

বৈশাখী মেলার সঙ্গে পান্তাভাতের কোনো মিল না থাকলেও এটি বাংলার কৃষকের প্রথম ভোরের খাওয়া ; প্রতি ঘরে ঘরে কৃষক ভোরে  পান্তাভাত, পোড়া মরিচ, পিয়াজ আর   ডাল বা তরকারি,যা মিলতো খেয়ে মাঠে কাজ করতে যেতো বা আজও যায়   । গ্রামে গঞ্জে মানুষ হয়েছি, ইলিশমাছ ভাজি সেতো স্বপ্ন, হয়তো পুকুর বা খাল থেকে ধরে আনা পুটি মাছ , সিং মাছ, ঘরের আংগিনা থেকে তরকারি দিয়ে মা রান্না করতেন, তা খেয়েই মাঠে গিয়ে কাজ করেছি। কেউ কেউ   রুইমাছ দিয়ে কি ভাবে ভর্তা বানায়  ফেসবুকে  দেখিয়েছে, সে যুগে মা চাচীরা গুঁড়া চিংড়ির বা শুঁটকির  ভর্তা বানিয়ে পান্তা ভাতের সঙ্গে খেতে দিতো।ভর্তা না পাইলে তো মরিচ আর পিয়াজ তো অবশ্য পাওয়া যেত, দিয়ে খেয়ে তুষ্ট হয়ে খেতেখামারে কাজে যেত    

 আমার দুই চাচী  পুকুরে বড়শি দিয়ে পুটি মাছ ধরতো, জ্যান্ত মাছ  লাপা লাপি করতো, দেখে আনন্দ পেতাম। ১০টা পুটি বা ছোট মাছ পেলে এক তরকারি হয়ে যেত, ঘরে নিয়ে গেলে  রান্না করে, বা ভাজি করে খাওয়া বেশ মজা লাগতো। 

বাংলাদেশ ক্রান্তীয় জলবায়ুর  দেশ, রাতে খাবার পর ভাত পাতিলে রেখে দিলে সকালে নরম ও এক জাতীয় গন্ধ অনুভূত হয় এবং দেরি করে খাইলে শরীর মেস মেস করে; সে জন্য মাকে  সে যুগে দেখতাম ভাতে পানি দিয়ে রেখে দিতো।  ভাতে দেয়া পানি শুদ্ধ ও অনেক সময় খেয়ে কাজে বা স্কুলে  গেছি।  

এই সুদূর কানাডাতে সেদিন একজন এক বাসায় গিয়ে কাঞ্জি ভাত বিভিন্ন রকমের ভর্তা দিয়ে খেয়ে এসে মজার গল্প করতে শুনেছি।  আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম কী ভাবে কাঞ্জি ভাত তৈরী করা হয় ? 

শুনলাম এক সপ্তাহ বা তার ও অধিক সময় ভাত রেখে দিয়ে শেষে মশলা, শুঁটকি বা আরো ও কিছু দিয়ে রান্না করেছে।  

এই পান্তাভাতের অনেক গল্প আছ। ১৯৬৩-১৯৬৫ আমি কুমিল্লাভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র, শহরতলিতে লজিং থাকতাম।  রোজ রোজ আমি মেথরপট্টির  নিকট দিয়ে যাতায়াত করতাম; সে যুগে কুমিল্লা শহরে কোনো সেনিটারি ল্যাট্রিন ছিলোনা বা থাকলে ও খুব কম ছিল।  মেথর সপ্তাহে একদিন রাত্রে বাড়ি বাড়ি থেকে ময়লা পরিষ্কার করে নিয়ে যেত। এরা ভাত জমিয়ে কি ভাবে টোডি (তারি) মদ তৈরী করে তা জানা নেই, তবে মেথরপট্টিতে খেয়ে নাচানাচি করতে দু/একবার নজরে পড়েছে। 

সে যুগে ঢাকার পুরানো শহরে  টোডি (তারি) মদ তৈরী হতো , ব্রিটিশ পিরিয়ডে যে সব ইংরেজ ঢাকা, কুমিল্লা বা অন্যান্য শহরে কাজ করতো, ওরা বলতো,” যাও   টোডি (তারি) মদ লেকে  আও   ” , খেত আর ফুর্তি করতো।   এ জাতীয় অনেক গল্প আমরা শুনেছি। 

আমাদের গ্রামেগঞ্জে গরীব চাষীরা সকালে পান্তাভাত খেয়ে কাজে যায় ; আজকাল সারাদেশের,এমনকি  শহরের বড়ো পরিবারের ছেলেমেয়ে ও গুণীজন এই পান্তাভাত দিয়ে বাংলা নববর্ষ  উদযাপন  করে, দেখে ভালোই লাগছে।  এতে আমাদের মানসিক পরিবর্তনের পরিচয় পাওয়া যায় , আমরা আর গেঁয়োচাষী বলে কাউকে অবজ্ঞা করি না; বরং সন্মান দেখাতে শিখেছি। এটাই গ্রামের চাষাভুষা মানুষের প্রাপ্য।      

থ্যাঙ্কসগিভিং ডে : 

আমাদের মতো এ সব দেশে ও এ ধরণের ট্রেডিশন আছে।    থ্যাঙ্কসগিভিং হল কানাডার বাৎসরিক ছুটির দিন যা উৎসব এবং পারিবারিক সমাবেশ দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অন্যান্য দেশে এই দিনটি উদযাপিত হয়। এটি নভেম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হয়। কানাডায় এটি অক্টোবরের দ্বিতীয় সোমবারে অনুষ্ঠিত হয়।হার্ভেস্টিং বা ফসল কাটা শেষ হলে এ দেশের মানুষ গড বা স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়।  বড়ো বড়ো তুর্কি (মোরগ) বাজার থেকে কিনে এনে রোস্ট করে নিজেরা ও বন্ধুদের নিয়ে আপ্যায়ন করে দিনটি উদযাপন করে।  

অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে,যারা কৃষক,অক্লান্ত পরিশ্রম করে ফসল উৎপাদন করে সারা জাতিকে বাঁচিয়ে রাখে, তারাই সবচেয়ে অবহেলিত।  চাষীদের উন্নতি হলে সমগ্র জাতির উন্নতি হবে ।   

সমাপ্ত  

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমেরিকা যাবো আমি কাকা, বাবাকে দিতে বলো টাকা – পর্ব ২
পরবর্তী নিবন্ধসুখ কি?
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন