নতুন এসেছেন কানাডাতে, কাজ খুঁজছেন !
একজন রিফুজি ক্লেমেন্টের গল্প !
নতুন বছর আসোলে কি নতুন? একই পৃথিবী, একই গ্রহ নক্ষত্র, শুধু ঘোরাঘুরি করে প্রতিনিয়ত এক দিক থেকে অন্য দিকে যাচ্ছে। তবে হাঁ, যদি সময়ের বিবেচনা করা হয় তাহলে প্রতি সেকেন্ডইতো নতুন। আল্লার রহমতে সুস্থমত বেঁচে থাকাটাই actually প্রতিটি সেকেন্ডের “happy second”. যদিও প্রতিটি সেকেন্ড উদযাপনযোগ্য, কিন্তু আমরা সবাই সেটা পারি না তাই অপেক্ষা করি একটি নতুন বছরের জন্য। যাহোক, সেটা কোনো সমস্যা নয়।
এই নতুন বছর সবার জন্য সমান নয়, কারো সামনে সম্ভাবনার দিগন্ত, কারো কাছে গত বছরের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সংগ্রামের বা স্বস্তির স্মৃতিচারণ এবং সুন্দর আগামীর প্রত্যাশা। সাম্প্রতিক সময়ে দুশ্চিন্তা বা টেনশনের অনেক কারণ আছে এবং আমরা অনেকেই এর থেকে দূরে নয়। যেমন ধরুন ইদানিং যারা বিভিন্নভাবে কানাডাতে নতুন এসেছেন এবং স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার মনস্থ করেছেন বা করছেন তাদের জন্য সময়গুলি বেশ চ্যালেন্জিং। শুধু উনারাই নয়, আমরা যারা অলরেডি এখানে অনেক দিন ধরে আছি তাদের সময়টাও বেশ চ্যালেন্জিং, বিশেষ করে বর্তমান আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপেক্ষিতে।
নতুন আসাদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশ থেকেই ইমিগ্রেশন নিয়ে আসা, ছাত্র হয়ে আসা, টুরিস্ট হয়ে আসা ইত্যাদি মানুষ। এদের মধ্যে যারা ইমিগ্রেশন নিয়ে আসেন বা ছাত্র হয়ে আসেন তাদের একদিক থেকে একটু চিন্তা কম কারণ তাদের ওয়ার্ক পার্মিশনের কোনো চিন্তা নেই, কিন্তু যারা টুরিস্ট হিসাবে এসেছেন তাদের দুশ্চিন্তা সব দিক থেকে, কারণ তাদের কাজের কোনো বৈধ অনুমতি নেই এবং অপেক্ষাকৃত ওই দুই গ্রূপের মতো উনারা সঙ্গে করে খুব বেশি ফান্ড নিয়ে আসেন না। যেহেতু বৈধ কাজের অনুমতি থাকে না তাই এক দাগেই তাদের কাজ খোঁজার বা কাজ করার সুযোগটা একেবারেই সীমিত হয়ে যায়। উনাদেরকে নির্ভর করতে হয় under the table কাজের জন্য, যাকে আমরা ক্যাশ জব বলি। এক্ষেত্রে খুবই কম প্রতিষ্ঠান আছে যারা আপনাকে বৈধ কাজের অনুমতি ছাড়া ক্যাশ জব দিবে। আবার যারা দিবে তারাও চাইবে আপনাকে বেতন কম দিতে এবং বেশি খাটাতে। থাকবেনা বিন্দুমাত্র কোনো বেনিফিটের ব্যবস্থা এবং তাদের যখন ইচ্ছা তখন আপনাকে বিদায় করে দিতে পারবে। উনাদের মতো মানুষদের সাথে আমি খুব একটা বেশি কাজ করি নাই, যতটা করেছি স্কীলড ইমিগ্রান্টদের নিয়ে, তবে উনাদের কারো কারো সাথে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ হওয়ার কারণে বেশ কিছু ব্যাপার জেনেছি। আজকে সেই রকম একজনের কথা শেয়ার করবো ।
এখানে যারাই স্থায়ীভাবে থেকে যেতে আসেন তারা কেউই এমন পরিমান ফান্ড নিয়ে আসেন না যে বসে বসে খাবেন, অর্থ্যাৎ তাদের কাজ খুঁজতেই হবে। যাহোক, আপনার বৈধ কাজের অনুমতি থাক আর নাই বা থাক, আপনাকে যেকোনো কাজের জন্য এখানে হয় ইংরেজি বা ফ্রেঞ্চ ভাষা জানতে হবে। এখন লোকেশন, আপনার কাংখিত চাকরির সেক্টর ইত্যাদির বিচারে আপনার ভাষাজ্ঞান বিভিন্ন লেবেলের হতে হবে, কিন্তু একেবারে এখানকার ভাষা না জানলে আপনার অনেক অনেক কম সুযোগ থাকবে। এখন আপনাকে প্রথমে নিজের ভাষাজ্ঞানের লেভেল খুঁজে বের করতে হবে তারপর যদি প্রয়োজনীয় ভাষাজ্ঞান থাকে তাহলে আপনার সময় এবং কষ্ট কিছুটা কমে গেলো, সাথে সাথে আপনি কাজ খোঁজাও শুরু করে দিতে পারেন। আর যদি আপনার প্রয়োজনীয় ভাষাজ্ঞান একেবারেই না থাকে অথবা খুব কম তাহলে আপনার জন্য কষ্টটা এবং অনিশ্চয়তা খুব বেশি, যেমন আপনার যেহেতু ভাষাজ্ঞান কম তাই আপনার কাজ পাওয়ার সুযোগটাও অনেক কম এবং যদিও কোনোকিছু পান আপনার সেই কাজ করার মধ্যেই ভাষাটাকে রপ্ত করতে হবে। শুনতে খুব কঠিন বা চ্যালেন্জিং হলেও কেউকেউ আছেন যারা এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছেন এবং একসময় তাদের পছন্দমতো জায়গায় পৌঁছে যান।
যারা ছাত্র তারাতো স্কুলেই যান, আবার যারা ইমিগ্রান্ট তাদের জন্য এখানে ESL ক্লাস আছে যদিও আমার কাছে সেটি খুব একটা বেশি কার্যকরী না, যদি কি না আপনি নিজে খাটাখাটনি না করেন। যাদের এই সুযোগ নেই তাদের মূলত নিজেরই শিখতে হবে। এখানে ২/১ টি Ethnic প্রতিষ্ঠান হয়তো এই ব্যাপারে আপনাকে কিছুটা সাহায্য করতে পারে, কিন্তু সেটা খুব বেশি নয় কারণ সরকার কোনো টুরিস্টকে বা অবৈধভাবে থাকা মানুষকে এই জাতীয় সাহায্যের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে ফান্ড দিবে না, কারণ এদেশের ট্যাক্সপেয়াররা সেটি চাইবে না। তাই এটি আপনার নিজের থেকেই শিখতে হবে এবং সাথে সাথে ছোটমতো যেকোনো ধরণের কাজও আপনাকে করতে হবে যদি আপনি দেশ থেকে অনেক টাকা না নিয়ে আসেন। যাহোক, যারা ছাত্র বা ইমিগ্রান্ট হয়ে আসছেন তাদের নিয়ে আর বেশি কথা বলবো না কারণ তাদের জন্য যথেষ্ট রিসোর্স এখানে আছে এবং অন্তত তারা না চাইলে দেশে ফিরে যেতে হবে না।
টুরিস্ট হয়ে যারা আসছেন তারা সাধারণত কোনো ছোটোখাটো রিটেল ব্যবসা বা ব্যক্তিগত কারো বাসায় ইত্যাদি জায়গায় ক্যাশে জব খোঁজেন এবং সেইসব জায়গায় কাজ করে থাকেন। আর আল্লা না করুক তাদের যদি কোনোধরনের অসুখ বিসুখ হয় তাহলে তাদের নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করতে হয় এবং সেই টাকা অনেক বেশি যেটি সব সময় সবার জন জোগাড় করা সম্ভব নয়, সে কারণে হটাৎ হটাৎ আমরা এখানকার বিভিন্ন FB গ্রূপে সাহায্যের আবেদন দেখি, অনেকেই সাহায্য করেন তবে সবার করার মতো সামর্থ থাকে না। যাদের ঠিক এই রকম অবস্থা তারা কিন্তু ইতিমধ্যে কাজ খোঁজার কিছু পন্থা বের করে ফেলেছেন এবং কষ্টে-মষ্টে চালিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু অধিকাংশই অনেক কষ্ট করছেন। আমি যে উনাদের সম্পর্কে বলছি তার মানে এই না যে উনাদের মতো করে রিস্ক নিয়ে দেশ থেকে এখানে আসার জন্য উৎসাহিত করছি। মোটেও না! আমার কথা হচ্ছে যারা অলরেডি নিজের বুদ্ধিতে অথবা দালালের খপ্পরে পরে এসেই পড়েছেন তারা যদি কোনোভাবে এখানে স্থায়ী হতে পারেন বা অন্তত ওয়ার্কপারমিট জোগাড় করে কাজ করতে পারেন তাহলে আমাদের সবার জন্যই ভালো, তারা যাই ইনকাম করুক এবং খরচ করুক তাতে অন্তত কানাডিয়ান অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও ডলার ইঞ্জেক্ট হবে। আমার ভূতপূর্ব প্রফেসর যিনি ফিনল্যান্ডের এক সময়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ছিলেন তিনি দুস্থ মানুষদের জন্য দেওয়া সোশ্যাল সার্ভিসকে draining resources না বলে বলতেন, তাদেরকে যদি দ্রুত অর্থনীতিতে ইনভল্ভ করা যায় তাহলে,” even they can share the burden” এজন্য ওখানকার Employment Assistance প্রোগ্রাম আমাদের থেকে অনেক ভালো।
যারা টুরিস্ট হয়ে এসে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করছেন উনাদের দেওয়া বিভিন্ন গ্রূপের পোস্ট থেকে পড়ে, উনাদের কারো কারো সাথে কথা বলে উনারা কিভাবে কি করছেন সেগুলির কিছু এখানে উল্ল্যেখ করছি। যেমন ধরুন তারা এখানকার যেসব Ethnic বা দেশি পত্রপত্রিকা বা সোশ্যাল মিডিয়া আছে সেগুলি ঘেটে বের করেন দেশি কি কি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে, সেখানে ফিজিক্যালি যান, তাদের সাথে আলাপ করেন, তাদের কোনো লোক লাগবে কি না সেটা জানেন, আবার কেউ কেউ ওই প্রতিষ্ঠানের অনুমতি নিয়ে একটি ছোট ফ্লায়ার তাদের প্রতিষ্ঠানে রেখে আসেন তাদের স্কিল এবং availability জানিয়ে যাতে করে প্রয়োজন হলে তাদেরকে খোঁজ করবে। দেশি বলতে আমি পুরা সাউথ এশিয়ান প্রতিষ্ঠানকেই বোঝাচ্ছি। অনেকেই বিভিন্ন FB গ্রূপে তাদের দক্ষতা জানিয়ে সদস্যদের বলেন তারা ক্যাশে কাজ খুঁজছেন। কেউকেউ পরিচিতদের সাহায্য নিচ্ছেন ইত্যাদি।
এবার সেই গল্পটি।
একজন ইন্ডিয়ানকে জানি উনি এখানে এসে উনার রিফুজি ক্লেইম করতে গিয়ে সব টাকা ফুরিয়ে ফেলেন। উনি তখন উনাদের কমুনিটির বেশ কিছু লোকজন খুঁজে বের করেন যারা মোটামুটি বাসায় থাকেন এবং রান্নাবান্না জানেন। উনি এই জাতীয় অন্তত ৮/১০ জনকে খুঁজে তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন উনি যদি ২/৪টি কাস্টমার পান তাহলে তারা কি তাদের জন্য খাবার তৈরী করে দিতে পারবে। তারা রাজি হয় এবং উনি তখন উনার কমুনিটির মধ্যে থেকেই কিছু কাস্টমার খুঁজে বের করেন এবং তাদেরকে একটু কম দামে খাবার সাপ্লাই দেন। এক্ষেত্রে উনি কিন্তু কোনো existing ক্যাটারিং সার্ভিস এর খাবার ডেলিভারি দেন নাই, বরং উনি কিছু ক্যাটারার নিজে তৈরী করেছেন এবং কাস্টমারও জোগাড় করেছেন। এর সাথে উনি একটি পেট্রল পাম্পে কাজ করতেন। কারো আবার বাজার করে দিতেন বিনিময়ে জাস্ট একবেলা খাবার খেতেন, কারো বয়স্ক বাবা-মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেন, বিনিময়ে একটা কফি বা একবেলা নাস্তা পেতেন, ইত্যাদি।
এই কাজগুলি উনি করেছেন কয়েকমাসের জন্য অর্থ্যাৎ উনার রিফুজি ক্লেম আবেদনের আগ পর্যন্ত যখন উনার কোনো বৈধ ওয়ার্কপারমিট ছিল না। যাহোক, অবশেসে উনার রিফুজে ক্লেম হয়ে গেলে উনি ওয়ার্কপারমিট পান এবং তার এই উদ্যোগ এবং অভিজ্ঞতা অন্নান্য কারণের সাথে একটি অন্যতম কারণ ছিল তার Humanitarian Groundএ ক্লেইম acceptance এর জন্য। হেয়ারিংএ যখন উনার এই ক্যাশে কাজ সমন্ধে জিজ্ঞেস করে তখন উনি বলেছিলেন উনি যাদের জন্য কাজ করতেন তাদের ইনকাম Taxable ছিল না এবং উনার নিজেরও খুব বেশি কিছু হতো না জাস্ট কোনোমতে চলতেন, তথাপি উনি অত্যান্ত দুঃখিত যে এখানকার প্রচিলিত আইনের বাইরে উনি বাঁচার তাগিদে কিছু করেছেন। যাহোক, উনি পরবর্তীতে ভালো একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ পান এবং উনি বর্তমানে কানাডার একজন ট্যাক্সপেয়ার। উনার কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রেও উনার ওই উদ্যোগের অভিজ্ঞতা অনেক কাজে লেগেছিলো, উনি বলেন। আমার কাছে উনার উদ্যোগটা ভালো লেগেছে। তাকে আমি যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম তার ওই কাজগুলির কোনোটাতেই কোনো ধরণের সেফটি-সিকিউরিটি নিশ্চিত ছিল না। তার উত্তর ছিল, আমি তো প্রথমেই নিজের সেফটি-সিকিউরিটি বিসর্জন করেছি দালালের খপ্পরে পড়ে ভালো করে না জেনে এখানে এসে, তাই উনি নিজেকে একটি সময় বেঁধে দিয়ে উক্ত উদ্যোগ নেন।
আমি, মাঝেমধ্যে উনার মতো ঘোরার নাম করে বা পড়াশুনার নাম করে এসে না ঘুরে বা না পড়ে এখানে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়া মানুষদের সমন্ধে সচেনতনমূলক কিছু কথাবার্তা বলি বা লিখি, কিন্তু তার মানে এই না যে আমি ঐভাবে আসাকে উৎসাহিত করি। আমি শুধু যারা ঐভাবে আসার ইচ্ছা করেন তাদেরকে বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরতে চেষ্টা করি, তারপর তাদের সিদ্ধান্ত।
এই দেশটি গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বর্ণের মানুষদের দ্বারা। এই মানুষদের কেউ এসেছেন উপনিবেশের মাধ্যমে, কেউ এসেছেন রিফুজি হয়ে, কেউ ইমিগ্রান্ট হয়ে অথবা কেউবা পড়তে এসে পরে স্থায়ী হয়েছেন। এরা সবাই যখন এখানকার নাগরিক হন তখন তাদেরকে আলাদা আলাদা করে নাগরিকত্ব সাটিফিকেট দেওয়া হয় না। আমাদের ভূতপূর্ব এক গভর্নর ছিলেন একজন প্ৰাক্তন রিফুজি, গতবারের ইমিগ্রেশন মন্ত্রী ছিলেন একজন রিফুজি, এমন অনেকেই আছেন। অনেকে সত্যিসত্যি দেশে বিপদের কারণ এখানে এসে রিফুজি ক্লেম করছেন, আবার কেউকেউ তার কেসটিকে সাজিয়েছেন। যাহোক, এই ব্যাপারে এখানকার সংশিলিস্ট প্রতিষ্ঠান ভালো জানেন এবং তারাই সিদ্ধান্ত নেন।
বরাবরের মতো এখনো বলছি, এখানে সবসময় লোক লাগবে তাই যতদূর পারেন সময় নিয়ে, ধৈর্য ধরে, সব কিছু জেনে, সঠিক পদ্ধতিতে আসার চেষ্টা করেন। প্রথম প্রথম কষ্ট হলেও আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে যদি আপনি Proactive হতে পারেন এবং নিজের অবস্থান পরিবর্তনের জন্য নিজেকে রেডি রাখতে পারেন।
সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
ভালো থাকবেন।