নিউ ইয়র্ক থেকে:-
কাঞ্চনজংঘার মুখোমুখি!
সকালে ঘুম থেকে উঠেছি ভোর সাড়ে তিনটায়। ম্যানেজারই ঘুম ভাংগিয়েছে। ফ্লাস্কে চা ভ’রে উঠে এলাম ভক্তরাজের গাড়ীতে! গাড়ীতে পডলো পাহাডী রাস্তায়।গন্তব্য টাইগার হিল।দার্জিলিং শহর থেকে টাইগার হিলের দুরুত্ব প্রায় এগার কিলোমিটার।এতো সকালেও রাস্তা ফাঁকা নয়!কারন আমাদের মতো আরো অনেক ট্যুরিসট ছুটে চলেছেন টাইগার হিলের দিকে!
এখন সময় ভোর চারটা দশ।আমরা দাডিয়ে আছি টাইগার হিলের অবজারভেশন ডেকে। সমুদ্র পৃসঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ৮৮০০ ফিট!আমাদের সামনেই কাঞ্চনজংঘা। পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্খ, উচ্চতা ২৮১৬৯ ফিট। কাঞ্চঞ্জঙ্ঘা শব্দটি এসেছে নেপালী ‘Kang-chen-zod-nga’ শব্দটি থেকে।যার মানে ‘বরফের মাঝে পাঁচটি মূল্যবান সম্পদ’। প্রতিবছর হাজার হাজার দেশী বিদেশী পর্যটক দার্জিলিংয়ে ছুটে আসেন কাঞ্চনজংঘাকে কাছ থেকে দেখার জন্য।
চলচ্চিত্র প্রেমী পাঠকদের বলছি- একটু পেছন ফেরে তাকান। উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত বিখ্যাত ছবি ‘পথে হলো দেরী’ ছবিটির কথা মনে আছে? এই দার্জিলিং এর এক পাহাড়েই তারা একে অপরের প্রেমে পরেছিলেন। সাক্ষী ছিল ঐ কাঞ্চনজংঘা!প্রথমবার যখন ছবিটা দেখেছিলাম, দৃশ্যটা মনে গেঁথে গিয়েছিল। আজ কাঞ্চনজংঘার সামনে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটাকে কিছুটা মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। খুবই নষ্টালজিক প্রচেষ্টা!
সিকিম সরকার কাঞ্চনজংঘাকে ‘পবিত্র পাহাড়’ হিসেবে ঘোষনা দিয়েছে। তাঁর অর্থ এই যে, কাঞ্চনজংঘা শুধু দূর থেকে যাবে, ওতে আরোহণ নিষিদ্ধ। শ্বেতশুভ্র বরফের মুকুট মাথায় দিয়ে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে কাঞ্চনজংঘা: ‘বরফের মাঝে পাঁচটি মূল্যবান সম্পদ’।
ধীরে ধীরে সূর্য্য উঠল কাঞ্চনজংঘার ওপাশ থেকে। শ্বেতশুভ্র মুকুট হয়ে গেল সোনালী মুকুট। কাঞ্চনজংঘা এখন স্বর্ণের পাহাড়! অভূতপূর্ব এই দৃশ্যান্তর। চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না।ঘোর লেগে গেলো আমার।ঘোর লেগে গেলো মা’য়ের।ঘোর লেগে গেলো অবজারভেশন ডেকে দাডিয়ে থাকা শত শত ট্যুরিষ্টের!
হালকা একটা ঘোরের মধ্যেই আমরা টাইগার হিল থেকে নেমে এলাম ‘বাতাসী লুপে’। এটি মূলত গোর্খা সৈনিকদের জন্য একটি মেমোরিয়াল। ‘বাতাসী লুপে’ অনেক ট্যুরিষ্ট গাইড এর সন্ধান মিললো। সবার হাতে বাইনোকুলার। এখান থেকে হিমালয়ের কিছু কিছু শৃঙ্গ বেশ স্পষ্টভাবে দেখা যায়। আমরাও শরনাপন্ন হলা এক গাইডের। তিনি আমাদের বেশ যতন করে বাইনোকুলার দিয়ে বেশ কয়েকটি পর্বত শৃঙ্গ দেখালেন। পাহাড়ী হাওয়ায় ক্ষুধার উদ্রেক হয়েছে! বাতাসী লুপে থেকে আমরা চলে এলাম দার্জিলিং শহরের চৌরাস্তায়।ততক্ষনে জমজমাট হয়ে গেছে এই এলাকা!লুচি আর ভাজি দিয়ে সারলাম প্রাতরাশ।
দার্জিলিং টয় ট্রেন!
পর্যটকদের জন্য এটি দার্জিলিংয়ের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক এই টয় ট্রেনে সওয়ার হন। দু’টো রুটে এই ট্রেন চলাচল করে। প্রথমটি হচ্ছে নিউ জলপাইগুরি থেকে দার্জিলিং এবং দার্জিলিং থেকে নিউ জলপাইগুড়ি। একেক দিকের দূরত্ব প্রায় ৮৮ কিলোমিটার, সময় লাগে প্রায় ৭-৮ ঘন্টা। দ্বিতীয় রুটটি হচ্ছে দার্জিলিং থেকে ‘ঘুম’ এবং ‘ঘুম’ থেকে দার্জিলিং, প্রায় সাত কিলোমিটার পথ। এটিকে বলা হয় ‘Joy ride’!
টাইগার হিল,বাতাসী লুপ ও চৌরাস্তা হয়ে আমরা যখন দার্জিলিং রেলষ্টেশনে পৌঁছালাম তখন বেলা প্রায় দশটা। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি টয় ট্রেন যাবে ‘ঘুম’ ষ্টেশনের দিকে। সময়ক্ষেপন না করে আমরা চেপে বসলাম ট্রেনে। স্টীম ইঞ্জিন চালিত ছোটখাটো তিন বগির ট্রেন। ট্রেন চলছে মূল রাস্তার পাশ দিয়েই। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেনটা আস্তে আস্তে ঘুরতে শুরু করলো বাঁক ধরে। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজংঘা, দার্জিলিং শহর, কাছের ও দূরের পাহাড়, চা বাগান ও পাহাড়ী নদী। একেবারে যাকে বলে- ‘পিকচার পারফেক্ট’!
‘বাতাসী লুপের’ কিছু নষ্টা লজিক গুরুত্বও আছে। এই পাহাড়ী বাঁকেই স্যুটিং হয়েছিল রাজেশ খান্না ও শর্মিলা ঠাকুর অভিনীত ছবি ‘আরাধনা’র।
বিদগ্ধ পাঠক, আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে-কিশোর কুমারের সেই বিখ্যাত গান-
‘মোর স্বপ্নেরও রানী তুমি কাছে এসো
আজ ঋতু ফালগুনে কেন দুরে থাকো’।
এই বিখ্যাত গানটির স্যুটিং হয়েছিল এই টয় ট্রেনে এবং এই বাতাসী লুপেই! কাজেই বাংলাদেশী ও ভারতীয় পর্যটকেরা এখানে এলেই কিছুটা নষ্টালজিক হয়ে পড়েন। স্মৃতির হাত ধরে ফিরে যান সূদুর অতীতে!
ভারতের উচ্চতম রেলস্টেশন ‘ঘুম’!
পাহাড়ী আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে ট্রেন এক সময়ে চলে এলো ‘ঘুম’ ষ্টেশনে।
আহা কি সুন্দর নষ্টালজিক ও কাব্যিক নাম! স্বর্গ থেকে মর্তে আসার পথে এখানেই একটু ঘুমিয়ে নিতেন ক্লান্ত দেবতারা। এরকমই রয়েছে জনশ্রুতি!
১৮৮১ সালে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭৪০৭ ফুট উচ্চতায় এই স্টেশন স্থাপন করা হয়। তখন এটিই ছিল পৃথিবীর সর্বোচ্চ উচ্চতার রেলস্টেশন। বর্তমানে এটি ভারতের উচ্চতম রেলস্টেশন এবং পৃথিবীর ১৪তম উচ্চতম রেলস্টেশন।
ইচ্ছে ছিল দেবতাদের মত একটু ঘুমিয়ে নেবো এই ‘ঘুম’ ষ্টেশনে। কিন্তু ট্রেন থামবে মাত্র ৪০ মিনিট, তারপর ফিরে যাবে দার্জিলিং। কাজেই আমরা মনস্থ করলাম করলাম কিঞ্চিৎ ঘুরে ফিরে দেখা যাক আশপাশটা।
‘ঘুম’ থেকে আমরা যখন হোটেলে ফিরে এলাম ততক্ষণে দুপুর তিনটে বেজে গেছে। হোটেলে এসে নাওয়া খাওয়া সেরে লম্বা ঘুম। ঘুম থেকে যখন উঠেছি ততক্ষণে সূর্য্য মিলিয়ে গেছে পশ্চিমে,পুবে উঠেছে থালার মতো এক চাঁদ।
ওই চাঁদের আলোয় বেলকনিতে বসেছি মা ও আমি।চারদিকে হাল্কা কুয়াসা।কিনতু এর মধ্যেও চাঁদের আলো পড়ে চক চক করছে গাছের পাতাগুলো! উত্তর থেকে ভেসে আসছে হাল্কা হিমালয়ী বাতাস! আমাদের দু’জনের গায়েই হাল্কা শীতের পোষাক।আরামদায়ক উষ্ণতা!
চাঁদের আলোয় আমি,মা’কে জিজ্ঞেস করলাম-‘মা,কেমন লাগছে দার্জিলিং’?
মা বললেন- ‘ভাল,খুব ভালো!এক কথায় অপূর্ব!এখানে না আসলে বুঝতাম না, সবাই কেন দার্জিলিং আসতে চায়! কি সুন্দর পাহাড়,গাছ-গাছালি! আর বাতাসে ও কিছু একটা আছে-আমার তো ক্ষিদে পাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে’।
কথা সত্যি। দার্জিলিং -এর হাওয়া অন্য রকম, ক্ষণে ক্ষণে ক্ষুধার উদ্রেক করে। এজন্যেই মনে হয় লোকজন এখানে ছুটে আসে ‘হাওয়া পরিবর্তন’ এর উদ্দেশ্যে।
নৈঃশব্দের কথোপকথন!
সন্ধ্যার হাত ধরে এক সময় এলো রাত। চারদিকে নিঃশব্দের চাদর।মা ঘুমিয়েছেন অনেক আগেই। ঘড়িতে সময় রাত সাড়ে ১১ টা। আমার ঘুম আসছে না। রুম থেকে বেরিয়ে এলাম বেলকনিতে। সাথে নিয়ে এলাম ফ্ল্যাক্স ভর্তি চা। বেলকনির সোফায় বসে আছি- সামনে চায়ের কাপ। আমাদের বেলকনিটা হোটেলের পেছন দিকে। বেলকনির সামনেই সারি সারি বিশাল গাছ। ওক অথবা রেইনট্রি । অন্ধকারে ভাল চেনা যায় না। সারিবদ্ধ গাছের ওপাশে আকাশ, আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ! পাহাড়ের গায়ে হালকা কুয়াশা। আকাশে চাঁদও আছে একটা। ওর আলোতেই দেখা যাচ্ছে সবকিছু।
চরাচরে কোথাও কেউ নেই! চারদিকে অদ্ভুত এক নিরবতা। এরি মধ্যে হালকা একটা বাতাস গাছগুলোকে, পাতাগুলোকে এবং সম্ভবত আমাকেও কাঁপিয়ে দিয়ে চলে গেল পাহাড়ের ওদিকটায়। কিছু ফেরারী মেঘ পাহাড়ের এপাশ থেকে চলে গেল ওপাশটায়। নিঃশব্দে চলছে দৃশ্যপটের পরিবর্তন।
আকাশে!
বাতাসে!
পাহাড়ে!
সাক্ষী আকাশের চাঁদ।
আর বেলকনিতে একাকী বসা আমি! কিছুক্ষণ পরে চাঁদও চলে গেল মেঘের আড়ালে। শেষ সাক্ষী আমি বসে আছি বেলকনিতে। মনে হলো চরাচরের এই নীরবতাকে ভঙ্গ করে নিজের উপস্থিতিকে জানান দিয়ে বলে যাই:
দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?’
বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরামুখ সবুজ নালিঘাস দুয়ার চেপে ধরে
‘অবনী বাড়ি আছো?
আধেক লীন হৃদয়ে দুরগামী
ব্যাথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?
(অবনী বাড়ি আছো? শক্তি চট্রোপাধ্যায়।)
মেঘের কারাগার থেকে চাঁদ আর ছাড়া পেলনা।এখন চারপাশে নিরবিচ্ছিন্ন অন্ধকার! মনে হলো সময় থেমে আছে দার্জিলিং-এর ঐ পাহাড় চূড়োয়!
মেঘের ফাঁকে!
গাছের পাতায়!
অথবা কুয়াসায়!
এইসব অপার্থিবতার শেষ সাক্ষী হয়ে আমিও চলে এলাম রুমের ভেতরে! কখন ঘুমিয়েছি,মনে নেই।
ঘুম ভাঙ্গালো সকাল ৬টা দশে। চা নিয়ে চলে এলাম বেলকনিতে,সামনে একই দৃশ্যাবলী!মনে পড়লো গত রাতের কথা।
আচছা,গতরাতটা কি স্বপ্নের রাত ছিল?
আমি বুঝতে পারি না!
কেবল তাকিয়ে থাকি দূরের হিমালয়ে আর মনে মনে বলি,’অবনী বাড়ি আছো’!
সিনহা মনসুর
চলবে… …