১৯৭৪ সনের ভাদ্র কি আশ্বিন মাস হতে পারে, সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়ি গিয়েছি ।দুইদিন বাড়ি থাকার পর ঢাকা চলে আসবো । শ্রদ্ধেয় কাদের ভাই, যার হাত ধরে আমি অনেক দূর এগিয়েছি, সেই কাদের ভাই বললেন,অনেক দিন আমার বোন রহিমার খোঁজ নেয়া হয় নি, ঢাকা যাওয়ার পথে একটু দেখে যাবো ।
তুমি কি আজ ঢাকা যাবে?
আমি বললাম হ্যাঁ, যাবো ।
চল, দুই জনে আজাগারা হয়ে রহিমাকে দেখে ঢাকা যা। ওখানে খানিক বসে রহিমার খোঁজ খবর নিয়ে ওয়ারুক স্টেশন থেকে ট্রেনে চাঁদপুর এবং লঞ্চে ঢাকা যাবো । আমি বললাম ওটা উল্টা দিক,ঠিক আছে চলুন যাই ।
কাদের ভাই নৌকা নিয়েছেন । আমরা দুইজন নৌকার যাত্রী এবং নৌকার মাঝি আমাদের পুর্ব পরিচিত বাচ্চুর বাপ্ (এই নামেই তাকে গ্রামের সবাই চিনেন )।
কাদের ভাইয়ের মা বাড়িতে হাতে তৈরী পিঠা,গাছের নারিকেল, আরও কত কি দিয়েছেন । বাচ্চুর বাপ্ নৌকা চালাচ্ছে, আমরা দুইজন নৌকায় বসে দুই দিকে তাকাচ্ছি । পরিচিত ও অপরিচিত গ্রামের দরিদ্র হাড্ডি সার লোক সালাম দিচ্ছে এবং আমরা জবাব দিচ্ছি। কেউ কেউ গ্রামের প্রচলিত নিয়মে অপ্রয়োজনেও জিগ্যেস করে, কোথায় যাবেন?
কাদের ভাই বললেন আজাগারা যাবো ।
নৌকার দুই পাশে গ্রামের বাড়িঘর , মহিলারা আমাদের দেখে মাথায় ঘোমটা টেনে দিচ্ছে, আবার কেউকেউ আড়ালে গিয়ে আড় নয়নে তাকাচ্ছে । সে যুগে ওটা ছিল বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জের নিয়ম । মেয়েরা আজকালকার মতো এতটা স্মার্ট ছিল না, সামনে আসতো না, একটু আড় নয়নে মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়ে পর্দা করতো ।
সে সময় বাংলাদেশের বর্ষাকালে নৌকা ভ্রমণ ছিল অতি আনন্দের । তখন স্কুল জীবনে বাংলা শিক্ষক বাংলাদেশের নৌকা ভ্রমণ সম্পর্কে আমাদের পরীক্ষায় লিখতে দিতেন ।
গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন্ প্রকার নৌকা, যেমন কুসা নৌকা,ঢুসা নৌকা, পাট/ধান ব্যাবসায়ীদের বড় নৌকা, জেলেদের মাছ ধরার, তাছাড়া বেদে যারা বর্ষার মৌসমে পানিতে নৌকায় বাস করে এবং এই গ্রাম সেই গ্রামে বা এই বাজারে সেই বাজারে সাপ দেখিয়ে লোকদের একত্রিত করে মেয়েদের শখের গহনা (ইমিটেশন), হারবাল ঔষধ ও অন্যান্য জিনিস বিক্রি করে ব্যবসা করতো । এই সব নৌকার প্রচলন সর্বত্র ছিল । বর্ষা মৌসুম শেষ হলে সব নৌকা পানি থেকে উঠিয়ে শুকিয়ে মেরামত ও আলকাতরা দিয়ে পরবর্তী বর্ষার জন্য তৈরী করে রাখা হতো।
দুই পাশের গ্রাম গুলবাহার,দেবীপুর, রঘুনাথপুর পার হয়ে বোয়ালজরি খাল দিয়ে এগুচ্ছি । কাদের ভাই বোয়ালজরি খালে জেলেদের নিকট থেকে রহিমার জন্য জ্যান্ত মাছ কিনে নিয়েছেন । আস্তেআস্তে দুই জন এদিক সেদিক তাকাচ্ছি আর নৌকায় বসে গল্প করছি । আমরা মারকি,কালছো পার হয়ে সামনে এগুচ্ছি । এখানে অনেক আত্মীয়স্বজন রয়েছেন যাদের সঙ্গে আমাদের ছোটবেলায় অনেক সময় কেটেছে ।
সুহিলপুর পার হয়ে হাজীগঞ্জের দিকে আমরা এগুচ্ছি । আমার মনে পড়ে ১৯৬০- এর কথা, আমি রঘুনাথপুর স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ডক্টর শহীদুল্লাহ কে সুহিলপুর মাদ্রাসায় ওয়াজ মাহফিলে দাওয়াত করা হয়েছে । এই জ্ঞানী ব্যক্তিকে দেখার জন্য আমরা কয়েকজন মিলে মাহফিলে গিয়েছি । তাঁর চমৎকার বক্তব্য ধর্মীয় শিক্ষার আলোকে বিভিন্ন্ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা মনোযোগ সহকারে প্রতিটি মুসল্লি শুনার চেষ্টা করেছে ।
আমাদের নৌকা ওয়ারুক স্টেশন পার হওয়ার পর আর এগুচ্ছে না । খাল ভর্তি কচুরিপানা , এলাকার লোক খালের কচুরি পানা পরিষ্কার করে নি । আমরা দু’জন হাত দিয়ে কচুরিপানা সরাচ্ছি এবং বাচ্চুর বাপ্ নৌকা চালাচ্ছে । ওয়ারুক থেকে আজাগারা এক মাইল যেতে আমাদের অনেক সময় লেগে গেলো ।
রাহিমা আমাদের দেখে খুব খুশি । আশ্চর্য্য হয়ে বললো , ভাই আপনারা এই কচুরিপানা ঠেলে কি ভাবে আসলেন?
কাদের ভাই বললেন , মায়া- মমতার টানে আসতে হলো । মা বললেন অনেক দিন তোমার কোনো খোঁজ- খবর জানেন না । সে যাই হোক, আমরা এক ঘন্টার বেশি থাকবো না ।
রহিমার শ্বশুর বললেন, আমরা আপনাদের না খেয়ে যেতে দেবো না । বাড়ির অন্যান্ন লোকজন এসে ভিন্নভিন্ন মাটির চুলায় রান্না করে আমাদের আপ্যায়ন করিয়ে বললো , আপনারা এই কচুরিপানা ঠেলে গিয়ে ট্রেন পাবেন না । ভোরে উঠিয়ে দেবো, নাস্তা করে চলে যাবেন ।
কাদের ভাই বললেন , না, এখনও ট্রেন ধরার এক ঘন্টার মতো সময় আছে । আমরা নৌকা নিয়ে ওয়ারুক রেল স্টেশনের দিকে এগুতে শুরু করলাম । কাদের ভাই এবং আমি দুই দিকে কচুরিপানা পরিষ্কার করছি আর বাচ্চুর বাপ্ যত জোরে সম্ভব নৌকা চালাচ্ছে । অর্ধেক পথ যাওয়ার পর দেখি ট্রেন স্টেশনে আসছে ।
কিন্তু আমাদের দুই জনেরই পরদিন অফিস । কাদের ভাই বললেন এই কচুরিপানা ঠেলে ফেরত গিয়ে সকালে এসে কোনো ক্রমেই ট্রেন পাবো না এবং গিয়ে অফিস করতে পারবো না ।রাতে পরবর্তী ট্রেনে গিয়ে চাঁদপুর থেকে লঞ্চে ঢাকা পৌঁছে অফিস করা যাবে । স্টেশনে পৌঁছে খোঁজ নিয়ে জানলাম যে রাতে কোনো ট্রেন নেই, ভোর ৫টায় সর্ব প্রথম ট্রেন আছে ।
রাতে কোথায় থাকবো ?
উনি বললেন, না, আমরা এখানেই থাকবো । স্টেশন মাস্টারকে বললাম, আমাদের জন্য ওয়েটিং রুম খুলে দেয়া হোক । রুমে ঢুকে যে অবস্থা দেখলাম এতে কোনো প্রাণী ১০ মিনিটও থাকতে পারবে না । নোংরা পায়খানার দুর্গন্ধ, তাছাড়া স্টেশন মাস্টার বলে সব বন্ধ করে বাসায় যাবে এবং ভোর ৪ টার দিকে এসে খুলবে ।
তারপর ?
স্টেশন মাস্টার পাশের একটা টিনের ঘর দেখিয়ে বললেন দেখুন, ওখানে থাকতে পারেন কি না ।এই বলে সে অফিস এবং ওয়েটিং রুম বন্ধ করে চলে গেলেন ।
ঘর দেখতে গেলাম ,ওই ঘরে কোনো মানুষতো দূরের কথা, কোনো প্রাণীও থাকছে বলে মনে হয় নি । ঘরের চার দিকে জঙ্গল, কোথায় সাপ বা অন্য কিছু আছে কোনো কিছুই অন্ধকারে দেখি না । বিকেল ৬টা থেকে ভোর ৪টা পর্য্যন্ত এখানেই থাকতে হবে । পাশে কোনো দোকানপাটও নেই; যে খানিক বসে সময় কাটাবো, তাছাড়া গ্রামেগঞ্জে কোনো দোকান রাতে খোলা থাকে না ।
ঘুমানোর মতো একটা চৌকি, না আছে কোনো মশারি, না আছে কোনো বিছানার চাদর বা বালিশ, শুধু একটা হোগলা চাটাই পাতানো । অন্ধকারের মধ্যে আমাদের দুইজনকে কাটাতে হবে ভোর পর্য্যন্ত ।
বর্ষার মৌসুমে চারিদিকে কচুরি পানা, ধান ক্ষেত,পাট ক্ষেত, জঙ্গল, মশার উপদ্রব বেশি ।মৌমাছির চাকে আঘাত করলে যেভাবে চারিদিক থেকে মৌমাছি ঘিরে আক্রমণ করে, ঠিক সেভাবে মশা গুনগুন করে আক্রমণ করা শুরু করেছে । মশার কামড়ে অস্থির হয়ে আমরা দুই জনে একবার বাহিরে গিয়ে রেল লাইনে হাঁটা হাঁটি করি, একবার ঘরের মধ্যে ঢুকি ।
কিন্তু উপায় কি?
ভোর ৪টা পর্য্যন্ত কোনো রকমে ওয়ারুক স্টেশনে এ অবস্থায় কাটিয়ে ট্রেনে উঠে মনে হলো , জেল খানার অত্যাচার থেকে এই মাত্র মুক্তি পেলাম ।
আমাদের প্রিয় কাদের ভাই বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব হিসাবে অবসর নেয়ার পর, অনেক দিন হলো দুনিয়া থেকে না- ফেরার দেশে চিরবিদায় নিয়েছেন । তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি ।