পার্থ, অস্ট্রেলিয়া থেকে:-
ব্রাজিলের কথা বলি । ২০০১ সাল ।
এক…
রিও ডি জেনেইরো যাচ্ছিলাম – ফ্রাংকফুট থেকে রিও । বিমানে আমার সমস্যা ছিল খাবার । খেতে পারতাম না । ডাল-তরকারী দিয়ে ভাত না খেলে মাথা বনবন করে ঘুরতো । বার ঘন্টার যাত্রা, আটলান্টিকের পেট কোনাকুনি পাড়ি দিতে হবে ।
দুপুরের খাবার বলতে খেলাম একটা রুটি মাখন দিয়ে মাখিয়ে । বাকি খাবার ছুঁয়ে দেখলাম না । কেবিন ক্রু ট্রে নিয়ে গেল। কফি খেতে খেতে ম্যুভির স্ক্রিন টেপাটিপি করছিলাম। মাঝবয়েসী এক কেবিন ক্রু এসে জিজ্ঞেস করলো,
“আমরা লক্ষ্য করেছি তুমি খাও নাই । আমাদের খাবারে কি সমস্যা হচ্ছে?
সমস্যা খাবারে না, সমস্যা আমি নিজেই !
বললাম, “আমি ভেজিটেরিয়ান”।
বলেই মনে হলো ভুল করলাম। এখন যদি আধাসিদ্ধ ব্রকলি গিলতে হয়? ক্রু উত্তর দিল,
“ভেজিটেরিয়ান হলে ভ্রমণের আগে আমাদের জানাতে হয়। আমাদের এখন ভেজিটেরিয়ান খাবার নাই । তবে পাইলট এবং ক্রুদের জন্য ফল থাকে। তুমি যদি চাও আমি এনে দিতে পারি।”
“ইয়েস প্লিজ, ইউ আর অসাম”, ভাবলাম কাঁচা ব্রকলি খাওয়ার চেয়ে আপেল খাই ।
ভদ্রলোক এক ট্রে ভরা আপেল, আঙ্গুর, এবং পিচ ফল নিয়ে এলো । ফলের ট্রে দেখে পাশের যাত্রীর দুই চোখ গোল গোল হয়ে গেল । চোখ বড় বড় হলে মুখ হা হয়ে যায় ।
ভ্যারিগ ব্রাজিলিয়ান এয়ারলাইনসকে মনে থাকবে ।
দুই…
হোটেল থেকে অফিসের দূরত্ব দশ-বার কিলোমিটার। প্রথম সকালে রিসেপশন থেকে ভাড়া গাড়ি নিয়ে অফিসে রওনা হলাম। কাঁচা-পাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ির মাঝ বয়েসী ড্রাইভার। উঁচু দালানগুলো পার হতেই রাস্তাটা লেকের পাশ দিয়ে বেঁকে চলে গিয়েছে। রোদ ঝলমলে পরিস্কার সকাল। এই লেককে পর্তুগিজ ভাষায় বলে ‘দি লাগোয়া’। লেকের পাশে পার্ক। পার্কের পাশ দিয়ে আমার রাস্তা। লেকের ওপারে প্রায় এক-দেড় কিলোমিটার দুরে সবচে উঁচু সবুজ পাহাড়ের চূড়ায় ‘ক্রিস্টো ডি রেডেমার’ – যিশু খ্রিস্টের পাথরের মূর্তি – যেন যিশু এই শহরকে তার প্রশ্বস্ত দুই হাতের শান্তির ছায়াতলে রেখেছেন। আমি ক্যামেরা বের করলাম । ফিল্মের ক্যামেরা, হিসাব করে ছবি তুলি । এক রিলে ছত্রিশটা ফিল্ম। কপাল ভালো হলে সাইত্রিশ বা আটত্রিশটা ছবি হয় । পরপর তিনটা ছবি তুলে ফেললাম। ড্রাইভার গাড়ি রাস্তার পাশে থামালো । ড্রাইভারের ইংরেজি জ্ঞানের চেয়ে আমার পর্তুগিজ জ্ঞান ভাল ছিল – আমি অন্তত একটা পর্তুগিজ শব্দ জানতাম “অবৃগাদো” (ধন্যবাদ)। সে আমাকে ক্যামেরা টেপার ইশারা করলে বুঝলাম গাড়ি থামিয়েয়েছে যেন আমি ছবি তুলে পারি। আরো দুটো ছবি তুললাম। এই ড্রাইভার প্রতিদিন সকালে আমাকে অফিসে নামিয়ে দিত । ফিরতাম ট্যাক্সি ধরে। দুই সপ্তাহ । কোনদিন তার সাথে কোন কথা হয় নাই । একটা শব্দও না । আমি শুধু বলতাম “অবৃগাদো”, ড্রাইভার হাসতো এবং মাথা ঝাঁকাতো ।
ড্রাইভার কি বোবা ছিল?
নাহ, তাকে রিসেপশনিস্ট মেয়ের সাথে হাসতে হাসতে আড্ডা দিতে দেখেছি ।
তিন…
এক রাতে খাবারের জন্য রেস্টুরেন্টে ঢুকেছি। ভাত আর মাছের একটা কিছু অর্ডার করেছিলাম । সিকিভাগও গিলতে পারি নাই । ঝাল-লবন-মসলা ছাড়া খাবার । কাউন্টারে বিল দিতে গেমাল। ম্যানেজার/ক্যাশিয়ার বললো,
“তুমি তো খাও নাই, আমাদের খাবারে কি কোন সমস্যা পাইছো ?”
“নাহ, খাবারে সমস্যা নাই, আমি অসুস্থ ।”
ভদ্রলোক আমাকে অবাক করলো, “আমি দাম নিতে পারব না। দুঃখিত।”
আমি তাকে দাম দিতে পারি নাই ।
চার…
আমার চলে যাবার দিন। সন্ধ্যায় ফ্লাইট রিও থেকে মায়ামি । হোটেলের লবিতে নেমে দেখি হাসিমুখে সেই ড্রাইভার দাঁড়িয়ে আছে। এয়ারপোর্ট প্রায় এক ঘন্টার পথ। যেতে যেতে ড্রাইভার পাহাড়ের গায়ে বস্তি দেখিয়ে প্রায় চিত্কার করছিলো, ‘মাইকেল জ্যাকসন, মাইকেল জ্যাকসন …।’ বুঝলাম মাইকেল জ্যাকসন “দে ডোন্ট কেয়ার এবাউট আস” এই বস্তিতেই শুট করেছিলেন।
বললাম, “ওকে ওকে …অবৃগাদো, অবৃগাদো”।
এয়ারপোর্ট পৌঁছে সে আমার ব্যাগ দুটো নামালো । তারপর যা করলো তা হজম করতে আমার সময় লেগেছিল । সে আমাকে জড়িয়ে ধরলো । শুধু বললাম, ‘অবৃগাদো সিনোর, অবৃগাদো ভেরি ভেরি মাচ” ।
আত্মিক যোগাযোগ স্থাপনে ভাষা নিষ্প্রয়োজন । মহান আল্লাহর এক আশ্চর্য্য সৃষ্টি ।