নিজাম উদ্দিন ভয়ানক ধরণের বিপদে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। কোনোরকম চিন্তা না করে নিজাম উদ্দিন চোখ বন্ধ করে বাংলা সিনেমার মতো যমুনা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরিয়ে এই মাত্র ছেড়ে যাওয়া ষ্টিমারের দিকে এগুতে থাকলেন। নদীর পাড় ঘেঁষে উৎসুক জনতা চিৎকার করে, হাত তালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে। ষ্টিমারের বারান্দায় নিজাম উদ্দিনের নতুন বিয়ে করা স্ত্রী রুপা যেন কাঁদতেও ভুলে গেছে। ভয়ে আতঙ্কে নীল হয়ে ষ্টিমারের বারান্দায় বসে প্রবল বেগে দোয়া ইউনুস পড়ে যাচ্ছেন। গভীর রাতে বাহাদুরাবাদ ঘাটে যেন মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি কোনো সিনেমা/নাটকের শুটিং চলছে। আশেপাশের লোকজন রুপাকে কেউ সান্তনা দিয়ে যাচ্ছে, কেউ বা কথা শোনাচ্ছে । এই মাত্র একজন রুপাকে বললো, ‘আপা উনি কি আপনার স্বামী লাগে, উনি কি সাঁতার জানে?; আরেকজন বললো, ‘কেরাম স্বামী রে বাবা , বৌরে ফেলাইয়া নীচে গেছিলো কি করতে ?’ আশার কথা হচ্ছে ষ্টিমার থেকে দড়ি বেঁধে লাল রং এর একটি প্রকান্ড টিউব নিজাম উদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে পানিতে নিক্ষিপ্ত করা হয়েছে।

পুরো ঘটনাটি আরেকটু বিস্তারিত আলোকপাত করা যাক। নিজাম উদ্দিন মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগে কানাডার টরেন্টো শহর থেকে জামালপুরের পৈতৃক বাড়িতে যেয়ে রুপা নামের এক অসুম্ভব রূপবতী মেয়েকে বিয়ে করে মাত্র দুই দিন আগে বোনার পাড়ায় তার একমাত্র খালার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ওখান থেকে সন্ধ্যার দিকে একতা এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠে স্ত্রীকে নিয়ে যাচ্ছিলেন ঢাকার দিকে। উদ্দেশ্য হচ্ছে ভোরে ঢাকায় পৌঁছে বাসে করে কক্সবাজারের যেয়ে রুপাকে নিয়ে কয়েক দিন অবকাশ যাপন করবে । ষ্টিমার ছাড়ার আগদিয়ে নিজাম উদ্দিন খেয়াল করলেন তার সাথে যে কয়টি সিগারেট আছে বড়োজোর ঘন্টাখানিক যাবে, কিন্তু স্টিমারে থাকতে হবে কমপক্ষে সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টা। নিজাম উদ্দিনের ধারণা ছিল সে পাড়ে নেমে দৌড়ে যেয়ে দ্রুত দুই প্যাকেট সিগারেট কিনে আনবে, জাস্ট যাবে আর আসবে। কিন্তু দোকানদারের কাছে একশো টাকার খুচরা না থাকায় দোকানদার পাশের হোটেলে গিয়েছিলো ভাংতির জন্যে। এরই মাঝে যখন ষ্টিমারের হুইসিল শোনা গেলো, ততক্ষনে দোকানদার ভাংতি টাকা ও সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে এগিয়ে আসতেই নিজাম উদ্দিন দোকানদারের হাত থেকে ছোঁ মেরে টাকা আর সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে ভোঁ দৌড়ে এসে দেখে ষ্টীমারটি ধীর লয়ে পানি কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। নিজাম উদ্দিন সম্বিৎ হারিয়ে কিছুক্ষন কাটা মুরগির মতো লাফাতে থাকলেন। তারপর, ভয়ডর ফেলে পানিতে লাফিয়ে পড়লেন। যাহোক, সাঁতরিয়ে লাল টিউবটি ধরে দড়ি বেয়ে যখন স্টিমারে উঠলেন রুপা তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে কেঁদে কেটে অস্থির । নিজাম উদ্দিন পকেটে হাত দিয়ে দেখে সিগারেটের প্যাকেট ভিজে নেতাপাতা অবস্থা। নিজাম উদ্দিন, আলগোছে রুপার হাত ধরে সিগারেটের জন্য প্রচন্ড রকমের মন খারাপ করে মধ্যরাতের বিশাল চাঁদের দিকে হা করে থাকিয়ে থাকলেন, তাকে এখন প্রায় চার ঘন্টা সিগারেট না খেয়ে থাকতে হবে । ওদিকে, রুপা ভাবতে থাকে এই অসম্ভব দায়িত্ব জ্ঞানহীন লোকটির সাথে তাঁর বাকি জীবনটি কেটে যেতে হবে।

নিজাম উদ্দিন হয়তো আরো কিছুক্ষন অতীতকালে থাকতে পারতেন কিন্তু তার রুমে অর্থ্যাৎ মানসিক আবাসন কেন্দ্রের এই ৮ নম্বর রুমের দরজায় বেরসিক এক স্টাফের কড়ানাড়ার কারণে নিজাম উদ্দিন ধাতস্ত হতে কিছুটা সময় নিলেন। তবে কি, এতক্ষন যা ঘটলো তা কি স্বপ্ন, না তার সিজিওফ্রেনিয়া (Schizophrenia) রোগের হেলুসিনেশন। গত কাল রাতে বিল্ডিং এর পিছনে ঝোপের আড়ালে যেয়ে হ্যাডলির সাথে মদ খেয়েছিল, তবে মাতাল হয়নি। নিজাম উদ্দিন ইতিমধ্যে বিল্ডিং এর মধ্যে মদ খাবার অভিযোগে ম্যানেজমেন্ট থেকে গত মাসে ওয়ার্নিং লেটার পেয়েছে, তাই বিল্ডিং এর মধ্যে আর মদ খায় না। মদ আর মানসিক রোগের ঔষুধ এক সাথে খেলে বিষ হয়, তাই নিজাম উদ্দিন গত রাতের ঔষুধ খায়নি । তবে নিজাম উদ্দিন শতকরা একশত ভাগ নিশ্চিত কিছুক্ষন আগে যে ঘটনার মধ্যে ছিলেন সেটা তার জীবনে সত্যি সত্যিই ঘটেছিলো। নিজাম উদ্দিনের স্পষ্ট মনে আছে ষ্টিমারের ওই কাহিনীর পরে ঠিক ঠিক সময়ে ঢাকায় পৌঁছে কক্সবাজারের বাস ধরে কক্স বাজারে যথা সময় পৌঁছে বেশ ধুম ধামের সাথে সে তিন দিন রুপার সাথে চমৎকার সময় কাটিয়েছিলো।

স্টাফ মেয়েটি নিজাম উদ্দিনকে সকালের ঔষুধ, রক্তের গ্লূকোজ পরীক্ষা ও ইন্সুলিন নেয়ার কথা মনে করে দেয়। নিজাম উদ্দিন চোখে মুখে পানি দিয়ে ঔষুধ এর জন্য ম্যানেজমেন্ট অফিসে ঢুকতেই দেখলো এক হ্যাঙ্গলা পাতলা ছেলে, সম্ভবত ২৩ /২৪ বছর বয়স হবে, অনেকটা তাঁর ছেলে রিফাতের বয়সী । মাথা ভর্তি আলুথালু চুল, মাঝারি দাড়ি গোফ, টেবিলে রাখা একটি প্যাপারে সিগনেচার করছে। নিজাম উদ্দিন ঢুকতেই স্টাফ মার্গারেট ছেলেটিকে দেখিয়ে নিজাম উদ্দিনকে বললো:
‘এই ছেলেটি এখন থেকে এই বিল্ডিংয়েই উপরতলার এগারো নাম্বার রুমে থাকবে। ছেলেটি তোমার দেশি অর্থাৎ বাংলাদেশী বংশোভূত। ‘
নিজাম উদ্দিনকে দেখেই ছেলেটি স্মিত হেসে পরিষ্কার বাংলাদেশী কায়দায় উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো :
‘স্লামু আলাইকুম আংকেল। আমি এখন থেকে এখানেই থাকবো।’

নিজাম উদ্দিন হাতে সুঁচ ফুটে এক ফোটা ব্লাড নিয়ে নিজে নিজেই রক্তের গ্লূকোজ পরীক্ষা করে স্টাফের হাত থেকে সকালের ঔষুধ, ইন্সুলিন নিয়ে অফিস ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বললো:
‘আমি বেজমেন্টের ডান দিকের কোনার আগের রুমটায় অর্থাৎ ছয় নম্বর রুমে থাকি, রুমে এসো, কথা হবে ।’

গল্পে গল্পে নিজাম উদ্দিন জানতে পারলো, ছেলেটির নাম রাজু । রাজুর বাবা সাখওয়াত হোসেন পেশায় বাংলাদেশে ব্যাংকার ছিলেন। এখানে তেমন সুবিধা করতে না পারায় প্রায়ই স্ত্রীর সাথে ঝগড়া/বিবাদে লিপ্ত হতেন। রাজুর জন্ম এখানে হলেও পরিষ্কার বাংলায় কথা বলতে পারে। রাজুর জন্মের পর ভাষা শিখতে অনেক সময় নিয়েছিল। পড়ে ডাক্তারি টেষ্টে ধরা পড়ে রাজুর এসপার্জার (Asperger) রোগ হয়েছে। এটি এক ধরণের অটিজম রোগ। এই ধরণের রুগীদের কমুনিকেশন স্কিল তেমন সুবিধার হয় না, তাই এঁরা কিছুটা অসামাজিক হয়ে বেড়ে উঠে। এদের বন্ধু /বান্ধব থাকে না বললেই চলে। সামান্য কারণেই রেগে যায়, তেমন হেসেও উঠে। ছোটবেলা থেকে উপযুক্ত ঔষুধের পাশাপাশি সোস্যাল স্কিলস, আচরণের উপর কিছু ট্রেনিং ও প্যারেন্টদেরকে সচেতন করার মধ্যদিয়ে এই ধরণের রোগীকে স্টেবল রাখা সম্ভব। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এঁরা পড়াশুনা শেষে চাকরি বাকরি করেও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। কিন্তু, ব্যাচারা রাজুর ক্ষেত্রে অবশ্য এসব ঘটেনি। রাজু প্রায়ই সহপাঠীদের সাথে স্কুলে মারামারিতে জড়িয়ে পড়তো। ভাইস প্রিন্সিপ্যাল স্যার প্রায়ই রাজুর বাবা/মাকে ডেকে নিয়ে এসে রাজুকে নিয়ে আলোচনা করতেন। বাসায় এসে এসব নিয়েও অশান্তি হতো । একদিন সকালে ঘুম ভেঙে রাজু দেখে তার বাসায় মা কান্নাকাটি করে পুলিশের সাথে কথা বলছে। রাজু শুনতে পেলো তার বাবা ব্যালকনি থেকে লাফিয়ে পরে আত্মহত্যা করেছে। পরে, রাজু জানতে পারে বাবা যখন বারান্দায় সিগারেট খাচ্ছিলেন , তার মা তাকে ধাক্কা মেরে আঠারো তালার নিচে ফেলে দেয়। তার মা এখন হাজতে। কানাডাতে রাজুদের আর কোনো আত্মীয় ছিল না। বাবার এক বন্ধুর কল্যানে রাজুকে একটি ইয়ুথ সেল্টারে রাখা হলো। শুরু হলো রাজুর হোমলেসের জীবনযাত্রা।

রাজু রুম থেকে চলে যাবার পরেও নিজাম উদ্দিন চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার সাথে এযাবৎকাল দেখা হওয়া ভাগ্যহীন মানুষদের কথা ভাবতে থাকে। তাঁর ভাগ্যহীনদের তালিকায় যে সমস্ত মানুষ রয়েছে সর্বাগ্রে সে নিজেকে রাখে, তাঁর পরে কাকে রাখা যায় তা নিয়ে কিছুটা দ্বিধার মধ্যে পরে যায় নিজাম উদ্দিন। একবার মনে হয় গতবছর দেখা টরেন্টো ডাউন টাউনের ‘জনের’ কথা, আরেক মুহূর্তে মনে হয় এই কিছুক্ষন আগে দেখা হওয়া রাজুর কথা। আবার নিজাম উদ্দিনের কিছু মূহর্তের জন্য এখানে অল্প সময়ের জন্য পরিচিত হওয়া হ্যাডলির কথাও মনে হয়, আহা! বেচারার বৌ ছেলেপেলে থেকেও নেই, অনেকটাই নিজাম উদ্দিনের নিজের মতো। ঘুরে ফিরে নিজাম উদ্দিনের সাথে কেন যেন কেবল ভাগ্যহীন মানুষদেরই বন্ধুত্ব ঘটে !

বেলা এগারোটার মতো বাজে। নিজাম উদ্দিন ঝটপট রেডি হয়ে মেইন ফ্লোরে অফিস ঘরের দিকে এগুতে থেকে। অফিসের এক স্টাফ মেয়ের সাথে নিজাম উদ্দিনের এপয়েন্টমেন্ট। আজেকের এপয়েন্টমেন্টের বিষয় বস্তু হলো নিজাম উদ্দিনের লক্ষ্য বা গোলস এর অগ্রগতি নিয়ে আলাপ করা । এখানকার স্টাফরা একেকটি রেসিডেন্টের সাথে বসে স্বল্পমেয়াদি গোল ঠিক করে প্রতি সপ্তাহে সেসব গোলস নিয়ে আলোচনা করে থাকেন । নিজাম উদ্দিনের তিনটি প্রধান গোলস হলো, আগামী এক মাসের মধ্যে ডেনটিস্ট ঠিক করে দাঁত দেখানো, প্রত্যেক সপ্তাহে এডিকশন কাউন্সেলরের সাথে দেখা করা, আগামী ছয় মাসের মধ্যে নিয়মিত গোসল, দাঁত মজা, ঘর/দোর পরিষ্কার প্রভৃতি বিষয়ে নিজেকে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলা। নিজাম উদ্দিনের এসব নিয়ম কানুন দম বন্ধ হয়ে আসে। এরই মাঝে মেয়ে নাজমা গত সপ্তাহে ঝড়ের মতো এটা সেটা খাবার ও একটি নতুন সেল ফোন নিয়ে বাবার সাথে দেখা করতে এসেছিলো। নাজমার এভাবে হুট হাট করে এখানে আসা, তার উপর আবার ফোনে বেঁধে রাখা সব কিছু নিজাম উদ্দিনের তেমন পছন্দ হয় না। তাই, মাঝে মাঝে মনে হয় এসব ফেলে দিয়ে পালিয়ে যেয়ে আগের মতো সেই ফিঞ্চ ও ৪০১ হাই ওয়ের ওখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাড়ির সামনে যেয়ে যদি আগের মতো ভিক্ষা করতে পারতো, সেটাই ভালো হতো । স্বাধীন ভাবে জীবন-যাপন করার মজাই আলাদা!!

ডাইনিং এরিয়া পাশ কাটিয়ে অফিস ঘরের দিকে এগুতেই নিজাম উদ্দিনের কানে হট্টগোলের আওয়াজ এলো। নিজাম উদ্দিন ওদিকটায় উঁকি দিতেই দেখতে পেলো হ্যাডলি ও স্টিফেনের মধ্যে ভয়ানক ধরণের ঝগড়া চলছে। দুই জনই একেবারে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে প্রায় হাতাহাতির মতো অবস্থা। পাশেই ২/৩ জন রেসিডেন্ট নির্বিকারভাবে টিভি দেখছে, যেন এরকম ঝগড়াঝাটি এখানে স্বাভাবিক ব্যাপার। নিজাম উদ্দিন পরে জানতে পারে আজকের এদের দুজনের ঝগড়ার বিষয় হলো এরকম: হ্যাডলি তার নিজের ক্যান ওপেনার দিয়ে কিচেনের তাকে থেকে টুনা ফিসের একটি ক্যান ওপেন করছিলো। স্টিফেনের ধারণা হ্যাডলি যে ক্যান ওপেনারটি ব্যাবহার করছিল সেটি তাঁর। এই নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড। পরে, স্টাফ মেয়েটি স্টিফেনকে তার রুমে নিয়ে দেখে তার ক্যান ওপেনার তার রুমেই আছে। কত তুচ্ছ ব্যাপারেই না এই মানুষগুলি নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয় ! নিজাম উদ্দিন মনে মনে ভাবে রাজু ছেলেটি নতুন এসেছে, ওকে এখানকার চালচলন ভালো করে বুঝিয়ে বলতে হবে।

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি চলছে। বাংলাদেশের উত্তর বঙ্গের মতো এখানেও টরেন্ট থেকে উত্তর সাইডে তুলনামূলক বেশি ঠান্ডা পরে। নিজাম উদ্দিন মেয়ের কিনে দেয়া হুডি টাইপের ভারী জ্যাকেট গায়ে দিয়ে বিল্ডিং এর সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কফি কাপ হাতে নিয়ে সিগারেট টানতে থাকে । মেয়ের কথা ভাবতে না ভাবতেই মেয়ের ফোন বেজে উঠে:
-‘ বাবা, তোমার আজকের স্টাফের সাথে মিটিং কেমন হলো?’
-‘ ভালো হয়েছে মা। আমার ডেন্টিস্ট জোগাড় হয়েছে। এই ডেন্টিস্ট ও ডি এস পি (অন্টারিও ডিসেবিলিটি সাপোর্ট প্রোগ্রাম ) পেসেন্ট নিয়ে থাকে। আমার উপরের পাটির ডান দিকের দুটি দাঁত ওঁরা বিনা পয়সায় ফিলিং করে দেবে।’
– ‘বাবা, তোমার সাথে জরুরি কথা আছে, এ জন্যেই আসলে ফোন দিয়েছি।’
-গতরাতে একরাম আঙ্কেল ফোন দিয়েছিলো , মা’র কোভিড পজিটিভ ধরা পড়েছে। মা কে একটি হাসপাতালের আই সি ইউ -তে রাখা হয়েছে। মা-র লাঞ্চের অবস্থা তেমন ভালো না।’

মুহূর্তেই নিজাম উদ্দিনের মুখ ভয়ে, আতঙ্কে শুকিয়ে গেলো । তাড়াহুড়া করে মেয়ের ফোন রেখে দিয়ে কিছুটা হতবম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিজাম উদ্দিন । রুপা তাকে ফেলে তাঁর বাল্য বন্ধু একরামের হাত ধরে অনেক বছর আগে পালিয়েছে। এ কথা ঠিক, রুপার উপর তার অনেক অনেক রাগ, অভিমান রোয়েছে, তারপরেও রুপার কোভিড পজিটিভ নিজাম উদ্দিনকে বেশ ভাবিয়ে তোলে। রুপা যে হাসপাতালে আছে সে হাসপালের ঠিকানা মেয়ের কাছ থেকে নেয়া হয়নি, তা ছাড়া নিয়েও বা লাভকি, ওঁরা তো নিজাম উদ্দিনকে আই সি ইউ -তে রাখা রুপার কাছে ঘেঁষতে দিবে না। সকাল থেকেই ঝকঝকে তকতকে রোদ উঠেছে। তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি হলেও গত রাতের তুষারপাতের কারণে বিল্ডিং এর সামনে ঘাসের উপর জমে থাকা সাদা সাদা তুষারগুলি গলতে শুরু করেছে। বিল্ডিং এর বাম দিকে ঝোপের ভিতর থেকে একটি কুচকুচে কালো বর্ণের কাঠ বিড়ালি তুষারের মধ্যে লুটোপুটি খাচ্ছে। তুষার নিয়ে শুধু যে মানব সম্প্রদায়ই মজা করবে, তুষারের উপর স্কেটিং করবে, তুষারের বল বানিয়ে এর ওর গায়ে ঢিল মেরে ঢলা ঢলি করবে, তাই কি হয়, এই পৃথিবীর উপর সবার যেমন অধিকার আছে কাঠবিড়ালিরও অধিকার আছে। এসব ভেবে ভেবে সিগারেটে লম্বা টান দিতে দিতে নিজাম উদ্দিন আবার তার আগের স্মৃতির সাগরে ডুবে গেলো । সিজিওফ্রেনিয়া রোগের হেলুসিনেশন উপসর্গের এই এক সুবিধা। ইচ্ছা করলেই যে কোনো সময়ের যে কোনো ঘটনায় ডুবে যাওয়া যায়।

কক্সবাজারে সন্ধ্যার দিকে পৌঁছে হোটেলে কোনোরকমে ঢুকতে না ঢুকতেই রুপা সমুদ্রের কাছে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিতে থাকে। নিজাম উদ্দিন রুপাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে শাওয়ার নিয়ে রাতের খাবার খেয়ে হেটে হেটে সমুদ্রের পারে দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। রুপার যেন আনন্দের সীমা নেই। জীবনের প্রথম সমুদ্র দেখতে এসেছে। বিশাল বিশাল ঢেউগুলো পাড়ে আছড়ে পড়ছে । আকাশের ডান দিক উজাড় করে প্রকান্ড চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় নীল পানিতে ঢেউগুলি মুক্তারমতো জ্বলছে। নিজাম উদ্দিনকে সম্পূর্ণ অবাক করে রুপা রিনরিনে চমৎকার গলায় রবীন্দ্র সংগীত ধরেছে:

তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে টুকরো করে কাছি,
ডুবতে রাজি আছি, আমি ডুবতে রাজি আছি॥
সকাল আমার গেল মিছে, বিকেল যে যায় তারি পিছে গো,
রেখো না আর, বেঁধো না আর কুলের কাছাকাছি॥

মাঝির লাগি আছি জাগি সকল রাত্রিবেলা,
ঢেউগুলো যে আমায় নিয়ে করে কেবল খেলা।
ঝড়কে আমি করব মিতে, ডরব না তার ভ্রুকুটিতে
দাও ছেড়ে দাও, ওগো, আমি তুফান পেলে বাঁচি॥

নিজাম উদ্দিন তাড়াতাড়ি করে সেল ফোনের জন্য পকেটে হাত দিলো । ফোনে মেয়েটির গানটি ভিডিও করা যেত। কিন্তু বিধি বাম। নিজাম উদ্দিন হোটেল রুমে ফোন রেখে এসেছে। রুপাকে একা ফেলে যাওয়া ঠিক হবে না আমতা আমতা করতে থাকে। এমনি গত রাতে স্টিমার ঘাটে ঝামেলা হয়েছিল, তাই এবার আর কোনো রিস্ক না নিয়ে দুইজন মিলেই এক সাথে হোটেলে যেয়ে দ্রুত সেলফোন নিয়ে এলো। আসে পাশে ছোট ছোট জটলা করে কিছু পরিবার ওদের মতো রাতের সমুদ্রের বিরল দৃশ্য দেখতে এসেছে । একটি ন্যাংটো বাচ্চা ছেলে পানিতে নামার জন্য চিৎকার করে কাঁদছে। মা কিছুতেই, এই রাতে এতটুকু ছেলেকে পানিতে নামতে দিবে না । নাছোড়বান্দা ছেলের মনের আশা পূরণ করার জন্যে বাবা তাকে পাঁজকোলা করে সমুদ্রের পানিতে যেই না পা ডুবিয়ে বসেছে, অমনি এবার ভয় পেয়ে বাচ্চা ছেলেটি চিৎকার করে মা কে ডাকছে । ছেলেটি এত ভয় পেয়েছে যে বাবার কোল থেকে সজোরে হিসি করে দিচ্ছে। ছেলেটি বাবার কোলে চিৎ হয়ে থাকায় বৃত্তাকারে হিসির পানি বাবার চোখ মুখ ছাপিয়ে সমুদ্রে পানিতে পড়ছে। আসে পাশের অনেকেই মজা দেখছে । কিন্তু, নিজাম উদ্দিনের খানিকটা মন খারাপ হলো। সমুদ্র, পাহাড়, চাঁদ এঁরা মানুষকে মনোরঞ্জন দেয়, মানুষের মন ভালো করে দেয়, এদের অপমান সহ্য করা যায় না।

ওদিকে রুপা সমুদ্রপাড়ের আরেক দিকে পানিতে পা ডুবিয়ে বাচ্চা মেয়ের মতো মনের আনন্দে হাত তালি দিয়ে চিৎকার করে নিজাম উদ্দিনকে কাছে ডাকছে । নিজাম উদ্দিন অনায়াসেই রুপার কাছে যেতে পারে, কিন্তু নিজাম উদ্দিন ইচ্ছা করেই যাচ্ছেনা। নিজাম উদ্দিনের মধ্যে অদ্ভুৎ এক ছেলেমানুষি ভর করেছে। এই চাঁদনী রাতে নীল সমুদ্রের পাশে রুপার হাসিমাখা মুখ খানিকটা দূরত্ব থেকে দেখার লোভ কিছুতেই সংবরণ করতে পাচ্ছে না। রুপার হাসি মাখা সেই মুখ দেখে সমুদ্র দেখার ওর মনের আশা পূরণ করতে পেরেছে ভেবে এই মুহূর্তে নিজাম উদ্দিনকে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুখী স্বামী মনে হচ্ছে।

নিজাম উদ্দিনের সেই উথাল পাতাল সুখ মাটি করে দিয়ে বারান্দা থেকে স্টাফ মেয়েটি চিৎকার করে নিজাম উদ্দিনকে দুপুরের ঔষুধ খাবার তাড়না দিলো। নিজাম উদ্দিন আবার সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ধীর পায়ে বিল্ডিং এর ভিতরের দিকে পা বাড়াতে যেয়ে রুপার জন্য বেশ মায়া হয় নিজাম উদ্দিনের। কেমন যেন একটি কষ্ট দলা পেকে ভিতর থেকে বেয়ে বেয়ে উপরে উঠার চেষ্টা করতে থাকে । বুক ভোরে নিশ্বাসঃ নিয়ে নিজম উদ্দিন ভাবতে থাকে, হাসপাতালের আই সি ইউ -তে থাকা রুপা এই নিশ্বাসঃ নিতে কতই না কষ্ট পাচ্ছে!! মুহূর্তেই নিজাম উদ্দিন কিছুটা বেপরোয়া হয়ে উঠে, ঔষুধ না খেলে কেমন হয়!! হেলুসিনেশনের উপসর্গগুলি আরো বেড়ে উঠুক। চুলোয় যাক তাঁর হাউজিং। রুপা বিহীন এ জীবনে আবার সে রাস্তাও ফিরে যাবে । তাঁর হোমলেস জীবনই ঢের ভালো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করার অবসরে ইচ্ছামতো রুপাকে নিয়ে ভেবে ভেবে চমৎকার সময় কাটানো যাবে। কিন্তু, পরক্ষনেই নিজাম উদ্দিন আবার ভাবে, মেয়ের জন্য, ছেলের জন্য এমনকি রুপার সাথে মধুর মধুর স্মৃতি রোমন্থনের জন্য হলেও তাঁকে এই বিচিত্র সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হবে।

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মৃতি থেকে-পর্ব ২
পরবর্তী নিবন্ধচলন্ত পোষ্টার
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন