রহমত,হাসি ও তাদের ছেলে মেয়েদের বিদায় দিতে গিয়ে রমিজ , ঝর্ণা এবং তাদের ছেলে মেয়েরা কান্নায় ভেঙে পড়ে। জন্ম থেকে এই দুই পরিবারের ছেলে মেয়েরা  গ্রামে একত্রে চলা ফেরা ,হাসি কান্না ,ভালো মন্দ নিয়ে উঠা বসা করেছে  ।  এই দুই পরিবারের ছেলে মেয়েরা অত্যন্ত গরিব,তবে তাদের মধ্যে রয়েছে মায়া মমতার বন্ধন  জড়ানো। সোহেল ও লতার  খেলার সাথী হারু ও রেনু ,তারা সারা দিন একত্রে খেলা দুলা, পড়া শুনা ও গল্প করতে ভালো বাসতো । আজ তারা চলে যাওয়াতে  সোহেল ও লতা একা হয়ে পড়ে । রহমত ও তার পরিবার কে বিদায় দিয়ে সোহেল ও লতার   চোখে  জল এসেছে ।সোহেল ও লতা বলে আব্বু আঙ্কেল, আন্টি, ভাইয়া ও আপু কি আবার আসবে  ? অবশ্যই ,ওরা গ্রামে  আবার আসবে ? তা হলে ওরা সবাই গেল কেন, আব্বু? ওরা ওখানে কাজ করবে ও থাকার জন্য চেষ্টা করবে,যদি সুবিধা করতে না পারে আবার চলে আসবে। ঢাকা ওরা কার বাসায় থাকবে ও কি খাবে ? ছেলে মেয়েদের  অনেক প্রশ্ন এবং জবাব দেয়া রমিজের  পক্ষে সম্ভব নয় ।  ওরা ছাড়া তো আমাদের থাকতে কষ্ট হবে ।লতা বলে ওরা তো আমাদের অনেক আদর করে। ওদের ব্যাতিত আমরা কি ভাবে থাকবো।আব্বু, আমরা চলো ওদের কাছে যাবো। আমরা কোথায় যাবো,ওদের তো কোনো ঠাঁই ঠিকানা নাই। তা’হলে ওরা কেন গেলো ?  সবাই কাঁদো কাঁদো অবস্থায় চুপ চাপ বসে রইলো।   হারু  ও রেনু তাদের মাটি দিয়ে বানানো ও কাঠের  খেলনা রেখে গিয়েছে। লতা  বলে   ও মা দেখো ,ভাইয়া আপু ভুলে খেলনা রেখে গেছে ।   চলো আমরা দৌড়ে গিয়ে তাদের খেলনা দিয়ে আসি ।   ঝর্ণা বলে এই খেলনা তোমাদের জন্য বানিয়েছে ।   তোমরা খেলবে এবং ওদের স্বরণ করবে । পরদিন ঘুম থেকে উঠে সোহেল ও লতা আর স্কুলে যেতে চায় না ।   ওরা বলে  ভাইয়া ও আপুর সঙ্গে একত্রে যেতে ভালো লাগে ।   ঝর্ণা কোনো রকমে বুঝিয়ে ওদেরকে স্কুলে পাঠিয়েছে ।   স্কুলে যাওয়ার পর ওদের ক্লাসের বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করে হারু  ও রেনু কি আর আসবে না? ওরা বলে কিছুই জানি না কবে আসবে ?

স্কুলের হেড মাস্টার  মুখলেসুর রহমান দুঃখ করে বলেন আমরা দুইজন ভালো ছাত্র /ছাত্রী হারালাম ।ওদের বাড়ি ঘর নাই বলে কেউ তাদের একটু জায়গা দিতে পারলো না । এটা নেহায়েত  অন্যায়  কাজ করা হয়েছে । ওরা তো এ গ্রামের লোক এবং তাদের সুখ দুঃখে সবার এগিয়ে আসা উচিৎ ছিল । বিকেলে এ বাড়ি ,সে বাড়ির দু এক জন রমিজের বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে ওরা কি শেষ বারের মতো চলে গেলো? রমিজ বলে গ্রামে ওদের কোনো রোজগার নাই, ঘর,আসবাব পত্র এবং শেষ সম্বল  রিক্সা ছিল তা ও নদীতে তলিয়ে গেছে ।ওদের অনেক কষ্ট হইতেছিল,সে জন্য ওরা ঢাকা চেষ্টা করবে যদি কিছু করতে পারে । আমাদের  এখানে ওরা কষ্ট করে ছিল । আমরা  ওদের যাওয়ার ব্যাপারে জোর করে বেশি কিছু বলি নি । ওরা নিজেরা চলে গিয়েছে,যদি ভালো কিছু করতে পারে ,ঢাকা  থাকবে, নতুবা চলে  আসবে । ফিরে আসলে আমরা ওদের জায়গা দেব ।  তা’ছাড়া আপনারা জানেন আমাদের  বাড়ি নিয়ে মিয়া বাড়ির সঙ্গে অনেক গন্ডগোল । ওরা বাড়ি ছেড়ে  দিয়ে অন্যত্র চলে যেতে  বলে । কাজেই আমরা  কি ভাবে ওদের জায়গা দিবো ।শুনে সবাই অনেক দুঃখ করে চলে গেলো । গ্রামে অনেকেই দুঃখ করে ওদের চলে যাওয়ার জন্য । কিন্তু মিয়া বাড়ির কেরামত আলী মিয়া ওদের   সমালোচনা করে ,বলে   রহমত এই গ্রামের  জুলুমবাজ লোক, সে সব সময় ঘাড় তেরা করে কথা বলে।

মিয়ারা গ্রামে অসহায় মানুষের জমি সামান্য কিছু পয়সা দিয়ে বা না দিয়ে দখল করে নেয় । ওরা কারো জমি একসঙ্গে টাকা দিয়ে কিনে না । জমি রেজিস্ট্রেশন করিয়ে আস্তে আস্তে টাকা,অথবা ধানের মৌসুমে ,ধান দিয়ে পরিশোধ করে । মিয়াদের বিঘা বিঘা জমি,বাগান বাড়ি,অথচ সাধারণ মানুষের ঘর উঠানোর মতো জমি নাই । তা ছাড়া নদী এ অঞ্চলের মানুষকে অসহায় করেছে । রহমত তার পরিবার নিয়ে এই  গ্রামে থেকে ও নাই,তার ভিটে বাড়ি টুকু পয্যন্ত নদী ভাঙ্গনের কারণে হারিয়েছে । এক দিকে কেরামত আলী মিয়া ও ওপর দিকে পরিস্তিতি তাদের বিমুখ করেছে।

এক দিন সকালের দিকে রমিজ  কাজে বের হলে কেরামত আলী মিয়ার স্ত্রী ঝর্ণাকে লোক দিয়ে খবর পাঠিয়েছে দেখা করার জন্য । ঝর্ণা একা বাসায় থাকে,এত দিন রহমতের স্ত্রী  হাসি ও ছেলে মেয়েরা ছিল, কোনো অসুবিধা হয় নি।  আজকাল যখন  ছেলে মেয়েরা স্কুল চলে যায়, ঝর্ণা  কোথাও যায় না ।  সে ঘরের আংগিনাতে আলু,কচু ও সবজি বাগান করেছে ।  সে সবজি বাগান এবং হাঁস  মুরগি দেখা শুনা করে এবং পুকুর থেকে বড়শি দিয়ে ছোট ছোট মাছ ধরে  রান্নার জন্য । সব সময় এটা সেটা নিয়ে ব্যাস্ত থাকে । রমিজ ওকে বলেছে,”ঘর খালি রেখে কোথাও যাবে না ।” সে ঘর খালি রেখে যায় নি এবং বলেছে যে ছেলে মেয়েরা আসলে ও গিয়ে দেখা করবে । লোকটা বলে যে আপনাকে এখন যাইতে বলেছে ।ঝর্ণা বলে যে আমি এখন কি ভাবে যাবো,ঘর খালি ওরা সবাই ঘরে আসলে আমি যাবো । এতে মিয়ার স্ত্রী অসন্তুষ্ট  হতে পারে  যে ঝর্ণা তার কথা অমান্য করেছে ।রমিজ ও ছেলে মেয়েরা  যখন ঘরে এসেছে তখন বলেছে যে মিয়া বাড়িতে আপা আমাকে যাইতে বলেছে, আমি যাই নি, কারণ ঘর খালি । রমিজ বলে তুমি ভালো করেছো, তুমি বাড়ি ঘর খালি রেখে যাবে আর এদিকে সব কিছু চুরি হয়ে যাবে । বিকালে সবাই ঘরে ফিরার পর রমিজ ও ছেলেমেয়েদের খাওয়া দাওয়া শেষ করে  সে মিয়া বাড়িতে গিয়ে  শুনে আপা তাকে যাইতে বলে নি । মিয়ার স্ত্রী বলে,” না ,আমি তোমাকে আসতে বলি নি ।কে তোমাকে বলেছে?”  ঝর্ণা বলে একটা লোক আমাকে বলেছে আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন । না তো! আমি তো এ ধরণের কাউকে বলি নি । আর লোকটাই বা কে ? তুমি কি ওকে চিনো ? না আপা, আমি চিনি না । আশ্চয্য! এ কথা ,সে কথার পর ঝর্ণা বলে আপা তা হলে যাই । আচ্ছা ।  ঝর্ণা চলে এসে রমিজকে গঠনা বলাতে   সে বলে তুমি কি লোকটা চীন? না,আমি লোকটাকে কোনোদিন ও এর পূর্বে দেখি নি । রমিজ সন্দহ করেছে যে, এটা কোনো রকম ষড়যন্ত্র হতে পারে ।

হাসি ও রহমত থাকাকালীন সময় ঝর্ণা মিয়া বাড়িতে ধান সিদ্ধ, ধান শুকানো  ও ঢেকিতে চাউল করার ব্যাপারে সাহায্য করতো । কিন্তু হাসি  চলে যাওয়ার পর আর খালি ঘর রেখে সে  একদিন ও মিয়া বাড়িতে যায় নি ।  এ নিয়ে মিয়া বাড়ির আপা খুব অসন্তুষ্ট এবং ঝর্ণা কে যখনি খবর পাঠায়  সে বলে আপা আমি একা একা বাড়িতে থাকি এবং  বাড়িতে হাঁস মুরগি তা ছাড়া খালি ঘর রেখে যাইতে পারি না । মিয়ার স্ত্রী বলে “তুমি কি আর কোনো দিন কাজ করতে পারবে না । ” আপা আমি ঘর খালি রেখে কি ভাবে আসবো  বলেন? কাজ করলে তো আমার ও লাভ ,একটু খাওয়া ও কিছু চাল পাওয়া যায় । এই টানাটানির সংসারে আমার ও ছেলে মেয়েদের একটু সাহায্য হয় । তা হলে আমি কি অন্য লোক খোঁজ করে নেবো ? দেখি, রমিজের    সঙ্গে আলাপ করে দেখবো । আমাকে জানাইও ,নতুবা আমি অন্য লোক খুঁজে নেবো । আচ্ছা ঠিক আছে আমি আপনাকে জানাইবো ।   কেরামত আলী মিয়া বলে ওর এখন অনেক দাম হয়েছে । ঝর্ণা বলে  না ভাইজান ,কি বলেন, দাম কিসের? সারা জীবন তো আপনাদের কাজ করেছি । এখন ক’টা হাঁস, মুরগি পালতাছি,ও গুলি নিয়ে একটু ব্যাস্ত থাকি,তা ছাড়া ছেলে মেয়েরা স্কুলে গেলে আর কেউ থাকার নাই । ওরা আসলে বিকেলের দিকে না হয় কোনো সময় আইসা একটু কাজ করে দিয়ে যামু । কইগো রফিকের মা,শুনলা ঝর্ণার কথা বার্তা । সে মুখের উপর তর্ক করা শিখছে। এখন আর আমাদের পছন্দ হয় না ,আগে হইতো । কাজের লোক রাশিদার মা বলে ,ভাইজান এর  একটা বিহিত করবার লাগবে,না হইলে আপনি  এই গেরামের মিয়া বংশের লোক কিসের । কেরামত আলী মিয়া বলে , তুমি ঠিক বলেছো ,বাড়িটা তো  আমাদের নামে । রমিজকে দয়া করে থাকতে দিয়েছি  বলে ঘাড়মোটা হইয়া গেছে  এই বলে কেরামত আলী মিয়া গ্রামের বাজারে চায়ের দোকানোর দিকে  রওয়ানা হয় ।. চায়ের দোকানে ঢুকার পূর্বে দেখে  কে একটা লোক  বাজারের পূর্ব দিক দিয়ে প্যান্ট শার্ট পড়ে যাইতেছে । মিয়া চায়ের দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করে ,”বসু, এই লোকটা কে প্যান্ট শার্ট পড়ে ঐদিকে যাইতেছে ? বসু বলে চাচাজান ও তো ছেরুর  ছেলে মোস্তফা ।কোন চেরু রে? ওই যে পোলের কাছে পান বিক্রি করে ।. হু, একটা ছালাম ও তো  দেয় না ।  ও কোথায় কি করে ? আদমজী জুট মিলে কাজ করে , শুনেছি শ্রমিক উনিয়নের বড় লিডার । তাই নাকি ?  জি,চাচাজান ।দে একটা চা দে ।  আজকাল যত সব অমানুষ ও মানুষ হয়েছে ।  জি চাচাজান ,ঠিক বলেছেন । শুনছিস , রমিজের বৌ ঝর্ণা আমাদের বাড়িতে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে । তার এখন চোখ বড় হয়েছে । আজকাল কারো বাসায় কাজ করে না । তাই নাকি চাচাজান? তুই কি মনে করিস, আমি কি তোর সঙ্গে ঠাট্টা করি? এটা তো ভারী অন্যায় চাচাজান । দয়া করে বাড়িতে থাকতে দিয়েছি , এখন দেখছি রমিজ   ও আমাদের দেখলে অন্য দিকে তাকিয়ে হাঁটে ।

রমিজের  বাবা ১৯৫০ সনের দিকে কিছু টাকা কেরামত আলীর বাবা নেয়ামত আলীর কাছ থেকে নিয়ে একটা কাগজে দস্তখত দিয়েছে ।   এই বাড়ি গত দুই জরিপে মিয়াদের নামে উঠানো হয়েছে ।    রমিজ  এই খবর তার বাবার মৃত্যুর পর জানতে পারে এবং এ নিয়ে যতবার বসেছে এবং কাগজ  ঠিক করতে চেয়েছে, কেরামত আলী মিয়া বলেছে যে এতে কিছুই অসুবিধা হবে না এবং ঠিক করে দিবে ।    কিন্তু আজ পয্যন্ত দেই/দিচ্ছি করে ঠিক করে দেয় নি ।    কেরামত আলী মিয়া গ্রামে বড়ো  শক্তিশালী লোক এবং সবাই তাকে  সমীহ করে ছলে । কেউ তার সঙ্গে কোনো ব্যাপারে বাদানুবাদ করে না এবং সালাম দিয়ে দূরে সরে পড়ে । রমিজ  ও ঝর্ণা ঘরের আঙিনায় কলা গাছ,নারিকেল ও সবজির বাগান  করেছে ,মিয়া বাড়ির লোকজন এসে  জোর করে নারিকেল ও কলা নিয়ে যায় এবং কিছু বলতে গেলে বলে এই বাড়ি তোমার বাবার কাছ থেকে কেনা হয়েছে ।তুমি অন্যত্র সরে পড়ো  এই বলে তাকে হুমকি দেয় । রমিজ  এই নিয়ে গ্রামের লোকদের ডাকিয়েছে এবং মিয়ারা কাগজ পত্র দেখায় যে গত দুই জরিপে এই ভিটা বাড়ি তাদের নামে রয়েছে এবং মিয়ারা খাজনা দিয়ে আসতেছে ।  রহমত কিছুটা সাহসী লোক ছিল এবং যত দিন এই গ্রামে ছিল ,তত দিন মিয়ারা বাড়ি দখল করতে আসে নি ।

রমিজ  এখন একাকী লোক এবং কেরামত আলী মিয়া কিছু লোক দিয়ে  রমিজ  ও তার পরিবারকে এই গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করে ।  রমিজ স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের নিকট অভিযোগ করেছে  এবং এ নিয়ে মীমাংসা করতে চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুই করতে পারে নি । কেউ কেউ তাকে উপদেশ দিয়েছে যে উপজিলা  AC  ল্যান্ডের অফিসে দরখাস্ত দিতে। শেষ পয্যন্ত উপজেলা AC  ল্যান্ডের অফিসে দরখাত করে এবং  অফিস  থেকে কেরামত আলী মিয়া কে কাগজ নিয়ে দেখা করতে বলেছে । কি সিদ্ধান্ত হয়েছে মিয়া বলে নি  বা অফিস থেকে  রমিজকে ও জানায় নি ।

রমিজ  দৈনিক মজুর খাটে,কোনো দিন কাজ করে এবং কোনো দিন বেকার থাকে ।   যদি কাজ না পায়, ছেলে মেয়েরা  না খেয়ে থাকে । ঝর্ণা ও আজকাল বাড়ি দেখা শুনা করে কাজ করার সময় পায়  না। মিয়া বাড়ির সঙ্গে বিবাদ অন্যান্য বাড়িতে গিয়ে একটু কাজ করে হয় ভাত ,না হয় চাল নিয়ে আসে এবং রান্না করে ছেলে মেয়েদের খাওয়াতে দেয় । .এ ভাবে তো আর খেয়ে না খেয়ে থাকা যায় না।   রমিজ  বলে বাবদাদার ভিটামাটি নিয়ে সে কোনো মীমাংসা করবে না ।  মৃত্যু হলে এখানেই তার কবর হবে ।  এক দিন  ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঝর্ণা দেখে রাত্রে  কয়েকটা মুরগি হারানো গিয়েছে।   ঝর্ণা চোখের পানি ফেলে এবং বলে এখানে সবই আমাদের শত্রু । আজকাল দিনের বেলা ও ঝর্ণা একা ঘরে থাকতে ভয় পায়।   রমিজ  জরুরি করে রহমতকে চিঠি দিয়েছে ।

প্রিয় রহমত:
তুমিতো এখান থেকে চলে গেলে ।   কিন্তু আমার বিপদ তুমি ছাড়া কাকে বলি  ।  কেরামত আলী মিয়া আমাদেরকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে কয়েক বার চেষ্টা করেছে ।  সে বলে এ    বাড়ি তারা আমার বাবার কাছ থেকে খরিদ করেছ।  কিন্তু কোনো দলিল দেখাতে পারে না।   তুমি এখানে থাকতে শুনেছ, লোকজন নিয়ে এসে ধমক দিয়েছে বাড়ি ছেড়ে দেয়ার জন্য । বাড়ির গাছ পালা নষ্ট করে দিয়েছে ।  এ অবস্থায় ঝর্ণা ছেলে মেয়ে কে স্কুলে পাঠিয়ে একা থাকতে ভয় পায় ।   আমরা রাতে ও এখানে ভয়ে ভয়ে থাকি ।  আমাদের আর্থিক অবস্থার খবর তোমার জানা ,কাজেই তুমি  আমার সবই জানো ।   তোমাকে আর কি লিখবো ।    তুমি ভাবি ও ছেলে মেয়ে নিয়ে কেমন আছো জানিয়ে লিখবে ।   ইতি: রমিজ

রহমত চিঠি পেয়ে হারুকে পড়ার জন্য বলে ,”হারু,তোমার চাচু কি লিখেছে পড়ে শুনাও ” হারু, চিঠি জোরে জোরে পড়ে সবাইকে শুনিয়েছে ।   শুনে রহমত ,হাসি ও ছেলে মেয়েরা দুঃখ পেয়েছে ।. ওরা বলে, কেরামত আলী মিয়া এবং তার লোকেরা কি এতোই  লোভী ? রমিজ চাচা কত গরিব মানুষ ,দিন আনে  দিন খায় ।.কি ভাবে তাদের বসত বাড়ি দখল করতে যায়. ? রহমত বলে ,হাসি তুমি ছেলে মেয়েদের  সামলাও, আমি ৩/৪ দিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে গিয়ে শুনে আসি । হাসি বলে,তোমাকে এ অবস্থাতে আমরা গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে সাহস পাই না । হারু বলে,”তুমি গিয়ে কি করবে ?” তুমি তো কাগজ পত্র বুঝ না । তুমি আমাদের হেডমাস্টার হাফিজউদ্দিন স্যারের সঙ্গে একবার এ নিয়ে আলাপ করো । উনি অনেক ভালো মানুষ ,সব সময় আমাকে  ও রেনুকে আদর করে এবং খোঁজ খবর নেয় ।  তাই হবে,কাল সকালে কাজ থেকে  এসে আমি চিঠিটা নিয়ে স্যারের সঙ্গে দেখা করবো । পর দিন সকাল রহমত কাজ থেকে এসে রুটি খেয়ে চিঠিটা নিয়ে স্কুলে গিয়ে প্রথমে হারুকে সঙ্গে নেয় । হারু ক্লাস থেকে এক ঘন্টার ছুটি নিয়ে আব্বুকে নিয়ে হেড স্যারের অফিসে গিয়ে চিঠিটা পড়তে অনুরোধ করে । হেড মাস্টার সাহেব হারুকে বলে,” তুমি ক্লাসে যাও,আমি তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলবো এবং দরকার হলে তোমাকে ডাকবো ।“ উনি চিঠি পড়ে   রহমতকে বুঝিয়ে বলে,আপনি রমিজকে কাগজ নিয়ে একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবেন । দেখি কি করতে পারি ।.আমি ঢাকা থাকি,এখান থেকে ওকে   কি পরামর্শ দেব? আমাদের দেশে প্রতারকের অভাব নাই । এ জাতীয় গঠনা নুতন কিছু না । রহমত বলে স্যার,আমি অনেক দিন গ্রামের বাড়ি যাই নি ।আমি দুই একদিনের জন্য বাড়িতে গিয়ে বুঝিয়ে ওকে কাগজ পত্র সহ  সঙ্গে করে নিয়ে আসবো । হেড মাস্টার বলেন,”তাও করতে পারেন ।”রহমত সালাম দিয়ে ঘরে এসে হাসির সঙ্গে আলাপ করে । হাসি বলে,যেতে পারো তবে সাবধানে থাকবে এবং রমিজ ভাইকে সঙ্গে নিয়ে কাগজ পত্র সহ পরদিন চলে আসবে । ছেলে মেয়েরা স্কুল থেকে বাসায় আসলে রহমত তাদের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেয় যে পর দিন সে গ্রামের বাড়িতে যাবে ।

রহমত রাতে কাজ করে সকালে ঘরে ফিরে সকালের খাওয়া শেষ করে  শুয়ে পড়ে । হাসি বাসায় না আসলে যাওয়া যাবে না । তাই খানিকটা ঘুমিয়ে নিলো । হাসির ঘরে ফিরতে আজ একটু দেরি হয়েছে,সে বাসায় এসে দেখে রহমত বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে আছে । সে বলে,”রাতে কাজ করেছো,এ ভাবে না ঘুমিয়ে যাওয়া কি ঠিক হবে? রহমত বলে,যাইতেই যখন হবে আর দেরি করে কি লাভ ? হেটে সে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে গিয়ে রমিজের ছেলে মেয়েদের জন্য এক ডজন কমলা নিয়ে নিলো ,কারণ অনেক দিন পর  বাড়ি যাওয়া ,খালি হাতে যাইতে একদম ভালো লাগছে না । টিকেট নিয়ে  লঞ্চের নিচের তলায় বসে পড়লো । দেখতে দেখতে এক সময় সে ঘুমিয়ে পড়ে । বাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা ৭টা বেজে গেলো । রহমতকে দেখে রমিজের   ছেলে মেয়েরা আনন্দে জড়িয়ে ধরে বলে,”কাকু, তুমি কেন একা এলে? আমি বললাম ওদের স্কুল আছে তাই আসতে পারে নি । দ্বিতীয়বার আসলে ওদের নিয়ে আসবো । অথবা ওদের কোনো ছুটিতে পাঠিয়ে দেব । ঝর্ণা ভাবি, বিকেলের রান্না করেছে । আমাকে দেখে আবার কিছু রান্না করলো । খাবার পর আমি ওদের  বুঝিয়ে সব কিছু বললাম ।  রমিজ  বলে, আমি সকালেই তোমার সাথে কাগজ নিয়ে যাবো ।    রাতে সে আমাকে জমির দাগ নকশা,এবং দাদা ও বাবার নাম, সব কিছু দেখিয়ে নিলো ।  আমি বললাম, আমি কাগজ ভালো বুঝি না ।   তবে তুমি সব কিছু নিয়ে নিবে যাতে হেড স্যার সব কিছু বুঝে পায় ।  ভোরে ঝর্ণা ভাবি আমাদের জন্য নাস্তা ও বাসার ছেলে মেয়েদের জন্য নারিকেলের লাড্ডু তৈরী করে দিলো। আমরা অতি ভোরে রওনা দিলাম,কাজেই কারো নজরে পড়লাম না ।   লঞ্চ ঘাট বেশি দূরে নয়।     সকাল সকাল লঞ্চে  উঠে   নিচের তলায় বসে দুই কাপ চা নিয়ে দীর্ঘ দিনের জমানো আলাপ করতে করতে  সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল এসে পৌঁছলাম ।   দুইজনে হেটে বাসায় গিয়ে কাপড় চোপড় রেখে সরা  সরি স্কুলে গিয়ে হেড স্যারের কে সালাম দিয়ে রমিজকে পরিচয় করিয়ে দিলাম ।   স্যার কাগজ গুলি দেখে কিছু কথা বার্থা জিজ্ঞাসা করে ।
“আপনারা এখন যান,আমি রমিজের   উপজেলার  AC ল্যান্ডের অফিসে একটা চিঠি লিখে দেব ,কাল এসে নিয়ে যাবেন। “স্যারকে ধন্যবাদ দিয়ে আমরা বাসায় চলে আসলাম।  বাসায় গিয়ে দেখি হাসি রান্না করে রেখেছে। খেয়ে আমরা খানিকটা ঘুরতে বের হলাম।  পর দিন স্কুলে গিয়ে হেড মাস্টার স্যারের সঙ্গে দেখা করলাম।  উনি একটা চিঠি এনভেলাপে দিয়ে বন্ধ করে আমার হাতে দিয়ে বললেন AC ল্যান্ডের অফিসে গিয়ে অফিসারের হাতে দিবেন।  স্যারকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ,আমরা  বাসায় এসে খেয়ে সদর ঘাট দুই জনে হাটতে হাটতে চলে যাই ।    রহমত ভাই আমাকে লঞ্চে   উঠিয়ে দিয়ে বিদায় দিয়ে চলে যায় ।    আমি   পর দিন AC ল্যান্ডের অফিসে গিয়ে ব্যাক্তিগত সীল মারা চিঠি অফিসারের হাতে  দিয়ে খানিক অপেক্ষা করি । চিঠিটা পড়ার পর  অফিসার আমাকে  চলে যাইতে বলে।
ক্রমশ:

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন