“ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন্, আসমানী তাগিদ ।  ”
নজরুল ইসলামের এই গজল শুনলে প্রতিটি বাংলাভাষী  মুসলমানের দু’চোখ জলে সিক্ত হয়ে উঠে । ঈদের দিনে প্রতিটি  বাংলাভাষী মুসলমান দূর দূরান্ত থেকে বাংলাদেশের টেলিভশন  চ্যানেল খুলে  ছোট্ট ছেলে মেয়েদের  সুন্দর ড্রেস পরে এই গজল পরিবেশনা  উপভোগ করে,সে কি চমৎকার , তা প্রশংসার যোগ্য  এবং সত্যি উপলব্ধি করার মতো । আমরা বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে  থেকেও টেলিভশন খুলে  দেশের এসব অনুষ্টান পরিবার পরিজনদের নিয়ে উপভোগ করি । মনে হয় আমরা বাংলাদেশে সবার সঙ্গে রয়েছি । হানিফ সংকেতের ঈদের প্রোগ্রাম, প্রতিটি বাঙালি যে যেখানেই  থাকুক উপভোগ করে । বিশেষ করে বিদেশি পুরুষ /মহিলাদের বাংলাদেশি ড্রেস পরে ছোট্ট নাটকে অংশ গ্রহণ  অনেক আকর্ষণীয়, হাসির  ও মনো মুগ্ধকর ।

মনে পড়ে আমাদের  ছোট্ট  সময়ের কথা, সন্ধ্যার হওয়ার পূর্বেই ছোট বড়ো মিলে চাঁদ দেখার আনন্দে মেতে উঠতাম ।চাঁদ  দেখার জন্য পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা ,যেই না চাঁদ দেখা হতো ,সে কি  হৈ চৈ  মহা উল্লাস আর আনন্দে মাতোয়ারা । সারা গ্রামে  ঈদের আনন্দে হৈ চৈ  চিৎকার শুরু হতো । আবার  অনেক সময় মেঘলা আকাশের জন্য  চাঁদ দেখা না গেলে হেলাল কমিটির উপর নির্ভর করতে হতো । আমাদের ছোট বেলায় এমনটিও অনেক সময় হয়েছে,যে পূর্ব পাকিস্তানে কোথায় ও চাঁদ দেখা যায়নি , এবার  নির্ভর করতে হবে পশ্চিম পাকিস্তানের উপর, রাতে খবর পাওয়া গেল যে পশ্চিম পাকিস্তানে ,লাহোর, শিয়ালকোট বা পেশাওয়ার চাঁদ দেখেছে । সুতরাং সরকারি আদেশ অনুযায়ী কাল ঈদ হবে,সে  আনন্দ কি ভুলে যাওয়ার!  মা চাচীরা রাত  জেগে সেমাই,ও অন্যান্য সুস্বাধু খাবার তৈরি করে রাখতো । গ্রামের বাড়িতে সকাল হতেই সবাই পুকুরে গোসল শেষে ঘরে এসে সেমাই,হালুয়া বা ঘরে তৈরি  বিভিন্ন রং বেরঙের মিষ্টি ও পিঠা খেয়ে   নুতন কাপড়, নুতন   টুপী  পরে   হাতে আতর লাগিয়ে নামাজের জায়নামাজ  নিয়ে ছোট বড়ো সবাই গ্রামের ঈদগাহ মাঠে একত্রিত  হয়ে নামাজের জন্য যাইতাম। কি গরিব,কি ধনী আজ সবাই এক সারিতে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করবো । আজ প্রতিটি মানুষ সমান,নাই কোনো ভেদাভেদ,একমাত্র আল্লাহকে স্বরণ করে সাজদাহ করবো  । মনে আজ  সীমাহীন আনন্দ ,আমরা এক মাস রমজানের রোজা রেখেছি এবং নামাজের শেষের দৃশ্য,সেতো,এক অপূর্ব ! প্রতিটি মানুষ একে ওপরের সঙ্গে কোলাকুলি করা(ইসলামে নেই কোনো ভেদাভেদ) ।ঈদের নামাজের শেষে আমাদের এনায়েতপুর  গ্রামের মুরুব্বি মরহুম জমিরউদ্দিন প্রধানিয়া সাহেব দাঁড়িয়ে উপস্থিত সব মুসুল্লীকে বলতেন, “ মুসিল্লগণ, আপনারা সবাই আমাদের বাড়িতে আমন্ত্রিত, প্রধানিয়া সাহেবের বাড়ির উঠানে বসিয়ে  ঈদের সব মুসুল্লীকে খিসুরি খাওয়াতেন ।”  প্রধানিয়া সাহেব জীবিত নাই, তবে তার স্মৃতি আজ ও আমাদের মধ্যে জাগ্রত । যতদূর শুনেছি, আজ ও আমাদের  গ্রামের সেই চিরাচরিত নিয়ম রয়েছে । ঈদের নামাজের শেষে সবাই মিলে একত্রে বসে খাওয়া এবং ঈদের আনন্দ উপভোগ করা । তার পরে,  বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকদের সঙ্গে দেখা করে ঈদের শভেচ্ছা বিনিময়  করা ছিলো ঈদের বিশেষ আনন্দ । ছেলে মেয়েরা এই ঘরে,সেই ঘরে  গিয়ে সালাম করে ঈদের বকশিস আদায় করতো  ,খেয়ে দেয়ে আনন্দ করে, এ বাড়ি সে বাড়ি ঘুরে বেড়াতো, তা কি ভুলে যাবার?

আজ বহু  বৎসর আমি দেশের বাইরে,১৯৮২ থেকে ১৯৮৫  নাইজেরিয়াতে চাকুরী নিয়ে  থেকেছি । সেখানেও দেখেছি দলে দলে নাইজেরিয়ান  মুসলমান ঈদের দিন সকালে বাব্বানগিদা (লম্বা জামা) ও টুপী পড়ে,মাঠে একত্রিত হয়ে ঈদের নামাজ  আদায় করে ,কি পরিচিত বা অপরিচিত  একই প্রকারে আলিঙ্গন করে আনন্দ উৎসবে মেতে  উঠে ।  সারাদিন এই বাড়ি সেই বাড়ি গিয়ে “ঈদ মুবারক ” বলে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতো । মক্কায় হারেমে   ওমরাহ করতে গিয়ে  দেখেছি সবাই একত্রিত হয়ে  নামাজ আদায় করে  বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে কোলাকুলি করে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে সুদৃঢ় করে । ইসলামে গরিব, ধনি, ছোট/বড়ো বা  সাদা/কালোর কোনো ভেদা  ভেদ নেই, এটাই তৌহিদের  মূল মন্ত্র ।

১৯৮৬ সনে আমি তখন  নিউ জার্সি ,USA কয়েকজন বাংলাদেশি একত্রিত মেস করে থাকি । ধারে কাছে কোনো মুসলমান বা মসজিদ আছে কিনা কারোই জানা নেই । রোজার মাস,সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে ,ঘরে এসে ইফতার করি ।আমাদের মধ্যে বয়োজেষ্ঠ  মিস্টার  নুরুল আলম,ভালো ইফতারি ও  রান্না জানতো । ইফতারের সময় আমরা ওর   স্বরণাপন্ন  হতাম । তাকে আমরা চিটাগংএর বড়দা বলে সবাই সম্মান করতাম । পরদিন  ঈদুল ফিতর ,এক্সট্রিম কোল্ড weather, কোথায় নামাজ পড়তে যাবো, কিছুই জানিনা । সিদ্বান্ত হলো ভোরে সবাই মিলে বেরিয়ে পড়বো,যেখানেই হোক,নামাজ পড়বো ।  সকালে ঘুম থেকে উঠে সবাই মিলে গাড়ি নিয়ে অনেকদূর যাওয়ার পর রাস্তার পার্শে কয়েকজন আফ্রিকান মুসলমান দেখে আমরা তাদের সঙ্গে যোগ দিলাম  ।  যদিও এদেশে খোলা মাঠে ঈদের নামাজ পড়া হয়না, (মসজিদ বা কমিউনিটি সেন্টারে),কিন্তু এই পরিস্থিতে  সবাই সিদ্ধান্ত নিলো এখানে রাস্তায় নামাজ পড়া হবে ।  নামাজ আদায় করে একে ওপরের সঙ্গে আলিঙ্গন করা ,৮/১০ জন মুসলমান ,কেউ নাইজেরিয়ান,কেউ বা মিসোরিও ,কেউ লিবিয়ান ,ঘানিয়ান,কোলাকোলি করে ঈদের আনন্দ আর  ভাই ভাইয়ের  মিলনকে সুদৃঢ় করে ঘরে ফিরে মিস্টার নুরুল আলমের তৈরী ঈদের খাবার খেয়ে দেশে পরিবার পরিজনকে  ঈদের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা টেলেফোনে  চেষ্টা   করেছি । তাও ল্যান্ড ফোন,আবার বাংলাদেশে সবার বাসায়  কানেকশন নাই ।

সারা দুনিয়ার মুসলমান ভাই ভাই ,তবে আজ আমাদের এই বিভেদ আর  হানাহানি কেন? লক্ষ লক্ষ মুসলমান কেন এত রক্ত দিচ্ছে ? সিরিয়ার একটা তিন বৎসরের বাচ্চা  আর্তনাদ করে বলেছিলো ,”আমি মরে গেলে আল্লাহর কাছে তোমাদের  বিরুদ্ধে ফরিয়াদ করবো,তোমরা  মানুষ হয়ে মানুষের বিরুদ্ধে   যে পশুত্বের আচরণ করছো ,তার জবাব দিতে হবে ।“  আজ সিরিয়া ,ইরাক,ইমেন ,আফগানিস্তান,লিবিয়া  এদের প্রতিটি দেশে  ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, ধর্মের নামে চলছে হানাহানি  ।  লক্ষ লক্ষ  রেফিউজি  নিকটতম তুরুস্কে,ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশগুলিতে  অন্যের দ্বারস্থ,যার  অধিকাংশ আহত,বিকলাঙ্গ, মা,বাবা,ভাই,বোন হারিয়ে অসহ অবস্থায় দিনের  পর দিন তাঁবুর নিচে ভিক্ষুকের মতো বেঁচে  আছে । কত লক্ষ মানুষ  হতাহত হয়েছে তার হিসাব নাই বা দিলাম ।  যারা বেঁচে আছে তারা  আজ অসহায়, অত্যন্ত অবহেলিত মানুষ ।  পরের কাছে হাত পেতে যা পায় তাই অথবা নর্দমা থেকে উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে দিনের পর দিন কোনো রকমে বেঁচে  আছে ।  লক্ষ লক্ষ মা বোন, সম্মানীয় ঘরের মহিলারা  , আজ ফকির,  নিজেদের  অস্তিত্ব হারিয়ে অন্যের অনুগ্রহের উপর  কোনো রকমে বেঁচে  আছে ।

যে ইরাক ,সিরিয়া,লিবিয়া আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ গিয়ে কাজ করেছে,আজ সে সব দেশের মানুষ অন্য দেশে করুনার পাত্র হয়ে  আছে, দ্বারে দ্বারে ভিক্ষুকের মতো তাকিয়ে থাকে কখন সাহায্য আসবে । আজ কোথায় তাদের ঈদ আর কোথায় তাদের আনন্দ?

এবার অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক, কানাডা অতি সুন্দর দেশ ,এখানকার সরকার  আমাদের   ধর্মীয় সব ধরণের সুযোগ সুবিধা ভোগ করার সুযোগ করে দিয়েছে ।   এখানকার মসজিদগুলি রমজান মাসে মুসুল্লীতে ভরপুর থাকে । আমাদের বাংলাদেশের মসজিদ আর এখানকার মসজিদগুলোর মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে । এখানকার মসজিদগুলিকে কমিউনিটি সেন্টার ও বলা যেতে পারে, মসজিদ গুলিতে সারা বৎসর ধর্মীয় ও সামাজিক বিবিধ প্রোগ্রামের ব্যবস্থা রয়েছে । বিশেষ করে রমজান মাসে প্রতিটি পরিবার ছেলে মেয়ে নিয়ে মসজিদে ইফতার , নামাজ ও খাওয়াদাওয়া করে । রমজান মাসে কিছু কিছু  মসজিদে পাঁচ শত  থেকে সাত শত লোক ইফতার ও খাওয়াদাওয়া করে ।  নিজেদের পরিবার নিয়ে যার যে টেবিল পছন্দ বসে,  কোরান,হাদিস ও ধর্ম  নিয়ে পারিবারিক   বা সমষ্টি গত  ভাবে চর্চা করে এবং নিজেদের খেয়াল খসি মতো ইফতারি  ও   খাওয়া সেরে তারাবি পড়ে  যার যেই বাসায় ফিরে  ।  এখানে প্রতিটি  মুসলমান  hospitable এবং সবাই মসজিদে সাহায্য সহযোগিতা   করে ।  রমজানের শেষ দশ দিন মসজিদ থাকে মুসুল্লীতে  ভরপুর ।  সবে কদরের রাতে মসজিদে মুসুল্লি ও তাদের পরিবার নিয়ে সারারাত থেকে এবাদত, ফাঁকে ফাঁকে ব্র্যাক  ও এন্টারটেইনমেন্ট করে  কাটায় ।  এখানে ছেলেমেয়েরা ও মা বাবার সঙ্গে রাত জেগে  থাকতে bore  হয়না বরং উপভোগ করে ।  কানাডা মুসলমান দেশ  নয়,কিন্তু এখানকার নিয়ম কানুন মনে হবে আমরা যেন একটা মুসলিম দেশে বাস করি ।  এখানে হাসপাতাল,কমিউনিটি সেন্টারে,কর্মস্থল সর্বত্র নামাজের ব্যবস্থা আছে ।  প্রতিটি মহল্লায় হালাল মাংসের দোকান রয়েছে, মুসলমানরা নিজেদের পছন্দ মতো হালাল উপায়ে কোরবানি দিতে পারে ।

কোভিড -১৯ ও আমরা:
এবারের রমজান সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের । সারা পৃথিবীতে কোরোনার  কারণে  সব কিছু অচল ।  সারা কানাডার প্রতিটি মসজিদ, মন্দির,চার্চ, অন্যান্য দর্মালম্বীদের উপসনাস্থল গুলি  জনশুন্য । সারা পৃথিবীর ব্যবসা বাণিজ্য ,যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ,সবাই  নিজ নিজ ইসুলেশনে গৃহে অবস্থান করতেছে ।   কানাডায় ৬ হাজারের বেশি   লোক  (কোভিড -১৯) এ পয্যন্ত মারা গিয়েছে ।  ঈদের নামাজ বা আনন্দ বলতে এবার কোথায় ও কিছু হবে   বলে মনে হয় না  ।  আল্লাহ’র কাছে প্রাথনা করি,আল্লাহ যেন এই বিপদ থেকে সারা পৃথিবীর মানুষকে মুক্তি দেন, আমীন ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধলকডাউনের এক অন্যরকম ঈদের গল্প – (প্রথম পর্ব)
পরবর্তী নিবন্ধবন্দি
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন