বেশির ভাগ মানুষই তার ফেলে আসা জীবনের বৈরী সময়ের কিছু স্মৃতি খুব সহজে ভুলে না। চাইলেও ভুলতে পারে না। এসব স্মৃতির কিছু অংশ মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলে আবার কিছু স্মৃতি সামনে এগিয়ে যাবার পথকে করে তুলে আরো আলোকিত । সবে তখন কানাডা এসেছি। আর দশজন অভিবাসী বাংলাদেশির মতো আমিও হৃদপিণ্ডের অর্ধেক নিয়ে এসেছি কানাডায় আর বাকি অর্ধেক রেখে এসেছি বাংলাদেশে। নুতন দেশে জীবনের নুতন অধ্যায়ের সূচনায় সবাই কিছুটা পুলকিত। নাগরিক সুযোগ সুবিধার নিরবিচ্ছিন্ন প্রবাহ দেখে চমকিত হওয়ার পালাও চলছে সমানভাবে। এই পুলক আর চমকের ফাঁকে ফাঁকে ভিড় করে স্মৃতিঘেরা, মায়াভরা জন্মভূমি আর রেখে আসা আপনজনদের স্মৃতি। মাঝে মাঝে গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে বসে থাকি, নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করি সব ছেড়ে ছুড়ে অচিন এই দেশে আসার যৌক্তিকতা কি ? শারীরিক অবস্থান একদেশে আর মন পড়ে রয়েছে আর একদেশে। মনে হয় আমি কোনো জায়গারই অংশ নই। এ এক অদ্ভুত ‘Sandwiched Feeling”। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। এসব টানাপোড়নের মধ্যেই দেখা দিলো বাসা ভাড়া করার প্রয়োজনীয়তা।

চার বছরের মেয়েকে নিয়ে তিনজনের সংসার। সুতরাং খুব একটা বড় বাসার দরকার নেই। খুঁজে খুঁজে একজনের বাসায় দুতলায় দুটো রুম নিয়ে টরোন্টোতে নুতন জীবনের শুরু । কয়েকমাস যেতে না যেতেই শুনলাম যে এই বাসা ছাড়তে হবে। কারণ বাড়িওয়ালা তার বোনের পরিবারকে এই বাসায় নিয়ে আসবে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই বাসা ছেড়ে একই রাস্তায় আর এক বাসায় ভাড়া উঠলাম ছোট ছোট দুই রুম নিয়ে। এই বাসাতেও কতদিন থাকতে পারবো সেই আশংখায় কোনো ফার্নিচার ও কিনতে পারছিনা। নিজের ইপ্সিত পেশায় তখনও প্রবেশ করতে পারিনি। কাজ করি এক কলসেন্টারে। সব মিলিয়ে ‘প্রশান্তি’ শব্দটির অবস্থান তখন জীবন থেকে অনেক দূরে। ঠিক ওই সময়ে ঢাকা থেকে আমার দুই প্রিয় সহকর্মী এক কনফারেন্সে যোগ দিতে টরোন্টোতে এসে পৌঁছেছেন। আমাদের বাসায় ছিলেন একরাত। অভিবাসী জীবনের প্রথম দিকের প্রতিকূলতা  সহকর্মীদের বুঝতে না দিলেও তারা কিছুটা হলেও আঁচ করতে পেরেছিলেন যে আমি এখন “Land of Opportunity‘ তে ‘Opportunity‘ এর অন্নেষণেই বেশি উদ্বিগ্ন। নানাবিধ কারণে এই বাসাতেও বেশিদিন থাকা হয়নি। এবার টরোন্টো শহরের পূর্ব প্রান্ত থেকে বসতির জন্য পাড়ি জমাই পশ্চিম প্রান্তে। মোটকথা বাসা বদলের পালা এরপরেও অব্যাহত ছিল কিছুদিন।

মানুষের জীবনে কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই পাল্টায়। পাল্টায় লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিরামহীন পথ চলার গতি ও প্রকৃতি। অভিবাসী জীবনের জটিল কিছু অধ্যায় পার হয়ে এসেছি অনেক আগেই। আলহামদুলিল্লাহ, এখন নিজের বাড়িতেই থাকি। ভাড়াও দেই বাসার আর এক তালা। কিছুদিন পর পর ভাড়াটিয়া খোজাঁর নুতন মিশনে নামি। বিজ্ঞপ্তি দেখে ভাড়া নেবার জন্য আসেন বিচিত্র রকমের মানুষ। মাঝে মাঝে পোষা কুকুর নিয়েও হাজির হন কেউ কেউ। মনে মনে ভাবি, “ভাড়ার দরকার নেই, কুত্তা সামলাও“। অব্যাহত থাকে নির্ঝঞ্জাট ভাড়াটিয়ার সন্ধান।

স্রষ্টায় অবিশ্বাসী মানুষদের কথা জানি না, কিন্তু বিশ্বাসী মানুষের জন্য মনে হয় আল্লাহ্পাক তার অফুরান নেয়ামতের দরজা একসময় খানিকটা হলেও খুলে দেন। সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করা ঐশী আলোয় উদ্ভাসিত হয় জীবন ও জগৎ। বদলে যায় মানুষের অবস্থা ও অবস্থান। তার অপার করুণা তখন প্রশান্তির বৃষ্টি হয়েই নামে আমাদের চারিপাশে। সেই করুণা অনুধাবনের প্রজ্ঞা বা সামর্থ্য কোনোটাই আমার নেই।অভিবাসীর সুখ দুঃখ: দ্বিতীয় পর্ব   ( ভাড়া বাসা-বাসা ভাড়া)

সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন