৮৪ সাল আমাদের বাসায় ক্যাসেট এসেছে একদিন একটা গান শুনছিলাম শচীন দেব বর্মনের, পাশে আমার মেজো খালা বসে, যিনি নিঃসন্তান ছিলেন। তাকিয়ে দেখি আমার খালার গাল বেয়ে পানি পরছে তার, চোখ মুছছেন। আমার মায়েরা চার বোন, আমার মা সবার ছোট। সেজ খালা আর আমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল মামাদের বাড়ীর কাছেই। উত্তরে একজন দক্ষিনে একজন। দূরত্ব ৫/১০ মিনিটের। আমার বড় খালার বিয়ে হয়েছিল বেলগাছী আর মেজো খালার সাদীপুর, চরভদ্রাসন থেকে অনেক দূরে। এই দুজন বছরে একবার আসতেন বাবার বাড়ী।
যদিও আমার মায়ের বিয়ের পরে আব্বার বদলীর চাকুরীর সুবাদে ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়েছে। আমরা বড় হবার পরে কিছু দিন বাড়ীতে ছিলাম আমরা। আমরা মামা বাড়ী প্রতি সপ্তাহে যেতাম। আমার বড় মামাকে দেখতাম বাড়ীর গাছের কলা, বেল, নারিকেল, আম বা ভালো কিছু রান্না হলেই এই দু’বনের বাড়ীতে নিয়ে হাজির। অনেক আদরের ছোট বোনেরা তাদের না দেখে থাকতে পারতেন না। আমার মা, সেজো খালাকে ও দেখতাম ভাইয়েরা এলে কি খুশী চোখে মুখে,আমার মিয়া ভাই, ছোট ভাই আসছে। আমার মেজো খালা আর বড় খালার তো সে উপায় ছিল না।
১২ বছরে বড় খালার আর ১০ বছরে মেজো খালার বিয়ে দিয়ে দূর দেশে পাঠিয়ে দেন ( যদিও একই জেলায়)। মেজো খালাকে যেদিন শ্বশুর বাড়ী পাঠান সেদিন তার বড় চাচীকে সাথে আসতে হয়েছে কান্নার চোটে। ঘুম থেকে উঠে দেখেন চাচী চলে গেছেন, আমার খালা সেই কথা মনে করে চাচীর জন্য সারাজীবন কাদছেন। আর বড় খালা ভাইয়ের বাড়ীতে আসার অপেক্ষায় থাকতেন ভাইয়েরা আনতে যাবে বছরে একবার। আহা সেই বাপের বাড়ীতে পা দিয়েই বুকের ছাতি ফুলে উঠত। কি খুশী সব ভাইবোনের, তার চাচাতো বোনেরা আসলেতো কথাই নেই। বড় খালা নাকি চরের দিকে তাকিয়ে থাকতেন চেনা কেউ আসে নাকি বাপের দেশের। তাদের যত্ন করে খাওয়াতেন মনে হতো বাপের বাড়ীর রক্তের কেউ। কেরাই নৌকায় নাইওরী যেতে দেখেলে তাকিয়ে থাকতেন আহারে কত আনন্দ নিয়ে বাপের বাড়ী যায় কেউ।
আমার ফুপুদের দেখেছি, খালাদের দেখেছি ভাইয়ের পাতে বড় মাছ,বড় মাংসের টুকরা টা দিয়ে কি আনন্দ চোখে মুখে। আব্বা লজ্জা পেয়ে বলতেন, কি করো বু, ভাইসাবরেও দে। আমার ফুপুর কথা, তারে সব সময় খাওয়াই তুমি আমার ভাই নিত্যিদিন আসোনি, আমি যা দেই খাও আমি দেখি। যদিও তারা পিঠাপিঠি ভাইবোন ছিলেন তারা, আমার ফুপা হাসতেন। আমার আব্বা সব সময় বলতেন আমি যখন না থাকি তোমার ফুপুর যেন অমর্যাদা না হয়, আমার মাত্র একটা বোন আছে এই দুনিয়ায় ১২ ভাইবোনের। ফুপু এখনো সারাদিন তার ভাইয়ের জন্য কাদে আমার ছোট ভাই কোথায় গেল!
আমার চাচাতো বোনেরা শ্বশুর বাড়ী থেকে আসলে বাড়ীতে চাদেঁর হাট বসতো। আমার নয়া কাকার তিন মেয়ে নিয়ে চাচী ২০ বছরে বিধবা হয়েছিলেন, চাচী তাকিয়ে থাকতেন তার ভাইয়েরা আসবে,সেই মামারা আসলে চাচীর কি আনন্দ সে বাপের বাড়ী যাচ্ছে। আমরা আবার আনতে যেতাম চাচাত বোনদের তাদের শ্বশুর বাড়ী। গ্রামের শুরুতে পারা দিতেই আসে পাশের বউ ঝিয়েরা বের হতো দেখার জন্য তাদের মাথার কাপড় নেমে যেত, এইতো বাবার বাড়ী এখানে সব স্বাধীন। নৌকায় ঘুরা, শাক তুলতে যাওয়া, রাত জেগে সবাই গল্প করা। বাবা, ভাইয়ের বাড়ী নিজের নাড়ী পোতা মাটি, আহা সেই মাটি যে আমার একান্ত নিজের। আমার মেজো চাচী শেষ বয়সে সব ভুলে গিয়েছিলেন ( আইজাইমার), সারাদিন গাছের নীচে বসে থাকতেন,বাড়ীর পোলাপান তাকে জিজ্ঞেস করতো, দাদী কি করেন, চাচীর উত্তর আমার ভাইয়ের আসা দেখি। সব ভুলে গেলেও তার বাবার নাম, ভাইদের আর ভাতিজার নাম ভুলেন নাই মৃত্যু পর্যন্ত।
দশ বারো বছরের সেই বালিকা বধুর যেমন ভাইয়ের বাড়ী, বাপের বাড়ীর জন্য হ্নদয়ের রক্ত ক্ষরণ হতো অনেক বেশী, এখনো হয় বোনেদের,ভাইকে তার পছন্দের খাবারটা খাওয়ানো, ভায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া,ভাইয়ের আসার পথে তাকিয়ে থাকা।
কয়েকদিন ধরেই আমার সেই প্রিয়জনদের কথা, মায়ের কথা, আমাদের পুরানো বাড়ির কথা খুব মনে পরছে। একটা গানের কথা বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে যাচ্ছে ” কে যাসরে ভাটির গাঙ বাইয়া, আমার ভাইধনরে কইও নাইওর নিতে আইয়া” তোরা কে যাস কে যাসরে।