ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় সেল ফোনের এলার্ম এর শব্দে ঘুম ভেঙ্গে জোৎসনা ম্যানশনের মালিক প্রৌকৌশলী মিজানুর রহমান চোখ রগড়াতে রগড়াতে দেখে তাঁর পরমা সুন্দরী স্ত্রী রুপা আরোও আগেই ঘুম থেকে উঠে ড্রেসিং টেবিলের সামনে সাজ সজ্জা করছে। ভোরে উঠতে অনাভ্যাস্ত মিজানুর রহমানের ধাতস্ত হতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো। মিজানুর রহমানের মনে পড়লো, এত সকালে এলার্ম দেয়ার রহস্য হচ্ছে আজ তাঁর স্ত্রীর আবদার অনুযায়ী লেকের ধারে সূর্যোদয় দেখার কথা। ঘরে সুন্দরী স্ত্রী থাকলে স্বামীদের কত আবদারই না মানতে হয় !!

স্ত্রী রুপার নির্দেশনা হচ্ছে যদিও সকাল বেলা, তবুও পোশাক-পরিচ্ছেদে চাকচিক্যের কোনো কমতি যেন না হয়, কারন, পুরা সূর্যোদয় দেখার পর্বটি ফেস বুকে লাইভ এ যাবে এবং কানাডা, বাংলাদেশ সহ তাবৎ দুনিয়ার মানুষ সেটি আগ্রহ অথবা অনাগ্রহ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে সুন্দরী রুপাকে সন্তুষ্ট করে বাহারি বাহারি সব কমেন্ট দিয়ে ভাসিয়ে দিবে। সুতরাং, মিজানুর রহমানকে বাথরুম সেরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই সকালবেলায় সেভ করতে হচ্ছে। মিজানুর রহমান বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলেন সেভ করতে যেয়ে তাঁর থুতনির নিচের দিকে খানিকটা কেটে যেয়ে খুব সুক্ষভাবে একটি চিকন রেখায় লালাভ রক্তের ধারা অলস ভঙ্গিতে ধুতনি বেয়ে গলার দিকে নামছে। তবে কি এটি বয়স বাড়ার লক্ষণ নাকি কোনো দুশ্চিন্তা!!

মিজানুর রহমানের খুব বেশি দুশ্চিন্তা হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই। বরঞ্চ বেশ মউজে থাকার কথা। গত সপ্তাহে তাঁর নৌবিহার পর্বে খোদ বাংলাদেশ থেকে ভিজিটর ভিসায় তিনজন বিশিষ্ট বাংলাদেশী নাগরিককে টরেন্টোতে ডেকে নিয়ে এসে সংবর্ধনা দেয়ার বিষয়টি টরেন্ট সহ পুরা কানাডা ও বাংলাদেশের মূল ধারার পত্রিকাগুলিতে হেড লাইন করা হয়েছে। মিজানুর রহমানের এই মহৎ কর্মকান্ডে টরেন্টতে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে বিত্তশীল লম্পট লুটেরা মিজানুর রহমানের সব অতীত ভুলে কেবল তাঁকে নিয়ে প্রশংসায় প্রশংসায় একাকার অবস্থা। সুতরাং, সেভ করতে যেয়ে মিজানুর রহমানের থুতনির নিচে কিছুটা যে কেটে গেলো, এর পিছনে দুশ্চিন্তা যে কাজ করছেনা এটা মোটামুটি নিশ্চিত। তবে আশার কথা কথা হলো, আফটার সেভ, এন্টি সেপটিক ক্রিম সহ নামি দামি সব ক্রিমের কল্যাণে কাটা দাগ এখন অনেকটাই নিষ্প্রভ মনে হচ্ছে।

টরেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্রী অদিতি অনেকটাই ধোঁয়াশার মধ্যে ছিল। যেহেতু সূর্যোদয় দেখার পর্বে বাবা যাচ্ছে তাই তাঁর যাওয়াটা ঠিক হবে কি ঠিক হবে না। এদিকে তাঁর প্রিয় লোপা আন্টি ক্রমাগত কানের কাছে বলেই চলেছে ‘ চল যাই, সূর্যোদয় দেখাটা অনেক ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হবে। অনেক মজা হবে।’ অদিতি প্রায় অনেকটাই রাজিই হয়েছিল, কিন্তু যখন শুনলো তাদের এই সূর্যোদয় দেখার ইভেন্টে বাংলাদেশের সেই তিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তিও থাকবেন, তখন অদিতি তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় থাকলো। এসব ভণ্ডামির মধ্যে সে নেই।

অদিতির সাথে বাবা মিজানুর রহমানের কোল্ড ওয়ার চলছে গত প্রায় সাত/আট বছর আগে থেকে। অদিতি তখন গ্রেড সিক্সে পড়ে। ভাগ্য ভালো এখানকার স্থানীয় বাংলা স্কুলে নিয়মিত যেয়ে সে বাংলাটা শিখেছিল। বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলার কি এক খবরের জন্য অনলাইনে বাংলাদেশের একটি খবরের কাগজ পড়তেই প্রথম পেজে দেখে বাবার ছবি। পাশে লেখা,’অবশেষে শিল্পপতি প্রকৌশুলি মিজানুর রহমানের সন্ধান প্রাপ্তি’। অদিতি বিদ্যুৎ বেগে পুরা খবরটি পড়ে জানতে পায়, এই সেই মিজানুর রহমান , তাঁর বাবা যিনি একাধিক প্রাইভেট ব্যাঙ্ক, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি সহ বহুবিধ ব্যাবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মালিক বাংলাদেশ থেকে নামে বেনামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এসে এখন টরেন্টোতে সপরিবারে বসবাস করছে। অদিতি বিষয়টি নিয়ে তাঁর বড় ভাই ও মায়ের সাথেও আলাপ করেছে, কিন্তু তেমন কোনো উৎসাহ পায়নি। সেই থেকে, অদিতি তাঁর বাবাকে বাবা ডাকে না। বাবাকে সে মনে প্রাণে ঘৃণা করে। বাবার প্রতি তাঁর এই ঘৃণার ব্যাপারটি প্রায় সবাই জানে। লোপা আন্টিকে মিজানুর রহমান অনেক আগে থেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন যেন বাবা-মেয়ের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে। লোপা আন্টি তাই বিভিন্ন অজুহাতে একেক ধরণের মুখরোচক ইভেন্ট এর আয়োজন করে বাবা, মেয়েকে এক সাথে করার চেষ্টা করে। কিন্তু খুব ভিতরের কথা হলো, লোপা আন্টি বাবার প্রতি অদিতির ঘৃনাকে সমর্থন করে। তাই, অদিতির সাথে লোপা আন্টির বেশ ভাব।

মিজানুর রহমান দ্রুত রেডি হয়ে ফ্রিজ খুলে শ্যাম্পেনের বোতল খুলে ঢোক ঢোক করে গিলে ফেলে। তাঁর ধারণা, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, জোস্না, নদী, পাহাড়, সমুদ্র এসব উপভোগ করতে হয় এলকোহল দিয়ে। এলকোহলের একধরণের ক্ষমতা আছে যা প্রাকিতৃক সৌন্দর্যকে তরল আকারে মানুষের কাছে উপভোগ্য করে তোলে। মানুষ সত্যিই বিচিত্র এক জীব। অর্থ মানুষের চিন্তা শক্তিকে আরো বিচিত্র করে তোলে।

আজকে অর্থাৎ নভেম্বরের দুই তারিখে হিসাবমতে সূর্যোদয় হওয়ার কথা সকাল ছয়টা পঞ্চান্ন মিনিটে। অন্টারিও লেকের ধারে এই সাত সকালে বিশাল আয়োজন। গত রাত থেকে বিচের এক ধারে ক্যাম্পিং এর মতো করে ম্যানেজার মোত্তালেবের নের্তৃত্বে এগারোজনের একটি দল এখানেই অবস্থান করছিলো। বাংলা পাড়ার হোটেল থেকে তিনজন বাবুর্চি নিয়ে আসা হয়েছে উনারা শেষ রাত থেকে বাংলাদেশী স্টাইলে সকালের নাস্তা, পরাটা, কলিজা ভুনা, ডিমের ওমলেট প্রভৃতির পাশাপাশি প্রধান আকর্ষণ হিসাবে ভাপা পিঠা বানানোর আয়োজন চালিয়ে যাচ্ছেন। ভোর পৌনে পাঁচটার দিকে মোত্তালেব সাহেবকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছে। তাঁর কারণ হচ্ছে, এই মাত্র প্রধান বাবুর্চি শরাফত আলী জানালেন ডিম অমলেটের জন্য কাঁচা মরিচ আনা হয়নি। মোত্তালেব সাহেব মিজানুর রহমানকে খবরের কাগজের মতো পড়তে পারেন। কাঁচা মরিচ ছাড়া ডিম ওমলেট খেয়ে মিজানুর রহমান স্যার যে কি পরিমান রেগে যাবেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এত সকালে কাঁচা মরিচ কোথায় পাওয়া যাবে এই চিন্তায় ম্যানেজার মোত্তালেব সাহেবের যখন পাগল প্রায় অবস্থা, তখন সহকারী বাবুর্চি ইউনুস জানালো, তাঁর এক বন্ধুর বাড়ি কাছেই আছে, ওর বেকইয়ার্ড এর সবজি বাগান থেকে সে দশ মিনিটের মধ্যে কাঁচা মরিচ নিয়ে আসতে পারবে। ম্যানেজার মোত্তালেব সাহেব কিছুটা শান্ত হলেন।

আগে থেকে সিটির পারমিশন নেয়া ছিল। কোভিড এর এই দ্বিতীয় ওয়েভের মধ্যে বেশ কড়াকড়ি নিয়ম, কোনোক্রমেই বাহিরের গ্যাদারিং এ লোকজনের সংখ্যা পঁচিশজনের বেশি হওয়া যাবে না। মোত্তালেব সাহেব আজকের উপস্থিত সকলের মাথা গুনে নিশ্চিত হলো মিজানুর রহমানের পরিবারের লোকজন, খুব কাছের বন্ধু-বান্ধব ও ব্যাপস্থাপনার সব লোকজন মিলে উপস্থিতির সংখ্যা একুশ জন। মোত্তালেব সাহেব পকেট থেকে সেল ফোন বের করে সময় দেখে নিলেন, ছয়টা একুশ মিনিট, অর্থাৎ সূর্যোদয় হতে এখনোও চৌত্রিশ মিনিট বাকি। সময় যেন কিছুতেই কাটছে না। ক্লাস টেনের ফিজিক্স বইয়ে আইনস্টাইনের E = mc2 সমীকরণের কথা মোত্তালেব সাহেবের ভীষণ মনে পড়লো।

সূর্য উঠার দিকে মুখ করে সামিয়ানা টাঙ্গানো হয়েছে। সামিয়ানার নিচে নিয়ম অনুযায়ী দুই মিটার পর পর চেয়ার রাখা হয়েছে। মিজানুর রহমানের পরিবারবের জন্য আরামদায়ক লম্বা সোফা রাখা হয়েছে। মিজানুর রহমানের সোফার পরেই বাংলাদেশ থেকে আসা তিন জন বিশেষ অতিথিদের বসার ব্যবস্থা। সামিয়ানার পিছন সাইড থেকে নাস্তার জন্য দেশীয় স্টাইলে রান্না করা কলিজা ভুনার সুবাস পাওয়া যাচ্ছে। একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার সকাল । আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়েই দিন তারিখ ঠিক করা হয়েছিল। সূর্যোদয়ের আর মাত্র সাত মিনিট বাকি। টান টান উত্তেজনায় রুপা সোফা থেকে দাঁড়িয়ে পুব আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তাঁর স্বামী মিজানুর রহমান স্ত্রীকে খুশি করার জন্যে রুপার পাশে উঠে দাঁড়িয়েছে। অয়ন, লোপাও বেশ উত্তেজিত। তবে বাংলাদেশ থেকে আসা তিনজন মেহমান, মুদি দোকানদার জনাব ইসমাইল হোসেন, গার্লস স্কুলের রিটার্ড সহকারী প্রধান শিক্ষক আশেকুর রহমান ও ঘাটাইল থানার সরকারি ডাক্তার জনাব আসগর আলী এনাদের কারো মধ্যেই তেমন কোনো বিকার লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। উনাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে, যেন উনারা পাঁচ দিনের ক্রিকেট টেষ্টের উত্তেজনাহীন চতুর্থ দিনের নির্ঘাত ড্র হওয়া ম্যাচের খেলা দেখছেন। নৌবিহার, সংবর্ধনা, সূর্যোদয় দেখা , আহা, বিত্তশীলদের টাকা খরচের কত কিছুই না বড়লোকি কারবার!!

লেকের পুবদিকের সীমানায় মেঘগুলি যেন পানির সাথে একেবারে মিশে গেছে। সাদা সাদা সিগার্লগুলি আকাশে উড়ছে। বাংলাদেশের জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শীতকালে বিচরণ করা অথিতি পাখির দল এই লেকের ধার ঘেঁষে কলকল করে হেটে যেয়ে পানিতে নামছে। ডিমের কুসুমের মতো লালাভ মেঘগুলির মধ্যে যে এতো সৌন্দর্য ছিল এটা দেখতে দেখতে রুপার প্রায় চোখে পানি এসে যাওয়ার মতো অবস্থা। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। অনান্য বছর এসময় বেশ ঠান্ডা পড়ে। এবার তা হয় নি। বাংলাদেশ থেকে আগত মেহমানরা আশায় আশায় ছিলেন যদি বরফ- টরফ পড়ে মজা করে এদেশের বরফ পড়া দেখবেন । কিন্তু, বরফতো দূরের কথা, শীতের নামগন্ধও নেই। এখানে অনেকটা বাংলাদেশের আশ্বিন মাসের মতো ঠান্ডা।

ডিম থেকে মুরগির ছানা বের হওয়ার মতো করে সূয্যিমামা এইমাত্র উঠলোবলে। তেজহীন সকালের সূর্য রস্মির লালাভ আলোয় লেকের স্থির পানিতে উপচে পড়ে সকালের হালকা মৃদু বাতাসে কাঁপছে যা সত্যি সত্যিই এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। টরেন্ট শহর থেকে প্রায় বারো /তেরো মাইল পুব দিকে অন্টারিও লেকের ধারে একুশ জোড়া চোখ পুব আকাশে দিকে তাকিয়ে আছে। একেক জোড়া চোখের উত্তেজনার পরিমান একেকরকম। রুপার কাছে আজকের সূর্যোদয় যেমনভাবে উপভোগ্য, মিজানুর রহমান কাছে এটি নিছক স্ত্রীর অন্যান্য সাধারণ আব্দারের প্রতি অনিচ্ছা সত্ত্বেও সাড়া দেয়া ছাড়া তেমন কোনো বাড়তি ঘটনা না। তবে, মিজানুর রহমানের আবছা আবছা মনে পড়ে খুব ছোটবেলার কথা। বাবার সাথে ঢাকা থেকে তাদের বাড়ি জয়পুইরহাটে যাচ্ছে ট্রেনে করে। সে সময় ঢাকা থেকে বাড়ি যাওয়ার ব্যাবস্থা হলো রাতের ট্রেনে ঢাকা থেকে সন্ধ্যার দিকে রওনা হয়ে, বাহাদুরাবাদ ঘাটে স্টীমারে ৪/৫ ঘন্টা যুমুনা নদীতে পাড়ি দিয়ে ওপারে যেয়ে আবার ট্রেনে উঠে সোজা সান্তাহার, তারপর, সান্তাহার থেকে বাসে করে জয়পুরহাট। শেষ রাতের দিকে, বাবা ও ছেলের কারো চোখে ঘুম নেই। স্টিমারের রেলিং ধরে বাবা-ছেলে কত গল্প। গল্প করতে করতে মিজানুর রহমান স্পষ্ট দেখতে পেলো চোখের সামনে রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার কেটে কিভাবে চারিদিকে ফর্সা হচ্ছে। একসময় পুবদিকে, লাল আলো ছড়িয়ে সূর্য উঠলো। যমুনা নদীর পানিতে সেই সূর্যের আলোর প্রতিচ্ছবি ছোট ঢেউ আকারে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। বাবা মিজানুর রহমানকে হাত ধরে বললেন,’ বাবা মিজান, তোকে ভোর থেকে গল্পে গল্পে রেখেছিলাম ভোর হওয়া তোকে দেখাবো বলে। এই যে রাতের জমাট অন্ধকার কেটে সূর্য আমাদেরকে আলো দেখালো, তুই একদিন লেখা পড়া শেষে শুধু আমাদের পরিবারের দারিদ্রতা দূর করবি তা না, আমাদের দেশের সকল অন্ধকার দূর করে আলোর পথ দেখাবি বাবা, তোর যে অনেক মেধা, তুই পারবি!!মিজানুর রহমানের কিছুটা এলকোহলের নেশায় হোক অথবা বাবার প্রতি ভালোবাসা থেকে হোক, কেন যেন মনটা আদ্র হতে থাকে। বাবার সেই মেধাবী মিজান দেশকে অন্ধকার থেকে উৎদ্ধার তো দূরে থাকে , সেই দেশের সাধারণ মানুষের হক মেরে, কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে দেশ থেকে চোরের মতো পালিয়ে এসেছে।

রুপার নিৰ্দেশনা অনুযায়ী মোত্তালেব সাহেবের ঠিক সূর্য উঠার মুহূর্তে কেসেট প্লেয়ারে বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই বাজানোর কথা ছিল। এতে করে, একধরণের বাড়তি আবেগময় পরিবেশ তৈরী হওয়ার কথা। মিজানুর রহমানের এতে খানিকটা আপত্তি ছিল। চতুর মিজানুর রহমানের ধারণা, এতে করে এখানে বাংলাদেশের কমিউনিটিতে তাকে নিয়ে একধরণের নেগেটিভ ইফেক্ট পড়ার কথা। কারণ, এই ব্যাপারটির মধ্যে কিছুটা হিন্দুয়ানীর কালচার আছে। যাহোক, স্ত্রীর আবদার বলে কথা !! কিন্তু, বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, ঠিক ছয়টা পঞ্চান্ন মিনিটে মোত্তালেব সাহেব যখন ক্যাসেট প্লেয়ার অন করবে দেখে ভিতরে বিসমিল্লাহ খাঁর ক্যাসেট নেই!! প্রমাদ গুনলেন ম্যানেজার মোত্তালেব সাহেব।

মোত্তালেব সাহেবের ভাগ্য ভালো বলতে হবে। ঘড়ির কাটায় ঠিক ছয়টা পঞ্চান্ন বাজার সাথে সাথে যখন ভুস করে লেকের পানির উপর থেকে সূর্য বের হয়ে এলো, আনন্দে দিশেহারা রুপা বিসমিল্লাহ খাঁর সানাইয়ের কথা বেমালুম ভুলে বাচ্চা বালিকার মতো হাত তালি দিয়ে চিৎকার করে উঠলো । লোপা আন্টি, অয়নও হাত তালি দিয়ে ভোরের সূর্যকে সম্ভাষণ জানাচ্ছে। হালকা এলকোহলের নেশায় মিজানুর রহমান রক্তিম সূর্যের দিকে তাকিয়ে ছোটবেলায় সেই যমুনা নদীতে দেখা সূর্যাস্তের সময় বাবার কথাগুলি মনে করে পাপেটের মতো করে ওদের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে হাত তালি দিতে থাকলো।

রুপার সৌজন্যে ফেস বুকের লাইভ প্রোগ্রামের মাধ্যমে সারা দুনিয়ার মানুষ আজকের টরন্টোর সূর্যোদয় পর্ব দেখতে পেলেন। বোধকরি, সূর্যোদয়ের চেয়ে লেকের ধারে নাস্তার পর্বটি মিজানুর রহমান সহ, বাংলাদেশ থেকে আসা অতিথিরা দারুন উপভোগ করছে। কলিজা ভুনা দিয়ে পরাটা, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা দিয়ে ডিম ওমলেট ও ভাপা পিঠা যেন অমৃতের মতো মনে হচ্ছে। মিজানুর রহমান নিজে একে একে সব মেহমানদের নাস্তার তদারকি করছেন। অতিথিদের মধ্যে ইসমাইল হোসেন সুযোগমতো মিজানুর রোহানকে বললেন:-‘স্যার, আমাদেরতো কালকে সকালের ফ্লাইটেই বাংলাদেশে চলে যাওয়ার কথা, এতদিন টরেন্টোতে আপনার সৌজন্যে অনেক দিনই থাকা হলো, জীবনে আর কোনোদিন এই দেশে আসা হবে কিনা ঠিক নেই, আপনে যদি একটু আমাদের ‘সি এন’ টাওয়ারে উঠার ব্যাবস্থা করতেন, খুব ভালো হতো। ‘

আনন্দের মুডে থাকা নিজাম উদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে ম্যানেজার মোত্তালেব সাহেবকে ডেকে আজ সন্ধ্যায় উনাদের সি এন টাওয়ার উঠার ব্যাবস্থা করে দিতে বললেন । শুধু তাইনা, যেহেতু আজকেই বাংলাদেশ থেকে আসা তিনজন অতিথিদের এখানে থাকার শেষ দিন, তাই, মিজানুর রহমান, মোত্তালেব সাহেবকে দায়িত্ব দিলেন ওঁদের কিছু টাকা পয়সা ধরে দিয়ে নিজ নিজ আত্মীয়দের জন্য শপিংমলে নিয়ে যেয়ে যেন কেনা কাটা করতে সাহায্য করা হয়। চতুর মিজানুর রহমান মোত্তালেব সাহেবকে বলতে ভুললেন না মেহমানদের কেনাকাটার সময় পত্রিকার সাংবাদিকদের যেন সাথে রাখা হয় । সুদূর বাংলাদেশ থেকে প্রকৌশুলি মিজানুর রহমানের আতিথিয়তা গ্রহণ করতে আসা অতিথি তিনজন জোহর নামাজ শেষে মিজানুর রহমানকে প্রানভরে দোয়া করলেন: ‘হে আল্লাহ, ফেরেস্তার মতো এই মানুষটির প্রতি তুমি তোমার খাস রহমত নাজিল করো, উনার আত্মীয়স্বজনরা যারা পরলোক গমন করেছেন, উনাদেরকে জান্নাতুল ডরদৌস দান করো, আমিন।

মেহমানদের দোয়া কতখানি কবুল হলো বোঝা গেলো না, তবে জোৎসনা ম্যানশনে অদিতি তাঁর বাবার অপেক্ষায় থাকল, আজ বিকালেই বাবার সাথে তাঁর একটা বোঝাপড়া হওয়া দরকার, বাবা দিন দিন ভণ্ডামির সীমাকে অতিক্রম করে চলেছে। বাংলাদেশ থেকে ভিজিটর ভিসায় নিয়ে এসে সংবর্ধনা দেয়া ওই অতিথিরা কালকেই বাংলাদেশে চলে যাবে। আজ রাতে বাসায় ডিনারের আমন্ত্রণে আসা বাংলাদেশের ওই তিনজনের সাথে কথা বলা খুবই জরুরী। ওঁদের সাথে চালাকি করে ওঁদের পেটের কথা বের করে আনতে হবে। আজকেই শেষ সুযোগ, ওকে জানতেই হবে এই মেহমানরা সত্যিকারের ভালো মানুষ নাকি তাঁর চতুর বাবার নামডাক কুড়ানোর একটি জজ মিঞার মতো সাজানো নাটক।

(চলবে)

(এই লেখার প্রতিটি চরিএ কাল্পনিক-লেখক)

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাড়িয়ে দাও হাত-পর্ব ২
পরবর্তী নিবন্ধ“Elephant in the Room”
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন