ঘরের ভিতর হাতী ! শিরোনাম দেখে মনে হবে কোন কল্পগল্পের শুরু। গল্প নয়, এটি একটি ইংরেজি প্রবাদ, যদিও এই প্রবাদের ভেতর লুকিয়ে আছে হাজারো মানুষের গল্প। ১৮১৪ সালে রাশিয়ার কবি, নাট্যকার ও পৌরানিক কাহিনী লেখক Ivan Krylov ‘The Inquisitive Man’ নামে একটি Fable বা পৌরাণিক গল্প লিখেন। এই গল্পে একজন মানুষের চোঁখে যাদুঘরের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিস ধরা পড়ে অথচ একই যাদুঘরে অবস্থিত বিশালাকার এক হাতীকে উনি দেখতে পাননি। পরবর্তীতে রাশিয়ার আর এক উপন্যাসিক Fyodor Dostoevsky তার ‘Demon’ উপন্যাসে এবং আরো পরে ১৮৮২ সালে Mark Twain এর ‘The Stolen White Elephant’ শীর্ষক ছোট গল্পেও একই ধারণার প্রতিফলন ঘটেছে। এই গল্পে ডিটেকটিভরা হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ান এক চুরি হয়ে যাওয়া সাদা হাতিকে, যে হাতি তার নিদৃষ্ট জায়গাতেই ছিল। বিরাজমান সমস্যাকে দেখেও না দেখার ভাণ করার যে প্রবণতা সেটাই Elephant in the Room নামে ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে এক প্রবাদে। খুব সহজে এবং সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করলে এই প্রবাদের অর্থ হচ্ছে কোনো সুস্পষ্ট সমস্যা বা কঠিন কোনো পরিস্তিতি যা সম্পর্কে মানুষ অবগত কিন্তু যা নিয়ে কেউই মুখ খুলতে নারাজ।
আমাদের সমাজে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিও এখন Elephant in the Room এর মতোই। এর উপস্তিতি কম বেশি অনুভব করেন সবাই, কিন্তু এ নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী নন অনেকেই। কানাডার মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিখ্যাত প্রতিষ্টান Centre for Addiction & Mental Health (CAMH) এর তথ্য অনুসারে কানাডায় প্রতি পাঁচজনে একজন মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন জীবনের যেকোনো এক পর্যায়ে। তাদের মতে ১৫-২৪ বছর বয়সীদের অন্য যেকোনো বয়সী মানুষের চাইতে মানসিক স্বাস্থ্য ও আসক্তি বিষয়ক ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। সুতরাং বিষয়টিকে জানা, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের চেষ্টা না করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। অবাক হবার বিষয় হচ্ছে যে আমরা শারীরিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যে কোনো সমস্যায় নিজেদের মধ্যে আলাপ করি, ডাক্তারের পরামর্শ নেই, চিকিৎসা গ্রহণ করি। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের বেলায় ঘটে তার উল্টো। একে চেপে রাখার যত রকম কায়দা কানুন আছে, সব প্রয়োগ করার প্রাণান্তকর চেষ্টা চলে। বিশেষ করে আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এই ক্ষেত্রে ‘Culture’ বা যে সংস্কৃতির মধ্যে আমরা বেড়ে উঠি তার একটা ব্যাপক প্রভাব আছে বলে আমার মনে হয়। একটি সমাজ বা সংস্কৃতি মানসিক স্বাস্থ্যের ধারণাটিকে কিভাবে প্রভাবিত করতে পারে, সেই বিষয়ক এক নিবন্ধে University of South Florida’ র College of Behavioral & Community Science এর অধ্যাপক Dr Mario Hernandez বলেন, “culture influences what gets defined as a problem, how the problem is understood and which solutions to the problem are acceptable.”। এই ব্যাখ্যাটি পুরোপুরি না হলেও বাংলাদেশী জনগোষ্টির বেলায় অনেকটাই প্রযোজ্য। মানসিক স্বাস্থ্যের চ্যালেঞ্জের বিষয়টিকে বুঝার চেষ্টা না করা বা সমস্যা হিসেবে মেনে না নেয়ার চিন্তা, এই চ্যালেঞ্জ প্রকাশ হলে সামাজিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার আশংখা, এরকম মনোভাব অনেকের মধ্যেই কাজ করে। সমস্যা যখন একেবারেই আয়ত্তের বাইরে চলে যায়, তখন শুরু হয় চিকিৎসার জন্য খোঁজাখুঁজি। ততদিনে সাধারণ এক সমস্যা মোড় নেয় (Crisis) সংকটে।
শারীরিক অসুস্থতার তুলনায় মানসিক অসুস্থতার বিষয়টি প্রকাশে মানুষের অনীহা কেন ? এই প্রশ্নের উত্তরে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। অনেক গবেষক হাজির হয়েছেন অনেক তথ্য, উপাত্ত নিয়ে। মনোবিজ্ঞানীরাও বিভিন্ন বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন। যে কযেকটি বিষয়ে সবাই একমত তার একটি হচ্ছে ভয় ও লজ্জা। ‘মানসিক রুগী’ বা ‘পাগল’ এর তকমা লাগার ভয়। সমাজের মানুষের কাছে নিজেকে, নিজের পরিবারকে ছোট করার ভয়ে অনেকে মানসিক স্বাস্থ্যগত প্রতিবন্ধকতাকে প্রকাশ করতে চান না। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে আশাহীনতা। অনেকে একেবারেই আশা হারিয়ে ফেলেন, ভাবেন আর কোনো কিছু দিয়েই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পাবেন না। তারা ভুলে যান যে যতক্ষণ শ্বাস আছে, ততক্ষন আশা আছে। তৃতীয় যে বিষয়টি উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে আস্থাহীনতা- ভয়াবহ বিষন্নতা, দুশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে যে মানুষগুলি দিন কাটান, তারা অনেকেই স্থির করতে পারেন না যে নিজের সমস্যা ব্যক্ত করা নিয়ে তারা কার উপর আস্থা রাখতে পারেন, কে তাদের একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি, উপলদ্ধির গোপনীয়তা বজায় রাখতে পারবেন। আবার অনেকে জানেনই না যে যথাযথ কাউন্সেলিং, চিকিৎসা, বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মাধ্যমে মানসিকভাবে অসুস্থ বেশির ভাগ মানুষই সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন, যাপন করতে পারেন স্বাভাবিক জীবন।
এই আশা হারানো, আস্থা হারানো, লক্ষচ্যুত মানুষগুলোর মনের ভেতর যে ঝড় বয়ে যায়, তার দাপট আন্দাজ করা সহজ নয়। তাদের আস্থা অর্জনের সুযোগ দিলে, একাগ্রতার সাথে তাদের কথা শুনলে, প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করার বিভিন্ন দিগন্ত উন্মোচনের জন্য একসাথে কাজ করতে পারলে, এই মানুষগুলোই আবার ঘুরে দাঁড়ান। নুতন করে খুঁজে পান জীবনের লক্ষ্য, বেঁচে থাকার সার্থকতা। বলাবাহুল্য, ‘Elephant’ তখন ‘Room’ ছেড়ে পালায়।
সৈযদ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে