টরোন্ট শহরে রংএর ছড়াছড়ি। চতুর্দিকে নিত্য-নতুন চমকপ্রদ রঙের বাহার। অথচ কোনো রঙেই দিব্যেন্দুর মনকে রাঙ্গায় না। ক’দিন যাবৎ সহকর্মী রবীণের দৃষ্টিগোচর হয়, নৈঃশব্দে শিথিল ভঙ্গিতে অফিস ঘরে ঢুকে চুপচাপ বসে থাকে দিব্যেন্দু। গভীর নিমগ্ন হয়ে ভাবনার সাগরে নিমজ্জিত হয়ে থাকে। আর একটার পর একটা ৫৫৫ সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে টেনে টেনে ধোঁয়া ছাড়ে।
রবীণ মহারাষ্ট্রের ছেলে। কলিগদের মধ্যে ওই সবার যুনিয়ার। খুব রসিক ছেলে। কথায় কথায় হাসায়, রঙ্গ-ব্যঙ্গ করে। দিব্যেন্দুকে বড়ভাই এর মতো গণ্যমান্য করে। রাম-লক্ষণের মতো সবসময় পিছে পিছে ঘোরে। দিব্যেন্দুর সংস্পর্শে থেকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলাও বলতে শিখেছে। হঠাৎ দিব্যেন্দুকে কাঁপিয়ে দিয়ে বলে,-‘উদাস কেন গুরু? মামলা ক্যায়া হ্যায়? কিসিসে ইস্ক হো গয়া হ্যায় ক্যায়া!’
সামনে একটা সোফায় ছিলো। ধপ্ করে সোফায় বসে বলে,-‘আরে ছোড়িয়ে! ইস্ক, ওভি তুমসে? কভি নেহি। হিম্মত চাহিয়ে।’
ফিক করে একটা বিষন্ন হাসি ফুটিয়ে দিব্যেন্দু বলল,-‘রবী, ভালোবাসার ফুল ফুটতে দেখেছিস কখনো?’
কথাটা এমনভাবে বলল, যেন একজন শিক্ষক তার ছাত্রকে প্রশ্ন করছে। রবীণ হোঃ হোঃ করে হেসে ওঠে। হাসিটা বজায় রেখে বলল,-‘ভালোবাসার ফুল? ওতো হর রোজ বাগিচায় দেখি। আজকাল তুমিও দ্যাখো বুঝি!’
মুহূর্তে বিষন্নতায় ছেয়ে গেল দিব্যেন্দু। একগাল ধোঁয়া ছেড়ে বলে,-‘শুধু তাই নয়রে, ভালোবাসার ফুল ফুটে ঝোরেও যেতে দেখেছি!’
কথাটা শুনে সোফা ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় রবীণ। একরাশ বিস্ময় নিয়ে হাঁ করে চেয়ে থাকে। দিব্যেন্দুর আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে বলে,-‘গুরু, তোমার আজ হয়েছে কি বলো তো? ভূতের মুখে রাম নাম। তোমায় তো কখনো ঐ গলিতে পা রাখতে দেখিনি। এয়াদ আছে, একদিন তুমিই বলেছিলে, নারীর সংস্পর্শ পুরুষের জন্য সর্বদা সুখদায়ক নয়, লাভজনক নয়, যদি সে ছলনা করে। আর তুমি তাদের হেট করো। ভুলে গেছো?’
হাতের কনুই দিয়ে দিব্যেন্দুর পেটে একটা গুঁতো মেরে বলে,-‘কিউ জনাব, আখির হো গয়া না প্যায়ার! কবসে চল রাহা হ্যায় ইয়ে শিলশিলে? তুমি তো বড় গভীর জলের মাছ! পেটমে ভুক অউর মুপে লাজ! এ্যাঁ! কোন্ বর্শিতে ধরলে গুরু? ভেরী ইন্টারেষ্টটিং!’
পরক্ষণেই সিরিয়াস হয়ে বলে,-‘ছোড়ো ইয়ে বাতে। মরদ লোকের এতো ভাবনা কিসের! দুনিয়ায় মেয়ে মানুষের অভাব আছে না কি! বলো তো আমিই ফিট্ করে দি”িছ!’
গম্ভীর হয়ে দিব্যেন্দু বলল,-‘এ্যাই, ফাইজলামি করিস না। বসে বসে আড্ডা দিচ্ছিস, কাজকর্ম নেই তোর? ম্যানেজারের কানে গেলে না…..!’ একটু থেমে বলে বলে,-‘খুব ইষ্ট্রিক্ট, দেবে সাসপেন্ড্ করে। কোনো এক্সকিউজ চলবে না।’
ববীণের গায়ে জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে বলে,-‘তুই যা এখন। লাঞ্চ আওয়ারে আসিস।’
কথা শেষ না হতেই টেলিফোনটা ঝন্ঝন্ করে বেজে ওঠে। রবীণ দ্রুত রিসিভারটা তুলে নিয়ে বলল,-‘হ্যালো’!
ওপাশ থেকে ভেসে আসে মহিলা কণ্ঠস্বর। -‘হ্যালো’
তৎক্ষণাৎ আবেগের প্রবণতা বেড়ে যায় রবীণের। চোখেমুখে কৌতূহল চেগে ওঠে। রিসিভারটা হাতে চেপে ধরে ফিস্ ফিস্ করে বলে,-‘গুরু, কন্যা কুমারী। নও, ধরো শিগ্গির।’
রবীণের হাত থেকে রিসিভারটা ঝট্ করে টেনে নিয়ে দিব্যেন্দু বলল,-‘ইয়েস, ক্যান আই হেল্প ইউ?’
হাঁপাতে হাঁপাতে জনৈক মহিলাটি বলল,-‘মিস্ জুলি ইস দেয়ার?’
-‘নো ম্যাম, উই আর অল মেল ওয়ার্কার হেয়ার।’
-‘হোয়াট?’
-‘ইয়েস ম্যাম। মে আই নো, ইওর নেইম, এ্যাড্রেস এ্যান্ড টেলিফোন নাম্বার?’
বিস্মিত কণ্ঠে মহিলাটি বলল,-‘নেইম, এ্যাড্রেস, টেলিফোন নাম্বার! হোয়াট ডু ইউ মিন? রাবিশ! আর ইউ যোকিং!’
মৃদু হেসে দিব্যেন্দু বলল,-‘নো ম্যাম, উই নিড ইট।’
বিব্রোত কণ্ঠে মহিলাটি বলল,-‘ফর হোয়াট?’
-‘ম্যাডাম, দিস ইস আওয়ার সীষ্টেম।’
-‘হোয়াট ননসেন্স!’
একেই মহিলা কণ্ঠস্বর। তন্মধ্যে অহেতুক অজ্ঞাত মহিলার এ ধরণের বিহেইভ মোটেই এক্সপেক্ট করেনি দিব্যেন্দু। অত্যন্ত বিব্রোতবোধ করে মনে মনে। কথা না বারিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল,-‘ম্যাডাম, কাম টু দি পয়েন্ট!’
মহিলাটি এবার নরম হয়ে পড়ে। মার্জিত হয়ে বলল,-‘আই এ্যাম মিস্ লাবণী। কলিং, ফ্রম…!’
মহিলার নাম শুনে হকচকিয়ে গেল দিব্যেন্দু। পড়ে যায় বিস্ময়ের ঘোরে। শুকনো একটা ঢোক গিলে মনে মনে বলল,-এ আবার কোন লাবণী! মহিলাটিকে বাধা দিয়ে বলল,-‘ও.কে, ফাইন। গিভ মি ইওর এ্যাড্রেস এ্যান্ড টেলিফোন নাম্বার!’
তৎক্ষণাৎ গলার স্বর বিকৃতি করে মহিলাটি বলল,-‘ওঃ গড্! ইউ আর রিয়েলি ষ্টুপিড ম্যান!’
আচমকা থতমত খেয়ে গেল দিব্যেন্দু। অস্বস্তিবোধ করে। অপদ’ হয়। ক্রোধে ভিতরে ভিতরে ফুলতে থাকে। ইতিমধ্যে চোখে চোখ পড়তেই নিঃশব্দে হেসে ফেলল রবীণ। মৃদুস্বরে বলল,-‘কি হলো দেবুদা, খামোশ কিউ!’
ওপাশ থেকে মহিলাটি বলল,-‘হ্যালো, হ্যালো!’
দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বিড়বিড় করে ওঠে দিব্যেন্দু।-‘হোয়াট রাবিশ!’ রবীণের দিকে তাকিয়ে বলে,-‘কি মুশকিলে পড়া গেল বল্ তো!’
মহিলাটি বলল,-‘আই ক্যান্ট হিয়ার ইওর ভয়েস। ইস ইট্ বিউটি সেলুন?’
বিব্রোত কণ্ঠে দিব্যেন্দু বলল,-‘নো ম্যাম, ইট ইস কম্পিউটার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানী লিমিটেড। রং নাম্বার!’
-‘ওঃ শীট্!’ বলে মহিলাটি তক্ষুণিই লাইন কেটে দিলো।
রিসিভারটা হাতে নিয়ে তখনও দাঁড়িয়ে থাকে দিব্যেন্দু। চেয়ে থাকে শূন্য দৃষ্টিতে। অহেতুক বিড়ম্বণায় প্রচন্ড রাগ হয় মনে মনে। ধপ্ করে রিসিভারটা রেখে সিগারেটের বাকি অংশ ছুঁড়ে গার্বেজে ফেলে দিলো। আর রাগটা গিয়ে পড়লো রবীণের ওপর।-‘কি রে, গেলি না তুই! এখনো বসে আছিস। ডাকবো মিষ্টার রায় চৌধুরীকে!’
রবীণ বেরিয়ে যেতেই ক্ষণপূর্বের অজ্ঞাত অপরিচিত মহিলার শ্রæতিকটূ তীক্ষè কণ্ঠস্বর বিষ ক্রিয়ার মতো শুধু দংশণই নয় মস্তিস্কের সমস্ত স্নায়ুকোষে রক্তের স্রোতের মতো সঞ্চালণ হতে থাকে দিব্যেন্দুর। কিছুতেই কাজে মন বসেনা। বারবার একই প্রশ্ন মনের মধ্যে উদয় হতে থাকে, কে এই মহিলা? কি তার পরিচয়? আশ্চর্য্যরে বিষয়, ঠিক এই রকমই বিহেইভ করতো ও। বিরল সেন্টিমেন্টাল। অনমণীয় জেদ। কথায় কেউ ওর সাথে পেরে উঠতো না। ইভেন কণ্ঠস্বরও এক্সয্যাক্ট ওর মতো। আই কান্ট বিলিভ! হাউ ইস দিস্ পসিবল? ইস সী হিয়ার? পরক্ষণেই ভাবে, না না, তা কেমন করে সম্ভব! জগতে একই নামে বহু মানুষ আছে। আননেসেসারি হেডেক্ নিয়ে টাইম ওয়েষ্ট করা, এর কোনো মানে হয় না। ফরগেট ইট!
(চলবে)