দুই
৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ পাকিস্তান সরকার জেনারেল ইলেকশন দিয়েছে । ১৯৪৭ সনে দেশ ভাগ হওয়ার পর এটাই একমাত্র জনগণের সরাসরি ভোটে ইলেকশন হবে । মানুষের মধ্যে একটা চরম উত্তেজনা দেখা দিয়েছে । শহরে গেলে এখানে ও ইলেক্শনের উত্তেজনা দেখা যায় । এখানে সেখানে ওয়ালের গায়ে প্রচুর পোস্টারিং হচ্ছে ।
পূর্ব পাকিস্তান থেকে দৈনিক প্রচুর ইয়ং ছেলে আর্টিলারি সেন্টারে রিক্রুটমেন্ট নিয়ে আসতেছে । অফিসে আসা যাওয়ার পথে বহু পূর্ব পাকিস্তানী নুতন ছেলেদের সঙ্গে দেখা হয় । আমাদের জানা দুই জন আর্মি মেজর ও ক্যাপ্টেন যারা বলে যে গত বৎসরে গুলিতে আমরা এত পূর্ব পাকিস্তানী রিক্রুট দেখি নি । এই প্রথম আমাদের নজরে পড়তেছে শত শত ট্রেইনী । এদের অনেকেই দুঃখ করে বলতে শুনেছি যে ট্রেনিং এতোই কষ্টকর যা ব্যাখ্যা করা যায় না । বুট পড়া ট্রেইনার আমাদের অনেক-কে যে ভাবে লাথি মেরে শাস্তি দেয় , তা সহ্য করা যায় না, আমরা ভীত থাকি ।
তারিখ ঠিক মনে নেই, আমরা শুনলাম পাবলিক মিটিং এ বক্তৃতা দেবেন কিছু বড়ো বড়ো পাকিস্তানী নেতা । মেসের কয়েকজন মিলে শুনতে গেলাম । আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের মাঠে সে যুগে যে কোনো পার্টির নেতারাই হোক না কেন , বক্তৃতা দিলে লোকজন দুব্বা ঘাসের উপর বসে আরাম করে বক্তৃতা শুনতো । কিন্তু ক্যাম্পবেলপুর মাঠে ভর্তি ধুলাবালি ,লোকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুনতে ছিল । উর্দুতে বক্তৃতা , সব কিছু বুঝতে পারিনি , শুধু বক্তৃতায় মাশ্রীকি পাকিস্তান, অল্প স্বল্প এটা সেটা বুঝতে পেরেছি আর বেশি কিছু বুঝতে চেষ্টা করিনি ।
আমাদের অফিসে এই কয়েক জন বাঙালিদের মধ্যে আবার দুইটা দল । কি নিয়ে এদের মধ্যে লাগালাগি শুরু হয়েছিল তা আজ আর মনে নেই । তবে লিডারশিপ সংক্রান্ত ব্যাপার নিশ্চয়ই ছিল একে অন্যের চেয়ে অনেক জ্ঞানী মনে করা । একদিন অফিসে গিয়ে জানতে পারলাম যে একজনের মাথা পাটিয়ে ফেলেছে এবং সে হাসপাতালে আছে । পশ্চিম পাকিস্তানী বস কি ভাবে দুই দলকে মীমাংসা করিয়ে দিয়েছিললেন মনে নেই । অফিসে বাঙ্গালীদের মধ্যে একটা থম থেমে ভাব , এই ঘটনার পর থেকেই অফিসে ম্যানেজমেন্ট , আমাদের সবাইকে নজরদারিতে রেখেছিলেন । কোনো বাঙ্গালীকে অফিসে একত্রে অফিসিয়াল কাজ ব্যাতিত কথা বলতে বা একত্র দেখলে সন্দহ করতেন । এক সপ্তাহ গেলে দেখলাম ওকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করা হয়েছে , অফিসে আসে, তবে মাথায় এখন ও ব্যাণ্ডেজ রয়েছে । ভয়ে সাহস করে কাউকে জিজ্ঞাসা করি না কি হয়েছিল? তবে জানতে পারলাম যে কোনোরকম পুলিশ কেস হয় নি । আমার রুমমেট লস্করের কাছে সব খবর থাকে, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম , কি জন্য এরা মারামারি করলো? সে বলে অনেক আগে থেকেই ওদের দু’জনের কথা কাটাকাটি হইতেছিল । উত্তেজনার বসবতী হয়ে এক পয্যায়ে মারামারি হয়েছে । কোনো মোকদ্দমা কি হয়েছে? না, আমাদের অফিসের বস মীমাংসা করে দিয়েছে ।
আমরা সরকারি ছুটির দিনে বিশেষ কেনা কাটার নাম করে পেশোয়ারের অদূরে বাড়া মার্কেট যাইতাম । ক্যাম্পবেলপুর থেকে পেশাওয়ার ৪৮ মাইল দূরে এবং আমরা কয়েক জন মিলে অতি পুরাতন শহর দেখতে যেতাম । আমার চোখ দেখানোর জন্য তক্ষশিলা (ট্যাক্সিলা) চক্ষু হাসপাতালে বেশ কয়েকবার গিয়েছিলাম । ওখানে প্রাচীন বৌদ্ধ সংস্কৃতির ধ্বংসাবশেষ দেখতে ভালো লাগতো ।
আমি এই ৪/৫ মাস বসে না থেকে ইসলামাবাদ গিয়ে চাকুরীর খোঁজ খবর নিতাম এবং এক সময় পেয়ে ও গেলাম । একদিন ক্যাম্পবেলপুর থেকে চলে গেলাম তল্পিতল্পা নিয়ে ।
ইসলামাবাদ মার্গাল্লা পাহাড়ের পাদদেশে অত্যন্ত সাজানো গুছানো নুতন শহর । জেনারেল আয়ুব খান, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, করাচী থেকে ইসলামাবাদ মার্গাল্লা পাহাড় কেটে এই রাজধানী স্থান্তরিত করেন । বিভিন্ন মিনিস্ট্রিতে পূর্ব পাকিস্তানী কিছু সিভিল সার্ভিস অফিসার্স ও কর্মচারী বিভিন্ন পদে কর্মরত ছিল । অত্যন্ত ছোট্ট শহর , মেইনলি চাকুরীজীবীরা থাকতেন । নুতন সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং ও হাউসিং ফ্যাসিলিটিজ রয়েছে । শহরের অদূরে রাওয়াল ডেম তৈরী করা হয়েছিল যেখান থেকে শহরে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে । রাওয়ালপিন্ডি ইসলামাবাদ এর দূরত্ব ১০ মাইলের মধ্যে, মাঝখানে চাকলালা উপশহর ।
সে সময় বাঙালিদের কারোই মনে কোনো শান্তি ছিল না । সরকারি সেন্সর থাকাতে , পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিনিয়ত কি হচ্ছে পত্রিকাতে সঠিক খবর আসতো না ।
মোটামোটি সবারই আপন লোকজন দেশে রেখে পশ্চম পাকিস্তানে চাকুরী করতো, এই অবস্থাতে অফিসে আমার মতো অনেকেরই মন বসতো না, হতাশার মধ্যে দিনরাত্রি পার করতাম ।
দেশে নির্জঞ্জাট ইলেকশন হয়ে গেলো । কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তর হচ্ছে না । তার পরের ঘটনা সবারই জানা । অফিস থেকে মেসে এসে আমরা রেডিও নিয়ে সারাক্ষন স্বাধীন বাংলা বেতারের খবর শুনার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা চেষ্টা চালিয়ে যাইতাম । কিন্তু ইসলামাবাদ বা রাওয়ালপিন্ডি থেকে কেউ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ধরতে পারছে বলে শুনিনি ।
আমাদের স্কুল সহপাঠি নজরুল ইসলাম করাচী ইউনিভার্সিটি থেকে সদ্য মাস্টার্স ডিগ্রী নিয়ে ইসলামাবাদ বেড়াতে এসেছে । সে যেই বাসায় উঠেছিল , ওই বাসায় আমাদের আরো দুইজন সহপাঠি থাকতো । ওটাই নজরুল ইসলামের সাথে আমার শেষ দেখা । সে আমাকে বলেছিলো ,”মিতা চলেন দেশে চলে যাই , দেশের পরিস্তিতি ভালো না । আমি বললাম ,আমি কিছুদিন হয় ক্যাম্পবেলপুর থেকে ইসলামাবাদ এসে নুতন চাকুরী নিয়েছি । তুমি যাও ,আমি কিছু দিন পর যাবো । ” তার দুই মাসের মাথায় আমরা খবর পেলাম, সে তার বাবা সহ নৌকা নিয়ে রঘুনাথপুর বাজারে গিয়েছে । সে নৌকায় বসে ছিল , তার বাবা কিছু কেনা কাটা করবে । রাজাকার বাজারে এসে ওকে গান পয়ন্টে নৌকা থেকে উঠিয়ে নিয়েছে । তার বাবা আর্তনাদ করে ওদের বলেছিলো ,”আপনারা আমাকে মেরে ফেলেন ,আমার ছেলের প্রাণ ভিক্ষা দেন, আমার ছেলেকে মারবেন না ।“সেদিন রাজাকার পাশন্ড পশুরা ওর বাবার আর্তনাদ শুনে নি, বাজার ভর্তি লোকের সামনে ওকে গুলি করে … ।
ক্রমশ: