নিউ ইয়র্ক থেকে:-

শ্রীনিকেতন: রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের গ্রাম!

sinha8b

শান্তিনিকেতন থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে শ্রীনিকেতন। মা আর আমি দু’জনে মিলে বেড়িয়ে পড়লাম রিকশা নিয়ে। লালমাটির রাস্তা, দুপাশে সবুজ ইউক্যালিপটাস আর লাল কৃষনচূডা!মনে পডলো রবীঠাকুরের গান:

‘ও যে আমায় ঘরের বাহির করে,
পায়ে-পায়ে পায়ে ধরে
মরি হায় হায় রে।
ও যে কেড়ে আমায় নিয়ে যায় রে;
যায় রে কোন্ চুলায় রে।
ও যে কোন বাঁকে কী ধন দেখাবে,
কোনখানে কী দায় ঠেকাবে’… …

দু’পাশে লালমাটি।এ’রি মধ্যি দিয়ে এগিয়ে চলেছে আমাদের রিকসা। শ্রীনিকেতনে রয়েছে রবীঠাকুরের প্রিয় নদী কোপাই, অভয়ারন্য আর বিশ্বভারতীর আরেকটি ক্যাম্পাস।

১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের জমিদার কর্নেল নরেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের কাছ থেকে সুরুল গ্রাম সন্নিহিত কুঠিবাড়িটি দশ হাজার টাকায় কেনেন। সুরুল গ্রামটি ছিল শান্তিনিকেতন থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপনের পর থেকেই রবীন্দ্রনাথ পল্লিসংস্কার নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলেন। সুরুল কুঠিবাড়িটি কেনার পর সেই মতে অল্পবিস্তর কাজও শুরু করেন।

১৯২২ সালে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে এসে ‘লেনার্ড নাইট এলমহার্স্ট’ এই সংস্থার পরিচালনভার গ্রহণ করেন। তাঁর সঙ্গে কাজে যোগ দেন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর।যোগ দেন শান্তিনিকেতনের শিক্ষক সন্তোষচন্দ্র মজুমদার, গৌরগোপাল ঘোষ, কালীমোহন ঘোষ, সচ্চিদানন্দ রায় ও কিম তারো কাসাহারা।এর সাথে আরো ছিল শান্তিনিকেতনের দশ জন ছাত্র। এই সময় এটিকে বলা হত ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচার,শান্তিনিকেতন।

শ্রীনিকেতন নামটির উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯২৩ সাল থেকে। বিশ্বভারতীর দ্বিতীয় শিক্ষাপ্রাঙ্গন শ্রীনিকেতনের কাজের উদ্দেশ্য ছিল কৃষির উন্নতি, রোগ নিবারণ, সমবায় প্রথায় ধর্মগোলা স্থাপন, চিকিৎসার সুব্যবস্থা, ও স্বাস্থ্য বিষয়ে গ্রামবাসীদের সচেতন করে তোলা।

ঘুরতে ঘুরতেই আমরা এলাম কোপাই নদীর তীরে। এটি ময়ূরাক্ষী নদীর একটি শাখা। ছোট্ট নদী, গ্রীষ্মে প্রায় শুকিয়ে যায় অথচ বর্ষায় ভাসিয়ে দেয় দু’কুল! রবীন্দ্রনাথ এই নদীকে নিয়েই লিখেছিলেন-

‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।’

শালবনের পাশ দিয়ে নদী।ওপাশে ইউক্যালিপটাসের পাতা আর এপাশে বড় বড় লাল মাটির উইডিপি।মাঝে নদীর হাঁটু জল। হাওয়া দিলে বড অদ্ভুত শব্দ হয়। নদীটি কাস্তের মত বাঁকানো। তারাশংকর বন্দোপাধ্যায় এই বাঁক দেখেই তার উপন্যাসের নাম দিয়েছিলেন ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’। কোপাই আমার ভাল লেগে গেলো।ওইটুকু তো নদী,যেন গড়ায় তোলা জল!

শ্রীনিকেতন থেকে পায়ে হেটে আমরা চলে এলাম ‘প্রান্তিক’।এখানে বসেছে গ্রাম্যমেলা।পসরা সাজিয়ে বসেছে সব দোকানীরা। এখানে সেখানে বসে আছে সব বাউলেরা, হাতে তাঁদের একতারা। জীবন এখানে কত সুস্থির, কত নিরিবিলি! মেলা দেখে আমরা এলাম শ্রীনিকেতন রোডে। সেখানেই দেখা মেললো নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের বাড়ী। অমর্ত্য সেন শান্তিনিকেতনে বেশ কিছু সময় কাটিয়েছিলেন।

sinha8c

অমর্ত্য সেনের বাড়ী অতিক্রম করে সামনে এগুতেই চোখে পড়লো- ‘ডিয়ার পার্ক’। এটি একটি অভয়ারন্য। আয়তন প্রায় দু’বর্গকিলোমিটার। আমরা পার্কের ভেতরে চলে এলাম। নির্ভয়ে নির্বিঘনে ঘুরে বেড়াচ্ছে হরিণ, ফাঁকে ফাঁকে দু‘চারটে ময়ূরও চোখে পড়লো। ওদের পালাবার কোন তাড়া নেই। রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই এই ডিয়ার পার্কে বসে থাকতেন,কাটাতেন কিছুটা অলস সময়!

এক জায়গায় দেখলাম বার্ড ওয়াচিং টাওয়ার।আমরা চড়ে বসলাম বার্ড ওয়াচিং টাওয়ারে। টাওয়ার থেকে ডিয়ার পার্ক দেখছি। চারদিকে সুনসান নিরবতা, ঝির ঝির বাতাস।বাতাসে পাতা নড়ার শব্দ, কিছু পাতা ঝরেও পড়ছে। এই সব শব্দের সাথে যুক্ত হয়েছে জানা ও অজানা পাখির কলতান। একেই বোধ হয় বলে সেরেনিটি!

সূর্য্যটা ডুবি ডুবি করছে!
টুক করে ডুবে যাবার আগে ওটা পশ্চিমাকাশের মুখে ঢেলে দিল কিছু অবারিত কমলা রং।
মা আমাকে বললেন,’দেখ,দেখ আকাশটা কি সুন্দর’!
আমি বললাম,’হ্যাঁ মা,ভারী সুন্দর।কিনতু তার চেয়ে বেশী সুন্দর তোমার এই আনন্দ ,তোমার এই উচ্ছাস’!

তারপর নীচু স্বরে আমি বিড বিড করে বললাম:

‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।
ধন্য হল ধন্য হল মানবজীবন।
নয়ন আমার রুপের পুরে
সাধ মিটায়ে বেড়ায় ঘুরে,
শ্রবণ আমার গভীর সুরে
হয়েছে মগন’!

জগতের আনন্দযজ্ঞে সবার নিমন্ত্রন হয় না!বহু বছর আগে সেই আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রন হয়েছিলো।নিমন্ত্রন পেয়েছিলেন মা ও!
সেই নিমন্ত্রন আমরা উপভোগ করেছি প্রানভরে!

সিনহা মনসুর
চলবে… …

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন