(ভ্রমণ কাহিনী)   

মিরপুর ১, ঢাকা   থেকে সদর ঘাট গিয়ে বরাবরের মতো লঞ্চে-  নদীর দুই পাড়ে   গ্রামের দৃশ্য দেখতে দেখতে চাঁদপুর যাবো; রাতে চাঁদপুর আত্মীয় বাড়ি থাকবো, এই আমার পরিকল্পনা।   আমার এক আত্মীয় বলেন, দিনের একটা বাজে, রাস্তার এই যানজটের মধ্যে   আপনি একা একা সদরঘাট যেতে পারবেন তো ? আমি বললাম, কি যে বলেন ? আমার জীবনের একটা বড়ো অংশ তো ঢাকা শহরেই কাটিয়েছি। সে বলে,  সে তো বহুদিন আগের কথা ,তখনকার ঢাকা শহর এবং আজকের ঢাকা শহর তো এক নয়। আমি বললাম,  ১৯৬৫ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত আমি তো ঢাকা শহরেই থাকতাম; পড়াশুনা শেষ করে  কাজ করতাম মতিঝিল; ঢাকা শহরে হাঁটতে ভালো লাগতো, তাছাড়া অধিকাংশ সময় পকেট খালি থাকতো যে জন্য পায়ে হেঁটেই আসা-যাওয়া করতাম। বিকেলে অফিস করে  হাঁটতে হাঁটতে রমনা পার্কের দিকে আসলেই জোড়ায় জোড়ায় কলেজ,  উনিভার্সিটির  ছেলে-মেয়েদের নজরে পড়তো; কেউবা পড়াশুনা নিয়ে আলাপ আলোচনা  করছে, কেউবা গল্প, প্রেমালাপ; ফেরিওয়ালার কাছ থেকে বাদাম নিয়ে খোসা ফেলছে; সে সময় রেসকোর্স ছিল ফাঁকা,এত এত গাছপালা ছিল না, বিকেলে ঘোড় দৌড়,  শাহবাগের মোড়ে  সন্ধ্যা হলেই গাঁজার আড্ডা বসতো। দুই দিকে দৃশ্য দেখতে দেখতে রেসকোর্স পার হয়ে TSC তে গিয়ে খোঁজ নিতাম, কোনো প্রোগ্রাম   থাকলে ভিতরে ঢুকে পড়তাম; নতুবা লাইব্রেরিতে গিয়ে বই নিয়ে নাড়াচাড়া করতাম, এক ফাঁকে বের হয়ে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কিছু নিয়ে খেয়ে নিতাম ।           

সে পুনরায়  বলে ১৯৬৫ -১৯৮২ আর বর্তমান ঢাকা শহর তো এক না।  তা ঠিকই বলছেন ।   চলেন আপনাকে একটা CNG ভাড়া করে দেই; মিরপুর -১ রাস্তার পাশে গিয়ে দুইজনে দাঁড়ালাম।  রাস্তায়  এত ভিড় যে কোনো খালি CNG পাওয়া যাচ্ছে না। ইতিপূর্বে  উবার কল দিয়ে ও ব্যর্থ  হয়েছি ,  এক ঘন্টার মতো অপেক্ষা করে একটা CNG পাওয়া গেলো, ওনাকে বিদায় দিয়ে CNG তে    উঠে বসলাম।    দুপুরের দিকে রাস্তা এত ভিড়; রাস্তায় গাড়ি, বাস, রিক্সা পিঁপড়ার মতো গতিতে থেমে থেমে চলছে।  মিরপুর -১ থেকে শ্যামলী পর্যন্ত আসতেই এক ঘন্টার মতো লেগেছে যা পায়ে হেঁটে ৩০-৪০ মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা না ।  ড্রাইভার একটু ফাঁক পেলেই দুই গাড়ির মাঝখানে বা এঁকেবেঁকে এগুতে চেষ্টা করে।  আমি বলি তুমি যেভাবে চালাচ্ছো, এতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।  সে বলে,” একটু ঝুঁকি না নিলে তো আমি সারা দিনেও সদরঘাট যেতে পারবো না। ” আমি চুপ করে থাকলাম ; সে ফাঁকফুক খুঁজে busy  রাস্তা থেকে শ্যামলীর ভিতর সরু  রাস্তা  দিয়ে কোথায় যাচ্ছে ? দু/একবার জিজ্ঞেস করলাম, তুমি রাস্তা চিনো কি ? সে কিছুই বলছে না।  আমি ধর্য্য ধরে চুপ করে থাকা ব্যতীত আর কি করতে পারি ? এলাকার ভিতরের রাস্তা ও এত busy যে কোনো ক্রমেই এগুতে পারছে না। সে একটু  রাস্তার ভিড় দেখে ডানে-বামে একে-বেঁকে এগুচ্ছে  ।  

এক মহিলা তার স্কুলের বাচ্চা নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে ; ড্রাইভার যেভাবে বেপরোয়া চালাচ্ছে, অল্পের জন্য মহিলা ও তার বাচ্চা বেঁচে গেছে এবং রাস্তার  লোকজন মারমূখী হয়ে CNG ঘেরাও দিয়েছে ।  আমি অগত্যা নেমে অনুরোধ করে ওদের থামিয়ে দিয়ে বলি “তুমি সাবধানে চালাবে; তুমিতো আমাকেও বিপদে ফেলেছিলে। ” CNG কোত্থেকে  কোথায়, কিভাবে যাচ্ছে ,আমি অধর্য্য হয়েই বা কি করতে পারি।  এখানকার রাস্তাঘাট আমি কিছুই চিনি না , এক পর্যায়ে  ৩২ নম্বর ধানমন্ডি, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে দেখে আমি কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। সে ধানমন্ডি, কলাবাগান, এলিফ্যান্ট রোড পার হয়ে সেগুন বাগিচা, আব্দুল গনি রোড ধরে নবাবপুর হয়ে সদর ঘাট টার্মিনালে বিকেল ৫টা বাজে আমাকে  পৌছিয়ে বলে এবার  নামেন।  আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, বললাম , তোমাকে ধন্যবাদ জানাই, তবে সাবধানে গাড়ি চালাবে।   

মনে মনে ভাবছি,বৃহত্তর ঢাকা শহরের লোক সংখ্যা কাগজে কলমে কত  ? তবে লোকমুখে শুনা যায় দুই কোটি বা তার ও বেশি । কাজেই সে অনুপাতে ব্যবসাবাণিজ্য এবং  যানবাহন বেড়েছে। রাস্তায় গেলে  দামি দামি গাড়ি নজরে পড়ে যা কানাডায় ও অনেকে ব্যবহার করতে স্বক্ষম না; ঢাকাতে আত্মীয়স্বজনের অনেকেই গাড়ি কিনতে আগ্রহী, প্রতিটি বিল্ডিং এর নিচে  গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।  সারা দেশে এই একটিমাত্র শহর যেখানে রোজগারের  জন্য  লোকের অত্যধিক ভিড়। 

২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি উচ্চ অর্থনৈতিক রাষ্ট্রের মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।  ঢাকা শহরে যে হারে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি  পেয়েছে ,তার সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন।  যে হারে দেশের দূরদূরান্ত থেকে  লোকজন রোজগারের নিমিত্তে এখানে এসে ভিড় জমিয়েছে,তার সমাধান কি ? 

ক ) ঢাকা  থেকে শিল্প,অফিস আদালত বিকেন্দ্রীকরণ  করা হলে  এখানকার যানজট হ্রাস পেতে পারে। খ)  দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিল্প নগরী গড়ে তুলা যেতে পারে।  গ) উপজেলা শহরগুলিকে শিল্পে, কারিগরি শিক্ষায় এগিয়ে  নেয়া হলে, গ্রামাঞ্চলগুলি নুতন প্রাণ পাবে; এবং লোকজনের কর্মসংস্থান বাড়বে,   বড়ো বড়ো শহরগুলিতে জনসংখ্যার   চাপ হ্রাস পাবে ।    লক্ষ লক্ষ হতদরিদ্র লোক কাজের অন্নেষণে ঢাকা এসে ভিড় জমাচ্ছে ;কিছু না কিছু করে জীবিকার্জন করে বেঁচে আছে। এই জনগণের  দিকে তাকিয়ে বিকল্প কিছু বের করতে হবে;  ঢাকা বৃহত্তর শহরের সুন্দর পরবিবেশ ও ধরে রাখার দায়িত্ব সরকার এবং জনগণের উপর ।  

 গ্রামগঞ্জে আজকাল ফকির দেখা যায় না; ঢাকা শহরে সর্বত্রই ফকির নজরে পড়ে এবং লোকজন  দানখয়রাত আগের তুলনায় বেশি করে বলে ফকির গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে ভিড় জমিয়েছে।   প্রতি কয়েক মিনিটে একজন বা দুইজন  ফকির এসে দোকানের সামনে সাহায্যের জন্য হাত বাড়ায় । 

বাংলাদেশে তো সব সময় গরিব ফকির ছিল বা এখনো ও আছে ; এই সুদূর কানাডাতে ও  ফকির দেখা যায়; বড়ো বড়ো রাস্তাগুলির মোড়ে,শপিং মলের গেটে, রেল স্টেশনে ঢুকতে  এদের নজরে পড়ে ;  আমাদের দেশের ফকিরের সঙ্গে এদের পার্থক্য রয়েছে।  এ দেশে ফকির (low income  person ) সরকার থেকে সোশ্যাল ভাতা পায়, তারপরে ও ভিক্ষা করে মদ,নেশা এবং সিগারেট কিনে।এরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রোজগার করে যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে থাকে,অনেকের সঙ্গে নিজস্ব কুকুর ও  থাকে।  

ঢাকা শহরে  রাতে শাহ আলী মাজার সংলগ্ন মাঠ ও সড়কে  ঢালাও বিছানা করে লোকজন  ঘুমায়। মাজারের সামনে মাঠে এবং সড়কের ফুটপাথে একজাতীয় লোক বালিশ ও কম্বল রাতের জন্য ৬০ টাকা করে ভাড়া নিয়ে  থাকে। যারা কম্বল-বালিশ ভাড়া নিয়ে থাকে,ওরা সারা দিন কাজ করে বা কোনো কাজে ঢাকা শহরে এসে রেস্টুরেন্টে খেয়ে ফুটপাথে ঘুমিয়ে পড়ে । মাজারের মাঠে রাতে কোনো খালি জায়গা দেখা যায় না  ; সবাই যার যা কিছু আছে মাথায় দিয়ে চাদর গায়ে দিয়ে রাতে ঘুমিয়ে পড়ে। 

অসংখ্য মহিলা ও খোলা মাঠে ঘুমায় ; এক ভোরে দুইটা ছোট্ট  নেংটা বাচ্চা তার মায়ের সঙ্গে নজরে পড়লো ; বাচ্চা দুইটা চিৎকার করে কাঁদতেছে, মহিলা জোরে থাপ্পড় মেরে কি যেন বলতেছে ; ওদের  এই অবস্থায় কান্না দেখে  পকেটে হাত দিয়ে যা পেলাম, বাচ্চাদের হাতে দিয়ে সরে পড়লাম। প্রায় প্রতিদিন আমি এই দৃশ্য দেখার জন্য মাজারের মাঠে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকতাম।  এ সব অসহায় মানুষের পরিবর্তন কবে হবে ?  মাজারে পুরুষ ও মহিলাদের  আলাদা আলাদা ঢুকার ব্যবস্থা রয়েছে ; এখানে পায়খানা -প্রস্রাবের বিশেষ ব্যবস্থা থাকায় রাতে লোকজনের মাঠে বা সড়কে পায়ে চলার পথে ঘুমায়।  তবে বৃষ্টি হলে ওদের বিশেষ অসুবিধা হয় , কে কার খবর রাখে ?   বৃহস্পতিবার  সারা রাত এখানে লোকজনের ভিড়  এবং মাজার জেয়ারত  করে ।    

মাজার সংলগ্ন বালুর মাঠ এরিয়াতে অনেক বিল্ডিং উঠতেছে; সারা রাত কাজ হয়, পাশে অনেক বস্তি;রিক্সাওয়ালা, কাজের বুয়া  বা অন্য পেশার লোক  অধিকাংশই পরিবার নিয়ে বস্তিতে ভাড়া করে থাকে।  অনেক পরিবার ৫-৭ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসিক ভাড়া দিয়ে থাকে।  কেউ কেউ নিজের পরিবার মাবাবা বা  শ্বশুর শাশুড়ি নিয়ে  থাকে। 

ভোরে এই মাজার সড়কে কিছু মহিলাকে দেখেছি ছোট্ট টুলে বসে  লোকদের মাথায় পানি দেয় এবং মনে মনে কি বলে ? তার পার্শে একটা পাত্রে  চুন,পানি  ও বোতলে ভেষজ ঔষধ  ।  জিজ্ঞেস করতেই বলে জন্ডিসের চিকিৎসা করি; আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম, এতে কি রোগ ভালো হয় ? বলে, ইনশাল্লাহ ভালো হয়।  বুঝলাম বনাজী ঔষধে হয়তো কাজ করে; নতুবা রোগী কেন আসবে?  

রাস্তার দুই পাশে ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট; ভোর হতেই ভিড় জমে নাস্তা খাবার জন্য।  অনেকে রুটি, হালুয়া,ভাজি নিয়ে বাসায় বা কাজে যায়।

এই মহল্লার বস্তিগুলিতে অনেক অনেক রিক্সার গেরেজ আছে : ভোর হলেই রাস্তায় রিক্সার ভিড়, ১০ মিনিট হাঁটার রাস্তা ৩০ টাকা ভাড়া, তার কমে কোনো রিক্সা পাওয়া যায় না।  একটা রিক্সাওয়ালা দৈনিক ৫০০-৭০০ টাকা রোজগার করে; মালিককে ভাড়া চুকিয়ে  দিয়ে বাকি টাকা নিয়ে বাসায় যায় এবং তার স্ত্রী বা ছেলেমেয়েরা ও বিভিন্ন বাসায় কাজ করে দৈনিক খাওয়া এবং মাসিক কয়েক হাজার টাকা নিয়ে   ঘরে ফিরে।  যত রিক্সাওয়ালা, জিজ্ঞেস করলে বলে বাড়ি ময়মনসিং,খুলনা,রাজশাহী বা অন্যান্য  জেলায়।  খেয়েদেয়ে ভালো আছে এবং কিছু বাড়িতে ও দিতে পারে।  

পপি নামে  ২৫-২৬ বৎসর বয়সী সদালাপী, এক মহিলা মিরপুর আমার আত্মীয়ের বাসায়  বুয়া হিসাবে কাজ করে; আমাদের সে যুগে কোনো কাজের ছেলে বা বুয়াকে বাড়ির মালিকের বা বাসার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলা থাক, ভয়ে ধারে কাছে ও ভিড়তে দেখি  নি।  কিন্তু আজকাল যুগের পরিবর্তনে সব কিছু পাল্টিয়েছে;ও হাঁসতে হাঁসতে ঘরে ঢুকে, মনে হয়  এই পরিবারের একজন ।  আলাপ প্রসঙ্গে জানা যায় যে সে মিরপুর মাজারের নিকট বালুর মাঠে চারিদিকে ওয়াল  দেয়া ছোট ছোট দুই কামরা বাসায় মাসিক ৫ হাজার টাকা ভাড়ায়  থাকে। কথাপ্রসঙ্গে জানা যায়   সে স্কুল থেকে SSC পাশ করেছে, স্বামী HSC পাশ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করে।  তার মধ্যে কোনো রকম দ্বিধা সংকোচ  দেখি নি। আমাকে হাঁসতে হাঁসতে বলে খালুজান , আমাদের কানাডায় নিয়ে যান ; আমি বলি, সম্ভব হলে, চেষ্টা করতাম।   তার জীবনের করুন ইতিহাস জানার সুযোগ হলো : ছোট বয়সে তার মা মারা গেলে বাবা আর একটি বিয়ে করে; সে তার নানী বাড়িতে মানুষ হয়েছে এবং ওরাই পড়াশুনা করিয়ে বিয়ে দিয়েছে।   

মিরপুর মাজারের সামনের গলিতেই বিশাল পাখির বাজার; এখানে দেশি ও বিদেশী বহু ধরণের পাখি পাওয়া যায়।  পাখির বাজারে  “পাখি লাভারদের ” অবস্থা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয়েছিল।  বিক্রেতাদের অধিকাংশই যুবক ছেলে, যারা ব্যাবসায়ীদের নিকট থেকে পাখি খরিদ করে খুচরা বিক্রি করে।   আমি একটা কবুতরের দাম জিজ্ঞেস করেছিলাম; বিক্রেতা ৩ হাজার টাকা চেয়েছিলো, কথাপ্রসঙ্গে সে বলেছিলো যে একটা বিশেষ ধরণের পাখি ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।  খাঁচায় রাখা  বেশির ভাগই বিদেশী পাখি,আমাদের বাংলাদেশের আবহাওয়ায় এগুলি  স্বাচ্ছন্দে পোষা যায় বলে বিক্রেতারা বলেছিলো।  অনেক যুবক ছেলেরা পাখি পোষে লাভবান হচ্ছে এবং বেকারত্ব দূর করছে।  পাখির বাজারে বেশ ভিড় এবং কানাডাতে যে সব পাখি বাজারে দেখা যায়, তার অধিকাংশই এই বাজারে দেখতে পেয়েছি।  

আমাদের  গ্রামগঞ্জে  সে যুগে প্রায় সবার বাড়িতেই গরু, ছাগল, হাঁসমুরগী ও কবুতর পুষতে  দেখা যেত ।  এ ভাবে ফার্ম খুলে পাখির ব্যবসা আগে দেখি নি।  এ জাতীয় নুতন নতুন উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা আমাদের ছেলেদের মধ্যে থাকা উচিৎ এবং প্রশংসার যোগ্য।     সে যুগে ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করে চাকুরীর পিছনে দৌড়াতো ; আজকাল চাকুরীর বাজার সোনার  হরিনের মতো, খুঁজে পাওয়া যায় না, বা পাওয়া গেলে ও ধরাছোঁয়ার বাইরে।  

ঢাকা শহরে অনেকগুলি বাজারে এই বিদেশী পাখি পাওয়া যায়; ওখানে কেউ কেউ বলতে শুনেছি, ঢাকা ব্যাতিত অন্যান্য শহরে ও আজকাল দেশি বিদেশী পোষা পাখির ব্যবসা রয়েছে।  আজকাল যুবক ছেলেরা বসে না থেকে বিভিন্ন ব্যবসায় নিজেদের মনোনিবেশ করছে। 

এই অল্প সময়ের মধ্যে  ঢাকায়  এক মুদি দোকানদারের সঙ্গে সখ্যতা হলো।  সে অনেকদিন সৌদি আরব থেকে কাজ করে ফেরত এসে একটা এপার্টমেন্ট কিনেছে।  সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে।  সাধারণতঃ যারা সৌদি আরব থাকে, তারা ধার্মিক হয় ; কিন্তু ওর বেলায় একটু ভিন্নতা লক্ষ্য করলাম।  সে শাহ আলী মাজার ভক্ত এবং প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে মাজারে  যায় ; ধর্ম সম্পর্কে ওর ভালো জ্ঞান আছে ,তবে মাজার পন্থী।  প্রতিদিন ওর দোকানের সামনে গেলে বলে, মামা, বসেন আলাপ করি  , আপনার জন্য চা নিয়ে আসি।   আমি বলি দুঃখিত, আমি বাহিরে চা খাই না।  পাশেই আমার আত্মীয়ের দোকান, ওর ওখানে গিয়ে খানিক বসি এবং লোকজনের অবস্থা অনুধাবন করি। একটা cone-  icecream হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে দাদা খান, না করলে শুনবে না; সকাল হলে লোকজন স্রোতের মতো কাজে বের হয় এবং সন্ধ্যার দিকে ঘরে ফেরত আসে; সবার হাতে বাজার ভর্তি ব্যাগ।   

যে কয়েকদিন ঢাকা ছিলাম,প্রায় প্রতিদিনই সকাল-বিকাল মিরপুর শাহ আলী মাজারের সামনে দিয়ে হাঁটাহাঁটি করতাম।অনেক সময় দাঁড়িয়ে দেখতাম মাজারে ভক্তদের ভিড়।  বিশাল আকারের এক ডেকচি; অহরহ  টাকা জমা হচ্ছে।  মাঝে মধ্যে  উঁকি মেরে দেখতাম ভক্তরা কি পরিমান টাকা দিচ্ছে।  মাজারের দুইটি গেট, একটি দক্ষিন ও আর একটি পূর্ব দিকে- সঙ্গেই রয়েছে পুলিশ সিকিউরিটি পোস্ট।  ।   

৫     

গ্রামে এক ধরণের লোক আমাদের ছেলেপেলেদের রাজনীতির দিকে টেনে এনে বিভ্রান্ত করছে বলে অনেকের ধারনা।  এ সব ছেলেপেলেরা দেশে গ্রামে থেকে পরিবেশ নষ্ট করে ও উপজেলার টেন্ডারবাজির পেছনে দৌড়ায়। এতে সরকারি কাজ টেন্ডারবাজির জন্য ব্যাহত হচ্ছে । এদের জন্য গ্রামের নিরীহ মানুষ অসুবিধার সম্মুখীন হয়।  এদের সাথে গ্রামের সহজ সরল মানুষ মুখ খুলে কথা বলতে সাহস পায় না।  গ্রামে অহরহ জমিজমা  নিয়ে ঝগড়াঝাটি থেকে শুরু করে মারামারি এবং মামলা মোকদ্দমা পর্যন্ত হয়।

এ সব সমস্যা থেকে ফিরে আসতে হলে, উপজেলায় বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ চালু করে বেকার ছেলেদের কাজে ব্যস্ত রাখা দরকার। স্থানীয় প্রশাসন গ্রামে গ্রামে কর্মহীন ছেলে / মেয়েদের চিন্নিত  করে যত্ন সহকারে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করে তুলতে পারে;  প্রতিটি ছেলে বা মেয়ে সঠিক প্রশিক্ষণ পেলে, নিজেদের মেধা কাজে লাগাতে পারে।

তবে একটা জিনিস লক্ষণীয় : মেয়েদের প্রতি আমাদের মনোভাব পরিবর্তন হয় নি।  ছেলে এবং মেয়েকে আমাদের সমাজে   এখনও ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে। মেয়েকে মাবাবা মাথার বোঝা হিসাবে দেখে ; মেয়ে পড়াশুনা করলে ভালো পাত্র পাওয়া যাবে, বিয়ে হলে শ্বশুর বাড়ি যাবে এবং চার দেয়ালের মধ্যে থেকে বাচ্চা লালন, এই মনোভাব পোষণ করে।   পশ্চিমা দেশগুলিতে কি মেয়ে বা কি ছেলে , সবাইকে শিক্ষা নিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক, এই মনভাব মাবাবা এবং সরকারের রয়েছে।  মেয়ে কলেজে পড়ে , ১৮-১৯ বয়স, মাবাবা বিয়ের জন্য অস্থির।  বললাম ছেলে হোক বা মেয়ে হোক , আপনার দায়িত্ব সমান ভাবে দেখা এবং পড়াশুনা করানো।  আমার কোথায় সন্তুষ্ট না; সমাজ এ সমস্যা  থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।  ২১-২২ বৎসরের এক মেয়ে আমাকে বলতেছিলো; জেঠাজি, আমি পড়াশুনায় ভালো ছাত্রী ছিলাম, মাবাবা আমাকে পড়াশুনা করতে দেয় নি। 

সে যুগে শহরে কিছু সংখক ছেলে বাসায় বাসায় গিয়ে ছেলেমেয়ে পড়িয়ে পয়সা রোজগার করতো; ছাত্র/ছাত্রীরা আজকাল পড়াশুনার পাশে পাশে নিজেদের চলার জন্য যে কোনো  ধরণের কাজ  করে  পড়াশুনার খরচ  এবং পরিবারকে সাহায্য করে। কলেজ বা উনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা দোকানে,রেস্টুরেন্টে, ট্যাক্সি বা রিক্সা চালিয়ে অথবা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করে পয়সা রোজগার করে।  পড়াশুনার পাশে পাশে ওরা ভবিষ্যতে কি  করবে এ সব চিন্তা ভাবনা মনে পোষণ করে।  এদের অনেকেই কিভাবে ইউরোপ,আমেরিকা,কানাডা বা অস্ট্রেলিয়া অথবা মিডল ইস্ট দেশ গুলিতে গিয়ে কাজ করে দেশে সাবলম্বী হবে সে সব চিন্তা করে।  আজকাল ইলেক্ট্রনিক    মিডিয়ার যুগ- এরা  সদাসর্বদা বিদেশে আত্মীয় বা বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।  দেশের প্রায় দুই কোটির মতো লোক বিদেশে কাজ করে দেশে টাকাপয়সা পাঠায় ; এটা সত্যিই দেশের জন্য, তথা জাতির জন্য সুখবর। প্রতিটি গ্রামে এমন কোনো বাড়ি নেই ; দুই/চার জন বিদেশে নেই।  কেউ আজকাল জিজ্ঞেস করে না, কি কাজ করে ?

৬  

গ্রামে বাড়ি বাড়ি খোঁজ নিলে দেখা যায় ঘরে ঘরে মহিলারা  একাকী জীবনে অভ্যস্ত;  মহিলারা ছেলেমেয়ে বা দাদা/দাদীরা নাতিনাতনি নিয়ে ব্যস্ত; স্বামীরা যতদূরেই থাকুক না কেন, দৈনিক অন্ততঃ একবার  মোবাইলে কথা হয়, ” তুমি কেমন আছো ? কবে আসবে ? এই পথ চাওয়া তো আর শেষ হয় না।  এভাবেই কষ্ট করে বিদেশ থেকে  দেশে টাকা পাঠায়। যে সব লোক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে থাকে , তাদের প্রায় সবাই দেড় থেকে দুই বৎসর পর এক বা দুই মাসের জন্য দেশে প্রিয়জনের সঙ্গে মিলিত হয় ; এ ভাবে অনেকে ২৫-৩০ বৎসর ও বিদেশে জীবন /যৌবন কাটিয়ে দেশে আসে।  

আমার এক পরিচিত, ৪২ বৎসর সৌদি আরব থেকে পয়সা কামাই করে দেশে বাড়ি ও জমিজমা করেছেন; যতবার মক্কা ওমরাও করতে গিয়েছি, দেখা হয়েছে ।  একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন ” তোমরা কানাডার পাসপোর্ট নিয়ে যখন তখন ঘুরতে আসো  ,” ৪২ বৎসর সৌদি আরব থাকি ;  দেশে যেতে চাইলে বৈধ কাগজ বানানোর জন্য পয়সা খরচ করে তবেই দেশে যাই। কি যে কষ্ট ?  

  আমাদের সে যুগে ভোর হলে, ফার্ম গেট,নিউ মার্কেট বা এখানে /সেখানে দেখতাম গরিব অশিক্ষিত দিনমজুর ওড়া/কোদাল  নিয়ে কাজের জন্য অপেক্ষা করে। আজকাল  আমাদের শিক্ষিত দামাল ছেলেরা ভোর হতেই বাংলাদেশ তথা বিশ্বের উন্নত দেশ গুলিতে কাজের খোঁজে বের হয়।  ইতালি,অস্ট্রিয়া,পর্তুগাল, জার্মানি বা অন্যান্য দেশে রেস্টুরেন্ট,কৃষি এমন কি যে যা পায়  তাই করে দেশে টাকা পাঠায়। আজকাল কেউ জিজ্ঞেস করে না ,”তুমি বা তোমরা বিদেশে কি কাজ করো ?”

৭ 

আমার আজ ও মনে পড়ে ১৯৭৭ কি ১৯৭৮ এর দিকে আমার এক পরিচিত,  লন্ডন থেকে ঢাকা এসেছেন । লন্ডন পড়াশুনা শেষ করে,কাগজ তৈরী করতে একটু বেশি সময় লেগেছে। বিয়ে করবেন, মনস্থির করেছেন ।   আমি ওর বিয়ের পাত্রীর খোঁজ দিয়েছিলাম।   পাত্রী মাস্টার ডিগ্রী,অগ্রণী ব্যাংকের অফিসার  , আমি তাঁর  সঙ্গে গিয়েছি পাত্রী দেখার জন্য। পাত্রী দেখতে সুন্দরী এবং স্মার্ট,  সরাসরি প্রশ্ন করছেন ,” আপনি লন্ডন কি কাজ করেন ?” উনিতো  হতবাক , চুপ করে পাত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন , পরে আমাকে বললেন ,” আমি যে   কাজ করি, ওকে বলা যাবে না, তাছাড়া ও পছন্দ করবে না। ” আজকাল পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে, দেশে ও আজকাল পড়াশুনা করে white  – collar  job  পাওয়া যায় না।  

৮  

আমি সচরাচর ঢাকা সদর ঘাট থেকে লঞ্চে আরাম করে নদী ও চারিদিকের দৃশ্য দেখতে দেখতে চাঁদপুর এক/দুই দিন আত্মীয় বাড়ি থেকে যাই;  এবার ও তার ব্যতিক্রম হয় নি। বিরাট লঞ্চ, কেবিনে   লাগেজ রেখে সামনে নদীর দৃশ্য দেখতে আমার বেশ ভালো লাগে।  প্রায় প্রতিটি কেবিন  লোকে ভর্তি, কেউ কেউ আমার মতো চেয়ার নিয়ে ব্যালকনিতে বসে অপূর্ব দৃশ্য দেখছে।  কতক্ষন পর পর ছেলেরা এসে চা নাস্তা বা রাতের খাওয়া দিচ্ছে; আমি বাহিরে কোনো কিছুই খাচ্ছি না, একটা ড্রিংক এবং বিসকুট নিয়েছি, বাহিরের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে। যাত্রী ভর্তি লঞ্চ ও কার্গো মালামাল নিয়ে আসা-যাওয়া করছে।  এ আমার পরিচিত পথ, কতই না এ পথে আসা-যাওয়া করেছি।   

১৯৬৮ সনে এক সন্ধ্যায় চাঁদপুর হয়ে ঢাকা যাবো; মতলব থেকে লঞ্চ মিস করছি; নদীবন্দরে ৩ নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত দেয়া হয়েছে। রাত ১০টার দিকে হুঁশিয়ারি সংকেত অমান্য করে  একটা লঞ্চ  যাবে দেখে অনেকের সঙ্গে আমি ও সাহস করে  লঞ্চে উঠে বসলাম।   লঞ্চ ছেড়ে দিলো; কিছু সময়ের মধ্যেই বিপদ দেখা দিলো, মানুষের চিৎকার আর আল্লাহুআকবার ধ্বনি, সারেং লঞ্চ তীরে ভিড়ালো।  আর কখনও নদী পথে এ জাতীয় উদ্যোগ নেই নি।  

চাঁদপুর পৌঁছতে রাত ৮টা বেজে গেলো ; মতলব থেকে স্বপন মোবাইল ফোনে  লঞ্চ টার্মিনালে আসবে বলে জানিয়েছে ।  লঞ্চ থেকে বের হয়ে দেখি ও টার্মিনালে অপেক্ষা করছে। রাতে আত্মীয় বাসায় থেকে পরদিন স্বপন সহ মতলব চলে গেলাম ; গ্রামের বাড়ি, খোলামেলা ভালো লাগছে।  মতলব বাজার, ছেলে/মেয়েদের আলাদা স্কুল; ক্লাসে গিয়ে ছেলেমেয়েদের ঘুরে ঘুরে দেখছি, পুরানো স্মৃতি স্বরণ করছি; আশেপাশের গ্রাম গুলি যাওয়া আসার পথে বেশ ভালো লেগেছে। ১৯৭০ সনের দিকে আমি মতলব স্কুল ছেড়েছি; ও সময়কার কোনো শিক্ষকই আজ এর বেঁচে নেই।  স্কুল গেটে দিয়ে ঢুকতেই সেই নামকরা হেডমাস্টার ওয়ালিউল্লাহ পাটোয়ারী ও তাঁর স্ত্রীর কবর নজরে পড়লো।  খানিক দাঁড়ালাম,শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসছে, কবর জেয়ারত করে ভিতরে গেলাম। কিন্তু কাউকেই চিনি না; নিজের লেখা তিনটা বই নিয়ে অফিসে গিয়ে নিজের ঢোল নিজেই বাজালাম, পরিচয় দিলাম।  অনেকে কুশল বিনিময় করলো এবং সেই পুরানো স্মৃতি নিয়ে আলোচনা হলো।   

 নিজের গ্রাম, সে যুগের সঙ্গে মিলিয়ে দেখছি ; আমার যুগের লোকজনের অনেকেই না ফেরার দেশে চলে গেছেন,বাকিদের সঙ্গে দেখা; গ্রামের মেঠো পথ আজ আর নেই, পরিবর্তে ইট বালির রাস্তা হয়েছে।  আজকাল আর কাঠ বা বাঁশের সেতু পার হওয়ার প্রয়োজন হয় না,  যে কোনো বাড়িতে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়। গ্রামে  যেটুকু সময় থেকেছি ; ভালো লেগেছে।         

চলবে : 

পূর্ববর্তী নিবন্ধ“শী নেক্সট ফ্যাশন” এর হালখাতা অনুষ্ঠান
পরবর্তী নিবন্ধহাউজ হাজব্যান্ড-(পর্ব দুই)
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন