পর দিন ললিত আশ্রম থেকে সকাল সকাল বের হয়ে কোথায় চলে গেছে কেউ বলতে পারছে না। প্রিয়ব্রত ডাক্তারের সঙ্গে এবং তার আশ্রমে আলাপ করেছে। ওরা জানিয়েছে যে যেখানেই যাক হয়তো বিকেলের দিকে চলে আসবে। আর যদি না আসে, পুলিশ রিপোর্ট করবে এবং পুলিশ ওকে খুঁজে বের করবে।  এ নিয়ে প্রিয়ব্রত নিমিকে বলেছে যে বাবাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করার   কিছু নেই। বাবা মাঝে মধ্যে বের হয়ে কোথায় চলে যায় এবং আবার এক সময় ফিরে আসে।তথাপি ওরা এখানে সেখানে এবং আত্মীয়স্বজন যে যেখানে আছে বলেছে খোঁজ নেয়ার জন্য। 

কিন্তু এক সপ্তাহ চলে গেছে, বাবার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।  পুলিশ ও খুঁজে বেড়াচ্ছে, কিন্তু ওর দেখা পাচ্ছে না। ইতিপূর্বে ললিত এত দীর্ঘ সময় নিখোঁজ থাকে নি এবং এ নিয়ে পরিবারের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। নিমি, প্রিয়ব্রত পুলিশকে জিজ্ঞেস করে জেনেছে ওরা শহরের আনাচে কানাচে নজর রাখছে।   যদি নজরে পড়ে  ওকে আশ্রমে নিয়ে আসবে এবং খবর দেবে।  

ললিত বাস স্টেশনে গিয়ে  টিকেট কেটে  মন্ট্রেয়ালে চলে গিয়েছে। সে বাস স্টেশনে নেমে আপন মনে ঘোরাঘুরি করে এক সময় খিদায় ক্লান্ত হয়ে এক ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে পার্কে গিয়ে বেন্সে শুয়ে পড়েছে। ঠান্ডার সময় পার্কে লোকজনের যাতায়াত থাকে না , চারিদিকে বরফ আর বরফ।  গাছে কোনও  পাতা থাকে না, দেখলে মনে হয় সব গাছ মরে গেছে।      

মাইনাস  টেম্পারেচার বাহিরের আবহাওয়া।  ললিতের ভালো কাপড় ও গায়ে নেই। তাকে পুলিশ এ অবস্থাতে দেখে উঠিয়ে নিয়ে  হোমলেস লোকদের সঙ্গে আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থা করে । সেখানে খাওয়া ও  থাকার ব্যবস্থা পেয়ে সে খুবই খুশি। কারণ সকালে গরম গরম সূপ,  বার্গার, ফ্রাইজ, কপি  এবং দুপুরে ও রাতে গরম  খাওয়া পেয়ে সে আর আশ্রম থেকে বের হতে চায় না।  

এ দিকে তাকে ছেলেমেয়েরা  খুঁজে না পেয়ে পুলিশ রিপোর্ট করেছে। এক শহর থেকে অন্য শহর স্থান পরিবর্তনের ফলে পুলিশ ও তাকে আর সময় মতো খুঁজে বের করতে পারছে না। 

কানাডাতে প্রতিটি মিউনিসিপালিটি হোমলেসদের জন্য খাওয়া, গরম কাপড় ও   থাকার ব্যবস্থা থাকে এবং বিভিন্ন আতিথেয়তা সংগঠন যেমন চার্চ, মসজিদ, মন্দির ও ব্যক্তিগত সাহায্যে সারা বৎসর খাওয়া ও কাপড় এবং হাত খরচের টাকা দেয়া হয়। এ ছাড়া ও  সরকারি অনুদান তো অবশ্য রয়েছে।এ দেশে   ৯১১ কল দিলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্স এসে রোগীদের অবস্থা বুঝে  চিকিৎসা শুরু করে যে পর্যন্ত  না রোগী হাসপাতালে নেয়া হয়। 

এ দেশে যারা গৃহহীন , এরা গরিব না, মানসিক রোগী। এ দের ছেলেমেয়েরা অনেকে বড় বড়  চাকুরী, ব্যবসা বাণিজ্য  করে।মেয়েদের এ দেশে গৃহহীন হিসাবে কম দেখা যায়। হোমলেস লোকদের    রাস্তা, শপিং মলে ঘোরাঘুরি  করতে দেখা যায়। এ দেশের সরকার মানসিক রোগীদের চিকিৎসার জন্য অনেক পয়সা খরচ করে। তাদের স্থায়ীভাবে আশ্রয়, চিকিৎসা ও ,নার্সিং দিয়ে থাকে। 

একদিন পুলিশ খবর দিয়ে জানায় যে ললিত মন্ট্রেয়ালে এক আশ্রয় কেন্দ্রে আছে। খবর পেয়ে প্রিয়ব্রত ও নিমি মন্ট্রেয়ালে গিয়ে বাবার খবর নিয়ে  বলে চলো তোমাকে অটোয়া নিয়ে যাবো। ললিত বলে আমি ওই আশ্রয় কেন্দ্রে আর যাবো না,ওখানে যে সব লোকজন আছে ওদের সঙ্গে থাকা সম্ভব না। ওরা আমাকে সব সময় বিভিন্ন ভাবে মানসিক অত্যাচার করে। প্রিয়ব্রত ও নিমি মানাজেমেন্টের সঙ্গে বাবার  অসুস্থতার রেকর্ড নিয়ে আলোচনা করে। ম্যানেজমেন্ট অফিস বলে ও বয়স্ক, যদি না যেতে চায়,তোমরা কিছুই করতে পারবে না। ও বরং এখানে থাকুক, আমরা ওর চিকিৎসা করাবো   এবং কোনো ব্যাপারে তোমাদের দরকার হলে যোগাযোগ করবো। অগত্যা ওরা ওকে কাপড় ও দরকারি এটা সেটা দিয়ে অটোয়া চলে আসে। 

নিমি ও প্রিয়ব্রত অটোয়া ফিরে এসে অদিতির সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে বলে বাবাকে ফিরে আনা সম্ভব হচ্ছে না। এটার মূল কারণ এখানে আশ্রমে অন্যদের সঙ্গে বাবার বনিবনা হতো না। ওখানে লোকজন খোলামেলা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব    রেখে  চলা ফেরা করে। খাওয়ার সময় ওরা সবাই হাসিখুশি আলাপ আলোচনা করে খায়। কপি ব্র্যাকে সবাই এক সঙ্গে গিয়ে  একে ওপরের সঙ্গে আলাপ করে।  আশ্রমে  ভারতীয় বসু নামে  একজন রোগী রয়েছে, ওকে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা সর্বদা খোঁজ খবর নিয়ে থাকে। আমরা তাদের সঙ্গে আলাপ করে আমাদের টেলিফোন নম্বর দিয়ে এসেছি, কোনো অসুবিধা হলে ওরা খোঁজ খবর দেবে এবং সব সময় দেখা শুনা করবে।তাছাড়া  কিচেনে দুইজন ভারতীয় বাবুর্চি আছে ওরা ওকে পছন্দ করে এবং বলেছে ওরা খোঁজখবর নেবে এবং প্রয়োজনে আমাদের সঙ্গে আলাপ করবে । অদিতি বলে ঠিক আছে বাবা যদি মন্ট্রিয়েল ভালো থাকে, থাকতে দাও।

নিমি পরদিন কাজে গিয়ে  নাহিদকে বলে উইকেন্ডে বাবাকে দেখে এসেছি। 

নাহিদ বলে কেমন দেখলে ?

বাবা আশ্রমে আছে এবং ভালো আছে। বাবা মন্ট্রিয়েল ছেড়ে অটোয়া আসতে চায় না। ওখানে আমাদের ভারতীয় আরও কিছু লোক আছে, ও তাদের  পছন্দ করে এবং বলে আমি এখানে ভালো আছি। বাবা যদি স্থায়ী ভাবে  মন্ট্রিয়েল থাকে আমি কাজ নিয়ে হয়তো এক সময়  চলে যাবো, বাবার  কাছে থাকলে দেখাশুনার জন্য ভালো হবে।

এখানকার ডাক্তার কি বলে?

ডাক্তার বলে মন্ট্রেয়ালেও ভালো চিকিৎসা   আছে। ও নিজের থেকে চিকিৎসা  নিলে তো ভালো। নতুবা তোমাদের ওর পিছনে লেগে থাকতে হবে।   এই জাতীয় রোগী পিছন থেকে বার বার  না বললে  ডাক্তারের কাছে যায় না বা রীতিমতো ঔষুধ নেয় না।

উইকেন্ডে নিমি মানসের সঙ্গে ঘুরতে বের হয়েছে। ওরা  পার্লামেন্ট হিল এলাকা ঘোরাঘুরি করে এক সময় ক্লান্ত হয়ে এক ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট গিয়ে খাওয়া  নিয়ে বসে । মানস জানতে চায় বাবা ললিতের কি অবস্থা ?

নিমি বলে বাবা এখানে আসতে চায় না, ওখানে ভালো আছে। মানস বলে ওখানে বাবাকে কে দেখা শুনা করবে?

নিমি বলে আমাদের দেশীয় কিছু লোক আছে ওদেরকে বলে এসেছি খোঁজ খবর  নিতে। নিমি বলে বাবা বয়স্ক লোক, এ দেশে বয়স্ক লোকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো চিকিৎসা দেয়া যায় না। সে জন্য বাবাকে মন্ট্রিয়েল থেকে এখানে আনা যাচ্ছে না ।   

বাবা ললিত আর এক অগঠন গঠিয়েছে , হাঁটতে গিয়ে পা ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে । নিমি বলে বাবার এত এত কষ্ট দেখলে ভালো লাগে না । হাসপাতালে ললিতের  ভগ্ন পা জোড়া লাগিয়েছে।  চারদিন হাসপাতালে রাখার পর ওকে  আশ্রমে পাঠানো হয়েছে।  বাবা পায়ের ব্যথায় চিৎকার, কিছুই সহ্য করতে পারছে না। ডাক্তার উচ্চ ক্ষমতাশালী ব্যথা নাশক ঔষুধ দিয়েছে। কিন্তু তাতে ও ব্যথা কমছে না ।  নিমি  সঙ্গে সঙ্গে ছুটি নিয়ে মন্ট্রিয়েল গিয়ে  বাবার কাছে  থেকে বাবাকে সেবা দিচ্ছে  এবং সঙ্গে হাসপাতালের নার্স ও   সময় সময় এসে এক্সারসাইজ করানো দেখিয়েছে।  হাসপাতাল ও হেলথ কিনিকে আনা নেয়ার জন্য হুইল ট্রান্স  দেয়া হয়েছে। নিমি না থাকলে ললিতের  অসুবিধা হতো হাসপাতাল ও হেলথ ক্লিনিকে আনা নেয়ার জন্য।  

এক মাসের অধিক সময় পার হয়েছে , এখনও সপ্তাহে তিনদিন নার্স আশ্রমে আসে এবং আস্তে আস্তে পা নাড়াচাড়া ও ওয়াকার দিয়ে  চলাফেরা করাচ্ছে । বাবার আর শান্তি নেই, একটার পর একটা অগঠন চলছে।সারাদিন বিচানায় শুয়ে ব্যথায়  কাৎরাইতে থাকে। দাদা ও অদিতি এসে দেখে অটোয়া চলে গেছে ।  কিন্তু কেউ না কেউ পার্শে থাকা দরকার।  আমি থেকে গেলাম এবং কাজের জায়গা থেকে ছুটির দরখাস্ত দিয়েছি। নাহিদ কে বললাম আমার ছুটি করিয়ে দিও।   নাহিদ বলে আমি দেখবো। 

নাহিদ ও শুচিতা দ্রুবকে নিয়ে মন্ট্রিয়াল গিয়ে নিমি ও ললিতকে দেখে এটা সেটা দিয়ে কয়েক ঘন্টা থেকে শুচিতার এক বান্ধবীর বাসায় রাত কাটিয়ে পর দিন ঘুরে অটোয়া চলে আসে। নাহিদ বলে কেউ না কেউ বাবার কাছে কিছুদিন থাকা দরকার। নিমি বলে বাবা আমাকে দেখলে অনেক খুশি হয়।  

নিমির এখানে ভালো লাগে, ছুটি বাড়িয়ে নিয়ে মন্ট্রেয়ালে ডে কেয়ার গুলিতে দরখাস্ত  দিয়েছে।   বেশ কয়েক জায়গায় দরখাস্ত দেয়ার পর এক জায়গায় কাজ পেয়েছে।   কাজের ব্যবস্থা হওয়াতে সে  একটা বাসা নিয়ে অটোয়া থেকে স্থায়ীভাবে চলে এসেছে। 

নিমি মানসকে বলে, আমি আর তোমার পিছনে সময় নষ্ট করবো না  ।   তোমার  মন মানসিকতার পরিবর্তন না হলে  আমি অযথা  তোমার পিছনে দৌড়াবো না।  তোমাকে আমি তিন বৎসর সময় দিয়েছি,তুমি যে সব কারন দেখাচ্ছো, তা অযৌক্তিক ।  

মানস বলে যেমন?

তুমি এক একবার এক একরকম বলো যার কোনো যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পাই না।     মানস হেঁসে বলে  একটু ধর্য্য ধরো,এখনই হুট্ করে কোনো কিছু সিদ্ধান্ত নেবে না।  আমি দেখি কি করতে পারি ।  

শুচিতা শুনে বলে তোমার কেস সম্পূর্ণ আমার কার্বন কপি।  আমি সুমিতের ফাঁদে পড়ে যে ভাবে আজ পর্যন্ত ভোগতেছি। মনে হয় তুমি ও সে দিকে পা বাড়াচ্ছ।  তুমি বুঝে শুনে পা বাড়াবে।  নতুবা শেষে আমার মতো ভুগে মরবে।  আমি মা বাবার কথা শুনি নি, নিজে এক রোখা সিন্ধান্ত নিয়ে বিয়ে করেছি, আজ আমি বুঝি কি ভুল করেছি। কেউ আমার কথা শুনে না, অনেকে আমাকে বলে যে আমি প্রদীপকে ভালো বাসি,সে জন্য এত সব অসুবিধা হচ্ছে । 

পড়াশুনা জীবনে আমি সুমিতকে ভালোবেসেছি এবং সে  সরলতার সুযোগে ভুল করে বিয়ে করেছি ।  

আমি কি পেয়েছি?

সুমিত তার মাবাবা ও ভাইবোনকে দেশ থেকে এনে সমস্যা করেছে। ওদের  কোনো বাস্তব জ্ঞান নেই।  ওর পরিবার এখানে এসে কলহ সৃষ্টি করেছে।    আমাকে ছোট ঘরের মেয়ে এবং চোর পৰ্যন্ত বানিয়ে হেনস্ত করতে দ্বিধা করে নি।  আমি কেঁদেছি , ওরা আমাকে চাকরানীর মতো ব্যবহার করেছে।  

নিমি বলে আমি তোমার দুঃখ দেখেছি এবং আমার জীবনে এ সব  হতে  দেব না।  আমি মানসকে বলেছি চলো আমরা  ছোটোখাটো করে বিয়ে করে ঘর সংসার শুরু করি । কিন্তু ওর প্ল্যান অনেক বড়ো, দেশে যাবে মাবাবা ও আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে আনন্দ করে বিয়ে করবে? 

নাহিদ বলে ওর এক পক্ষের লোকজন আনন্দ  করবে ,তোমার লোকজন গত দুই যুগের ও বেশি সময় কানাডা থাকে । 

 তোমার কেউ কি ইন্ডিয়া অনুষ্ঠান করতে যাবে ?

বাবা অসুস্থ্য, এক ভাই সেও দেশে যেতে চায় না । আমাদের দেশে আপন জন বলতে কেউ নেই।  

নাহিদ বলে তাহলে কিসের আনন্দ হবে?  

ওকে বুঝিয়ে দুইজনে এখানে ছোট খাটো করে বিয়ে করে নাও।  পরে  এক সময় দেশে গিয়ে লোকদের খাওয়া দিয়ে একটু আনন্দ করবে।  ঠিক আছে দেখি।  

নিমি একদিন টেলিফোন উঠিয়ে বলে মানস তুমি একবার মন্ট্রিয়েল এস, আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই।  কি কথা বলবে টেলেফোনে বলো, আমি শুনবো।  টেলেফোনে এত এত কথা বলা যাবে না।  তুমি এখানে এস আমি কিছু কথা বলব।  ঠিক আছে আমি আসবো ।  

পরের উইকেন্ডে মানস মন্ট্রিয়েল এসে নিমির সঙ্গে দেখা করে এবং নিমি ওকে নিয়ে বাবা ললিতের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়     ।  ললিত বলে যেহুতু তোমরা একে অপরকে ভালো বাস, তোমরা মন্দিরে  চলো, আমি  ছোট খাটো করে মন্ত্র পড়িয়ে  বিয়ে দিয়ে দেব।  পরে দুই জনে এক সময় দেশে গিয়ে মাবাবা ভাইবোনকে নিয়ে বড়ো করে অনুষ্ঠান করে নাও।  মানস বলে বাবা আমি ভেবে চিনতে পরে আপনাকে জানাব।  নিমি ভিতরে ভিতরে অসন্তুষ্ট হয়ে বলে তুমি যাও, আমি পরে কথা বলবো।  

মানসকে বিদায় দিয়ে  নিমি বাসায় এসে চোখের পানি ফেলে, আমার কপাল ঠিক শুচিতার মতো।  শুচিতা যেভাবে তার স্বামী সুমিত এবং তাদের পরিবার থেকে নাজেহাল হয়েছে, এ ভাবেই আমাকে ও মানসের নিজের এবং পরিবার থেকে নাজেহাল হতে  হবে। সে  কয়েক সপ্তাহ নিজ থেকে কথা বলা বন্ধ করে  দিয়ে চুপ করে থাকে।  

মানস কয়েকবার  নিমিকে টেলেফোনে  না পেয়ে শেষে মন্ট্রিয়েল এসে নিমির সঙ্গে দেখা করে ।  নিমি বলে আমি আপাতত বিয়ে করবো না। 

মানস  বলে কেন?

নিমি বলে বাবার অসুখ,আমি একটু টেনশনে আছি।  বাবার অসুখ ভালো হলে চিন্তা করে দেখবো । এই বলে নিমি বলে  বাবাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। আজ  তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারলাম না, তুমি যেতে পারো, আমাকে যেতে হবে।   

মানস তাকিয়ে থেকে বলে এই কোন নিমি ?   

আমি যেই নিমিকে গত তিন বৎসর থেকে চিনি,এ কি সেই নিমি ?

মানস  অনেক দিন যোগাযোগ করেও আর নিমিকে রাজি করাতে পারে নি ।  

এ ভাবেই তাদের  মধ্যে সম্পর্কে টানাপোড়ন শুরু হয়। 

নিমি কাজ থেকে এসে তাড়াহুড়া করে রান্না ছড়িয়েছে।  অদিতি ও প্রিয়ব্রত এই  উইকেন্ডে মন্ট্রিয়েল  আসছে  ।  ওরা সরা সরি বাবাকে দেখার পর  নিলয় কে নিয়ে নিমির বাসায় উঠেছে। রাতের খাবার পর ওরা নিলয়কে নিয়ে বসে অধিক রাত পর্যন্ত টেলিভশন  দেখে ঘুমিয়ে পড়ে।  পরদিন সকালে নিমি ও অদিতি সকালের নাস্তা খেয়ে বাহিরে বের হয়েছে। প্রিয়ব্রত নিলয়কে নিয়ে বাসায়  রয়েছে।  ওরা ঘন্টা দুয়েক পরে বাজার করে ঘরে ঢুকে।  

প্রিয়ব্রত বলে মানস একটু আগে আমাকে টেলিফোন করেছে ।  সে এখন মন্ট্রিয়েল আছে এবং বাসায় আসতে চায়।  আমি বলেছি যে নিমি বাসায় নেই,আসলে টেলিফোন করবে।  ওরা রান্না করে খাওয়া দাওয়া করে কিছু সময় রেস্ট নিয়ে বাবা ললিতকে দেখতে গিয়েছে।  গিয়ে দেখে মানস ও বাবার ওখানে আছে।  

মানস বলে আমি তোমার বাসায় যাবো বলে ঠিক করেছি।  কিন্তু তোমার বাসার ঠিকানা না জানাতে আর যেতে পারছি না।  নিমি কিছুই বলছে না।  বাবা বলে মানস আমাকে বলেছে, সে রাজি আছে এবং আমার কথা মতো ছোটোখাটো করে বিয়ে করে নেবে। অদিতি বলে মানস তুমি এখানে যদি বিয়ে করতে চাও, আমরা তোমাদের বিয়েতে আশীর্বাদ করতে পারব।  তোমরা  পরে সময় করে দেশে গেলে দেশের লোকজনকে নিয়ে আনন্দ করবে।  মানস বলে ঠিক আছে বাবা  মিলিয়ে দিলে- ই হবে।  প্রিয়ব্রত বলে ঠিক আছে ওদের আর একটু সময় নিতে দাও। ওরা যখন দুইজনে মিলে বলবে, ও সব ব্যবস্থা করা যাবে।  

মানস অটোয়া চলে যাওয়ার পর অদিতি বলে নিমি, সে কি সিরিয়াস বিয়ে করার ব্যাপারে?

নিমি বলে ওতো বিয়ে করতে চায়।  কিন্তু দেশে গিয়ে মাবাবাকে নিয়ে, এখন মন পরিবর্তন করেছে।  দেখি কিছু সময় যাক, পরে দেখা যাবে।  ঠিক আছে ভালো ভাবে চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।  ললিত বলে মানস রাজি হয়েছে , তুমি দেরি কেন করো?

বাবা আমাকে একটু সময় দাও, আমি বুঝে শুনে তোমাকে জানাব। 

ললিত এখনও ওয়াকার  নিয়ে চলাফেরা করে।  নার্স সপ্তাহে তিন দিন এসে ওকে ব্যায়াম ও গোছল  করিয়ে বিছানা পাল্টিয়ে নুতন বেড শিট লাগিয়ে দিয়ে ময়লা কাপড়  লন্ড্রি করে রেখে যায়।   

বিকেলের দিকে ওরা ভাই বোন  এবং নিলয় সহ  ঘোরাঘুরি করে নিমিকে নামিয়ে দিয়ে অটোয়া চলে যায়।  নিমি বাসায় ফিরে এসে সারাদিনের থালা বাসন ধুয়ে,ঘর পরিষ্কার করে  টেলিভশন নিয়ে বসে আবহাওয়ার পূর্বাবাস দেখে,  আজ সন্ধ্যার দিকে তুষারপাত হবে।

নিমি মন্ট্রিয়েল এসে এই প্রথম তুষারপাত দেখবে ।  সাদা তুলার মতো তুষার পড়ে,  দেখতে বেশ ভালো লাগ এবং কিছুক্ষনের মধ্যে চারিদিক সাদা বরফে ঢেকে  যায়  ।  নিমি ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে এবং আকাশের দিকে তাকাচ্ছে ।  এ সময় কে যেন দরোজায় নক করছে, নিমি ঘরে ঢুকে দরোজার কাছে গিয়ে বলে কে।  মেয়েলি গলার কণ্ঠস্বর, দরজা খুলে দেখে পাশের এপার্টমেন্টের নমিতা ঘর থেকে কিছু খাওয়া নিয়ে নিমিকে দেখতে আসছ।  নিমি বলে দিদি     ঘরে এস, সে বলে না আমি কিছু খাওয়া দেয়ার জন্য এসেছি।  আর একদিন আসবো এই বলে খাওয়ার বাটি হাতে দিয়ে চলে যায়।  নিমি খাওয়ার ঢাকনা খুলে দেখে কিছু মিষ্টি জাতীয় খাওয়া দিয়েছ।  সে বাটি টেবিলে রেখে পুনরায় ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে সাদা তুষার পড়া দেখে, এক ঘন্টার মধ্যে সারা শহর সাদা তুষারে ঢেকে গেছে । দেখতে বেশ ভালো লাগছে ।  এ দিকে স্নোব্লোয়ার  দিয়ে মিউনিসিপ্যালিটির লোক রাস্তা পরিষ্কার করা শুরু করেছে।   

নিমি ঘরে ঢুকে টেলিভিশনের সামনে বসে নমিতার দেয়া মিষ্টি খাচ্ছে আর অটোয়া থাকাকালীন সময়ের ডে কেয়ার এ কাজ করা এবং বাচ্চাদের নিয়ে তুষার ও বরফের মধ্যে বাহিরে হাঁটাহাঁটি  করা নিয়ে ভাবছে।  টেলিফোন রিং হচ্ছে শুনে সে গিয়ে ধরে এবং শুচিতা বলে নিমি কেমন আছো ? 

নিমি অবাক হয়ে বলে, আমি ভাবছি তোমাকে নাম্বার দেব, শুচিতা তুমি কি করে আমার টেলিফোন নাম্বার  পেলে?

শুচিতা বলে তোমার বান্দবী নাহিদ আমাকে দিয়েছে।  

তুমি কেমন আছো এবং দ্রুব কেমন আছে ?

আমরা সবাই ভাল।  

তোমার একাকী জীবন মন্ট্রেয়ালে কেমন কাটছে ?

দাদা, অদিতি ও নিলয় কাল এসেছিলো এবং মানস ও আমাকে দেখতে এসেছে।  

মানসের সঙ্গে তোমার কোনও কিছু কি হলো ? 

না, সে গতকাল আমাকে দাদা, অদিতি  ও বাবার সামনে বলেছে এখানেই বিয়ে করবে।  তুমি কি বললে ?

আমি বলেছি একটু চিন্তা করতে দাও।  তার কারণ ওর আগের প্ল্যান ছিল ইন্ডিয়া গিয়ে  সবাইকে নিয়ে আমরা বিয়ে করব।  আমাদের কেউ রাজি হয় না দেখে সে রাজি হয়েছে।  দেখো চিন্তা করে কোনটা ভালো হয়।  

আঙ্কল ও আন্টি কি ইন্ডিয়া থেকে ঘুরে এসেছে?

না , এখনো আসে নি।  

সুমিতের কি অবস্থা ? 

ও এখনও হাসপাতালে আছে এবং শরীর অনেকটা ফুলে গেছে। 

ডাক্তার কি বলে ? 

ডাক্তার বলে ওর শরীরে পানি নেমেছে।  ও হাঁটাহাঁটি করতে পারছে না। আমি আজ ওকে দেখতে গিয়েছিলাম।  

নিমি,  তোমার বাবার কি অবস্থা?

বাবা এখনও নার্সের কেয়ার এ আছে। একথা সেকথা বলে টেলিফোন রেখে দেয়।

 নিমি ভাবে বাবা   আসতে আসতে ওয়াকার ঠেলে ঠেলে হাঁটে।   আমি প্রতিদিন বিকেলে কাজ থেকে বের হয়ে বাবাকে দেখতে যাই।  বাবা আমাকে দেখলেই হেঁসে বলে “মা কেমন আছো ? “

বাবা টিম হর্টনের কপি পছন্দ করেন । সঙ্গে একটা ডেনিস বা একটা ডোনাট বা মাফিন নিতে ভুল করি না।  বাবা দেখলে খুব খুশি হয়ে হাত বাড়িয়ে নিয়ে অতি তৃপ্তির সঙ্গে  খায়। আমি এর   ফাঁকে বিছানার চাদর, বালিশের কভার, আলমারি  খুলে কাপড় গুলি গুছিয়ে রাখি। জুতা, স্যান্ডেল অগোছালো অবস্থায় থাকে যা গুছিয়ে রাখি।   ওর রুম মেট বলে তুমি বাবার অনেক খেয়াল রাখো । কিচেন হেল্পার এর সঙ্গে আলাপ করে জানি বাবা ঠিক ভাবে খাওয়া দাওয়া করে কি না।  

বাবাকে ওয়াকার ঠেলে ঠেলে বাহিরে নিয়ে  একটু কথা বলি।  বাবাকে শান্তনা দিয়ে বলি,বাবা তুমি একা না, আমি তোমার কাছেই থাকি।  মাঝে মধ্যে উইকেন্ডে বাবাকে বাসায় নিয়ে আসি এবং বাবার পছন্দের এটা সেটা তৈরী করিয়ে সামনে দেই।  বাবা আগের চেয়ে অনেক সুস্থ বোধ করে, তা ছাড়া বাবা চিকিৎসা নিতে অবজ্ঞা করে না।    

বাবা মনখোলা মানুষ, জিজ্ঞেস করে মানসের সঙ্গে তোমার বিয়ের কি হলো? 

আমি বলি বাবা একটু সময় নিচ্ছি, তোমাকে বলবো যদি কিছু হয়।  বাবা বলে অদিতি বলেছিলো নরেশের সঙ্গে তোমার বিয়ের প্রস্তাব আছে।  বাবা আমি এই মুহূর্তে কিছুই বলতে পারছি না।  নুতন চাকরি একটু মনোযোগ দিয়ে কাজ করি ।     

আমার দুই কামরা বাসা , উইকেন্ডে মাঝে মধ্যে বাবাকে নিয়ে আসি এবং কাছে রেখে দেই। বাবার পছন্দের খাওয়া তৈরী করে খাওয়াই যাতে বাবা একটু তৃপ্তি সহকারে খেতে পারে।  আশ্রমে বিভিন্ন দেশীয় লোক একত্রে থাকে এবং ওরা সবার পছন্দের খাওয়া তৈরী করতে পারে না।     

মানস দেশে তার বাবামা এবং আত্মীয়দের টেলিফোন করে জানিয়েছে , নিমির সঙ্গে তার অনেক দিনের সম্পর্ক রয়েছে এবং ওর পক্ষের কেউ দেশে যাওয়ার মতো নেই।  ওরা গত দুই দশক এই দেশে থাকে।  বাবামা বলে দেশে গিয়ে সবাইকে নিয়ে বিয়ে করতে, এটা সম্ভব হচ্ছে না এবং শর্ট করে আমাকে এখানেই বিয়ে করে নিতে হবে।  বাবামা ওর অবস্থা বুঝে বলেছে তুমি বিয়ে করে নাও এবং পরে দেশে এসে দেখা করে বাকি অনুষ্ঠান এখানে করবে ।  

মানস নিমিকে বলে  আমি মাবাবার কাছ থেকে সবুজ সংকেত  পেয়েছি । কাজেই সামনে এগিয়ে যেতে আর কোনো বাধা নেই। নিমি শুচিতাকে বলে মানস রাজি হয়েছে তার মাবাবা এখানে আমাদের বিয়ে হলে অমত করবে না।  শুচিতা এ নিয়ে নাহিদের সঙ্গে আলাপ করে বলে নিমি এখন  এগিয়ে গেলে খারাপ কিছু দেখছি না।  

নিমি বাবাকে দেখতে গিয়ে বলে বাবা মানস রাজি হয়েছে এবং বলেছে এখানে ছোট খাটো করে অণুষ্ঠান করে নেবে।  ললিত বলে আমি তেমন কিছু খারাপ দেখছি না।  নিমি অদিতির সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে হোঁচট খায়।  অদিতি বলে নরেশ সব দিক থেকে ভালো এবং তুমি ভালো ভাবে চিন্তা করে দেখবে।  নিমি বাবাকে বলে, বাবা অদিতি আমাকে বলে নরেশ কে বিয়ে করার জন্য।  ললিত বলে মানস ও নরেশ উভয়-ই ভালো।  তবে তুমি মানসকে পছন্দ করো, আমি তোমাকে বলছি ওকে আমি দেখছি, অত্যন্ত ভালো ছেলে , আমি আশীর্বাদ করেছি তা উঠিয়ে নিতে পারবো না।    

অদিতি বলে বাবা মানসের চেয়ে নরেশ বেশি শিক্ষিত এবং কলেজে প্রফেসরি করে।  নিজের বাড়ি, গাড়ি সবই আছে এবং ধীরস্থির মানুষ।  ললিত বলে থাকগে, মানস  ইয়ং ছেলে এবং তোমাদেরও  বাড়ি গাড়ি হবে।  এ দেশে বাড়ি গাড়ি করতে পয়সা দরকার হয় না, সবাই লোন করে বাড়ি গাড়ি করে।  

এক উইকেন্ডে প্রিয়ব্রত,অদিতি নিমি ও মানসকে মন্দিরে নিয়ে বাবা ললিতের উপস্থিতিতে ঠাকুর দিয়ে ওদের বিয়ে অনুষ্ঠান করিয়ে দিয়ে বলে তোমরা সুখী হও। বিয়ের পর  ওরা নিমির এপার্টমেন্টে গিয়ে উঠে।    

ক্রমশ :

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন