ফরহাদ ও হামিদ সকাল ৮টা বাজে গোপীবাগের মেস থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে টিকাটুলীর মোড়ে গিয়ে ঠেলা গাড়ির উপর বসে এদিক সেদিক তাকায় যদি কেউ বিল্ডিংয়ের ইট , বালি , রড সিমেন্ট বা বাড়ির ফার্নিচার বা দোকানের মালামাল নেয়ার জন্য ডাকে। সকাল ৮ টার দিকে গেলে দেখা যায় সাত /আট জন লোক লুঙ্গি ও ছেঁড়া গেঞ্জি বা ময়লা জামা পরে ঠেলা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে কাজের জন্য। এরা মাঝে মধ্যে পানের দোকানে গিয়ে পান নিয়ে চিবাইতে চিবাইতে এ দিক সেদিক তাকায় । ওদের বেশি কাজ যাত্রাবাড়ী, ডিএনডি, নারিন্দা, গোপীবাগ, গোলাপবাগ এবং ধলপুর ।কেউ একজন গাড়ির দিকে আসলে সবাই ভিড় জমায় কার গাড়ি আগে কাজ পাবে। অনেক সময় কারো একটা বা দুইটা গাড়ি দরকার হয়। কিন্তু সবাই একত্র হয়ে তর্ক শুরু করে কে আগে কাজ নেবে।

সকাল ৯টার দিকে এক ঠিকাদার এসে বলে তার দুইটা গাড়ি দরকার কিছু বালি ও রড দোকান থেকে নিয়ে যাত্রাবাড়ী যাবে। ৪টা গাড়ির সব কটাই যাইতে চায়। এ নিয়ে ঝগড়াঝাটি শুরু কে কার আগে যাবে। যদিও কার আগে কে কাজে যাবে নিয়ম রয়েছে, কিন্তু নিয়ম কেউ মানে না। ফরহাদ,হামিদ ও আর একটা গাড়ি দোকান থেকে রড এবং সিমেন্ট নিয়ে দুপুরের দিকে ক্লান্ত হয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে সিঙ্গারা, চা অথবা রুটি সবজি খেয়ে কাজের জন্য বসে আছে । ওপর দুইটা গাড়ি কাজ সেরে এখনও ফিরে আসে নি।

দিনের শেষে হামিদ ও ফরহাদ যা কিছু রোজগার করে তাতেই সন্তুষ্ট; তাদের চাওয়া এবং পাওয়া খুবই সীমিত, নাই কোনো পরিকল্পনা বা স্বপ্ন; কাজের পর বাসায় গিয়ে ডাল ভাত যা মিলে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে । সারা দিনের কাজের ক্লান্তির পর বিছানায় যাওয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়ে। ওরা দুইজনেই আঙুলে হিসাব করে আর কতদিন পর বাড়ি যাবে। বাড়িতে গিয়ে,নব্য বিবাহিতা স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলে একটু হাঁসি , একটু সাময়িক আনন্দ, এইতো গরিবের চাওয়া।

হামিদ ও ফরহাদের টাকা পয়সার অভাব থাকলেও; দুইজনের স্ত্রীর ভালোবাসার কমতি নেই; ওরা দুইজনেই প্রতিবার বাড়ি যাওয়ার পূর্বে স্ত্রীর জন্য কে কি নেবে সে ব্যাপারে কোনো প্রকার কার্পণ্যতা করে না। ফরহাদের মা, বোন রিনা এ নিয়ে ঝগড়া করলেও সে ওদের কথা না শুনে স্ত্রীর মুখের একটু হাসি ফুটাতে চেষ্টা করে। মা অভাবের তাড়নায় ছেলেকে অযথা পয়সা খরচ করতে নিষেধ করে, আবার বৌয়ের দিকে তাকিয়ে নিজের অতীত স্বরণ করে ।

হামিদ গত মাসে অসুস্থ হয়ে দুই সপ্তাহ কাজ করতে পারে নি। ফরহাদ অন্য এক জনকে নিয়ে কাজ করেছে। ফরহাদ মেসে এসে অসুস্থ্য হামিদকে ডাক্তারের নিকট নিয়ে ওষধের প্রেসক্রিপশন সংগ্রহ করে ফার্মেসী থেকে বাকিতে ওষধ এনেছে ।ফার্মাসিস্ট হামিদ ও ফরহাদকে সব সময় ঠেলা গাড়ির উপর বসে থাকতে দেখে, হামিদের অবস্থা অনুধাবন করে ওকে বাকিতে ওষধ দিয়ে বলে ভালো হয়ে কাজ করে পয়সা দেবে, হামিদ মাথা নেড়ে বলে দেব ।

ফরহাদ ও হামিদ এক সঙ্গে বাড়ি যায় এবং এক সঙ্গে ঢাকা আসে; এক জনের সুখে দুঃখে আর একজন এগিয়ে এসে সাহায্য করে।

ফরহাদ বাড়ি যাওয়ার পূর্বে স্ত্রী আলেয়ার জন্য লিপিস্টিক ও কাঁচের চুঁড়ি কিনে রেখেছে। ঢাকা শহরে মেয়েরা সুন্দর শাড়ি, গহনা,স্যান্ডেল পরে বাহির হয়। ফরহাদ মনে মনে বলে আমি গরিব ঘরে জন্মিয়েছি বলে কী শখ স্বাধ নেই ?

আমার মন কী চায় না আলেয়াকে একটু সুন্দর করে সাজিয়ে দেখি ?

সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত; সন্ধ্যার পরে আলেয়া ও ফরহাদের বোন রিনা পুকুর ঘাটে বসে চাঁদের আলো দেখতে ছিল । পুকুরে প্রচুর মাছ, রাতে আলো নিয়ে ঘাটলায় দাঁড়ালে দেখা যায় ভেসে ঘাটের কিনারায় স্থির হয়ে আছে, মনে হয় হাতেই ধরা যাবে। আলেয়া ও রিনা চাঁদের আলোতে পুকুরে মাছের নড়াচড়া দেখে বলে কি সুন্দর দেখাচ্ছে, যেন হাত দিয়ে ধরা যাবে ।

আজ ফরহাদের বাড়ি আসার কথা, এখনও ঢাকা থেকে বাড়ি আসে নি। দূরে বাঁশ ঝড়ের নিচে জোনাকি আলো ছড়াচ্ছে । রাত ৯:৩০ এর দিকে কে একজন খাল পার হয়ে বাঁশ ঝাড়ের নিচ দিয়ে আসতে দেখে আলেয়া ও রিনা এগিয়ে গিয়ে দেখে ফরহাদ আসতেছে। ওরা ওকে এগিয়ে নিয়ে উঠানে আসলে মা বলে এত দেরি কেন ?

ফরহাদ বলে কাজ করেছি বিকাল ৪টা পর্যন্ত , সে জন্য দেরি হয়েছে । সারা দিন কাজের পর ক্লান্ত শরীরে লুঙ্গি নিয়ে পুকুর ঘাটে গিয়ে গোছল করে ঘরে ঢুকার পর আলেয়া ওকে ভাত, ট্যাংরা মাছ সিম তরকারি ও ডাল, সামনে বসে আছে ।

ফরহাদ বলে তুমি খাবে না ?

আলেয়া বলে আমরা সবাই খেয়ে ফেলেছি, শুধু তুমি খাও নি।খাওয়ার পর ফরহাদ বলে আজ পূর্ণিমার চাঁদের আলো, চলো বাহিরে একটু হাঁটাহাঁটি করি। ওরা কিছুক্ষন হেঁটে পুকুরের ঘাটলায় গিয়ে বসে পানির দিকে চেয়ে আছে। পুকুরে চাঁদের আলোতে মাছের নড়াচড়া দেখে ফরহাদ বলে পুকুরে বর্ষার পানিতে অনেক মাছ এসেছে। আলেয়া বলে মনে হয়। ফরহাদ বলে কাল বড়শি দিয়ে পুকুরে মাছ ধরবো; আলেয়া হেঁসে বলে মাছ ধরা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। খানিক বসে আলেয়া বলে চলো ঘুমাতে যাই। ফরহাদ রাত্রে ঘুমানের আগে আলেয়ার জন্য নেয়া, কাঁচের চুঁড়ি ওর হাতে দিয়ে বলে, চুঁড়ি হাতে দাও। আলেয়া বলে এখন না কাল দেব। না, এখন দিয়ে দেখো হাতে লাগে কী ?

আলেয়া বলে, হাতে লাগবে, মা দেখলে রাগ করবে, তুমি আমার জন্য কেন এত পয়সা খরচ করো ?

ফরহাদ বলে কী আর আনলাম, আমার মন চেয়েছিলো । আলেয়া বলে গত মাসে তুমি আমার জন্য এটাসেটা এনেছো, এ নিয়ে মা রাগ করেছেন এবং বলেছেন ফরহাদের সংসারের প্রতি কোন মনোযোগ নেই।

পরদিন সকালে ফরহাদ ৭৫ টাকা পকেট থেকে বের করে বলে মা এগুলি রাখো। ওর মা বলে ও আল্লাহ এই টাকা দিয়ে সারা মাস আমরা কি ভাবে চলবো । ফরহাদ বলে মা কাজ পাওয়া যায় না, গাড়ি ভাড়া, মেসের খরচ দিয়ে এই কয় টাকাই ছিল এবং সবই তোমাকে দিলাম। আমি বাড়ি থেকে গিয়ে ধার করে চলতে হবে।

মাসের প্রথম এবং শেষ ২-৩ দিন অনেকে পুরানো ভাড়া বাসা বদলে নুতন বাসায় উঠে; তাদের বাসার মালামাল নেয়ার জন্য ঠেলা গাড়ি দরকার । এই কয়েকদিন একটু কাজ পাওয়া যায়, বাকি দিনগুলি নির্মাণ ঠিকাদার বা সাব কন্ট্রাক্টর যখন দরকার মালামাল কিনে ওদের ডেকে কাজের জায়গায় নিয়ে যায়। তাও অনেক ঠেলা গাড়ি,কার আগে কে নিয়ে যাবে এ নিয়ে মারামারি ; সবাই কাজ করতে চায়। সারা দিন ইট, বালি, সিমেন্ট, রড ঠেলা গাড়িতে বোঝাই করে ধাক্কিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া এবং পায়ে হেঁটে হয়রান হয়ে ঘরে ফিরি। এত ক্লান্ত হওয়ার পর, যেন আর হাঁটতে পারি না, মেসে ফিরে কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না।

মা বলে অন্য সহজ কাজ খুঁজে পাও না?

মা পড়াশুনা ব্যতীত কোনো সহজ কাজ পাওয়া যায় না। সব কাজ মাটি কাটা, ইট ভাঙা, সিমেন্টের বস্তা মাথায় করে বিল্ডিঙের উপর তলায় উঠানো অনেক কষ্ট ।

আমাকে সহজ কাজ দেবে ?

মেসে থাকলে খরচ লাগে, সারা মাস কাজ পাওয়া যায় না ; কোত্থেকে খরচ করি ?

বাড়িতে থাকলে তোমরা বলো আমি অলস, সারাদিন বসে থাকি, কাজ করি না। মা বলে যেই কাজ সারা মাস পাওয়া যায় সেই কাজ খুঁজে বের করো । মাকে বুঝিয়ে বলি , দেখবো অন্য কোনো কাজ পরিবর্তন করতে ।

ফরহাদ ও হামিদ হালকা শরীর; পরনে লুঙ্গি, গায়ে গেন্জি,,পায়ে প্লাস্টিকের চপ্পল পরে শহরের অলি গলি (বাসা, দোকান) থেকে মালামাল ঠেলা গাড়ি করে ঠেলে ঠেলে নিয়ে গন্তব্যস্থানে পৌঁছে দিয়ে ভাড়ার টাকা নিয়ে লুঙ্গির বগলে রেখে গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে টিকাটুলী এসে রেস্টুরেন্ট থেকে সিঙ্গারা ও চা খেয়ে গাড়িতে বসে এ দিক সেদিক তাকায় একটা ভাড়ার জন্য। ঘাম অথবা বৃষ্টিতে টাকা ভিজে যাবে, সে জন্য প্লাস্টিকের ব্যাগে টাকা মুড়িয়ে রাখে; রৌদ্র, বৃষ্টি, গরম,শীত কোনো কিছুতেই কাজ বন্ধ থাকে না।

ট্রাফিক জ্যাম হলে এদের অসুবিধা। ট্রাফিক পুলিশের বেতের পিটুনি, বাস,গাড়ি, রিক্সাওয়ালাদের গালি গালাজ নিত্য ডাল ভাত।ফরহাদ এবং হামিদ সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে যে রোজগার করে এ দিয়ে কোনো রকমে নিজেদের খাওয়া খরচ হলেও মাবাবা ভাইবোন, স্ত্রী ভাইবোনদের নিয়ে কোনো রকমেও সংসার চলে না। নিজের দৈনন্দিন চলার পয়সা, বাড়িতে মা বাবা এবং বৌয়ের জন্য কিছু নিতে হবে।

ফরহাদ ও হামিদ অতীব গরিব, বাড়িতে জমি জমা নেই; দুইজনের বাবা লোকজনের খেতে খামারে কাজ করে; ভোর হলেই বাবা এ দিক সেদিক কাজের খোঁজে বের হয়। বাবা অসুস্থ্য, দুর্বল হয়ে পড়েছে; তাছাড়া টানাটানির সংসার এবং ঠিক ভাবে খাওয়া পরা মিলে না। এদিকে বিয়ে করেছে ,নতুন বৌ,ভরণ পোষণ রয়েছে।

হামিদ ও ফরহাদ সারা দিনে যা কিছু রোজগার হয় মালিকের গাড়ি ভাড়া দিয়ে দুইজনে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে মেসে ফিরে। ঠেলা গাড়িতো আর ইঞ্জিন চালিত নয়, একজন সামনে এর একজন পিছনে ঠেলে ঠেলে রাস্তা দিয়ে মাল নিয়ে মালিকের কর্মস্থল বা বাড়িতে পৌঁছে দিলেই দুই পয়সা রোজগার।

দুইজনই স্কুলে কয়েক ক্লাস পড়াশুনা করে আর্থিক অনটনে আর করে নি । বাড়ি গেলে আর ফেরত আসতে মন চায় না। একেতো অধিক পরিশ্রম, ওপর দিকে স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার আকর্ষণ।

বাড়ি থেকে ফিরে আসলে অন্যরা জিজ্ঞেস করে কি ভাই এত দেরি হলো ?

হাঁসতে হাঁসতে বলে আসতে না দিলে কি করবো?

মেসের আর আর সবাই হেঁসে বলে আসতে না দিলে থেকেই যাইতেন। হামিদ ও ফরহাদ লজ্জার জন্য কিছু না বলে মিসকি হেঁসে এদিক সেদিক তাকায়। রমিজ বলে তোমরা প্রতিমাসে না গিয়ে দুই মাসে একবার বাড়ি গেলে পরিবারকে আর একটু বেশি সাহায্য করতে পারো । একজন হেঁসে হেঁসে বলে,সর্বনাশ ভাইজান, বৌ ছাড়া দুই মাস থাকা যায় ?

হামিদ ফরহাদের প্রতিবেশী, ছোটকাল থেকে একত্রে মানুষ হয়েছে।সকালে দুইজনই বাজারে গিয়ে চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে ফরহাদ বলে মাকে সকালে ৭৫ টাকা দিয়েছি। কিন্তু মা আমাকে বলে আল্লাহ এই টাকা দিয়ে সারা মাস কিভাবে চলবো।

হামিদ বলে তুমি কী বললে ?

আমি বললাম যে সারা মাস কাজ থাকে না, নিজেরা মেসে ডাল ভাত খেয়ে যা বেঁচেছে তাই দিলাম। হামিদ বলে আমার গত মাসে ওষধের টাকা এবং মেস খরচের পর মাত্র ৫০ টাকা বাবার হাতে দিয়েছি, বাবা আমাকে কিছু বলে নি। তুমি তো আমার চেয়ে বেশি দিয়েছো, তবু খুশি হয় না?

সংসারে অভাব, বাবা এবং আমি মিলিয়ে কোনো রকমে চালাই । প্রতি সপ্তাহে মেহমান বাড়তি থাকে এবং ওদের জন্য মাকে কিছু না কিছু আলাদা করতে হয়।

আলেয়া বলে ফরহাদ তুমি না থাকলে কী হবে, মেহমান বলা নেই কহা নেই এসে হাজির এবং মায়ের অনেক কষ্ট হয়। অনেক সময় ঘরে কিছুই থাকে না। মা এ ঘরে সে ঘরে গিয়ে ভাত এবং তরকারি ধার করে ওদেরকে খাইয়ে দেয়। কিন্তু এখানেই শেষ না , এরা দুই তিন দিন ও থাকে। এ সব মেহমান মামা,খালা, ফুফু এবং আরও জানা অজানা হঠাৎ করে কোনো খবর না দিয়ে চলে আসে। তাছাড়া শ্বশুর বাড়ির লোকজন আলেয়াকে দেখার জন্য এক বদনা দুধ , গাছের কাঁঠাল , কলা, লিচু, পুকুরের মাছ নিয়ে আসে । আলেয়া সংসারের অবস্থা বুঝে এবং তাদের সময় অসময় আসা পছন্দ করে না।এ অবস্থায় আমি যা রোজগার করি তার তিন গুন্ করলেও সংসার চলবে না। হামিদ বলে এটা শুধু তোমার বেলায় না, আমাদের ও এ অবস্থা। মানুষ বোঝে না, মনে করে এক বেলা গিয়ে খেয়ে আসতে পারলেই হলো।

ফরহাদ বলে আমার মা বলেছে আমাকে এই কাজ ছেড়ে দিয়ে অন্য কাজ করতে। হামিদ বলে তুমি আমি গাড়ি ছেড়ে দিলে অন্য লোক নিয়ে নেবে।

তোমার মাকে জিজ্ঞেস করো যে কি কাজ করব ?

মা মনে করে ঠেলা গাড়ি বাদ দিয়ে যে কোনো কাজ করলেই পয়সা বেশি আসবে।

হামিদ বলে চলো এবার গিয়ে রমিজ ভাইকে জিজ্ঞেস করে দেখি, রিক্সা চালাতে পারবো কি না ?

একদিন কাজ থেকে আসার পর রমিজ ভাইকে পেয়ে গেলাম। ভাই আমরা দুই জনে কি রিক্সা চালাতে পারবো ?
রমিজ বলে তোমরা ঠেলা গাড়ি চালিয়ে তো ভালোই আছো। ফরহাদ বলে গত তিন দিন ঠেলা গাড়ি থেকে কোনো রোজগার হয় নি। আমরা সারা দিন গাড়িতে বসে ছিলাম, কেউ আসে নি । মাঝে মধ্যে আমরা দুই – তিন দিন বসে থাকি কাজ ছাড়া। এই করে তো আর চলতে পারি না।

রমিজ বলে প্রতি রাতে ৫০ টাকা রিক্সার মালিক কে দিয়ে কোনো দিন ১০ টাকা বা ৫ টাকা পকেটে নিয়ে ঘরে আসি। নিজের মেসের খরচ, বাড়ি ছেলেমেয়ে, টাকা না দিলে ওরা কি ভাবে চলবে ?

তোমরা নুতন মানুষ,রিক্সা চালান শিখতে ও ঢাকার রাস্তা চিনে নিতে সময় লাগবে । ফরহাদ বলে আমরা গত ১০ বৎসর ঢাকা থাকি, ঢাকার রাস্তা আমরা চিনি, রিক্সা চালান শিখতে যেটুকু সময় লাগে । রমিজ বলে ঠিক আছে, দেখি জিজ্ঞেস করে মালিকের অতিরিক্ত রিক্সা আছে কি ?
পরদিন রমিজ রহমতকে জিজ্ঞেস করে জেনেছে যে মালিকের এই মুহূর্তে কোনো রিক্সা নেই ভাড়া দেয়ার মতো;যদি ভবিষ্যতে হয় ওকে জানাবে। এই করে ফরহাদ ও হামিদ দুই জনে ঠেলাগাড়ি নিয়ে কাজ করে সময় চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের সব চেয়ে বড়ো অসুবিধা হচ্ছে পায়ে হেঁটে ঠেলা গাড়ি টেনে টেনে বেশি দূর যেতে পারে না। বৃষ্টি হলে রাস্তা কাদামাটি, এই করে ওরা প্রায়ই অসুস্থ্য থাকে।

সে দিন দিনের দুইটা বাজে ওরা ভাড়া পেয়েছে মালিবাগ থেকে ইট ও বালি নিয়ে রায়ের বাজার যাবে। ওরা দুই গাড়ি নিয়ে নির্মাণ স্থলে রেখে দিয়ে এসে আর এক গাড়ি নিয়ে মগ বাজারের মোড়ে যানজটে পড়ে। পিছন থেকে এক ট্রাক এসে জোরে ধাক্কা দিলে ফরহাদ গাড়ির নিচে পড়ে যায়।

ফরহাদ মাথায় ও হাতে পায়ে আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে। চারিদিকে লোকের চিৎকার, মানুষ এসে ভিড় জমিয়েছে । ঘটনার স্থলে পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্স এসেছে।

জনগণ উত্তেজিত হয়ে ট্রাক ড্রাইভার ও হেলপারকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওরা জনগণের ভিড়ে লুকিয়ে দূরে সরে পড়েছে । পুলিশ ট্রাক জব্দ করে ড্রাইভার,হেল্পার বা মালিকের খোঁজ করে। হামিদ ঠেলা গাড়ির সামনে থাকাতে তার কোনো কিছুই হয় নি । হামিদ ফরহাদ ফরহাদ বলে চিৎকার করে কান্না শুরু করে।

লোকজন এগিয়ে এসে ওকে শান্তনা দিয়ে বলে দেখি কি করা যায় ?

পুলিশ ট্রাক ও ঠেলা গাড়ি পুলিশ হেড কোয়ার্টারে পাঠানের ব্যবস্থা করে হামিদ ও ফরহাদের নাম, ঠিকানা রেকর্ড করে কিভাবে ট্রাক ঠেলা গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে ফরহাদকে ট্রাকের নিচে ফেলে দিয়েছে জেনে নেয় । স্থানীয় লোকজনের বিবরণে জানা যায় যে ট্রাফিক জ্যামের কারণে ঠেলা গাড়ি এগুতে পারছিলো না এবং মাল বোঝাই ছিল। সামনে রিক্সা এবং বাস রাস্তা ব্লক করে রেখেছে । ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জোরে ঠেলা গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে ফরহাদকে ট্রাকের নিচে ফেলে দিয়েছে ।

হামিদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যাওয়া হলে সে বলে আমি সামনে গাড়ি টানতেছি এবং ফরহাদ পেছন থেকে ধাক্কা দিতেছিল। আমার সামনে রিক্সা এবং বাস আস্তে আস্তে এগুচ্ছিলো এবং মানুষ গাড়ি ও রিকশার সামনে দিয়ে রাস্তা পার হতে ছিল পায়ে হেঁটে। পিছন থেকে ট্রাক জোরে চালিয়ে ফরহাদ ও ঠেলা গাড়ি ধাক্কা দিলে ফরহাদ নিচে পড়ে যায়। আমি প্রথম বুঝতে পারি নি যে ফরহাদ গাড়ির নিচে পড়েছে। কিন্তু মানুষের চিৎকারে আমি সামনে থেকে দৌড়ে এসে দেখি ও গাড়ির নিচে পড়ে আছে। পুলিশ শান্তনা দিয়ে বলে তুমি এখানে বস, ফরহাদকে অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তোমাকে হাসপাতালে পাঠানো হবে ওকে দেখানোর জন্য । ফরহাদের বাবার নাম,পুরা ঠিকানা লিখে নিয়ে বলে বাড়িতে খবর পাঠানোর জন্য তোমার কে আছে?

ফরহাদের গ্রামের তপুকে দেখিয়ে বলে স্যার ও আমাদের গ্রামের। পুলিশ ওকে বলে তুমি হাসপাতালে গিয়ে দেখে বাড়ি গিয়ে খবর দেবে। ট্রাক ড্রাইভার,হেল্পার নিখোঁজ । পলিশ ট্রাক এবং ঠেলা গাড়ি আটক রেখে হামিদ ও তপুকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গিয়ে দেখে ফরহাদের এখন পর্যন্ত জ্ঞান ফিরে আসে নি।

তপু এক নজর ওকে দেখে মালিবাগ তার গ্রামের অন্যদের খবর দিয়ে নিজে বাড়ি রওয়ানা দেয় এবং রাত ১০টার দিকে পৌঁছে। ফরহাদের বাড়িতে গিয়ে খবর দিতেই কান্নার ঝড় শুরু হয়। ফরহাদের মাবাবা,বোন ও স্ত্রীর কান্না ও চিৎকারে সারা গ্রামের লোকজন একত্রিত হয়েছে। তপু সারা দিনের ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরে আসলে ওর মা বাবা দুঃখ করে বলে ফরহাদ ছোট্ট কাল থেকে মাবাবার সংসারে কষ্ট করে আসছে।

ফরহাদের স্ত্রী আলেয়া ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা, ফরহাদের দুর্ঘটনায় অতিরিক্ত চিৎকারে সে রাতে প্রসব ব্যথায় অসুস্থ্য হয়ে পড়ে । পাশের বাড়ির এক বৃদ্ধা ধাত্রী রহিমা এসে ভোর ৪টায় বাচ্চা প্রসব করায় । আলেয়া ছেলের মুখ দেখে খুশি হলেও স্বামীর দুর্ঘটনার খবরে কান্না কাটি করে।

ভোরে ফরহাদের বাবা ও রিনা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছে ইমার্জেন্সি বিভাগে গিয়ে ফরহাদকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখে । ডাক্তার জানিয়েছে যে ওর ব্রেইনে আঘাত পেয়েছে ; এই মুহূর্তে কিছুই বলা যাবে না। মাথা ব্যাণ্ডেজ দেয়া ; চোখ, মুখ ফুলা, অক্সিজেন দেয়া আছে। ফরহাদের বাবা ও রিনা শুধু কান্না কাটি করছে। নার্স বলে রোগীর কাছে এত কান্না কাটি না করে আপনারা বাহিরে বারান্দায় গিয়ে অপেক্ষা করেন।

ওরা সারাদিন রোগীর কাছে বসা এবং তপু ও গ্রামের লোকেরা দুইবার এসে বলেছে আপনারা বাহিরে গিয়ে কিছু খেয়ে আসেন। কিন্তু না বাবা বা মেয়ে কেউ খেতে যাচ্ছে না। ডাক্তার এসে একবার বুঝিয়ে বলেছে আপনারা এখানে কান্নাকাটি করে আপনার ছেলেকে বাঁচাতে পারবেন না। তপু বলে আংকেল আপনারা থানাতে গিয়ে কেসের কি অবস্থা জেনে নেন।

থানাতে ট্রাকের মালিক এসে ধরা দিয়েছে এবং বলেছে যে ট্রাক ড্রাইভারের কোনো অপরাধ নেই। ফরহাদ ট্রাকের সামনে পড়েছে; পুলিশ রিপোর্টে বলা হয়েছে ফরহাদের ত্রুটির জন্য এই এক্সিডেন্ট হয়েছে । কিন্তু প্রতক্ষদর্শীর বিবরণে জানা যায় যে ট্রাক ড্রাইভার স্পিড নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নি এবং ফরহাদকে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দিয়েছে। ট্রাকের মালিক থানা থেকে ট্রাক রিলিজ করে নিয়ে গেছে। ফরহাদ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে এবং তার বাবার কোর্টে গিয়ে কেস করার মতো আর্থিক অবস্থা নেই।

এক সপ্তাহ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ফরহাদের মৃত্যু হয় এবং তার বাবা ও গ্রামের অন্যরা তার লাস নিয়ে গ্রামের বাড়ি গেলে বাড়ি ভর্তি লোক লাশ দেখার জন্য ভিড় জমায়। আলেয়া তার ছোট্ট শিশুকে নিয়ে ঘরে কান্নাকাটি করে। রিনা এসে বলে ভাবি তুমি ভাইয়ের লাশ দেখতে এস।

আলেয়া ছোট্ট বাচ্চা বুকে জড়িয়ে ধরে ঘর থেকে উঠানে বের হয়ে লোকজনের ভিড় ঠেলে সামনে যেতে ইতস্তত করে। লোকজন জায়গা ছেড়ে দিয়ে বলে বৌকে ফরহাদের লাশ দেখাও। খাটে ফরহাদের লাশ রেখেছে এবং সে নিকটে গিয়ে চিৎকার করে ;আলেয়ার শাশুড়ি কোলের শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে। আলেয়া অতিরিক্ত কান্না শুরু করেছে এবং বাড়ির লোকজন তাকে শান্তনা দিচ্ছে।

খবর পেয়ে আলেয়ার মা বাবা ও ভাইবোন এসে পড়েছে এবং দিনের শেষের দিকে সমাধিস্থ করা হয়। ৩-৪ দিন পর ওর মাবাবা আলেয়ার শ্বশুর শাশুড়িকে বলে আপনারা রাজি থাকলে আমরা আলেয়াকে কয়েক দিনের জন্য নিয়ে যাবো। আলেয়ার শ্বশুর বলে আমার ছেলে তো নেই, আমরা বৌকে দিয়ে আর কি করবো ?
আলেয়ার বাবা মনে মনে দুঃখ পেয়ে ও বলে আমি নিয়ে যাই পরে যা কিছু সিদ্ধান্ত হয় সে মতে কাজ করবো।

আলেয়া শিশুকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যাওয়ার তিন মাস শেষ হয়েছে ; এই পৰ্যন্ত ফরহাদের মাবাবা আলেয়া বা এই ছোট্ট বাচ্চার খবর নিতে আসে নি। আলেয়া তিন মাস অপেক্ষা করে তার ভাই খায়েরকে নিয়ে একদিন এসে শ্বশুরবাড়ি উঠে। কিন্তু তাকে দেখে কেউ ভালোভাবে গ্রহণ করে নি। দুই দিন থাকার পর আলেয়া নিজ থেকে বলে ফরহাদ আজ বেঁচে নেই, তবে তার ছেলে বেঁচে আছে। সে ও একদিন বড় হবে এবং আমি ওকে পড়াশুনা করে বড় করবো। ফরহাদের বাবা মা বলে তোমার বয়স বেশি হয় নি এবং তোমার মা বাবা তোমাকে অন্যত্র বিয়ে দিলে, তোমার জন্য ভালো হবে। তুমি যে কতদিন পারো শিশুকে রাখবে , না পারলে আমরা নিয়ে নেবো। আলেয়া বলে আমি আমার ছেলেকে আপনাদের কাছে রেখে একদিন ও থাকতে পারবো না। ফরহাদকে আমি বিয়ে করেছি । আপনাদের সংসারে অভাব ছিল,কিন্তু আমাদের মধ্যে ভালোবাসার অভাব ছিল না। আমি বিয়ে একবারই করেছি, ফরহাদ আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছে, তা আমি পূরণ করতে চেষ্টা করবো। এই ছেলেই একমাত্র আমার ভবিষ্যত, যত কষ্টই হোক, তাকে মানুষ করার মধ্যে ফরহাদকে পাবো।
(ক্রমশ)

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বপ্নের ইমিগ্রেশন – পর্ব ১০
পরবর্তী নিবন্ধHappy New Year এবং দেশীয় কালচারের রসায়ন
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন