তখন কার্তিকের ধানের ছড়াগুলো হলুদ হয়ে এসেছে। বাতাস ত্রিমুখী ভাবে ঘুরে উত্তর দিক থেকে বইছে। তিরতির করে শীত এসে জমা হয়েছে গ্রামের পথে-ঘাটে।
একদিন দুপুরে পয়লা কাটা খেজুরের রসে হাত ডুবিয়ে তেস্যাভাত খাচ্ছি। তখনই শুনলাম, হিঁদুপাড়ায় জারিগান হবে। সন্ধ্যার পর দলে দলে লোক আসে। তাঁবুর বাইরেও অনেক লোক সমাগম হয়। শরীয়ত মারেফতের পালাগান। সেই জারীগানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল শরীয়তের শিল্পী অবিবাহিতা এবং সদ্য কিশোরী অতিক্রান্ত যুবতী। তার আকর্ষনেই এত মানুষের ঢল।
তো, জারিগান শুরু হল। মেয়েশিল্পী মঞ্চে উঠে বন্দনাগীত শেষ করে একটি বিচ্ছেদ গাইল। আহা! সে কি টান, কি সুর, কি মায়া আর দরদে ভরা নারীকন্ঠ! মনে হল, ওমন সুর শুনে বাতাস বেহূস হয়ে যাবে। একথা বলতে দ্বিধা নেই, মেয়টির গান শুনে ক্লাস টেনের ছাত্র অভির মনে হত, তাবত পৃথিবীর সব গোল্লায় যাক, এই মেয়েটি যদি কিছু একজন হত! কি সুর তার, সুরের তালের সাথে অঙ্গের কি ভঙ্গিমা। আমি মুগ্ধ হয়ে মেয়েটির দিকে চেয়েছিলাম। ওই জারীশিল্পী মেয়েটির প্রতি আমার একটা মোহ আরো বছর দুই কাজ করেছিল।
তারপর ঢাকায় চলে আসি। সেই শিল্পী মেয়েটির খবর আর নেয়া হয়নি। তবে সেই রাতে জারী গানের আসরে যে ঘটনাটা ঘটেছিল হঠাৎ করে সেই স্মৃতিটা আজ মনে উঁকি দিয়েছে একজনকে দেখে। সে গহরের বউ ‘ফুলি’।
গহর মিয়া ঢোল বাদক ছিলেন। সেই রাতে মেয়েশিল্পী শরীয়তের ভূমিকায় অনেক ছুয়াল করে প্রতিপক্ষ মালেক দেওয়ানকে চাপানির পর চাপনি দিয়ে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। দর্শক মেয়েশিল্পীর সমর্থনে উল্লাসে মাতে। চারিদিকে রই রই শব্দে নারীশিল্পীর জয়ধ্বনি। প্রতিপক্ষের শিল্পীর চাপানিতে অস্থির মালেক দেওয়ান গহর নামক ঢোল বাদককে লাথি দিয়েছিল। গহর ওখানেই মারা যায়। মালেক দেওয়ানের যাবজ্জীবন হয়েছিল বিচারে।
আজ অনেক বছর পর রাস্তার পাশে খেলাওয়ালা, মজমাওয়ালা ক্যানভাসারের মুখে শুনলাম, সে পটুয়াখালী মির্জাগঞ্জ উপজেলার কাঁকড়াবুনিয়া গ্রামের মালেক দেওয়ানের ছেলে। তার বিক্রয়পন্য বটিকা তয়ের করেছে তার মা মালেক দেওয়ানের স্ত্রী ‘ফুলি’। শুনেই সেই স্মৃতি মনে পড়ল। এখন মনে মনে ভাবি, কোথায় সেই নারীশিল্পী, কোথায় মালেক দেওয়ান? নারীশিল্পীকে দেখলে আজও কি সেই কিশোর বয়সের প্রেমানুভূতি অনুভব করব!
আহা! আবার যদি সেইদিন ফিরে আসত। সেই কিশোর বেলার গান।