টাইম কলের সামনে কে আগে কলসী রেখে আসছিল আর সুযোগ পেয়ে কে সেটা সরিয়েছে সেই ঝগড়াটা প্রায় প্রতিদিন সকালে উঠেই শুনতাম। আমাদের বাসার রাস্তার কোনায় ছিল সেই টাইম কল। কারো গল্প বাজার করার, মাছ ধরার, বিচার আচার, রিক্সা যাবার টুংটাং শব্দ, আজকালকার পোলাপান কত বেয়ারা, উঠতি রোমিওদের দাত মাজা শেষ না হওয়া আর ততক্ষনে পুরো এলাকা জেগে উঠেছে। এটা ছিল নিত্যকার জীবনের চালচিত্র।

আমাদের স্কুল শুরু হতো ১১ টা থেকে তার আগে খুব সকালে রাতের রান্না বাসি ভাত খেয়েই চলে যেতাম প্রদীপ স্যারের বাসায় অংক করতে( বার্ষিক পরীক্ষার আগে) অবশ্যই এই ৫ মিনিটের পথ যেতে আধাঘন্টার মতো লাগতো। অন্য বান্ধবীদের জন্য অপেক্ষা আর যেতে যেতে পুরো এলাকার কার সাথে কার মনোজগতের খেলা চলছে জেনে নেয়া। প্রদীপ স্যারের কাছে আমরা যারা পড়েছি সবাই জানি শিক্ষক ও মানুষ হিসেবে উনি ছিলেন অসাধারণ। সবার খুব কাছের বন্ধুর মতো, ছেলে মেয়েরা লাইনচ্যূত হলেই স্যার বলতেন মন দিয়ে অংক কর।

এলাকার কোন মুরুব্বীকে দেখলেই সবাই একেবারে ভদ্র হয়ে যেত। কারণ ছিল এই নালিশ বাড়ীতে যাবেই, ছেলেদের বিড়ি খাওয়ার পার্টনারশিপ ছিল অতি কঠিন। হাত ঘুরে সেই বিড়ি চলে যেত একেবারে পিছনের জনের হাতে। সারা পাড়ায় সবাইকেই যেন চেনা লাগতো। সে রিক্সা চালকই হোক বা এলাকার নেতা ভাই, সবাই এক জায়গায় একাত্মা।

বাসায় এসে আর পড়া নাই, বাসার গাছের তেতুল, নাড়ু এটা সেটা নিয়ে স্কুলে যাবার প্রস্তুতি। কারো বাড়ীতে তখন গেট দেয়া হতো না দিনের বেলায়। অনেকের বাড়ীতে টিনের শিকল দেয়া দরজা ছিল বা অনেকের বাড়ীতে শুধু পাটখড়ি দিয়ে সীমানায় বেড়া। টিনের গেট সেই ফজরে খোলা হতো আর বন্ধ হতো ঘুমের আগে। এর মধ্যে আব্বার আফিসে যাবার প্রস্তুতি। নাস্তা ছিল হয় আটার রুটি, চা, ভাজি বা জাউভাত ভর্তা অথবা খিচুড়ি ।

বাসায় সব সময় আত্নীয় স্বজনরা থাকার কারনে আব্বাকে বাজারে যেতে হতো না। বাজার থেকে টাটকা মাছ আর সব্জি আনা হলেই আনন্দ ধরতো না ময়না মা চাচীর। কি দিয়ে মাছ রান্না করবে চাচী মাকে বলে দিতেন। টিনের চালের রান্না ঘর অনেকটা অংশ ই খোলা। মোরা নিয়ে বসে, দাড়িয়ে আশে পাশের কাকী, খালাম্মাদের গল্প। তাদেরও রান্নার তাড়া আছে, কারো বাড়ীতে ইলিশ বা কারো বাড়ীতে পুটিমাছ আনা হয়েছে সেই দিন। কিন্তু এই পুটি আর ইলিশের মধ্যে কোন বিভেদ ছিল না, ছিল না প্রতিযোগিতা। পাশের বাড়ীর মুরুব্বীর জন্য দুই টুকরো মাছ দিয়ে মা, চাচীরা ঠিকই তরকারী পাঠিয়ে দিতেন।

আবার বিকেলে পাশের বাড়ীর মা, চাচীদের এক সাথে হওয়া। বিকেলের চা আর পান খাওয়া। আর আমরা বিকেলে বাড়ীতেই নাই। পাশেই রেল রাস্তা, সেখান দাড়ালে একেবারে ৩/৪ কিলোমিটারের সব দেখা যেত। রাস্তার দুই ধারে দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ। একেবারে চরকমলাপুর পর্যন্ত দেখা যেত। সব বান্ধবীরা মিলতাম দারোগা বাড়ীর ভিটায়। সামনে বিশাল পুকুর, ভিটায় বড় বড় সফেদা গাছ। একেবারে রেললাইনের ধারে। আশে পাশেই এলাকার ছেলেদের আড্ডা। আমাদের বাসার সামনের মাঠেই ছিল ক্রিকেট খেলার আয়োজন। বিকেলের প্রথম আলোতেই তাদের আগমন।

কত যে বার মনে পরে সেই দিনের কথা। সব বন্ধুরা মিলে কালিখোলা, হরিসভায় পূজা দেখা, বায়তুলামানের মেহগনির রাস্তা দিয়ে হেটে চলা। আরেকটু দুরে গেলেই পুরো খোলা আকাশ আর ফসলের মাঠ। গ্রামের মেয়েদের শ্বশুর বাড়ী যাওয়া আর মায়ের পথ চেয়ে দাড়িয়ে থাকা দেখতে পাওয়া।
টেপাখোলার বেদে প্ললীতে ঘুরা, বকুল ফুলের মালা গাথা, হিজল ফুল,রয়াল ফলের কালেকশনের প্রতিযোগিতা, কিভাবে যে চলে যেত দিন!

মফস্বল শহরে বড় হওয়ার একটা বড় এডভান্টেজ ছিল। এক দিকে প্রকৃতির স্নিগ্ধতার সাথে, দূরন্ত শৈশব, কৈশর আর যৌবনের চিরচেনা চোরগলিতে হেটে বেড়ে ওঠা।
দূরে কোথাও দূরে দূরে আমার মন বেড়ায় শুধু ঘুরে ঘুরে……..।

 

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন